রামাযান ও ছিয়াম

রমজান মাসের ১০ গুরুত্বপূর্ণ দিক

কুরআনের আলোকে রামাযান

রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের মাস রামাযান। এটি মুমিনের জন্য প্রশিক্ষণের মাস। আল্লাহ তা‘আলা এ মাসে ছিয়াম পালন করা প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক মুমিন নর-নারীর উপর ফরয করেছেন। মুমিন পাপ থেকে মুক্ত হয়ে পুণ্য অর্জনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় এ মাসে। এ মাসে শয়তানকে শৃংখলিত করা ও জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়া হয়। আল্লাহ তা‘আলা মানুষের ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তির পথপ্রদর্শক হিসাবে এ মাসের ক্বদর রজনীতে কুরআন নাযিলের শুভ সূচনা করেছেন। তাই সালাফে ছালেহীন রামাযান মাসে অধিকাংশ সময় কুরআন তেলাওয়াতে অতিবাহিত করতেন।

১. রামাযানে মাসব্যাপী ছিয়াম ফরয

ছিয়াম বা ছাওম (الصَّوْمُ وَالصِّيَامُ) আরবী শব্দ, যার অর্থ বিরত থাকা। ইসলামী পরিভাষায় ‘ছিয়াম’ অর্থ,الْإِمْسَاكُ عَنِ الْأَكْلِ وَالشُّرْبِ وَالْجِمَاعِ مِنْ طُلُوْعِ الْفَجْرِ إِلَى غُرُوبِ الشَّمْسِ مَعَ النِّيَّةِ- ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের নিয়তে ছুবহে ছাদেক হ’তে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও যৌনসম্ভোগ হ’তে বিরত থাকা’। আল্লাহ তা‘আলা এ মাসে ছিয়াম পালন করা প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক মুমিন নর-নারীর উপর ফরয করেছেন। আল্লাহ বলেন,يَآ أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ- ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমাদের উপর ছিয়াম ফরয করা হ’ল, যেমন তা ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা আল্লাহভীরু হ’তে পার’ (বাক্বারাহ ২/১৮৩)

২. কুরআন নাযিলের মাস রামাযান

ইসলামী শরী‘আতের মূল উৎস কুরআন মাজীদ। এতে মানব জীবনের সার্বিক দিক নির্দেশনা বিদ্যমান। রামাযান হিজরী সনের সেই মহিমান্বিত ৮ম মাস, যে মাসে আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতির হেদায়াতের জন্য কুরআন নাযিল করেছেন। আল্লাহ বলেন,شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ- ‘রামাযান হ’ল সেই মাস, যাতে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। যা মানুষের জন্য সুপথ প্রদর্শক ও সুপথের স্পষ্ট ব্যাখ্যা এবং সত্য ও মিথ্যার পার্থক্যকারী’ (বাক্বারাহ ২/১৮৫)

অনেকে মনে করেন, মধ্য শা‘বানের রাত্রিতে অর্থাৎ কথিত ‘শবেবরাতে’ কুরআন নাযিল হয়। যা মারাত্মক ভুল। তাদের পক্ষে দলীল হিসাবে সূরা দুখান-এর ৩ ও ৪ আয়াত পেশ করা হয়ে থাকে। যেখানে আল্লাহ বলেন,إِنَّآ اَنْزَلْنَاهُ فِى لَيْلَةٍ مُّبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِيْنَ- فِيْهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيْمٍ- ‘আমরা এটি নাযিল করেছি এক বরকতময় রাত্রিতে; আমরা তো সতর্ককারী। এ রাত্রিতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়’ (দুখান ৪৪/৩-৪)। হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) স্বীয় তাফসীরে বলেন, ‘এখানে ‘বরকতময় রাত্রি’ অর্থ ‘ক্বদরের রাত্রি’। যেমনটি আল্লাহ অন্য আয়াতে বলেন,إِنَّآ أَنْزَلْنَاهُ فِىْ لَيْلَةٍ الْقَدْرِ- ‘নিশ্চয়ই আমরা এটি নাযিল করেছি ক্বদরের রাত্রিতে’ (ক্বদর ৯৭/১)। আর এ কথা সুবিধিত যে, ক্বদর রাত হচ্ছে রামাযান মাসে’।

