ধর্মীয় উত্সব/উপলক্ষ

আশূরায়ে মুহাররম ও আমাদের করণীয়

আল্লাহ পাক বার মাসের মধ্যে চারটি মাসকে বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন। সে চারটি মাস হ’ল মুহাররম, রজব, যুলক্বা‘দাহ ও যুলহিজ্জাহ। অন্যভাবে বললে বলা যায় যে, যুলক্বা‘দাহ হ’তে মুহাররম পর্যন্ত একটানা তিন মাস। অতঃপর পাঁচ মাস বিরতি দিয়ে ‘রজব’ মাস। এভাবে বছরের এক তৃতীয়াংশ তথা ‘চার মাস’ হ’ল ‘হরম’ বা সম্মানিত মাস। লড়াই-ঝগড়া, খুন-খারাবী ইত্যাদি অন্যায়-অপকর্ম হ’তে দূরে থেকে এর মর্যাদার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা প্রত্যেক মুসলমানের ধর্মীয় কর্তব্য। যেমন আল্লাহ বলেন, فَلاَ تَظْلِمُوا فِيْهِنَّ أَنْفُسَكُمْ  ‘এই মাসগুলিতে তোমরা পরস্পরের উপরে অত্যাচার কর না’ (তওবা ৩৬)

ফযীলত :

১. হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, أَفْضَلُ الصِّيَامِ بَعْدَ رَمَضَانَ شَهْرُ اللهِ الْمُحَرَّمُ وَأَفْضَلُ الصَّلاَةِ بَعْدَ الْفَرِيْضَةِ صَلاَةُ اللَّيْلِ، رواه مسلم ‘রামাযানের পরে সর্বোত্তম ছিয়াম হ’ল মুহাররম মাসের ছিয়াম অর্থাৎ আশূরার ছিয়াম এবং ফরয ছালাতের পরে সর্বোত্তম ছালাত হ’ল রাতের নফল ছালাত’ অর্থাৎ তাহাজ্জুদের ছালাত।[1]

২. হযরত আবু ক্বাতাদাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ  করেন, وَصِيَامُ يَوْمِ عَاشُوْرَاءَ أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِى قَبْلَهُ، رواه مسلم ‘আশূরা বা ১০ই মুহাররমের ছিয়াম আমি আশা করি আল্লাহর নিকটে বান্দার বিগত এক বছরের (ছগীরা) গোনাহের কাফফারা হিসাবে গণ্য হবে’।[2]

৩. আয়েশা (রাঃ) বলেন, كَانَ يَوْمُ عَاشُوْرَاءَ يَوْمًا تَصُوْمُهُ قُرَيْشٌ فِى الْجَاهِلِيَّةِ وَكَانَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَصُوْمُهُ، فَلَمَّا قَدِمَ الْمَدِينَةَ صَامَهُ وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ فَلَمَّا فُرِضَ رَمَضَانُ قَالَ : مَنْ شَاءَ صَامَهُ وَمَنْ شَاءَ تَرَكَهُ، رواه البخارىُّ ‘জাহেলী যুগে কুরায়েশগণ আশূরার ছিয়াম পালন করত। রাসূলুললাহ (ছাঃ)ও তা পালন করতেন। মদীনায় হিজরতের পরেও তিনি পালন করেছেন এবং লোকদেরকে তা পালন করতে বলেছেন। কিন্তু (২য় হিজরী সনে) যখন রামাযান মাসের ছিয়াম ফরয হ’ল, তখন তিনি বললেন, যে ব্যক্তি ইচ্ছা কর আশূরার ছিয়াম পালন কর এবং যে ব্যক্তি ইচ্ছা কর তা পরিত্যাগ কর’।[3]

৪. হযরত মু‘আবিয়া বিন আবু সুফিয়ান (রাঃ) মদীনার মসজিদে নববীতে খুৎবা দান কালে বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, هَذَا يَوْمُ عَاشُورَاءَ، وَلَمْ يُكْتَبْ عَلَيْكُمْ صِيَامُهُ، وَأَنَا صَائِمٌ، فَمَنْ شَاءَ فَلْيَصُمْ وَمَنْ شَاءَ فَلْيُفْطِرْ ‘আজ আশূরার দিন। এদিনের ছিয়াম তোমাদের উপরে আল্লাহ ফরয করেননি। তবে আমি ছিয়াম রেখেছি। এক্ষণে তোমাদের মধ্যে যে ইচ্ছা কর ছিয়াম পালন কর, যে ইচ্ছা কর পরিত্যাগ কর’।[4]

৫. (ক) হযরত আব্দুল্লাহ বিন আববাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় হিজরত করে ইহুদীদেরকে আশূরার ছিয়াম রাখতে দেখে কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা বলেন, هَذَا يَوْمٌ عَظِيمٌ أَنْجَى اللهُ فِيْهِ مُوْسَى وَقَوْمَهُ وَغَرَّقَ فِرْعَوْنَ وَقَوْمَهُ فَصَامَهُ مُوْسَى شُكْرًا فَنَحْنُ نَصُوْمُهُ. فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَنَحْنُ أَحَقُّ وَأَوْلَى بِمُوْسَى مِنْكُمْ. فَصَامَهُ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ ‘এটি একটি মহান দিন। এদিনে আল্লাহ পাক হযরত মূসা (আঃ) ও তাঁর কওমকে নাজাত দিয়েছিলেন এবং ফেরাঊন ও তার লোকদের ডুবিয়ে মেরেছিলেন। তার শুকরিয়া হিসাবে মূসা (আঃ) এ দিন ছিয়াম পালন করেন। অতএব আমরাও এ দিন ছিয়াম পালন করি। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তোমাদের চাইতে আমরাই মূসা (আঃ)-এর (আদর্শের) অধিক হকদার ও অধিক দাবীদার। অতঃপর তিনি ছিয়াম রাখেন ও সকলকে  রাখতে বলেন’ (যা পূর্ব থেকেই তাঁর রাখার অভ্যাস ছিল)।[5]

(খ) হযরত  আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে যে, আশূরার দিনকে ইহুদীরা ঈদের দিন হিসাবে মান্য করত। এ দিন তারা তাদের স্ত্রীদের অলংকার ও  উত্তম পোষাকাদি পরিধান করাতো’।[6]

(গ) ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, লোকেরা বলল, হে রাসূল! ইহুদী ও নাছারাগণ ১০ই মুহাররম আশূরার দিনটিকে সম্মান করে। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, فَإِذَا كَانَ الْعَامُ الْمُقْبِلُ إِنْ شَاءَ اللهُ صُمْنَا الْيَوْمَ التَّاسِعَ، وفى رواية : لَئِنْ بَقِيتُ إِلَى قَابِلٍ لأَصُومَنَّ التَّاسِعَ ‘আগামী বছর বেঁচে থাকলে ইনশাআল্লাহ আমরা ৯ই মুহাররম সহ ছিয়াম রাখব’। রাবী বলেন, কিন্তু পরের বছর মুহাররম আসার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়ে যায়।[7]

৬. হযরত আব্দুল্লাহ বিন আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত অন্য এক হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, صُومُوا يَوْمَ عَاشُورَاءَ، وَخَالِفُوا الْيَهُودَ، صُومُوا قَبْلَهُ يَوْمًا، أَوْ بَعْدَهُ يَوْمًا ‘তোমরা আশূরার দিন ছিয়াম রাখ এবং ইহুদীদের খেলাফ কর। তোমরা আশূরার সাথে তার পূর্বে একদিন বা পরে একদিন ছিয়াম পালন কর’।[8]

উপরোক্ত হাদীছ সমূহ পর্যালোচনা করলে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠে। যেমন- (১) আশূরার ছিয়াম ফেরাঊনের কবল থেকে নাজাতে মূসার (আঃ) শুকরিয়া হিসাবে পালিত হয়।

(২) এই ছিয়াম মূসা, ঈসা ও মুহাম্মাদী শরী‘আতে চালু ছিল। আইয়ামে জাহেলিয়াতেও আশূরার ছিয়াম পালিত হ’ত।

