বানরবাদ ও ট্রান্সজেন্ডার, এরপর কি?
‘বানরবাদ’ হ’ল ডারউইনের তত্ত্ব অনুযায়ী মানুষকে বানর জাতীয় পশুর বংশধর হিসাবে প্রমাণ করা। সাবেক বামপন্থী শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ (সিলেট) ২০১২ সালে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এটি চালু করেন। যা আজও চলছে। আর ‘ট্রান্সজেন্ডার’ হ’ল অস্ত্রোপচার ও হরমোন প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে লিঙ্গ পরিবর্তন করে আল্লাহর সৃষ্টিকে বিকৃত করা। সদ্য সাবেক মহিলা শিক্ষামন্ত্রী দীপুমণি (চঁাদপুর) এটি চালু করেন। ইতিপূর্বে তার চালু করা যৌন স্বাস্থ্য ও প্রজনন শিক্ষার নামে সমকামিতা ও ব্যভিচার উস্কে দেওয়ার শিক্ষা আজও বন্ধ হয়নি। ফলে বেড়েই চলেছে অপ্রতিহত গতিতে নারী ধর্ষণ ও নির্যাতন। যার অধিকাংশ গোপন থাকে। তাছাড়া আখেরাতে জবাবদিহিতার অনুভূতিহীন এই শিক্ষা ব্যবস্থায় দেশে দুর্নীতি বৃদ্ধি পাবে। রাস্তা হবে, কিন্তু কার্পেট উঠে যাবে। পুলিশ থাকবে, কিন্তু আইন-শৃংখলা থাকবে না। আদালত থাকবে, কিন্তু ন্যায়বিচার থাকবে না। বস্ত্তত ‘ট্রান্সজেন্ডার’ একটি শয়তানী প্রতারণা। বহু পূর্বেই আল্লাহ মানবজাতিকে শয়তানের ধেঁাকা থেকে সতর্ক করে বলেছেন, ‘(শয়তান বলে,) আর আমি তাদেরকে আদেশ করব যেন তারা আল্লাহর সৃষ্টিকে পরিবর্তন করে দেয়। (আল্লাহ বলেন,) যে ব্যক্তি আল্লাহকে ছেড়ে শয়তানকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, সে প্রকাশ্য ক্ষতিতে পতিত হয়’ (নিসা ১১৯)।
যেমন ক্ষতিতে পড়েছে ভারত ও পাশ্চাত্যের দেশগুলি। সেখানে দেখা দিয়েছে বিভিন্ন সামাজিক, স্বাস্থ্যগত ও আইনগত সমস্যা। উত্তরাধিকার বন্টন নিয়ে তৈরী হচ্ছে মারাত্মক সামাজিক বিশৃংখলা। সাধারণ মানুষের তুলনায় ২২গুণ বেশী আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে এসব লোকদের মধ্যে। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা মাহদেশের দেশগুলি এর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। এমনকি উগান্ডা পশ্চিমা বিশ্বের নিষেধাজ্ঞা ও বিশ্বব্যাংকের ঋণ স্থগিত করার মতো অর্থনৈতিক ঝঁুকির বিষয়টিকেও উপেক্ষা করেছে। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিও ‘ট্রান্সজেন্ডার’ মতাদর্শের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এই ইস্যুতে ইতালীর সরকার পরিবর্তন হয়েছে। হাঙ্গেরী ট্রান্সজেন্ডারদের আইনগত স্বীকৃতি বন্ধ ঘোষণা করেছে। স্কুলের পাঠক্রমে ট্রান্সজেন্ডার বা এলজিবিটি মতাদর্শ অন্তর্ভুক্তির প্রতিবাদে গত ২০শে সেপ্টেম্বর’২৩ কানাডার লক্ষ লক্ষ পিতা-মাতা রাস্তায় নেমে এসেছেন। বিশ্ব বিখ্যাত টেক বিলিওনিয়ার ইলন মাস্ক এই নোংরা মতাদর্শের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে এর ভয়াবহতা অনুধাবনের জন্য বিশ্বের পিতামাতাদেরকে সতর্ক করেছেন। তিনি What is a woman নামে সম্প্রতি একটি ভিডিও ডকুমেন্টারী শেয়ার করেন। যা এক সপ্তাহের মধ্যে ১৭০ মিলিয়ন মানুষ দেখেছেন।
অথচ বাংলাদেশ সরকার নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালার মনোনয়ন পত্রে ‘লিঙ্গ’ পরিচয়ে সংশোধনী এনে পুরুষ ও মহিলার পাশাপশি ‘হিজড়া’ যুক্ত করার মাধ্যমে ট্রান্সদের জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ তৈরী করে দিয়েছে। গত বছরের ২৩শে ফেব্রুয়ারী যা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়েছে (দৈনিক প্রথম আলো, ৩১ শে মার্চ ২০২৩)। আল্লাহ বলেন, ‘আর তিনিই সৃষ্টি করেন পুরুষ ও নারী জোড়ায় জোড়ায়’ (নজম ৪৫)। ফলে পুরুষ ও নারীর বাইরে হিজড়া কোন তৃতীয় লিঙ্গ নয়। বরং লিঙ্গ প্রতিবন্ধী। যার জন্য চিকিৎসা প্রয়োজন। তারা আদৌ জৈবিক তাড়না থেকে মুক্ত নয়। অতএব সরকারের উচিত গত বছরের উক্ত গেজেট সংশোধন করা এবং এইসব ভ্রান্ত মতবাদ পোষণকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া। নইলে অদূর ভবিষ্যতে এমন সব সমস্যার সম্মুখীন হ’তে হবে যা সমাধান করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। যে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে এখন পাশ্চাত্য বিশ্ব।
