নারী অঙ্গন

নারী শিক্ষা

ইসলামে নারী শিক্ষা অপরিহার্য। যেমন পুরুষের জন্য অপরিহার্য। তবে উভয়ের জন্য শিক্ষার পরিবেশ হবে ভিন্ন এবং উভয়ের উপযোগী শিক্ষা সিলেবাস হবে ক্ষেত্রবিশেষে ভিন্ন। তবে উভয়ের শিক্ষার ভিত্তি হবে একই। আর তা হ’ল তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাত। দুনিয়াতে ভূমিষ্ট হবার পর ছেলে শিশু ও মেয়ে শিশু উভয়কে প্রথমে জানতে হবে তার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ সম্পর্কে। অতঃপর জানতে হবে, আল্লাহ তাকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর দাসত্ব করার জন্য। অতঃপর সে তার কর্তব্য ও কর্মক্ষেত্র সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করবে। উভয়ের আবেগ-অনুভূতি পৃথক। তাই দু’বছরের শিশুর মধ্যেও দেখা যাবে যে, তাদের খেলনা পৃথক, পোষাক পৃথক ও খেলার সাথী পৃথক। দেখবে যে তাদের রুচি ও দাবীও পৃথক। কন্যা শিশু বাইরে যেতে চায় না। সে হাড়ি-পাতিল নিয়ে খেলে। ছেলে শিশু ঘরে থাকতে চায় না। সে বাস-ট্যাক্সির খেলনায় মেতে থাকে। মেয়ে শিশু বাপের বেশী আদরের হ’লেও মায়ের কোলে ঘুমাতে সে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। ঠিক এভাবেই তাদের চাহিদা অনুযায়ী ছোট থেকে শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরী করতে হবে। সেই সঙ্গে দিতে হবে অনুকূল পরিবেশ। মাছ যেমন পানির মধ্যে স্বাধীন। মেয়েরা তেমনি পর্দার মধ্যে স্বাধীন। ছেলে ও মেয়ে প্রত্যেকে তাদের বিপরীত পরিবেশে বিব্রত বোধ করে। একইভাবে টাইট-ফিট অর্ধনগ্ন পোষাকে তারা উভয়ে সংকুচিত হয়। কিন্তু ঢিলা পোষাকে ও বোরকা-ম্যাক্সির মধ্যে উভয়ে স্বস্তিবোধ করে ও খোলা মনে চলাফেরা করে। এর বিপরীত কিছু করতে গেলেই সেটা হয় তাদের স্বভাব বিরুদ্ধ। যাতে ঘটে নানা বিপত্তি। ইসলাম নারী ও পুরুষের এই স্বভাবগত প্রবণতাকে সম্মান দেখিয়েছে এবং তাদের জন্য পৃথক শিক্ষা পরিবেশ ও শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে। দেশের ও মানবতার কল্যাণকামী যেকোন ব্যক্তিকে ইসলামের এই মঙ্গলময় আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হ’তেই হবে। যার কোন বিকল্প নেই।

ইসলামী শিক্ষার মূল ভিত্তি তাওহীদ সম্পর্কে জানলেই শিশুমনে ভেসে ওঠে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর বড়ত্ব ও মহত্তের কথা। সে তার কাছে প্রার্থনা করে বলে, রবিব যিদনী ইলমা ‘হে আমার প্রতিপালক! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দাও’ (ত্বোয়াহা ১১৪)। সে তার পাঠ শুরু করে বিসমিল্লাহ বলে এবং শেষ করে আলহামদুলিল্লাহ বলে। অতঃপর যে নিষ্পাপ রাসূলের মাধ্যমে সে তার স্রষ্টার বিধান পেয়েছে, তার আদেশ-নিষেধ মেনে চলার জন্য সে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। অতঃপর সে ঈমানে মুফাছ্ছাল ও ঈমানে মুজমাল শিখে নেয় এবং আল্লাহ, রাসূল, ফেরেশতামন্ডলী, আল্লাহর কিতাব, বিচার দিবস ও তাক্বদীরের ভাল-মন্দের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে। সে জান্নাতের আকাঙ্ক্ষায় ব্যাকুল হয় এবং জাহান্নামের ভয়ে ভীত হয়। এতে তার হৃদয় সর্বদা পরিশুদ্ধ থাকে। এভাবে যখন শিশুর মানস জগত গড়ে ওঠে, তখন একে একে সে অন্যান্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান লাভ করতে থাকে। যে জ্ঞান তার ইহকাল ও পরকালকে সমৃদ্ধ করে।