(৩) ২য় হিজরীতে রামাযানের ছিয়াম ফরয হওয়ার আগ পর্যন্ত এই ছিয়াম সকল মুসলমানের জন্য পালিত নিয়মিত ছিয়াম হিসাবে গণ্য হ’ত।

(৪) রামাযানের ছিয়াম ফরয হওয়ার পরে এই ছিয়াম ঐচ্ছিক ছিয়ামে পরিণত হয়। তবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিয়মিত এই ছিয়াম ঐচ্ছিক হিসাবেই পালন করতেন। এমনকি মৃত্যুর বছরেও পালন করতে চেয়েছিলেন।

(৫) এই ছিয়ামের ফযীলত হিসাবে বিগত এক বছরের গোনাহ মাফের কথা বলা হয়েছে। এত বেশী নেকী আরাফার দিনের নফল ছিয়াম ব্যতীত অন্য কোন নফল ছিয়ামে নেই।

(৬) আশূরার ছিয়ামের সাথে হযরত হুসায়েন বিন আলী (রাঃ)-এর জন্ম বা মৃত্যুর কোন সম্পর্ক নেই। হুসায়েন (রাঃ)-এর জন্ম মদীনায় ৪র্থ হিজরীতে এবং মৃত্যু ইরাকের কূফা নগরীর নিকটবর্তী কারবালায় ৬১ হিজরীতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মৃত্যুর ৫০ বছর পরে হয়।[9]

মোট কথা আশূরায়ে মুহাররমে এক বা দু’দিন স্রেফ নফল ছিয়াম ব্যতীত আর কিছুই করার নেই। শাহাদতে হুসায়েনের নিয়তে ছিয়াম পালন করলে ছওয়াব পাওয়া যাবে না। কারণ কারবালার ঘটনার ৫০ বছর পূর্বেই ইসলাম পরিপূর্ণতা লাভ করেছে এবং অহি-র আগমন বন্ধ হয়ে গেছে।

আশূরার বিদ‘আত সমূহ :

আশূরায়ে মুহাররম আমাদের দেশে শোকের মাস হিসাবে আগমন করে। শী‘আ, সুন্নী সকলে মিলে অগণিত শির্ক ও বিদ‘আতে লিপ্ত হয়। কোটি কোটি টাকার অপচয় হয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে। সরকারী ছুটি ঘোষিত হয় ও সরকারীভাবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদি পালিত হয়। হোসায়েনের ভুয়া কবর তৈরী করে রাস্তায় তা‘যিয়া বা শোক মিছিল করা হয়। ঐ ভুয়া কবরে হোসায়েনের রূহ হাযির হয় ধারণা করে তাকে সালাম করা হয়। তার সামনে মাথা ঝুঁকানো হয়। সেখানে সিজদা করা হয়, মনোবাঞ্ছা পূরণ করার জন্য প্রার্থনা করা হয়। মিথ্যা শোক প্রদর্শন করে বুক চাপড়ানো হয়, বুকের কাপড় ছিঁড়ে ফেলা হয়। ‘হায় হোসেন’ ‘হায় হোসেন’ বলে মাতম করা হয়। রক্তের নামে লাল রং ছিটানো হয়। রাস্তা-ঘাট রং-বেরং সাজে সাজানো হয়। লাঠি-তীর-বল্লম নিয়ে যুদ্ধের মহড়া দেওয়া হয়। হোসায়েনের নামে কেক ও পাউরুটি বানিয়ে ‘বরকতের পিঠা’ বলে বেশী দামে বিক্রি করা হয়। হোসায়েনের নামে ‘মোরগ’ পুকুরে ছুঁড়ে ফেলে যুবক-যুবতীরা পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঐ ‘বরকতের মোরগ’ ধরার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। সুসজ্জিত অশ্বারোহী দল মিছিল করে কারবালা যুদ্ধের মহড়া দেয়। কালো পোশাক পরিধান বা কালো ব্যাজ ধারণ করা হয় ইত্যাদি। এমনকি  অনেকে শোকের মাস ভেবে এই মাসে বিবাহ-শাদী করা অন্যায় মনে করে থাকেন। ঐ দিন অনেকে পানি পান করা এমনকি শিশুর  দুধ পান করানোকেও অন্যায় ভাবেন।

ওদিকে উগ্র শী‘আরা কোন কোন ‘ইমাম বাড়া’তে হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর নামে বেঁধে রাখা একটি বকরীকে লাঠিপেটা করে ও অস্ত্রাঘাতে রক্তাক্ত করে বদলা নেয় ও উল্লাসে ফেটে পড়ে। তাদের ধারণা মতে আয়েশা (রাঃ)-এর পরামর্শক্রমেই আবুবকর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অসুখের সময় জামা‘আতে ইমামতি করেছিলেন ও পরে খলীফা নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেকারণ আলী (রাঃ) খলীফা হ’তে পারেননি (নাঊযুবিল্লাহ)। হযরত ওমর, হযরত ওছমান, হযরত মু‘আবিয়া (রাঃ), হযরত মুগীরা বিন শো‘বা (রাঃ) প্রমুখ জলীলুল ক্বদর ছাহাবীকে এ সময় বিভিন্নভাবে গালি দেওয়া হয়।

এ ছাড়াও রেডিও-টিভি, পত্র-পত্রিকা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একথা বুঝাতে চেষ্টা করে যে, আশূরায়ে মুহাররমের মূল বিষয় হ’ল শাহাদাতে হোসায়েন (রাঃ) বা কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা। চেষ্টা করা হয় এটাকে ‘হক ও বাতিলের’ লড়াই হিসাবে প্রমাণ করতে। চেষ্টা করা হয় হুসায়েনকে ‘মা‘ছূম’ ও ইয়াযীদকে ‘মাল‘ঊন’ প্রমাণ করতে। অথচ প্রকৃত সত্য এসব থেকে অনেক দূরে।

আশূরা উপলক্ষ্যে প্রচলিত উপরোক্ত বিদ‘আতী অনুষ্ঠানাদির কোন অস্তিত্ব এবং অশুদ্ধ আক্বীদা সমূহের কোন প্রমাণ ছাহাবায়ে কেরামের যুগে পাওয়া যায় না। আল্লাহ ব্যতীত কাউকে সিজদা করা যেমন হারাম, তা‘যিয়ার নামে ভুয়া কবর যেয়ারত করাও তেমনি মূর্তিপূজার শামিল। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, مَنْ زَارَ قَبْرًا بِلاَ مَقْبُوْرٍ كَأَنَّمَا عَبَدَ الصَّنَمَ، رواه البيهقى والطبرانى ‘যে ব্যক্তি লাশ ছাড়াই ভুয়া কবর যেয়ারত করল, সে যেন মূর্তিকে পূজা করল’।[10]

এতদ্ব্যতীত কোনরূপ শোকগাথা বা মর্সিয়া অনুষ্ঠান বা শোক মিছিল ইসলামী শরী‘আতের পরিপন্থী। কোন কবর বা সমাধিসৌধ, শহীদ মিনার বা স্মৃতি সেŠধ, শিখা অনির্বাণ বা শিখা চিরন্তন ইত্যাদিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করাও একই পর্যায়ে পড়ে।

অনুরূপভাবে সবচেয়ে বড় কবীরা গোনাহ হ’ল ছাহাবায়ে কেরামকে গালি দেওয়া। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, لاَ تَسُبُّوا أَصْحَابِى، فَلَوْ أَنَّ أَحَدَكُمْ أَنْفَقَ مِثْلَ أُحُدٍ ذَهَبًا مَا بَلَغَ مُدَّ أَحَدِهِمْ وَلاَ نَصِيْفَهُ ‘তোমরা আমার ছাহাবীগণকে গালি দিয়ো না। কেননা (তাঁরা এমন উচ্চ মর্যাদার অধিকারী যে,) তোমাদের কেউ যদি ওহোদ পাহাড় পরিমাণ সোনাও আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে, তবুও তাদের এক মুদ বা অর্ধ মুদ অর্থাৎ সিকি ছা‘ বা তার অর্ধেক পরিমাণ (যব খরচ)-এর সমান ছওয়াব পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না’।[11]