অতঃপর নতুন শিক্ষা কারিকুলাম চালুর পিছনে রয়েছেন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের প্রফেসর ড. জাফর ইকবাল সহ হাতেগণা কয়েকজন বামপন্থী শিক্ষাবিদ। যারা ইতিপূর্বে সৃজনশীল ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। যা ব্যর্থ হয়েছে। এখন আবার নতুন কারিকুলাম চালু করতে যাচ্ছেন, যা আগেরটার চাইতেও অবাস্তব ও অযৌক্তিক। যে বিষয়ে ক্ষুব্ধ অভিভাবকরা বলেন, শিক্ষার্থীদের বিছানা গোছানো, রান্না-বান্না শেখানো, পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তে গ্রুপ ভিত্তিক মূল্যায়ন, পাঠ্য বইয়ের পরিবর্তে তাদের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেওয়ার ব্যবস্থাকে আমরা কোনভাবেই মেনে নিতে পারি না। এর সঙ্গে পাঠ্য বইয়ের আপত্তিকর শব্দ ও বিষয় পড়ানোয় আমরা উদ্বিগ্ন। নতুন কারিকুলামে শিক্ষার্থীদের এসাইনমেন্ট দেওয়া হয়। এতে প্রতিবার নতুন নতুন উপকরণ কিনতে হয়। যা আমাদের উপর বাড়তি খরচের বোঝা চাপিয়েছে। এই কারিকুলামের শিক্ষায় আমাদের সন্তানরা ওয়েটার বা হোটেল বয় ছাড়া আর কিছুই হবে না। তাছাড়া রাত ২/৩ টা পর্যন্ত জেগে তাদের প্রজেক্টের কাজ করতে হচ্ছে। একেকটা প্রজেক্টের জন্য অনেক ধরণের জিনিষপত্র কিনতে হয়। এতে আমাদের খরচ অনেক বেড়ে যাচ্ছে। তাছাড়া এই শিক্ষাক্রমে মূল্যায়ন পদ্ধতিও আজগুবি। এতে লিখিত পরীক্ষা নেই বললেই চলে। শিক্ষার্থীরা একক বা দলগতভাবে কাজ করবে। আর মূল্যায়ন করবেন শিক্ষকরা। ফলে আগে যে অভিভাবক দু’জন শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়াতেন, তিনি এখন ৫/৬ জনের কাছে প্রাইভেট পড়ান। শিক্ষক প্রাইভেটে কি পড়ালেন সেটা বিষয় নয়, শিক্ষার্থী প্রাইভেট পড়ে সেটাই বড় বিষয়’। ফলে পড়াশোনা বিমুখ হয়ে গড়ে উঠবে আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধররা (দৈনিক ইনকিলাব ২৭শে ডিসেম্বর’২৩ বুধবার)।
নতুন শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেছেন, আমার মন্ত্রীত্বকালে বিতর্কিত শিক্ষা কারিকুলাম বাস্তবায়িত হবে না। তিনি ট্রান্সজেন্ডারের চরম বিরোধিতা করে বলেন, ট্রান্সজেন্ডার আর হিজড়া এক নয় (দৈনিক ইনকিলাব ২১শে জানুয়ারী রবিবার, ১ম পৃষ্ঠা)। এই মন্তব্যের জন্য আমরা তঁাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি এবং দো‘আ করছি যেন তিনি এই দৃঢ়তার উপর শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারেন। যদিও ইতিপূর্বে তিনি বলেছিলেন যে, সাবেক দুই বামপন্থী শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শের মাধ্যমে তিনি কাজ করবেন। সেটা করলে তিনি ভুল করবেন।
প্রশ্ন হয় ৯২% মুসলিম প্রধান দেশে ইসলামী শিক্ষা চালু না করে নাস্তিক্যবাদী শিক্ষাব্যবস্থা জাতির উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার দুঃসাহস এরা পায় কোথায়? জনগণের কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে এদের পুষতে হবে কেন? আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতাকে ভয় করুন! সর্বোচ্চ দায়িত্বশীল হিসাবে সর্বোচ্চ শাস্তি থেকে বঁাচার চেষ্টা করুন!