যে ইলম আদমকে ফেরেশতাদের উপরে স্থান দিয়েছিল সে ইলম ছিল তাওহীদের ইলম। আজও সেই ইলমই মানুষকে সৃষ্টিজগতের উপরে শ্রেষ্ঠত্বের আসন দিবে। এর বিপরীত ঈমানহীন শিক্ষা হ’ল শয়তানী শিক্ষা। যার ধোঁকায় পড়ে আদমকে জান্নাত হারাতে হয়েছিল। আজও মানুষকে জান্নাত হারাতে হবে এবং দুনিয়া অকল্যাণে ভরে যাবে। যেমনটি এখন হচ্ছে। আজ বিশ্বের প্রায় সর্বত্র নারী নেতৃত্ব দেখা গেলেও নারী নির্যাতনে বিশ্বে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিদিন নিষ্ঠুরতম নির্যাতনের খবর সমূহ মিডিয়ায় প্রকাশিত হচ্ছে। যার কোন তুলনা বিশ্ব ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না। ২০১৮ সালের সর্ব সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী পৃথিবীর সর্বোচ্চ সংস্থা ‘জাতিসংঘে’ নিযুক্ত নারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এক তৃতীয়াংশ নিয়মিত যৌন হয়রানির শিকার। লোক-লজ্জার ভয়ে যেগুলি প্রকাশ পায় না, তার হিসাব এর বাইরে। খৃষ্টান পোপ-পাদ্রী ও হিন্দু ব্রাহ্মণদের নারী নিগ্রহ তো মিডিয়ায় শিরোনাম হচ্ছে অহরহ। ইভটিজিং ও নারী ধর্ষণ তো এখন বাংলাদেশের নিয়মিত খবরে পরিণত হয়েছে। অথচ শিক্ষায় ও ক্ষমতায় নারীর অংশগ্রহণ এখন সবচেয়ে বেশী। এরপরেও নারী নির্যাতনের এই চিত্র কেন? একটাই উত্তর আসবে, আর তা হ’ল শিক্ষার নামে চলছে বস্ত্তবাদী শিক্ষা বা ঈমানী শিক্ষাহীন ইবলীসী শিক্ষা। যা তাকে কেবল অর্থোপার্জন শিখায়, নেকী অর্জন শিখায় না। সে ধনী হয়, কিন্তু সুখী হয় না।

বস্ত্ততঃ যে ইলম মানুষকে জান্নাতের পথ দেখায়, সেটাই হ’ল প্রকৃত ইলম। সেই ইলম শিক্ষা করা নারী ও পুরুষ প্রত্যেক মুমিনের উপর ফরয (ইবনু মাজাহ হা/২২৪)। যে ব্যক্তি উক্ত ইলম শেখার জন্য রাস্তা তালাশ করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের রাস্তা সহজ করে দেন (মুসলিম হা/২৬৯৯)। এমনকি তার জন্য ফেরেশতারা ডানা বিছিয়ে দেন (আবুদাঊদ হা/৩৬৪১)। ‘আল্লাহ যার কল্যাণ চান, তাকে দ্বীনের বুঝ দান করেন’ (বুখারী হা/৭১)। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ‘এক ঘণ্টা দ্বীন শিক্ষায় রাত্রি জাগরণ সারা রাত্রি ইবাদতের চাইতে উত্তম’ (দারেমী হা/৬১৪)। ঐ ইলম কেবল তার জীবদ্দশাতেই কল্যাণ দেয় না, মৃত্যুর পরেও তার আমলনামায় জারি থাকে (মুসলিম হা/১৬৩১)