শোকের নামে দিবস পালন করা, বুক চাপড়ানো ও মাতম করা ইসলামী রীতি নয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, لَيْسَ مِنَّا مَنْ ضَرَبَ الْخُدُودَ، وَشَقَّ الْجُيُوبَ، وَدَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ  ‘ঐ ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়, যে ব্যক্তি শোকে নিজ মুখে মারে, কাপড় ছিঁড়ে ও জাহেলী যুগের ন্যায় মাতম করে’।[12]

অন্য হাদীছে এসেছে যে, ‘আমি ঐ ব্যক্তি হ’তে দায়িত্ব মুক্ত, যে ব্যক্তি শোকে মাথা মুন্ডন করে, উচ্চৈঃস্বরে কাঁদে ও কাপড় ছিঁড়ে’।[13]

অধিকন্তু ঐ সব শোক সভা বা শোক মিছিলে বাড়াবাড়ি করে সৃষ্টি ও সৃষ্টিকর্তার পার্থক্য মিটিয়ে দিয়ে হোসায়েন কবরে রূহের আগমন কল্পনা করা, সেখানে সিজদা করা, মাথা ঝুঁকানো, প্রার্থনা নিবেদন করা ইত্যাদি পরিষ্কারভাবে শিরক।

বিদ‘আতের সূচনা :

আববাসীয় খলীফা মুত্বী‘ বিন মুক্বতাদিরের সময়ে (৩৩৪-৩৬৩হিঃ/৯৪৬-৯৭৪ খৃঃ) তাঁর কট্টর শী‘আ আমীর আহমাদ বিন বূইয়া দায়লামী ওরফে ‘মুইযযুদ্দৌলা’ ৩৫১ হিজরীর ১৮ই যিলহজ্জ তারিখে বাগদাদে হযরত ওছমান (রাঃ)-এর শাহাদত বরণের তারিখকে তাদের হিসাবে খুশীর দিন মনে করে ‘ঈদের দিন’ (عيد غدير خم) হিসাবে ঘোষণা করেন। শী‘আদের নিকটে এই দিনটি পরবর্তীতে ঈদুল আযহার চাইতেও গুরুত্ব পায়। অতঃপর ৩৫২ হিজরীর শুরুতে ১০ই মুহাররমকে তিনি ‘শোক দিবস’ ঘোষণা করেন এবং সকল দোকান-পাট, ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত বন্ধ করে দেন ও মহিলাদেরকে শোকে চুল ছিঁড়তে, চেহারা কালো করতে, রাস্তায় নেমে শোকগাথা গেয়ে চলতে বাধ্য করেন। শহর ও গ্রামের সর্বত্র সকলকে শোক মিছিলে যোগদান করতে নির্দেশ দেন। শী‘আরা খুশী মনে এই নির্দেশ পালন করে। কিন্তু সুন্নীরা চুপ হয়ে যান। পরে সুন্নীদের উপরে এই ফরমান জারি করা হলে ৩৫৩ হিজরীতে উভয় দলে ব্যাপক সংঘর্ষ বেধে যায়। ফলে বাগদাদে তীব্র নাগরিক অসন্তোষ ও সামাজিক অশান্তির সৃষ্টি হয়।[14]

বলা বাহুল্য বাগদাদের সুন্নী খলীফার শক্তিশালী শী‘আ আমীর মুইয্যুদ্দৌলার চালু করা এই বিদ‘আতী রীতির ফলশ্রুতিতে আজও ইরাক, ইরান, পাকিস্তান ও ভারত সহ বিভিন্ন মুসলিম এলাকায় আশূরার দিন চলছে শী‘আ-সুন্নী পরস্পরে গোলযোগ ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ।

হক ও বাতিলের লড়াই?

কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা যেকোন নিরপেক্ষ মুমিনের হৃদয়কে ব্যথিত করে। কিন্তু তাই বলে এটাকে হক ও বাতিলের লড়াই বলে আখ্যায়িত করা চলে কি? যদি তাই করতে হয়, তবে হোসায়েন (রাঃ)-কে কূফায় যেতে বারবার নিষেধকারী এবং ইয়াযীদের (২৭-৬৪হিঃ) হাতে আনুগত্যের বায়‘আত গ্রহণকারী বাকী সকল ছাহাবীকে আমরা কি বলব? যাঁরা হোসায়েন (রাঃ) নিহত হওয়ার পরেও কোনরূপ প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ গড়ে তোলেননি। মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর মৃত্যুর পরে ঐ সময়ে জীবিত প্রায় ৬০ জন ছাহাবীসহ তৎকালীন ইসলামী বিশ্বের প্রায় সকল কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ পরবর্তী খলীফা হিসাবে ইয়াযীদের হাতে বায়‘আত করেন।[15]

কেবলমাত্র মদীনার চারজন ছাহাবী বায়‘আত নিতে বাকী ছিলেন। হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর, আব্দুল্লাহ বিন আববাস, আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের ও হুসায়েন বিন আলী (রাঃ)। প্রথমোক্ত দু’জন  পরে বায়‘আত করেন। শেষোক্ত দু’জন গড়িমসি করলে হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) তাঁদেরকে লক্ষ্য করে বলেন, إِتَّقِيَا اللهَ وَلاَ تَفَرَّقَا بَيْنَ جَمَاعَةِ الْمُسْلِمِيْنَ ‘আপনারা আল্লাহকে ভয় করুন! মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করবেন না’।[16]

হুসায়েন (রাঃ) ও আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়ের (রাঃ) দু’জনেই মদীনা থেকে মক্কায় চলে যান। সেখানে কূফা থেকে দলে দলে লোক এসে হুসায়েন (রাঃ)-কে কূফায় যেয়ে তাদের আনুগত্যের বায়‘আত গ্রহণ করতে অনুরোধ করতে থাকে। কূফার নেতাদের কাছ থেকে ১৫০টি লিখিত অনুরোধ পত্র তাঁর নিকটে পৌঁছে।[17] তিনি স্বীয় চাচাতো ভাই মুসলিম বিন আক্বীল (রাঃ)-কে কূফায় প্রেরণ করেন। সেখানে ১২ থেকে ১৮ হাযার লোক হুসায়েনের পক্ষে মুসলিম-এর হাতে আনুগত্যের বায়‘আত গ্রহণ করে। মুসলিম বিন আক্বীল (রাঃ) সরল মনে হুসায়েন (রাঃ)-কে কূফায় আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে পত্র পাঠান। সেই পত্র পেয়ে হুসায়েন (রাঃ) হজ্জের একদিন পূর্বে সপরিবারে মক্কা হ’তে কূফা অভিমুখে রওয়ানা হন। হুসায়েন (রাঃ)-এর আগমনের খবর জানতে পেরে কূফার গভর্ণর নু‘মান বিন বাশীর (রাঃ) জনগণকে ডেকে বিশৃংখলা না ঘটাতে উপদেশ দেন। কোনরূপ কঠোরতা প্রয়োগ করা হ’তে তিনি বিরত থাকেন। ফলে কুচক্রীদের পরামর্শে তিনি পদচ্যুত হন ও বছরার গভর্ণর ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদকে একই সাথে কূফার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি প্রথমেই মুসলিম বিন আক্বীলকে গ্রেফতার করে হত্যা করেন। তখন সকল কূফাবাসী হুসায়েন (রাঃ)-এর পক্ষ ত্যাগ করে। ইতিমধ্যে হুসায়েন (রাঃ) কূফার সন্নিকটে পৌঁছে যান। ইবনে যিয়াদ প্রেরিত সেনাপতি তখন তাঁর গতিরোধ করে। সমস্ত ঘটনা বুঝতে পেরে হযরত হোসায়েন (রাঃ) তখন ইবনে যিয়াদের নিকটে নিম্নোক্ত তিনটি প্রস্তাবের যেকোন একটি মেনে নেওয়ার জন্য সন্ধি প্রস্তাব পাঠান। إِخْتَرْ مِنِّيْ إِحْدَى ثَلاَثٍ : إِمَّا أَنْ أُلْحِقَ بِثِغَرٍ مِنَ الثُّغُوْرِ وَإِمَّا أَنْ أَرْجِعْ إِلَى الْمَدِيْنَةِ وَإِمَّا أَنْ أَضَعْ يَدِىْ فِىْ يَدِ يَزِيْدَ بْنِ مُعَاوِيَةَ ১- আমাকে সীমান্তের কোন এক স্থানে চলে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হৌক। ২- মদীনায় ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হৌক। ৩- আমাকে ইয়াযীদের হাতে হাত রেখে বায়‘আত গ্রহণের সুযোগ দেওয়া হউক।[18]