আমরা তরুণ শিক্ষামন্ত্রীকে অতীতের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। একটা জাতিকে ধ্বংস করতে গেলে সর্বাগ্রে সেদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে হয়। সেকারণ বৃটিশরা যখন মনে করল যে, তাদেরকে ভারতবর্ষ ছাড়তেই হবে, তখন ইংরেজ সরকার লর্ড মেকলের (১৮০০-১৮৫৯) পরিকল্পনা মতে ১৮৩৫ সালে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থাকে দু’ভাগ করে মাদ্রাসা শিক্ষা ও সাধারণ শিক্ষা নামে দ্বিমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে। এর মাধ্যমে তারা রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি ইত্যাদি বৈষয়িক ক্ষেত্রে ইসলামী শিক্ষাকে অচল প্রমাণ করতে চায়। পাখির একটি ডানা ভেঙ্গে দিলে তার যে অবস্থা হয়, ইসলামী শিক্ষাকে মাদ্রাসা শিক্ষার নামে নির্দিষ্ট একটি মাযহাবী ফিক্বহ, মানতেক ও হিকমতের মধ্যে বন্দী করে বাস্তবে অনুরূপ পঙ্গু করে ফেলা হয়।
মেকলে বলেছিলেন, আমরা এদেশ থেকে চলে গেলেও এমন শিক্ষাব্যবস্থা রেখে যাব, যেখানে তৈরী হবে, a class of persons Indian in blood and colour, but English in tastes, in opinions, in morals and in intellect. ‘এমন একটি শ্রেণী যারা রক্তে ও বর্ণে হবে ভারতীয় এবং রুচি, মতামত, নৈতিকতা ও বুদ্ধিমত্তায় হবে ইংরেজ’। দেখা গেল, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই যে ‘কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট ১৯৭৪’ পেশ করা হয়, সেখানে ১ম শ্রেণী থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত ধর্মীয় শিক্ষা বাতিল করা হয় এবং নাচ-গান অপরিহার্য করার সুফারিশ করা হয়। সেই থেকে এযাবৎ একই ধারায় দেশে দ্বিমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু রয়েছে। বরং বর্তমান সরকারের আমলে নূরুল ইসলাম নাহিদ (২০০৯-২০১৯) ও দীপুমণির (২০১৯-২০২৪) সময় নাস্তিক্যবাদী শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। যা দেশের আপামর জনসাধারণের আক্বীদা-বিশ্বাস ও সামাজিক রীতি-নীতির বিরোধী। অথচ জনগণের ভোট নিয়ে ক্ষমতায় বসে গণবিরোধী কাজ করতে এইসব বামদের একটুও বিবেকে বঁাধেনা। এতেই মনে হয় যে, এরা বিদেশের দেওয়া এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন। তাদের জানা উচিত ছিল যে, দেশের মুসলমানদের হাতে ‘কুরআন’ আছে। যা থেকে তারা কখনই বিচ্ছিন্ন হবে না ইনশাআল্লাহ। যেমন সাবেক বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ইউলিয়াম গ্লাডস্টোন (১৮৮২-১৮৯৪) ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে দঁাড়িয়ে ‘কুরআন’ হাতে নিয়ে বলেছিলেন, So long as this book remained with the Muslims in that country and they respected and followed it, the British would never be able to dominate them. He added that the only solution was to try and separate the Holy Qur’an from the Muslims of Egypt. ‘যতদিন ভারতবর্ষের মুসলমানদের হাতে এই কুরআন থাকবে এবং তারা একে সম্মান করবে ও অনুসরণ করবে, ততদিন ইংরেজরা তাদের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে কখনই সক্ষম হবে না। এই সাথে তিনি যোগ করে বলেন, একমাত্র সমাধান হ’ল পবিত্র কুরআনকে মিসরীয় মুসলমানদের থেকে পৃথক করা ও সেজন্য চেষ্টা করা’। তাই বাংলাদেশের জনগণ কখনই এই ফালতু শিক্ষা কারিকুলাম গ্রহণ করেনি। ফলে বেসরকারী উদ্যোগে সর্বত্র ইসলামী শিক্ষা কারিকুলাম ও প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে এবং সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি কেবল সার্টিফিকেট বিতরণের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
অতএব আমরা অবশ্যই চাইব এমন একজন সাহসী শিক্ষামন্ত্রীকে, যিনি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সার্বিক কল্যাণের জন্য দেশে একক ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করবেন। যাতে ধ্বংসোন্মুখ পাশ্চাত্য সভ্যতার ন্যায় আমাদের দেশের তরুণ ও যুবসমাজের নৈতিক চরিত্র ভোগ-লিপ্সার ফেনিল স্রোতে ধসে না পড়ে এবং আসমানী ও যমীনী গযবে দেশ ধ্বংস না হয়ে যায়। আল্লাহ আমাদের পরবর্তী বংশধরদের রক্ষা করুন-আমীন!
প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মাসিক আত-তাহরীক