ইসলামী জ্ঞানে পারদর্শী ব্যবসায়ী কখনো পুঁজিবাদী হবে না। কখনো ওযনে ও মাপে কমবেশী করবে না। কখনো কৃপণ হবে না। বরং তার দেওয়া যাকাত ও ছাদাক্বায় দেশে সম্পদের বিস্তৃতি ও প্রবৃদ্ধি ঘটবে। সমাজ থেকে দারিদ্র্য বিদূরিত হবে। ধনী ও গরীব পরস্পরের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে। ইসলামী রাজনীতিক সর্বদা সমাজের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দিবেন স্রেফ পরকালীন পাথেয় সঞ্চয়ের স্বার্থে। ইসলামী বিজ্ঞানী সর্বদা নতুন নতুন নে‘মত আবিষ্কারে পৃথিবীকে কল্যাণে ভরে দিবেন ও আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করবেন। ইসলামী কৃষক আল্লাহর নামে কৃষিকাজ করবে। আল্লাহ তার কৃষিতে বরকত দিবেন। দেশ শস্য-শ্যামলে ভরে যাবে। ইসলামী পরিবারে কোন অশান্তি থাকবে না। আনন্দে ও বিপদে সর্বাবস্থায় তারা আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট থাকবে। আল্লাহর উপর ভরসা করেই তারা নিশ্চিন্ত হবে।

সকল জ্ঞানের উৎস হ’ল কুরআন ও হাদীছ। এই দুই উৎস অনুধাবন ও গবেষণার মাধ্যমে দুনিয়ায় ও আখেরাতে সকল কল্যাণ লাভ করা সম্ভব। যার মাধ্যমে এক সময় মুসলমান জ্ঞান-বিজ্ঞানে ও বিশ্ব রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিয়েছে। ইহূদী-নাছারাদের ফাঁদে পড়ে মুসলিম নেতারা নিজেদের জ্ঞানের খনি ব্যবহার না করে ‘আল্লাহর অভিশপ্ত’ ও ‘পথভ্রষ্টদে’র উচ্ছিষ্ট কুড়ানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। এই ইলম শেখার কারণেই মা আয়েশাকে স্বয়ং জিব্রীল এসে সালাম জানিয়েছেন (তিরমিযী হা/৩৮৮১)। বড় বড় ছাহাবীগণ কোন বিষয় আটকে গেলে তাঁর কাছে গিয়েই সমাধান নিতেন (ঐ, হা/৩৮৮৩)। পুরুষদের মধ্যে আবু হুরায়রা (৫৩৭৪টি) এবং নারীদের মধ্যে আয়েশা ছিলেন (২২১০টি) হাদীছের শ্রেষ্ঠ হাফেয। আর এজন্যেই তারা দুনিয়াতে সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদা লাভ করেছিলেন। আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর জন্য দো‘আ করার সাথে সাথে তা কবুল হয়ে যায়। ফলে তিনি কোন হাদীছ একবার শুনলে আর ভুলতেন না। তার মুশরিক মায়ের জন্য রাসূল (রাঃ) দো‘আ করলেন। পরে তিনি বাড়ী গিয়ে দেখলেন, তার মা ইসলাম কবুল করেছেন। পার্থিব সম্মানের দিক দিয়ে খলীফা ওমরের সময়ে তিনি বাহরায়েন ও উমাইয়া যুগে মদীনার গভর্ণর ছিলেন (আল-ইছাবাহ, ক্রমিক ১০৬৭৪)

নারী শিক্ষা এমন হ’তে হবে, যাতে সে সেরা সম্পদে পরিণত হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, দুনিয়া পুরাটাই সম্পদ। আর দুনিয়ার সেরা সম্পদ হ’ল পুণ্যশীলা নারী (মুসলিম হা/১৪৬৭)। তিনি বলেন, সোনা-রূপার চেয়ে মূল্যবান হ’ল ঐ স্ত্রী, যে তার স্বামীকে ঈমানের পথে সহযোগিতা করে (ইবনু মাজাহ হা/১৮৫৬)। অতএব নারীকে নিম্নোক্ত গুণাবলী সম্পন্ন করে গড়ে তুলতে হবে। যথা : (১) সে শরী‘আতের পূর্ণ পাবন্দ হবে (২) তার যবান সংযত হবে (৩) শারঈ পর্দায় অভ্যস্ত হবে (৪) স্বামীর অনুগত হবে। (৫) সন্তান প্রতিপালনে আন্তরিক হবে। (৬) সৎকর্মশীল মহিলাদের সাথে উঠাবসা করবে। (৭) কুরআন ও হাদীছে দক্ষ হবে। (৮) নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া সর্বদা গৃহে অবস্থান করবে।