সেনাপতি আমর বিন সা‘দ বিন আবী ওয়াকক্বাছ উক্ত প্রস্তাব সমূহ মেনে নিলেও দুষ্টমতি ইবনে যিয়াদ তা নাকচ করে দেন ও প্রথমে ইয়াযীদের পক্ষে তার হাতে বায়‘আত করার নির্দেশ পাঠান। হুসায়েন (রাঃ) সঙ্গত কারণেই তা প্রত্যাখ্যান করেন ও সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। ফলে তিনি সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হন (ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজে‘ঊন)

প্রত্যক্ষদর্শী জীবিত পুরুষ সদস্য হযরত আলী বিন হুসায়েন ওরফে ‘যয়নুল আবেদীন’ (রাঃ)-এর পুত্র শী‘আদের সম্মানিত ইমাম আবু জা‘ফর মুহাম্মাদ বিন আলী বিন হুসায়েন (রাঃ) ওরফে ইমাম বাক্বের (রাঃ)-এর সাক্ষ্য ঠিক অনুরূপ, যা হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী স্বীয় গ্রন্থ ‘তাহযীবুত তাহযীব’-য়ে (২য় খন্ড পৃঃ ৩০১-৩০৫) এবং হাফেয ইবনু কাছীর স্বীয় ‘আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ’-তে (৮ম খন্ড পৃঃ ১৯৮-২০০) ত্বাবারীর বরাতে উল্লেখ করেছেন। ইমাম বাক্বের বলেন, যখন বিরোধী পক্ষের নিক্ষিপ্ত একটি তীর এসে হুসায়েনের কোলে আশ্রিত শিশুপুত্রের বক্ষ ভেদ করে, তখন তিনি বিশ্বাসঘাতক কূফাবাসীদের দায়ী করে বলেন, اَللَّهُمَّ احْكُمْ بَيْنَنَا وَبَيْنَ قَوْمٍ دَعَوْنَا لِيَنْصُرُوْنَا ثُمَّ يَقْتُلُوْنَنَا ‘হে আল্লাহ! তুমি ফায়ছালা কর আমাদের মধ্যে এবং ঐ কওমের মধ্যে, যারা আমাদেরকে সাহায্যের নাম করে ডেকে এনে হত্যা করছে’।[19]

উপরের আলোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, কারবালার ঘটনাটি ছিল নিতান্তই রাজনৈতিক মতবিরোধের একটি দুঃখজনক পরিণতি। এই মর্মান্তিক ঘটনার জন্য মূলতঃ দায়ী ছিল বিশ্বাসঘাতক কূফাবাসীরা ও নিষ্ঠুর গভর্ণর ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ নিজে। কেননা ইয়াযীদ কেবলমাত্র হুসায়েনের আনুগত্য চেয়েছিলেন, তাঁর খুন চাননি। হুসায়েন (রাঃ) সে আনুগত্য দিতেও প্রস্ত্তত ছিলেন। ইয়াযীদ স্বীয় পিতার অছিয়ত অনুযায়ী হুসায়েনকে সর্বদা সম্মান করেছেন এবং তখনও করতেন। ইতিপূর্বে হুসায়েন (রাঃ) ও আব্দুল্লাহ বিন যোবায়ের (রাঃ) অন্যান্য ছাহাবীগণের সাথে ইয়াযীদের সেনাপতিত্বে ৪৯ মতান্তরে ৫১ হিজরীতে রোমকদের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের অভিযানেও অংশগ্রহণ করেছেন।

যখন হুসায়েন (রাঃ)-এর ছিন্ন মস্তক ইয়াযীদের সামনে রাখা হয়, তখন তিনি কেঁদে উঠে বলেছিলেন, لَعَنَ اللهُ ابْنَ مَرْجَانَةَ يَعْنِىْ عُبَيْدَ اللهِ بْنَ زِيَادٍ، أَمَا وَاللهِ لَوْ كَانَ بَيْنَهُ وَبَيْنَ الْحُسَيْنِ رَحِمٌ لَمَا قَتَلَهُ وَقَالَ : قَدْ كُنْتُ أَرْضَى مِنْ طَاعَةِ أَهْلِ الْعِرَاقِ بِدُوْنِ قَتْلِ الْحُسَيْنِ (مختصر منهاج السنة 1/350)- ‘ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের উপরে আল্লাহ পাক লা‘নত করুন! আল্লাহর কসম যদি হুসায়েনের সাথে ওর রক্তের সম্পর্ক থাকত, তাহলে সে কিছুতেই ওঁকে হত্যা করত না’। তিনি আরও বলেন যে, ‘হুসায়েনের খুন ছাড়াও আমি ইরাকীদেরকে আমার আনুগত্যে রাযী করাতে পারতাম’।[20]

অন্য বর্ণনায় পাওয়া যায়, ইয়াযীদ আরও বলেন যে, ‘ইবনে যিয়াদের উপরে আল্লাহ লা‘নত করুন! সে হুসায়েনকে কোনঠাসা ও বাধ্য করেছে। তিনি ফিরে যেতে চেয়েছিলেন অথবা আমার নিকটে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে সবকিছু প্রত্যাখ্যান করে ও তাঁকে হত্যা করে। এর ফলে সে আমাকে মুসলমানদের বিদ্বেষের শিকারে পরিণত করেছে। তাদের হৃদয়ে আমার বিরুদ্ধে শত্রুতার বীজ বপন করেছে। ভাল ও মন্দ সকল প্রকারের লোক হুসায়েন হত্যার মহা অপরাধে আমাকে দায়ী করবে ও আমার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করবে। হায়! আমার কি হবে ও ইবনু মারজানার (ইবনে যিয়াদের) কি হবে! আল্লাহ তাকে মন্দ করুন ও তার উপরে গযব নাযিল করুন’।[21]

হুসায়েন পরিবারের স্ত্রী-কন্যা ও শিশুগণ ইয়াযীদের প্রাসাদে প্রবেশ করলে প্রাসাদে কান্নার রোল পড়ে যায়। ইয়াযীদ তাঁদেরকে বিপুলভাবে সম্মানিত করেন ও মূল্যবান উপঢৌকনাদি দিয়ে সসম্মানে মদীনায় প্রেরণ করেন।[22]

যে তিন দিন হুসায়েন পরিবার ইয়াযীদের প্রাসাদে ছিলেন, সে তিন দিন সকাল ও সন্ধ্যায় হুসায়েনের দুই ছেলে আলী (ওরফে ‘যয়নুল আবেদীন’) এবং ওমর বিন হুসায়েনকে সাথে নিয়ে ইয়াযীদ খানাপিনা করতেন ও আদর করতেন’।[23]

