স্বামী-স্ত্রীর দায়িত্ব ভাগাভাগির সমস্যা

আমার প্রিয় কাজের একটি হলো স্বামীর জন্য খাবার প্রস্তুত করে টেবিলে দেয়া, আর খেয়ে ওঠার সাথে সাথে গরম গরম চা। মা-বাবা এবং স্বামীর খেদমত করার মাঝে একটা অপার্থিব আনন্দ আছে, একটা পারলৌকিক তৃপ্তি আছে – এই যুগের অতি ব্যস্ত পেশাজীবি নারীরা সেই আনন্দটা কখনোই উপভোগ করতে পারে না। সপ্তাহ জুড়ে কর্মস্থানের চিন্তা আর কাজের চাপে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সে নিজেই অবসর চায়। সে চায় স্বামীই তাকে চা বানিয়ে সামনে দিক, পারলে রান্নাটাও করে দিক।
এমন অনেক পরিবার আছে, যেখানে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কাজ করে। দুজনেই পরিবারের জন্য উপার্জন এবং খরচ করে। কিন্তু স্বামী বাসায় ফিরেই টিভি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়, ওদিকে স্ত্রীকে খাবার গরম করে টেবিলে দিতে হয়৷ আস্তে আস্তে স্বামীর প্রতি স্ত্রীর অভিযোগ তৈরি হয়। ক্লান্ত শরীরে সংসারের এত কাজ করতে বিরক্ত লাগে। সাংসারিক কাজের ভাগাভাগি নিয়ে শুরু হয় দুজনের মন কষাকষি, ক্ষোভ, দাম্পত্য কলহ। “দুজনেই বাইরে কাজ করছি, তাহলে ঘরের কাজ কেন দুজনে ভাগাভাগি করে নিব না?” – এই চিন্তা থেকে সৃষ্টি হয় স্বামী-স্ত্রীর মানসিক দূরত্ব।
আবার ধরুন স্বামী মহাশয়ও ভদ্রলোক। তিনি ঘরের কাজ ভাগাভাগি করে নিলেন। নিজের কাপড় নিজে ধোন, টেবিলে খাবার সার্ভ করেন, বাসায় তিনদিন তিনি, আর তিনদিন তার স্ত্রী রান্না করেন। কিন্তু এই সম্পর্কে পরস্পর নির্ভরশীলতা কোথায়? এ যেন চুলচেরা হিসাব করে ব্যবসা চালানোর শামিল। ব্যবসায়ী পার্টনাররাও হয়তো এত হিসেবী হয় না।
আজকাল স্বামী-স্ত্রীর এই হিসাব আর কাজ ভাগাভাগির মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সন্তান নেয়ার ব্যাপারেও নারীদের অনীহা সৃষ্টি হচ্ছে। তারা অধিক সন্তান গ্রহণে আগ্রহী না। “আমি কেন বাচ্চা নিব? আমি কেন আমার ক্যারিয়ারকে রিস্কে ফেলাব? প্রেগনেন্ট হলে হাজবেন্ডের তো কোনো কষ্ট হবে না, আমাকেই যত স্যাক্রিফাইস করতে হবে! আমি কেন এত কম্প্রোমাইজ করব?”
এভাবেই নারী-পুরুষ যখন দুজনেই বাইরের দুনিয়ার পিছে ছুটতে থাকে, তখন সংসারে ইমব্যালেন্স সৃষ্টি হয়৷ আল্লাহ তা’আলা স্বামী এবং স্ত্রীকে আলাদা আলাদা দায়িত্ব দিয়েছেন। স্বামীর দায়িত্ব উপার্জন এবং পরিবারের ভরণপোষণ। স্ত্রীর দায়িত্ব সন্তান গ্রহণ, বাচ্চাকাচ্চা ও ঘরের দেখাশোনা। এই ভূমিকা যখন উল্টোপাল্টা হয়ে যায়, তখন সম্পর্কে কোনো না কোনোভাবে প্রভাব পড়বেই। আল্লাহর কথার অমান্য করলে তাতে নেগেটিভ ইমপ্যাক্ট থাকবেই থাকবে৷
আজকাল যেমন ডিভোর্সের হার অনেক বেড়ে গেছে। স্বামী যদি স্ত্রীকে বলে তুমি বাসায় থাকো, চাকরি কোরো না, বাচ্চা নাও – তাহলে অনেক মেয়েই খেপে গিয়ে ডি-ভো-র্স দিয়ে দেয়। আবার দুজনে বাইরে কাজ করার ব্যাপারে খুব একমত হলেও দেখা যায় তারা অন্যভাবে সাংসারিক দায়িত্বে ছাড় দিচ্ছে। যেমন – ক্যারিয়ার এস্টাবলিশ করতে গিয়ে দেরিতে বিয়ে করা, সন্তান-গ্রহণ না করা, পরিবার ও সন্তান-সন্ততিকে বেশি সময় না দেয়া ইত্যাদি।
সাংসারিক দায়িত্বগুলিও কিন্তু কোনো অংশে সহজতর বা কম নয়, হোমমেকার নারীরাও ব্যস্ত থাকে, তাদেরও ফুরসতের দরকার পড়ে, বিশেষ করে যদি ছোট ছোট বাচ্চাও দেখাশোনা করতে হয়৷ তবু এই ব্যস্ততার বেশিরভাগ জুড়েই থাকে তার সংসার, তার পরিবার৷ পরিবারের সবকিছু তার নখদর্পনে। পেশাজীবি নারীরা পরিবারকে কখনোই এত গুরুত্ব দিতে পারে না। মানুষ তো সুপারম্যান না। সে একসাথে দুইদিক পারফেক্টলি কীভাবে সামলাবে? স্বাভাবিকভাবেই ক্যারিয়ার, আয়-উপার্জনহ ও বাইরের দুনিয়াতে যখন একজন নারী বেশি প্রায়োরিটি দেয়, তখন তার সাংসারিক ভূমিকা নিজের অজান্তেই সেকেন্ড প্রায়োরিটিতে পরিণত হয়।
কত সুন্দর ছিল আমাদের নানী-দাদীদের সময়টা। যখন উনারা সংসারের খেদমত করতেন আর পুরুষরা ঘর সামলাতে বাইরে খাটতেন। সে সময় সমাজে ভারসাম্য ছিল। স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কে পারস্পরিক নির্ভরশীলরা ছিল, মায়া ছিল। এত হিসাব করে সংসার চালাতে হতো না। একই কাজ নিয়ে দুজনের কাড়াকাড়ি হতো না। এখন নারীরাও পুরুষ হতে চায়। আগ বাড়িয়ে চাকরি-বাকরি করতে চায়। ঘরের কাজকে তুচ্ছ ভাবে। তাই তো আজ ঘরগুলো আমাদের ভাঙনের পথে। মানুষ শুধু নিজেকে নিয়েই ভাবতে শিখছে, আর দিন দিন হয়ে উঠছে আরও স্বার্থপর। একজন গৃহিনী ফুলটাইম মা নিঃস্বার্থভাবে পরিবারকে সময় দেন, হয়তো টুকটাক অন্য কাজ করেন। আর কর্মজীবি নারী সপ্তাহ জুড়ে অন্যের কাজই করেন, অন্যের ব্যবসা বা নিজের ক্যারিয়ার সামলান; তার কাছে স্ত্রী বা মায়ের ভূমিকাটাই পার্ট-টাইম।
– আনিকা তুবা