৩. ছিয়ামের সময় ছুবহে ছাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত

আল্লাহ তা‘আলা উম্মতে মুহাম্মাদীর উপর বড়ই দয়াশীল। তাই তিনি পূর্ববর্তী উম্মতের চেয়ে উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য ইসলামের বিধান সমূহ সহজ করে দিয়েছেন। ছিয়াম পূর্ববর্তী উম্মতের উপরও ফরয ছিল। ইহূদী ও নাছারাদের নিয়ম ছিল যে, তারা ইফতার ছাড়াই রাতে ঘুমিয়ে গেলে পরের দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত তাদের উপর খানাপিনা নিষিদ্ধ ছিল। রামাযানের ছিয়াম ফরয হবার প্রথম দিকে মুসলমানদের উপর এই নিয়মই বলবৎ ছিল। কিন্তু সেটি কষ্টকর হওয়ায় তা বাতিল করে ছুবহে ছাদেকের পূর্বে সাহারীর নিয়ম প্রবর্তন করা হয় এবং ছিয়ামের সময় ছুবহে ছাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়।

ক্বায়েস বিন ছিরমাহ আনছারী ছায়েম ছিলেন। তিনি ইফতারের সময় স্ত্রীর কাছে এসে বললেন, তোমার কাছে কোন খাবার আছে কি? স্ত্রী বলল, নেই। তবে আমি যাচ্ছি, দেখি কোন ব্যবস্থা করা যায় কি-না। তিনি শ্রমজীবী ছিলেন। ফলে দ্রুত চোখ বুঁজে এল। অতঃপর স্ত্রী এসে তাকে ঘুমন্ত দেখে বলে ওঠেন, হায় দুর্ভাগ্য! পরদিন দুপুরে তিনি ক্ষুধায় বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেলেন। ঘটনাটি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট পেশ করা হ’ল। তখন নিম্নোক্ত আয়াতটি নাযিল হ’ল, وَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الْأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الْأَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ ثُمَّ أَتِمُّوا الصِّيَامَ إِلَى اللَّيْلِ، ‘আর তোমরা খানাপিনা কর যতক্ষণ না রাতের কালো রেখা থেকে ফজরের শুভ্র রেখা তোমাদের নিকট স্পষ্ট হয়। অতঃপর ছিয়াম পূর্ণ কর রাত্রির আগমন পর্যন্ত’ (বাক্বারাহ ২/১৮৭)। অর্থাৎ ছুবহে ছাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ছিয়াম রাখ। আগের মত ইফতারের পূর্বে ঘুমিয়ে গেলে পরদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত নয়।