ইয়াযীদ বিন মু‘আবিয়াহ-র চরিত্র সম্পর্কে হুসায়েন (রাঃ)-এর অন্যতম বৈমাত্রেয় ছোট ভাই ও শী‘আদের খ্যাতনামা ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হানাফিইয়াহ (রাঃ) বলেন, مَا رَأَيْتُ مِنْهُ مَا تَذْكُرُونَ، وَقَدْ حَضَرْتُهُ وَأَقَمْتُ عِنْدَهُ فَرَأَيْتُهُ مُوَاظِبًا عَلَى الصَّلَاةِ مُتَحَرِّيًا لِلْخَيْرِ يَسْأَلُ عَنِ الْفِقْهِ مُلَازِمًا لِلسُّنَّةِ ‘আমি তাঁর মধ্যে ঐ সব বিষয় দেখিনি, যেসবের কথা তোমরা বলছ। অথচ আমি তাঁর নিকটে হাযির থেকেছি ও অবস্থান করেছি এবং তাঁকে নিয়মিতভাবে ছালাতে অভ্যস্ত ও কল্যাণের আকাংখী দেখেছি। তিনি ‘ফিক্বহ’ বিষয়ে আলোচনা করেন এবং তিনি সুন্নাতের পাবন্দ’।[24]

সমুদ্র অভিযান এবং রোমকদের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের ফযীলত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, أَوَّلُ جَيْشٍ مِنْ أُمَّتِى يَغْزُونَ الْبَحْرَ قَدْ أَوْجَبُوا… وَقَالَ : أَوَّلُ جَيْشٍ مِنْ أُمَّتِى يَغْزُونَ مَدِينَةَ قَيْصَرَ مَغْفُورٌ لَهُمْ… رواه البخارىُّ عن أم حرام (رض)- ‘আমার উম্মতের ১ম সেনাবাহিনী যারা সমুদ্র অভিযানে অংশ গ্রহণ করবে, তারা জান্নাতকে ওয়াজিব করে নিবে’। …অতঃপর তিনি বলেন, ‘আমার উম্মতের ১ম সেনাবাহিনী যারা রোমকদের রাজধানীতে অভিযান করবে, তারা ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে’।[25]

মুহাল্লাব বলেন, এই হাদীছের মধ্যে হযরত মু‘আবিয়া (রাঃ) ও তাঁর পুত্র ইয়াযীদ-এর মর্যাদার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। কেননা হযরত ওছমান (রাঃ)-এর খেলাফতকালে (২৩-৩৫ হিঃ) সিরিয়ার গভর্ণর থাকাকালীন সময়ে মু‘আবিয়া (রাঃ) ২৭ হিজরী সনে রোমকদের বিরুদ্ধে ১ম সমুদ্র অভিযান করেন। অতঃপর মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর খেলাফত কালে (৪১-৬০হিঃ) ৫১ হিজরী মতান্তরে ৪৯ হিজরী সনে ইয়াযীদের নেতৃত্বে রোমকদের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের উদ্দেশ্যে ১ম যুদ্ধাভিযান প্রেরিত হয়। উক্ত নৌযুদ্ধে ছাহাবী আবু আইয়ূব আনছারী (রাঃ) মারা যান ও কনস্টান্টিনোপলের প্রধান ফটকের মুখে তাঁকে দাফন করার অছিয়ত করেন। অতঃপর সেভাবেই তাঁকে দাফন করা হয়। কথিত আছে যে, রোমকরা পরে ঐ কবরের অসীলায় বৃষ্টি প্রার্থনা করত’।[26]

২৭ হিজরীর ১ম যুদ্ধে মু‘আবিয়া (রাঃ) রোমকদের ‘ক্বাবরাছ’ (قبرص) জয় করেন। অতঃপর ৫১ হিজরীতে রোমকদের রাজধানী জয় করে ফিরে এসে ইয়াযীদ হজ্জ ব্রত পালন করেন।[27] ইবনু কাছীর বলেন, ইয়াযীদের সেনাপতিত্বে পরিচালিত উক্ত অভিযানে স্বয়ং হুসায়েন (রাঃ) অংশ গ্রহণ করেন।[28] এতদ্ব্যতীত যোগদান করেছিলেন, হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর, আব্দুল্লাহ বিন আববাস, আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের, আবু আইয়ূব আনছারী প্রমুখ খ্যাতনামা ছাহাবীগণ।[29]

মৃত্যুকালে মু‘আবিয়া (রাঃ) ইয়াযীদকে হুসায়েন (রাঃ) সম্পর্কে অছিয়ত করে বলেছিলেন, فَإِنْ خَرَجَ عَلَيْكَ فَظَفَرْتَ بِهِ فَاصْفَحْ عَنْهُ فَإِنَّ لَهُ رَحِمًا مَا مِثْلَهُ وَحَقًّا عَظِيْمًا- ‘যদি তিনি তোমার বিরুদ্ধে উত্থান করেন ও তুমি তাঁর উপরে বিজয়ী হও, তাহ’লে তুমি তাঁকে ক্ষমা করবে। কেননা তাঁর রয়েছে রক্ত সম্পর্ক, যা অতুলনীয় এবং রয়েছে মহান অধিকার’।[30] ইবনু আসাকির স্বীয় ‘তারীখে’ ইয়াযীদ-এর মন্দ স্বভাবের বর্ণনায় যে সব উদ্ধৃতি পেশ করেছেন, সে সম্পর্কে ইবনু কাছীর বলেন, وَقَدْ أَوْرَدَ ابْنُ عَسَاكِرَ أَحَادِيثَ فِي ذَمِّ يَزِيدَ بْنِ مُعَاوِيَةَ كُلُّهَا مَوْضُوعَةٌ لاَ يَصِحُّ شَيْءٌ مِنْهَا ‘ইয়াযীদের মন্দ স্বভাব সম্পর্কে ইবনু আসাকির বর্ণিত উক্তি সমূহের সবগুলিই জাল। যার একটিও সত্য নয়।[31]

মাত্র ৩৭ বছর বয়সে মৃত্যু কালে ইয়াযীদের শেষ কথা ছিল, اَللَّهُمَّ لاَ تُؤَاخِذْنِي بِمَا لَمْ أُحِبُّهُ، وَلَمْ أُرِدْهُ، وَاحْكُمْ بَيْنِي وَبَيْنَ عُبَيْدِ اللهِ بْنِ زِيَادٍ ‘হে আল্লাহ! আমাকে পাকড়াও করো না ঐ বিষয়ে যা আমি চাইনি এবং আমি প্রতিরোধও করিনি এবং আপনি আমার ও ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের মধ্যে ফায়ছালা করুন’।[32]

ইযায়ীদ স্বীয় আংটিতে খোদাই করেছিলেন, آمَنْتُ بِاللهِ الْعَظِيْمِ ‘আমি ঈমান এনেছি আল্লাহর উপরে যিনি মহান’।[33]

পর্যালোচনা

শাহাদাতে কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার বিষয়ে দু’টি চরমপন্থী দলের তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়। একদল হুসায়েন (রাঃ)-এর ভন্ড সমর্থক কূফার উগ্র শী‘আ ও তাদের অনুসারী ঐতিহাসিক ও লেখকবৃন্দ। যারা হুসায়েন (রাঃ)-এর শাহাদতকে হযরত ওমর, ওছমান, আলী, ত্বালহা, যোবায়ের (রাঃ) প্রমুখ জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত মহান ছাহাবীগণের শাহাদতের চাইতে উচ্চ মর্যাদায় আসীন করতে চেয়েছেন। এই দলের শীর্ষস্থানীয় ছিলেন কূফার মোখতার ছাক্বাফী (১-৬৭হিঃ)। ২য় দল হুসায়েন বিদ্বেষী কূফার নাছেবী ফের্কার কিছু লোক, যারা আলী (রাঃ)-এর প্রতি ও তাঁর বংশের প্রতি সর্বদা বিদ্বেষ পোষণ করত। এরা হুসায়েন (রাঃ)-এর শাহাদতে খুশী হয়েছিল ও তাঁকে ইসলামের প্রথম বিদ্রোহী ও ঐক্য বিনষ্টকারী হিসাবে আখ্যায়িত করেছিল। এমনকি তারা ‘আশূরার দিন খুশী হয়ে ভাল খানাপিনা করলে ও পরিবারের উপরে বেশী বেশী খরচ করলে সারা বছর প্রাচুর্যের মধ্যে থাকা যাবে’- বলে জাল হাদীছ তৈরী করে প্রচার করেছিল। তারা এই দিনকে ‘ঈদের দিন’ গণ্য করে চোখে সুর্মা লাগায়, উত্তম পোষাক পরিধান করে, ভাল খানাপিনা করে ও রাস্তায় আনন্দ-ফুর্তি করে’।[34]

