নারী অঙ্গন

চট্টগ্রামের প‍র্দানশীল বোনেরা

আমাদের দেশে প্রচলিত একটা ধারণা আছে যে, সিলেট এবং চট্টগ্রামের লোকজন অপেক্ষাকৃত ধার্মিক হয়ে থাকে। হয়তো যারা এদেশে ধর্ম প্রচার করতে এসেছিলেন তাঁদের অনেকের ঘাঁটি এসব অঞ্চলে ছিল বিধায় এ অঞ্চলের লোকজন ধর্মের ব্যাপারে অধিকতর সচেতন হয়ে থাকবে বলে আশা করেই এ ধরনের ধারণা করা হয়ে থাকে। এই অনুমান কতটা সঠিক কতটা বেঠিক সে হিসেবে যাওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। চট্টগ্রাম আমার জন্মস্থান এবং জীবনের একটা অংশ এখানে কাটিয়েছি আমি। সে হিসেবে আমার বোনদের মধ্যে ইসলামের একটি মৌলিক বিধান পালন সংক্রান্ত যেসব ভুল ধারণা দেখেছি সেটা নিয়ে কিঞ্চিত আলোচনা করতে চাই।

কেউ যদি সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করে আমার ভুল ধরিয়ে দেন তাকে আমার সবচেয়ে বড় শুভাকাঙ্ক্ষী মনে হয়। কেননা তিনি বিচার বিশ্লেষণ করে আমাকে আমার একটি ত্রুটি থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করেছেন। বোনেরা, আমি নিজেও আপনাদের একজন। তাই আপনারা আমার কথায় আহত না হয়ে যদি বোঝার চেষ্টা করেন, তবে আমরা উভয়েই উপকৃত হব।

আমি খুব একটা ইসলামিক পরিবারে জন্মাইনি। এখনো শিখছি। তবে ইসলামের দিকে এগোতে গিয়ে লক্ষ্য করেছি, ইসলামের মৌলিক নিয়মগুলোর মধ্যে যে ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের সবচেয়ে বেশি ঝামেলা হয় তা হলো পর্দা। আমরা অনেকেই জানি না যে নামাজ বা রোজার মতো পর্দাও পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্য ফরজ। অনেক মানুষ এখনো মনে করে পর্দা একটি অপশনাল ব্যাপার এবং এটি শুধু নারীদের জন্য প্রযোজ্য। অনেকের ধারণা পর্দা মানে শুধু একপ্রস্থ কাপড়। কিন্তু পর্দা মানে যে আচার-আচরণ থেকে শুরু করে সৌন্দর্যের প্রদর্শন পর্যন্ত সবকিছুতে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আসা সেটা যেদিন থেকে বুঝতে পেরেছি সেদিন থেকে আমি একে মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছি। সুকুমার রায়ের কবিতায় “নিয়মছাড়া হিসাবহীন” বাক্যাংশটি পড়তে যত ভালো লাগে, আসলে কিন্তু অনিয়মের মধ্যে তেমন ভালো কিছু পাবার নেই।

আমি ফাকীহ (ইসলামি আইনজ্ঞ) নই। সুতরাং পর্দাসংক্রান্ত ফিক্হের আলোচনায় যাবো না। আমি সহজ ভাষায় যতটুকু বুঝি, পর্দা বলতে বোঝানো হয়েছে এমন পোশাক যা শরীরের রঙ এবং আকৃতিকে ঢেকে রাখে এবং এমন আচরণ যা ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হতে মানুষকে নিরাপদ রাখে। নারীদের আল্লাহ সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন, তাদের চুল থেকে নখ পর্যন্ত সবই আকর্ষণীয়। বিশ্বাস না হলে যেকোনো ভাষায় যেকোনো কবির প্রেমের কবিতা পড়ুন। তাই আল্লাহ তাদের শুধু মুখ এবং হাত ছাড়া বাকি সবটুকুই ঢেকে নিজেদের কেবল তাদের জন্য উন্মুক্ত রাখতে বলেছেন যারা অবিসংবাদিতভাবে মেয়েটির ভালো চায় বা অন্তত ক্ষতি চায় না।