৪. রামাযানের রাতে স্ত্রীগমন হালাল

আল্লাহ তা‘আলা পুরুষ ও নারী সৃষ্টি করেছেন একে অপরের সহযোগী হিসাবে। তারা একে অপরের জীবন সঙ্গী। তারা একে অপরের সাথে মিলে-মিশে জীবন-যাপন করবে এটাই কুরআনের নির্দেশ। ইহূদী-নাছারাদের জন্য রামাযানের রাতে যৌনসম্ভোগ নিষিদ্ধ ছিল। রামাযানের ছিয়াম ফরয হ’লে প্রথম দিকে মুসলমানদের জন্যও একই নিয়ম ছিল। রামাযান মাসে ছিয়াম অবস্থায় যদি কেউ ঘুমিয়ে যেত, তাহ’লে তার জন্য খানাপিনা ও স্ত্রীসম্ভোগ পরদিন ইফতার পর্যন্ত নিষিদ্ধ থাকত। এতে ছাহাবীরা পুরা রামাযান মাস স্ত্রীর নিকটবর্তী হ’তেন না। কিন্তু ইতিমধ্যেই অনেকে খেয়ানত করে ফেলেন। ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) একদিন সকালে এসে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট রাতের বেলায় তার ঘুমন্ত স্ত্রীর উপর পতিত হওয়ার বিষয়টি জানান। কা‘ব বিন মালেক (রাঃ) থেকেও অনুরূপ ঘটনা জানানো হয়। তখন আল্লাহ তা‘আলা বান্দার প্রতি অনুগ্রহ করে সূরা বাক্বারাহর নিম্নোক্ত আয়াতাংশটি নাযিল করেন। যেখানে আল্লাহ বলেন, أُحِلَّ لَكُمْ لَيْلَةَ الصِّيَامِ الرَّفَثُ إِلَى نِسَائِكُمْ هُنَّ لِبَاسٌ لَكُمْ وَأَنْتُمْ لِبَاسٌ لَهُنَّ عَلِمَ اللهُ أَنَّكُمْ كُنْتُمْ تَخْتَانُونَ أَنْفُسَكُمْ فَتَابَ عَلَيْكُمْ وَعَفَا عَنْكُمْ فَالْآنَ بَاشِرُوهُنَّ وَابْتَغُوا مَا كَتَبَ اللهُ لَكُمْ، ‘ছিয়ামের রাতে তোমাদের জন্য স্ত্রীগমন সিদ্ধ করা হ’ল। তারা তোমাদের পোষাক এবং তোমরা তাদের পোষাক। আল্লাহ জেনেছেন যে, তোমরা খেয়ানত করেছ। তিনি তোমাদের ক্ষমা করেছেন এবং তোমাদের অব্যাহতি দিয়েছেন। অতএব এখন তোমরা স্ত্রীগমন কর এবং আল্লাহ তোমাদের জন্য যা নির্ধারণ করেছেন, তা সন্ধান কর’ (বাক্বারাহ ২/১৮৭)। অর্থাৎ সন্তান কামনা কর।

৫. তওবা কবুলের মাস রামাযান

তওবা কবুলের শ্রেষ্ঠ মাস রামাযান। এ মাসে সাধ্যমত তওবা করতে হবে। তাহ’লে আল্লাহ বান্দার যাবতীয় পাপ মাফ করবেন। আল্লাহ বলেন, يَآ أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا تُوبُوآ إِلَى اللهِ تَوْبَةً نَّصُوحًا عَسَى رَبُّكُمْ أَنْ يُّكَفِّرَ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيُدْخِلَكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ، يَوْمَ لاَ يُخْزِي اللهُ النَّبِيَّ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ، نُورُهُمْ يَسْعَى بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَبِأَيْمَانِهِمْ، يَقُولُونَ رَبَّنَآ أَتْمِمْ لَنَا نُورَنَا وَاغْفِرْ لَنَآ إِنَّكَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ- ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট তওবা কর বিশুদ্ধ তওবা। নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের পাপসমূহ মোচন করবেন এবং তোমাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার তলদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত। যেদিন আল্লাহ স্বীয় নবী ও তার ঈমানদার সাথীদের লজ্জিত করবেন না। তাদের জ্যোতি তাদের সামনে ও ডাইনে ছুটাছুটি করবে। তারা বলবে, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের জ্যোতিকে পূর্ণ করে দিন এবং আমাদের ক্ষমা করুন। নিশ্চয়ই আপনি সবকিছুর উপরে সর্বশক্তিমান’ (তাহরীম ৬৬/৮)