এই দলেরই লোক ছিল ইরাকের পরবর্তী নিষ্ঠুর উমাইয়া গভর্ণর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ছাক্বাফী (৪১-৯৬ হিঃ)। হুসায়েনভক্ত মোখতার বিন ওবায়েদ আল-কাযযাব ছাক্বাফী এবং হুসায়েন বিদ্বেষী নিষ্ঠুর গভর্ণর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ছাক্বাফী দু’জনেই ছিলেন একই গোত্রের লোক। এভাবেই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর একটি ভবিষ্যদ্বাণী কার্যকর হয়। যেখানে তিনি বলেছিলেন, أَنَّ فِىْ ثَقِيْفٍ كَذَّابًا وَّمُبِيْرًا ‘অতিসত্বর ছাক্বাফী গোত্রে একজন মিথ্যাবাদী ও একজন ধ্বংসকারী ঘাতকের জন্ম হবে’।[35]

উপরোক্ত দুই চরমপন্থী দলের উত্থানের ফলে মুসলিম সমাজে দু’ধরনের বিদ‘আত চালু হয়েছে ১- ঐদিন শোক ও মর্সিয়ার বিদ‘আত ২- ঐদিন খুশী ও আনন্দ প্রকাশের বিদ‘আত।

এক্ষেত্রে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মধ্যবর্তী পথ হ’ল এই যে, হুসায়েন (রাঃ) মযলূম অবস্থায় শহীদ হয়েছিলেন। অতএব রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব বিভক্ত করার বিষয়ে মুসলিম শরীফে বর্ণিত ছহীহ হাদীছটি[36] তাঁর উপরে প্রযোজ্য নয়। কেননা তিনি প্রকাশ্যে কখনোই ইয়াযীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেননি। বরং মদীনার গভর্ণরের প্রস্তাবের জওয়াবে তিনি বলেছিলেন, إِنَّ مِثْلِي لاَ يُبَايِعُ سِرًّا … وَلَكِنْ إِذَا اجْتَمَعَ النَّاسُ دَعَوْتَنَا مَعَهُمْ ‘আমার মত ব্যক্তি গোপনে বায়‘আত করতে পারে না। … বরং যখন লোকজন সমবেত হবে, তখন আপনি আমাদের ডাকবেন’।[37] এরপর তিনি মক্কায় চলে যান ও কূফাবাসীদের নিরন্তর আহবানে তিনি সেখানে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে তাদের বিশ্বাসঘাতকতা বুঝতে পেরে তিনি ইয়াযীদের নিকটে বায়‘আত করা সহ তিনটি প্রস্তাব পাঠান। অতএব পূর্বে তাঁর বিদ্রোহ প্রমাণিত হয়নি এবং শেষে বরং তাঁর আনুগত্য প্রমাণিত হয়।

হুসায়েন (রাঃ)-এর কূফায় যাত্রার প্রাক্কালে ছাহাবীগণের ভূমিকা :

হযরত হুসায়েন (রাঃ) নিহত হওয়ায় ছাহাবায়ে কেরাম চরমভাবে দুঃখিত ও মর্মাহত হন। কূফায় রওয়ানা হওয়ার প্রাক্কালে হযরত আব্দুল্লাহ বিন আববাস ও আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ)-এর ন্যায় জলীলুল ক্বদর ছাহাবীগণ তাঁকে বারবার নিষেধ করেন এবং আলী (রাঃ) ও হাসান (রাঃ)-এর সাথে কূফাবাসীদের পূর্বেকার বিশ্বাসঘাতকতার কথা তাঁকে জোরালোভাবে স্মরণ করিয়ে দেন। ইবনু আববাস ও ইবনু ওমরের বারবার তাকাদা সত্ত্বেও যখন তিনি ফিরলেন না, তখন ইবনু আববাস (রাঃ) তাকে বললেন, যদি ইরাকীরা সত্য সত্যই আপনাকে চায়, তবে তারা দলেবলে এসে আপনাকে সসম্মানে নিয়ে যাক। কিন্তু তারা তো কেবল চিঠি দিয়েছে। কিন্তু হুসায়েন (রাঃ) কোন কথা শুনলেন না। অবশেষে বারবার অনুরোধ করে ব্যর্থ হয়ে তিনি বললেন, ইরাকীরা প্রতারক। আপনি তাদের ধোকায় পড়বেন না। এরপরেও যদি আপনি নিতান্তই যেতে চান, তবে আমার অনুরোধ আপনি মহিলা ও শিশুদের নিয়ে যাবেন না। আমি ভয় পাচ্ছি যে, ওছমান যেভাবে তার স্ত্রী ও সন্তানদের সামনে নিহত হয়েছেন, আপনিও তেমনি ওদের চোখের সামনে নিহত হবেন’। এরপর আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) এসে তাঁকে বুঝালেন। কিন্তু তাতেও তিনি ফিরলেন না। তখন তিনি তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বুক ভাসিয়ে শেষ বিদায় দেন এই বলে, أَسْتَوْدِعُكَ اللهَ مِنْ قَتِيْلٍ ‘হে নিহত! আল্লাহর যিম্মায় আপনাকে সোপর্দ করলাম’। এইভাবে একে একে আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়ের, মুহাম্মাদ ইবনুল হানাফিইয়াহ, আবু সাঈদ খুদরী, আবু ওয়াক্বিদ লায়ছী, জাবের বিন আব্দুল্লাহ, মিসওয়ার বিন মাখরামাহ, উমরাহ বিনতে আব্দুর রহমান, আবুবকর বিন আব্দুর রহমান, আব্দুল্লাহ বিন জা‘ফর, আমর বিন সাঈদ ইবনুল ‘আছ প্রমুখ ছাহাবীগণ তাঁকে কূফায় না যাওয়ার অনুরোধ করেন। বিশেষ করে আবুবকর বিন আব্দুর রহমান এসে তাঁকে বলেন, هُمْ عَبِيْدُ الدُّنْيَا، فَيُقَاتِلُكَ مَنْ قَدْ وَعَدَكَ أَنْ يَّنْصُرَكَ ‘ওরা দুনিয়ার গোলাম। যারা আপনাকে সাহায্যের ওয়াদা করেছে, ওরাই আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে’। কিন্তু সবাইকে নিরাশ করে তিনি জবাব দেন, مَهْمَا يَقْضِى اللهُ مِنْ أَمْرٍ يَكُنْ ‘আল্লাহ যা ফায়ছালা করবেন, তাই-ই হবে’। এই জবাব শুনে আবুবকর বলে উঠলেন, ‘ইন্না লিল্লা-হি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজে‘ঊন’[38] হুসায়েনের শাহাদাতের পর জনৈক ইরাকী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু ওমরের কাছে ইহরাম অবস্থায় মাছি মারা যাবে কি-না জিজ্ঞেস করলে তিনি দুঃখ করে বলেন,

يَا أَهْلَ الْعِرَاقِ تَسْأَلُوْنِيْ عَنْ قَتْلِ الذُّبَابِ وَقَدْ قَتَلْتُمُ ابْنَ بِنْتِ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَقَالَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : هُمَا رَيْحَانَتَاىَ مِنَ الدُّنْيَا

‘হে ইরাকীগণ! তোমরা আমার নিকটে মাছি হত্যা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছ? অথচ তোমরা রাসূল (ছাঃ)-এর নাতিকে হত্যা করেছ। যাদের সম্বন্ধে তিনি বলেছেন ‘এ দু’ভাই দুনিয়াতে আমার সুগন্ধি স্বরূপ’।[39]