নারী ও পুরুষের কর্মক্ষেত্র আল্লাহ বণ্টন করে দিয়েছেন। পরিবারে ও সমাজে পুরুষ হবে কর্তৃত্বশীল (নিসা ৩৪)। পুরুষ পরিবারের ভরণ-পোষণের দায়িত্বশীল এবং স্ত্রী হবে সংসার ও সন্তানদের দায়িত্বশীল। প্রত্যেকে প্রত্যেকের দায়িত্ব সম্পর্কে আল্লাহর নিকট জিজ্ঞাসিত হবে (বুঃ মুঃ)

পরিশেষে বলব, দেশে প্রচলিত ধর্মীয় ও সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার দ্বিমুখী ধারাকে সমন্বিত করে কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক একক ও পূর্ণাঙ্গ ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা আবশ্যক। ছেলে ও মেয়েদের পৃথক শিক্ষা পরিবেশ নিশ্চিত করার মাধ্যমে উভয়ের জন্য উচ্চ শিক্ষা এবং পৃথক কর্মক্ষেত্র ও কর্মসংস্থান প্রকল্প গ্রহণ করা যরূরী। নইলে যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারী শিক্ষার নিরাপদ পরিবেশ নেই, সে পরিবেশে নারী কখনোই যেতে পারে না। যে সরকার ও সমাজ নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না, তাদের মুখে নারী শিক্ষা ও নারী প্রগতির কথা মানায় না। বৃটিশ আমলে মুসলমানরা নিজেদের উদ্যোগে লেখাপড়া শিখেছে। মেয়েরা ঘরেই শিক্ষিতা হয়েছে। তাতেই আমাদের মায়েরা যা জানতেন, আজকের একজন এম.এ. পাস মেয়েও তা জানে কি-না সন্দেহ। আর সেইসব দ্বীনদার পর্দানশীন মায়েদের গর্ভ থেকেই এসেছেন পরবর্তী নেতারা। স্কুল-কলেজে বস্ত্তবাদী শিক্ষা ও সহশিক্ষার পরিবেশে যেসব নারী হাযারো যুবকের লোলুপ দৃষ্টির শিকার, তাদের গর্ভ থেকে কখনো কোন মেধাবী ও ভদ্র সন্তান আসতে পারে না। আজকাল মেধাহীনদের ভিড় বৃদ্ধির অন্যতম কারণ এটা কি-না, সেটা গবেষণার বস্ত্ত।

মনে রাখতে হবে, নারীর কর্মক্ষেত্র তার গৃহ এবং পুরুষের কর্মক্ষেত্র বাইরে। উভয়ের সহযোগিতায় পরিবার শান্তিময় হবে। নারী হ’ল খেলার মাঠে গোলরক্ষকের মত। খেলোয়াড়রা সারা মাঠ দাপিয়ে বেড়ায়। অথচ গোলরক্ষক গোলপোস্টে দাঁড়িয়ে থাকে। এক্ষণে যদি সে গোলপোস্ট ছেড়ে নিজেই স্ট্রাইকার হ’তে চায় ও মাঠের মধ্যে চলে যায়, তাহ’লে খেলার অবস্থা কেমন হবে? নারীকে ঘর ছেড়ে বাইরে পাঠালে ঘরের অবস্থা তেমনটি হবে। যা এখন হ’তে চলেছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘পৃথিবীর সেরা নারী হ’লেন চার জন। খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ, ফাতেমা বিনতে খাদীজা, (ফেরাঊনের স্ত্রী) আসিয়া বিনতে মুযাহিম ও (ঈসার মা) মারিয়াম বিনতে ইমরান’ (ছহীহাহ হা/১৫০৮)। অতএব আমাদের মেয়েরা তাদের মত হৌক এবং কখনোই প্রগতির নামে অন্যদের পুচ্ছধারী না হৌক, সর্বান্তঃকরণে আমরা সেটাই কামনা করি- আমীন!

– ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

আরও দেখুন
Close
Back to top button