৬. বেশী বেশী দো‘আর মাস রামাযান

রামাযান মাস দো‘আ কবুলের মাস। তাই প্রত্যেক ছায়েমের উচিত আল্লাহ তা‘আলার নিকট দো’জাহানের কল্যাণ কামনা করে বেশী বেশী দো‘আ করা। সালাফে ছালেহীন রামাযান আগমনের ছয় মাস আগে থেকে দো‘আ করতেন, যেন রামাযানের ইবাদত-বন্দেগী ভালোভাবে করতে পারেন। আবার রামাযানে সম্পাদিত নেক আমল কবুল হওয়ার জন্য পরবর্তী পাঁচ মাস আল্লাহর কাছে দো‘আ করতেন। অর্থাৎ সারাটা বছর রামাযানের প্রভাবে তাদের হৃদয়গুলো প্রভাবিত থাকতে। ওমর ইবনে আব্দুল আযীয (রহ.) ঈদের খুৎবায় বলতেন, ‘হে লোক সকল! তোমরা ত্রিশ দিন ছিয়াম রেখেছ, ক্বিয়াম করেছ। আর আজকের এই ঈদগাহে তোমাদের আমলগুলো কবুল করার আরয নিয়ে আল্লাহর দরবারে হাযির হয়েছ’। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اُدْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ، إِنَّ الَّذِيْنَ يَسْتَكْبِرُوْنَ عَنْ عِبَادَتِيْ سَيَدْخُلُوْنَ جَهَنَّمَ دَاخِرِيْنَ- ‘তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিব। যারা অহংকার বশে আমার ইবাদত হ’তে বিমুখ হয়, সত্বর তারা জাহান্নামে প্রবেশ করবে লাঞ্ছিত অবস্থায়’। এখানে ‘ইবাদত’ অর্থ দো‘আ’।

৭. দানের মাস রামাযান

রামাযান মাস বেশী বেশী দানের মাধ্যমে নিজেকে জাহান্নাম থেকে মুক্তির এক গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ মাসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রবাহিত বায়ুর চাইতেও বেশী দান করতেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে দান করবে আল্লাহ তাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিবেন। আললাহ বলেন,مَنْ ذَا الَّذِي يُقْرِضُ اللهَ قَرْضًا حَسَنًا فَيُضَاعِفَهُ لَهُ أَضْعَافًا كَثِيرَةً، ‘কোন্ সে ব্যক্তি যে আল্লাহকে উত্তম ঋণ দিবে, অতঃপর তিনি তার বিনিময়ে তাকে বহুগুণ বেশী প্রদান করবেন?’ (বাক্বারাহ ২/২৪৫)

৮. রামাযানের ছিয়াম শুরু হবে চাঁদ দেখে

আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত সর্বশেষ বিশ্বধর্ম ইসলাম। ইসলামের বিধান অনুযায়ী রামাযান, হজ্জ, দুই ঈদ প্রভৃতি ইবাদত চান্দ্র মাসের সাথে সম্পৃক্ত। এতে পৃথিবীর সকল প্রান্তের মুসলমানের জন্য সকল ঋতুতে এগুলি পালনের সুযোগ হয়। অথচ সৌর মাসের সাথে সম্পৃক্ত হ’লে কোন দেশে কেবল গ্রীষ্মকালেই রামাযান আসত, আবার কোন দেশে কেবল শীতকালেই আসত। এতে নির্দিষ্ট অঞ্চলের লোকদের উপর তা পালন করা কষ্টকর হয়ে পড়ত। পক্ষান্তরে ছালাতের সময়কালকে আল্লাহ সূর্যের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। উদয়াচলের পার্থক্যের কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের লোকেরা চাঁদ দেখে রামাযানের ছিয়াম শুরু করবে ও চাঁদ দেখে ছিয়াম ছাড়বে। আল্লাহ বলেন,فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি (রামাযানের) এ মাস পাবে, সে যেন ছিয়াম রাখে’ (রাক্বারাহ ২/১৮৫)। তাই চাঁদের হিসাবে সারা বিশ্বে একই দিনে ছিয়াম ও ঈদ পালন করা আল্লাহ তা‘আলার উক্ত কল্যাণ বিধানের বিরুদ্ধাচরণের নামান্তর।