হুসায়েন (রাঃ)-এর শাহাদাতে আহলে সুন্নাতের অবস্থান :

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত হুসায়েন (রাঃ)-এর মর্মান্তিক মৃত্যুতে গভীর দুঃখ প্রকাশ করে। কিন্তু তাতে বাড়াবাড়ি করে শী‘আদের ন্যায় ঐদিনকে শোক দিবস মনে করে না। দুঃখ প্রকাশের ইসলামী রীতি হ’ল ‘ইন্না লিল্লা-হি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজে‘ঊন’ পাঠ করা (বাক্বারাহ ১৫৫-৫৬) ও তাঁদের জন্য দো‘আ করা।

বনী ইস্রাঈলের অসংখ্য নবী নিজ কওমের লোকদের হাতে নিহত হয়েছেন। মুসলমানদের প্রাণপ্রিয় খলীফা হযরত ওমর (রাঃ) মসজিদে নববীতে ফজরের ছালাতরত অবস্থায় মর্মান্তিকভাবে আহত হয়ে পরে শাহাদাত বরণ করেছেন। ওছমান গণী (রাঃ) ৮৩ বছরের বৃদ্ধ বয়সে নিজ গৃহে কুরআন তেলাওয়াত রত অবস্থায় পরিবারবর্গের সামনে নিষ্ঠুরভাবে শহীদ হয়েছেন। হযরত আলী (রাঃ) ফজরের জামা‘আতে যাওয়ার পথে অতর্কিতে আক্রান্ত হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। তাঁকে তাঁর হত্যাকারী এবং বিরোধীরা ‘কাফের’ ও ‘আল্লাহর নিকৃষ্টতম সৃষ্টি’ (شَرُّ خَلْقِ اللهِ) বলতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি।[40] যদিও হোসায়েন (রাঃ)-কে তাঁর হত্যাকারীরা কখনো ‘কাফের’ বলেনি।

হাসান (৩-৪৯হিঃ)-কে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়।[41] আশারায়ে মুবাশশারাহর অন্যতম সেরা ব্যক্তিত্ব হযরত ত্বালহা ও যুবায়ের (রাঃ) মর্মান্তিকভাবে শহীদ হন। তাঁদের কারু মৃত্যু হুসায়েন (রাঃ)-এর মৃত্যুর চাইতে কম দুঃখজনক ও কম শোকাবহ ছিল না। কিন্তু কারু জন্য দিনক্ষণ নির্ধারণ করে মাতম করার ও সরকারী ছুটি ঘোষণা করে শোক দিবস পালন করার কোন রীতি কোন কালে ছিল না। ইসলামী শরী‘আতে এগুলি নিষিদ্ধ।

শী‘আ চক্রান্তের ফাঁদে সুন্নীগণ

শী‘আ লেখকদের অতিরঞ্জিত লেখনীতে বিভ্রান্ত হয়ে যেমন বহু ইতিহাস লিখিত হয়েছে, তেমনি ‘বিষাদ সিন্ধু’-র ন্যায় সাহিত্য সমূহের মাধ্যমে বহু কল্পকথাও এদেশে চালু হয়েছে। বঙ্গদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতায় বহু বৎসর যাবৎ শী‘আদের অবস্থান থাকার কারণে হুসায়েন ও কারবালা নিয়ে অলৌকিক সব কল্পকাহিনী এদেশের মানুষের মন-মগযে বদ্ধমূল হয়ে আছে। এছাড়াও তারা অতি সুকৌশলে এদেশের শিক্ষিত সুন্নী মুসলমানদের বিভ্রান্ত করার জন্য কিছু পরিভাষা চালু করে দিয়েছে। যেমন সম্মান প্রকাশের জন্য উপমহাদেশে ছাহাবীগণের নামের পূর্বে ‘হযরত’ বলা হয় ও শেষে দো‘আ হিসাবে ‘রাযিয়াল্লা-হু ‘আন্হু’ বলা হয় ও সংক্ষেপে (রাঃ) লেখা হয়। কিন্তু হযরত হোসায়েন (রাঃ)-এর নামের পূর্বে ‘ইমাম’ এবং শেষে নবীগণের ন্যায় ‘আলাইহিস সালাম’ বলা হচ্ছে ও সংক্ষেপে (আঃ) লেখা হচ্ছে। এর কারণ এই যে, শী‘আদের আক্বীদা মতে ‘ইমাম’গণ নবীগণের ন্যায় মা‘ছূম বা নিষ্পাপ। হুসায়েন (রাঃ) তাদের অনুসরণীয় বারো ইমামের অন্যতম। তাদের ভ্রান্ত আক্বীদা মতে নবীগণের ন্যায় ‘ইমাম’গণ আল্লাহর পক্ষ হ’তে মনোনীত হন। সেকারণ নবীগণের ন্যায় ইমামগণের নামের শেষে তারা ‘আলাইহিস সালাম’ বলেন।

পক্ষান্তরে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের বিশুদ্ধ আক্বীদা মতে ছাহাবীগণ ‘মা‘ছূম’ বা নিষ্পাপ নন এবং তাঁরা নবীগণের সমপর্যায়ভুক্ত নন। অতএব সুন্নী আলেম ও বিদ্বানগণের উচিত হবে শী‘আদের সূক্ষ্ম চতুরতা হ’তে সাবধান থাকা; যেন আমাদের ভাষার মাধ্যমে তাদের ভ্রান্ত আক্বীদার প্রচার না হয়।

ইয়াযীদ-কে আমরা কখনোই ‘মালঊন’ বা অভিশপ্ত বলব না। বরং সকল মুসলমানের ন্যায় আমরা তার মাগফেরাতের জন্য দো‘আ করব। ইমাম গাযযালী (৪৫০-৫০৫ হিঃ) বলেন, ‘হোসায়েনকে তিনি হত্যা করেননি, হত্যা করার হুকুম দেননি, হত্যা করায় খুশীও হননি। এমনকি ওবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদ প্রেরিত সেনাদলের নেতা ওমর বিন সা‘দ সহ বহু সৈন্য হোসায়েন (রাঃ)-কে হত্যার ঘোর বিরোধী ছিলেন। এক পর্যায়ে অন্যতম সৈন্যাধ্যক্ষ কূফার বীর সন্তান হোর বিন ইয়াযীদ পক্ষত্যাগ করে ইবনে যিয়াদ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে নিহত হন। অতএব ইবনে যিয়াদের কঠোর নির্দেশ ও শিমার বিন যিল-জাওশান-এর নিষ্ঠুরতাই ছিল এই হত্যাকান্ডের জন্য মূলতঃ দায়ী।

উপসংহার

আমাদেরকে কারবালার ঘটনা সম্পর্কে সকল প্রকার আবেগ ও বাড়াবাড়ি হ’তে দূরে থাকতে হবে এবং আশূরা উপলক্ষে প্রচলিত শিরক ও বিদ‘আতী আক্বীদা-বিশ্বাস ও রসম-রেওয়াজ হ’তে বিরত থাকতে হবে। সাথে সাথে নিজেদের ব্যক্তি জীবন ও বৈষয়িক জীবন এবং সর্বোপরি আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও নেতৃত্ব নির্বাচন ব্যবস্থাকে নিখুঁত ইসলামী ছাঁচে ঢেলে সাজাবার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করতে হবে এবং তা বাস্তবায়নের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। আল্লাহ আমাদের তাওফীক্ব দিন- আমীন!!