পুরুষদের যেহেতু আল্লাহ ভারী কাজের জন্য সৃষ্টি করেছেন, তাদের এমন আহামরি কোনো সৌন্দর্য দেননি; সুতরাং তাদের জন্য শারীরিক পর্দার পরিধিও অনেক কম করে দিয়েছেন। আচরণের দিক থেকে পুরুষদের নিয়ন্ত্রণ কম বিধায় তাদের জন্য পর্দা অনেক বেশি কঠোর করে দেওয়া হয়েছে। দৃষ্টি থেকে শুরু করে বাড়িতে প্রবেশ পর্যন্ত সর্বত্র তাদের সাবধানতা অবলম্বন করার কথা বলা হয়েছে। এদিক থেকে মেয়েদের কোমল স্বরে অপ্রয়োজনীয় গল্প-গুজব থেকে বিরত থাকা ছাড়া আর তেমন কোনো বাধা দেওয়া হয়নি। কথাবার্তা কেবল প্রয়োজনীয় বিষয়ের মধ্যেই সীমিত রাখার ব্যাপারে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। কেননা অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা এবং অনিয়ন্ত্রিত আচরণ থেকে কী কী হয় তা নিয়েই পৃথিবীর তাবৎ নাটক, সিনেমা, উপন্যাস রচনা করা হয়। আর সেগুলো পড়ে পাঠক চোখের জল ফেলেন; যাকে এই বেদনার মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করতে হয় তার কথা তো বাদই দিলাম।

এবার মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। আমরা আবুধাবী থেকে দেশে ফিরে আসি ১৯৮৯ সালে। চট্টগ্রাম থাকতে আসি ১৯৯০ সালে। ছুটিতে এলে মূলত ঢাকায় থাকা হতো, তাই চট্টগ্রাম তেমন পরিচিত ছিল না। জন্মস্থানের সাথে পরিচিত হতে গিয়ে কিছু কিছু জিনিস দেখে খুব আশ্চর্য হয়ে যাই।

আবুধাবীতে দেখতাম যারা পর্দা করতেন তাঁরা সম্পূর্ণভাবে করতেন, আর যারা করতেন না তারা করতেন না। চট্টগ্রাম এসে প্রথম দেখলাম মহিলারা বোরকা পরে হাঁটছেন কিন্তু তাদের মাথার কাপড় গলায় পেঁচানো! মাথাও ঢাকছে না, শরীরও ঢাকছে না! তাঁরা কখনো সেই স্বচ্ছ ওড়না তুলে আধামাথায় দিচ্ছেন, আবার কখনো সবার সামনে ওড়না খুলে চুল ঠিক করছেন। আমি বেশ অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেলাম। যাদের দেখে আমি নিজেই হতবাক, স্বাভাবিকভাবেই তাদের দেখে আমার বাবা-মাকে বোঝানো কঠিন আমি কেন পর্দা করতে চাই।

কলেজে যাওয়া শুরু করার পর দেখতে পেলাম অনেক মেয়েরা পরিবারের চাপে বাসা থেকে বোরকা পরে বেরোচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কিছু দূর এসে বোরকা খুলে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখছে; আর শুধু অ্যাপ্রন পরে কলেজে আসছে! আরেকবার চট্টগ্রাম এয়ারপোর্টে এক অসাধারণ সুন্দরীকে দেখলাম। তাকে শ্বশুরবাড়ির সবাই বিদায় জানাতে এসেছে। প্লেনে উঠামাত্র দেখি তিনি বোরকা স্কার্ফ সব খুলে ফেললেন, পাশে বসা স্বামী নির্বিকার! আমার খুব মায়া লাগত ওদের জন্য। ওদের বাবা-মা সমাজ ওদের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো করে পর্দা চাপিয়ে দিয়েছে, কিন্তু এর কী প্রয়োজন বা কেন করতে হবে তা তাঁরা নিজেরাই জানে না। এটা তাঁদের কাছে একটা ফ্যামিলি ট্রেডিশন বৈ কিছুই নয়। যা তারা বোঝে না তা তাদের ওপর চাপিয়ে দিলে মেয়েরাই বা কী করে মেনে নেবে? আমার খুব দুঃখ হতো। ওরা পর্দা করার সুযোগ পেয়েও খুলে ফেলছে, আর আমি করতে চাইছি কিন্তু এই নিয়ে আমার পরিবার আমার ওপর বিরক্ত!

চট্টগ্রামে একটা ট্র্যাডিশন আমার ভীষণ খারাপ লাগে। অনেক মেয়েরা বাইরে পর্দা করলেও ঘরে নির্দ্বিধায় অন্য পুরুষদের সামনে বেপর্দা অবস্থায় চলে যায়। এ ব্যাপারটা যে কত হাস্যকর তা কারও মাথায়ই আসে না! যদি পর্দার উদ্দেশ্য হয় পরপুরুষের কাছ থেকে নিজের সৌন্দর্য গোপন করা, তাহলে তার সামনে এই সৌন্দর্য এক জায়গায় গোপন এবং আরেক জায়গায় প্রকাশ করলে কী লাভ?….

লিখেছেন : রাহনুমা বিনতে আনিস (‘নট ফর সেল’ বইয়ের অংশ-বিশেষ)

মন্তব্য করুন

আরও দেখুন
Close
Back to top button