৯. রামাযানে ক্বদরের রাত

রামাযানের শেষ দশক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রামাযানের শেষ দশক উপস্থিত হ’লে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ইবাদতের জন্য কোমর বেঁধে নিতেন। রাত্রি জাগরণ করতেন ও স্বীয় পরিবারকে জাগাতেন। শেষ দশকে তিনি যত কষ্ট করতেন, অন্য সময় তত করতেন না। রামাযানের শেষ দশক বিশেষ করে ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ মোট পাঁচটি বেজোড় রাতের মধ্যে রয়েছে লায়লাতুল ক্বদর তথা ক্বদরের রাত। এটি হাযার মাস অপেক্ষা উত্তম। এ রাতের মর্যাদা উল্লেখ করে আল্লাহ তা‘আলা সূরা ক্বদর নাযিল করেছেন। আল্লাহ বলেন,إِنَّآ أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ- وَمَآ أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ- لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِّنْ أَلْفِ شَهْرٍ- تَنَزَّلُ الْمَلَآئِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ- سَلاَمٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ- ‘আমরা একে নাযিল করেছি ক্বদরের রাত্রিতে। তুমি কি জানো ক্বদরের রাত্রি কি? ‘ক্বদরের রাত্রি হাযার মাস অপেক্ষা উত্তম। এ রাতে অবতরণ করে ফেরেশতাগণ এবং রূহ, তাদের প্রভুর অনুমতিক্রমে বিভিন্ন নির্দেশনা সহকারে। এ রাতে কেবলই শান্তি বর্ষণ। যা চলতে থাকে ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত’ (ক্বদর ৯৭/১-৫)। 

ক্বদরের রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বস্ত্ত সমূহ স্থিরীকৃত হয়। আল্লাহ বলেন,إِنَّآ أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُّبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِينَ- فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ- أَمْرًا مِّنْ عِنْدِنَآ إِنَّا كُنَّا مُرْسِلِينَ- رَحْمَةً مِّنْ رَّبِّكَ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ- ‘আমরা এটি নাযিল করেছি এক বরকতময় রজনীতে। নিশ্চয়ই আমরা সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয় আমাদের পক্ষ হ’তে আদেশক্রমে। আমরাই তো প্রেরণ করে থাকি যা তোমার পালনকর্তার পক্ষ হ’তে (বান্দাদের প্রতি) রহমত স্বরূপ। তিনিই তো সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (দুখান ৪৪/৩-৬)। অর্থাৎ ঐসব বিষয় ফেরেশতাদের নিকট অর্পণ করা হয়, যা ইতিপূর্বে তাক্বদীরে লিপিবদ্ধ ছিল। সেখান থেকে প্রতি লায়লাতুল ক্বদরে আল্লাহ প্রত্যেক মানুষের জন্য তার এক বছরের কর্মকান্ড স্বীয় প্রজ্ঞা অনুযায়ী পৃথক করে দেন। 

১০. রামাযানে ই‘তিকাফ

রামাযান মাসে ই‘তিকাফ করা লায়লাতুল ক্বদর পাওয়া ও তাক্বওয়া অর্জনের একটি বড় মাধ্যম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মসজিদে নববীতে রামাযানের শেষ দশকে নিয়মিত ই‘তিকাফ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর স্ত্রীগণও ই‘তিকাফ করেছেন। ই‘তিকাফের জন্য জুম‘আ মসজিদ হওয়াই উত্তম। তবে নিয়মিত জামা‘আত হয় এরূপ ওয়াক্তিয়া মসজিদেও ই‘তিকাফ করা জায়েয। ২০শে রামাযান সূর্যাস্তের পূর্বে ই‘তিকাফ স্থলে প্রবেশ করতে হবে এবং ঈদের আগের দিন বাদ মাগরিব বের হ’তে হবে। তবে বাধ্যগত কারণে শেষ দশদিনের সময়ে আগপিছ করা যাবে। ই‘তিকাফকারী ই‘তিকাফ অবস্থায় মসজিদের বাইরে গিয়ে কোন রোগীর সেবা করতে পারবে না, জানাযায় শরীক হবে না, স্ত্রীগমন করবে না এবং বাধ্যগত প্রয়োজন ব্যতীত বের হবে না। আল্লাহ বলেন,وَلَا تُبَاشِرُوهُنَّ وَأَنْتُمْ عَاكِفُونَ فِي الْمَسَاجِدِ تِلْكَ حُدُودُ اللهِ فَلَا تَقْرَبُوهَا كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللهُ آيَاتِهِ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ ‘আর তোমরা স্ত্রীগমন করো না যখন তোমরা মসজিদ সমূহে ই‘তেকাফ অবস্থায় থাক। এটাই আল্লাহর সীমারেখা। অতএব তোমরা এর নিকটবর্তী হয়ো না। এভাবে আল্লাহ স্বীয় আয়াত সমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করেন মানুষের কল্যাণের জন্য, যাতে তারা সংযত হয়’ (বাক্বারাহ ২/১৮৭)