[1]. মুসলিম, মিশকাত হা/২০৩৯ ‘নফল ছিয়াম’ অনুচ্ছেদ; ঐ, বঙ্গানুবাদ হা/১৯৪১।
[2]. মুসলিম, মিশকাত হা/২০৪৪; ঐ, বঙ্গানুবাদ হা/১৯৪৬।
[3]. বুখারী ফাৎহুল বারী সহ (কায়রো : ১৪০৭/১৯৮৭), হা/২০০২ ‘ছওম’ অধ্যায়।
[4]. বুখারী ফাৎহসহ হা/২০০৩; মুসলিম হা/১১২৯ ‘ছিয়াম’ অধ্যায়।
[5]. মুসলিম হা/১১৩০।
[6]. মুসলিম হা/১১৩১; বুখারী ফৎহ সহ হা/২০০৪।
[7]. মুসলিম হা/১১৩৪।
[8]. বায়হাক্বী ৪র্থ খন্ড ২৮৭ পৃঃ। বর্ণিত অত্র রেওয়ায়াতটি ‘মরফূ’ হিসাবে ছহীহ নয়, তবে ‘মওকূফ’ হিসাবে ‘ছহীহ’। দ্রঃ হাশিয়া ছহীহ ইবনু খুযায়মা হা/২০৯৫, ২/২৯০ পৃঃ। ৯, ১০  বা ১১ দু’দিন ছিয়াম রাখা উচিত। তবে ৯, ১০ দু’দিন রাখাই সর্বোত্তম।
[9]. ইবনু হাজার, আল-ইছাবাহ আল-ইস্তী‘আব সহ (কায়রো : মাকতাবা ইবনে তায়মিয়াহ ১ম সংস্করণ ১৩৮৯/১৯৬৯) ২য় খন্ড পৃঃ ২৪৮, ২৫৩।
[10]. বায়হাক্বী, ত্বাবারাণী। গৃহীত : আওলাদ হাসান কান্নৌজী ‘রিসালাতু তাম্বীহিয যা-ল্লীন’ বরাতে : ছালাহুদ্দীন ইউসুফ ‘মাহে মুহাররম ও মউজূদাহ মুসলমান’ (লাহোর : ১৪০৬ হিঃ) পৃঃ ১৫।
[11]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৫৯৯৮ ‘ছাহাবীগণের মর্যাদা’ অনুচ্ছেদ; ঐ, বঙ্গানুবাদ হা/৫৭৫৪।
[12]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১৭২৫ ‘জানাযা’ অধ্যায়।
[13]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১৭২৬।
[14]. ইবনুল আছীর, তারীখ ৮/১৮৪ পৃঃ; গৃহীত : মাহে মুহাররম পৃঃ ১৮-২০।
[15]. ইবনু রাজাব, যায়লু তাবাক্বা-তিন হানাবিলাহ, ২য় খন্ড, পৃঃ ৩৪ বর্ণনা : আব্দুল গণী  মাক্বদেসী (৬০-৭০০ হিঃ)।
[16]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ (বৈরুত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, তাবি), ৮ম খন্ড পৃঃ ১৫০।
[17]. আল-বিদায়াহ ৮/১৫৪।
[18]. ইবনু হাজার, আল-ইছাবাহ ২/২৫২; ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ৮/১৭১।
[19]. ইবনু হাজার, তাহযীবুত তাহযীব ২/৩০৪ পৃঃ; আল-বিদায়াহ ৮/১৯৯ পৃঃ। দুঃখ লাগে এই ভেবে যে, যারা প্রতারণা করে ডেকে এনে হযরত হুসায়েন (রাঃ)-কে হত্যা করেছিল, সেই কূফাবাসী ইরাকীরাই বড় হুসায়েন প্রেমিক সেজে ঘটা করে শোক পালন ও তা‘যিয়া মিছিল করছে। আর সুন্নীদের গালি দিচ্ছে।-লেখক।
[20]. ইবনু তায়মিয়াহ, মুখতাছার মিনহাজুস সুন্নাহ (রিয়ায : মাকতাবাতুল কাওছার ১ম সংস্করণ ১৪১১/১৯৯১) ১ম খন্ড পৃঃ ৩৫০; একই মর্মে বর্ণনা এসেছে, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৮ম খন্ড, পৃঃ ১৭৩।
[21]. আল-বিদায়াহ ৮ম খন্ড পৃঃ ২৩৫।
[22]. মুখতাছার মিনহাজুস সুন্নাহ ১ম খন্ড পৃঃ ৩৫০।
[23]. আল-বিদায়াহ ৮ম খন্ড পৃঃ ১৯৭।
[24]. আল-বিদায়াহ ৮ম খন্ড পৃঃ ২৩৬।
[25]. বুখারী হা/২৯২৪, ‘জিহাদ’ অধ্যায় ‘রোমকদের বিরুদ্ধে লড়াই’ অনুচ্ছেদ।
[26]. ফৎহুল বারী ৬ষ্ঠ খন্ড পৃঃ ১২০-২১।
[27]. আল-বিদায়াহ ৮/২৩২ পৃঃ।
[28]. আল-বিদায়াহ ৮/১৫৩ পৃঃ।
[29]. ইবনুল আছীর, ‘তারীখ’ ৩/২২৭ পৃঃ-এর বরাতে ‘মাহে মুহাররম’ পৃঃ ৬৩।
[30]. তারীখে ইবনে খলদুন (বৈরুত : ১৩৯১/১৯৭১) ৩য় খন্ড পৃঃ ১৮।
[31]. আল-বিদায়াহ ৮/২৩৪ পৃঃ।
[32]. আল-বিদায়াহ ৮/২৩৯ পৃঃ।
[33]. প্রাগুক্ত।
[34]. আল-বিদায়াহ ৮/২০৪ পৃঃ।
[35]. মুসলিম হা/২৫৪৫, ‘ফাযায়েলে ছাহাবা’ অধ্যায়; ঐ, মিশকাত হা/৫৯৯৪ ‘কুরাইশ বংশের মর্যাদা’ অনুচ্ছেদ। খলীফা আব্দুল মালিক বিন মারওয়ানের সময়ে (৬৫-৮৬/৬৮৫-৭০৫) ইরাকের গভর্ণর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ (৭৬-৯৬/৬৯৪-৭১৪) মক্কা অবরোধ করে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়ের (১-৭৩)-কে হত্যা করার পর তাঁর মা হযরত আসমা বিনতে আবুবকর (রাঃ)-কে ডেকে পাঠালে তিনি যেতে অস্বীকার করেন। তখন স্বয়ং হাজ্জাজ তাঁর বাড়ীতে এসে রাগতঃস্বরে তাঁকে বলেন, كَيْفَ رَأَيْتِنِى صَنَعْتُ بِعَدُوِّ اللهِ ‘আল্লাহর শত্রুর সঙ্গে আমি যে আচরণ করেছি, সে বিষয়ে আপনার মত কি’? জবাবে অশীতিপর বৃদ্ধা হযরত আসমা (রাঃ) নির্ভীকচিত্তে বলেন, رَأَيْتُكَ أَفْسَدْتَ عَلَيْهِ دُنْيَاهُ وَأَفْسَدَ عَلَيْكَ اَخِرَتَكَ ‘আমি মনে করি তুমি এর দ্বারা তার দুনিয়া নষ্ট করেছ এবং সে তোমার আখেরাত বরবাদ করেছে’। অতঃপর তিনি উপরোক্ত হাদীছ বর্ণনা করে বলেন, ‘মিথ্যাবাদীকে তো আমরা দেখেছি। এক্ষণে ধ্বংসকারী হিসাবে আমি তোমাকে ভিন্ন কাউকে মনে করি না’। মুখের পরে এই কড়া জবাব শুনে হাজ্জাজ চুপচাপ উঠে চলে যায়’।
[36]. মিশকাত হা/৩৬৭৬-৭৭ ‘ইমারত’ অধ্যায় ।
[37]. আল-বিদায়াহ ৮/১৫০।
[38]. আল-বিদায়াহ ৮/১৬২-৬৩ পৃঃ; তাহযীবুত তাহযীব ২/৩০৭ পৃঃ।
[39]. বুখারী হা/৩৭৫৩; মিশকাত হা/৬১৩৬ ‘নবী পরিবারের মর্যাদা’ অনুচ্ছেদ।
[40]. আল-বিদায়াহ ৭/৩৩৯।
[41]. আল-বিদায়াহ ৮/৪৪।

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button