উপসংহার

প্রতি বছর রামাযান আসে মুমিন-মুত্তাক্বীদের গুনাহ মাফের বার্তা নিয়ে। এ মাসে তারা নেকীর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় জান্নাতে উচ্চ মর্যাদা লাভের আশায়। কুরআন নাযিলের মাধ্যমে আল্লাহ এ মাসকে সম্মানিত করেছেন। এ মাসে সালাফে-ছালেহীন কুরআন তেলাওয়াত সহ সর্বপ্রকার সৎকর্ম সাধ্যমত বেশী বেশী করার চেষ্টা করতেন। প্রসিদ্ধ আছে যে, ক্বাতাদাহ (রাঃ) অন্য সময় প্রতি সাত দিনে এক খতম এবং রামাযানে প্রতি তিন দিনে এক খতম কুরআন তেলাওয়াত করতেন। আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) ইয়াতীম-মিসকীন ছাড়া ইফতার করতেন না। দাঊদ ত্বাঈ, মালেক বিন দীনার, আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)-এর একই সদভ্যাস ছিল। ইমাম মালেক, যুহরী ও সুফিয়ান ছওরী (রহঃ) রামাযানে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে কুরআন তেলাওয়াতে রত হ’তেন। আমাদের উচিৎ তেলাওয়াতের সময় কুরআন অনুধাবন করা ও অশ্রু বিগলিত হওয়া। ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর ক্বিরাআত শ্রবণকালে সূরা নিসা ৪১ আয়াতে পৌঁছে গেলে রাসূল (ছাঃ) তাকে থামতে বলেন। এসময় তিনি অশ্রু বিগলিত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, ‘ঐ চক্ষু কখনো জাহান্নামে যাবে না, যে চক্ষু আল্লাহর ভয়ে কাঁদে’। সকল মুমিনের এ মাসে সাধ্যমত সৎকর্ম করার প্রতিযোগিতা করতে হবে। কোন বদভ্যাস থাকলে তা রামাযানেই ত্যাগ করার প্রতিজ্ঞা করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে কুরআন থেকে শিক্ষা নিয়ে এ মাসে সৎ আমলের প্রতিযোগিতা করার তাওফীক দান করুন-আমীন!

– ড. মুহাম্মাদ আব্দুল হালীম
(আত-তাহরীক)


১. ইবনু কাছীর, ১ম খন্ড, ৫০১ পৃ., তাফসীর সূরা দুখান ৩-৪ আয়াত।
২. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, ছিয়াম ও ক্বিয়াম, (রাজশাহী : হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, এপ্রিল ২০২৩), পৃ. ২২।
৩. সাইয়েদ হুসাইন আল-আফানী, নিদাউর রাইয়ান ফী ফিক্বহিছ ছাওম, ২/২০৪।
৪. মুমিন ৪০/৬০; ‘আওনুল মা‘বূদ হা/১৪৬৬-এর ব্যাখ্যা, ‘দো‘আ’ অনুচ্ছেদ-৩৫২।
৫. বুখারী হা/৫০৫৫।
৬. তিরমিযী হা/১৬৩৩।

মন্তব্য করুন

Back to top button