সালাত সুন্দর করার অনন্য মাস রমাদান!
ধরুন আপনার এলাকার খুব প্রভাবশালী মানুষের কাছে আপনার প্রয়োজন তুলে ধরার একটা সুযোগ পেলেন যিনি আপনার প্রয়োজন মেটানোর ক্ষমতা রাখেন, ক্ষমতা রাখেন আপনাকে শাস্তি কিংবা স্বস্তি দেওয়ার। এই সুযোগে আপনার যতো অভাব, চাহিদা, আবেগ, অনুভূতি সব তার সামনে পেশ করতে পারবেন। তখন আপনি নিশ্চয়ই চেষ্টা করবেন নিজেকে একটু গুছিয়ে, পরিপাটি করে তার সামনে উপস্থিত করতে। তার সামনে দাঁড়াতে আপনি যথেষ্ট খেয়াল রাখবেন পাছে না কোনো বেয়াদবি হয়ে যায়। কথা বলতে চেষ্টা করবেন খুব গুছিয়ে, ধীরে-সুস্থে।
আপনার এলাকার প্রভাবশালী মানুষটির সাথে দেখা করতে আপনার মনে কতো ভয়-বিনয় জড়ো হচ্ছে দেখুন। অথচ আপনার রবের সামনে দাঁড়ানোর বেলাতেই যতো উদাসীনতা এসে ভর করে। যেখানে সামান্য কয়েকজন মানুষের উপর ছড়ি ঘুরানো মানুষটার প্রতি এতো ভয়, এতো বিনয় সেখানে সমগ্র জগতের প্রতিপালক মহান রব যিনি কীনা সকল প্রভাবশালীদের উপর প্রভাবশালী তার সামনে দাঁড়াতে অন্তরে কতটুকু ভয় আর বিনয়ের মিশেল থাকা প্রয়োজন একটু ভাবুন। সেই রাজাধিরাজ মহান রবের সামনে কথা বলতে কতটুকু সংযত হওয়া প্রয়োজন একটু ভাবুন। কিন্তু এখানটায় এসেই আমাদের যতো তাড়াহুড়ো বাঁধে। যিনি আমাদের সকল কথা শুনেন, যিনি আমাদের ডাকে সাড়া দেন তাঁর সাথে কথা বলতেই আমাদের অনীহা। সলাতে দাঁড়ালে আমাদের জিহ্বা যে কথাগুলো উচ্চারণ করে দ্রুততার কারণে নিজেরাই বুঝতে পারিনা। কারও সামনে এভাবে কথা বললে তিনি নিশ্চয়ই রাগান্বিত হবেন, বিরক্ত হবেন। অথচ রবের সামনে দাঁড়িয়েই আমরা এভাবে তিলাওয়াত করি।
আচ্ছা! একবার ভেবে দেখুন তো- এভাবে আপনার রবের সাথে কথা বলতে কী আপনার মনে একটুও অনুশোচনা হয়না? ইচ্ছে জাগে না রবের সামনে বিনয়ী হতে, কান্নায় কপোল ভিজিয়ে রবের কাছে আকুতি করতে, সলাতে রবের সাথে আলাপনের মধু-স্বাদ অনুভবের জন্য ভিতরটা কী একদমই ছটফট করে না?
আপনার নিশ্চয়ই সলাতকে সুন্দর করতে ইচ্ছে করে! খুশু-খুযু সহকারে সলাতে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে। চলুন এমনভাবে নিজের সলাতকে সুন্দর করি যেন এর মিষ্টতা অন্তরের সাথে সাথে জিহ্বায়ও অনুভূত হয়।
এমন করতে হলে কী করণীয় আমাদের জেনে নিই এক এক করে-
✻ আমাদের প্রথম করণীয় হচ্ছে- একদম তাড়াহুড়ো নয়, বরং যথেষ্ট পরিমাণ সময় নিয়ে আমরা সলাত আদায় করবো। আর (হাদীসের ভাষায়) সলাতের মধ্যে কোনোপ্রকার ফাঁকিবাজি নয়। সলাতের ভেতর তাড়াহুড়ো করার প্রবণতা আপনার সলাতের খুশু তথা একাগ্রতা ছিনিয়ে নিবে। সুতরাং অস্থিরমতি নয়, সুস্থির হোন। শরীরকে স্থির আর মনকে প্রশান্ত করে সলাত আদায় করুন। আর এই স্থিরতা শুধু সলাতের ভেতরভাগেই নয়। বরং সলাতের সময় হওয়ার পর থেকে সলাতের দাঁড়ানোর আগ পর্যন্তও, অর্থাৎ সলাতের আগের সময়টাতেও আনা চাই।
✻ আযানের ধ্বনি কানে আসামাত্র সলাতের জন্য উঠে দাঁড়ান। প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করুন। এতে করে ঠিক আগের সময়টিতে পার্থিব চিন্তাভাবনা ঝেড়ে ফেলে আখিরাতের ভাবনায় ডুব দেওয়ার এক অপার্থিব সুযোগ আপনি পাচ্ছেন।
✻ উত্তম স্থানে উত্তম সময়ে সালাত আদায়ের স্বাদ অতুলনীয় এক অনুভূতি সৃষ্টি করে। যেমন ধরুন, অন্য কোনো স্থানের তুলনায় মসজিদে সলাত আদায় করলে মানসিক স্থিরতা ও পবিত্রতার এক অন্যরকম আবেশ ছুঁয়ে যায়। অতিরিক্ত কিছু আশারও সঞ্চার ঘটে সলাত ক্ববুল হওয়ার ব্যাপারে। আর যদি এটা হয় পবিত্র কাবা কিংবা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওজা ঘেঁষা মসজিদে তাহলে তো কথাই নেই। এমনিভাবে বিশেষ বিশেষ সময়ে সলাত আদায় করাও চমৎকার কিছু অনুভূতি এনে দেয়। যেমন, রমাদানের রাতে কিয়ামুল লাইলের আমেজ। ইতিকাফের দিনগুলোতে নিবিষ্টচিত্তে সলাত। দেখবেন, ওয়াক্তের শুরুতে সলাত আদায় করলে স্বাদ ও মনোযোগের সাথে পড়া হয়, অলসতা করে ওয়াক্তের শেষের দিকে পড়লে দায়সারা গোছের সলাত হয়। তাই আমাদের উচিৎ হবে আউয়াল ওয়াক্তে মসজিদে গিয়ে সলাত আদায় করা।
✻ একই কাজ বারবার করতে থাকলে একঘেয়েমি পেয়ে বসা খুবই স্বাভাবিক। সলাতে একঘেয়েমি ভাব চলে আসার একটা অন্যতম কারণ হলো, আমরা নির্দিষ্ট কিছু দুআ ও যিকর-ই বুঝে-না বুঝে বারবার পাঠ করি। ফলে সলাতের ভেতর নির্লিপ্ততা জেঁকে বসে, উদাসীনতা পেয়ে বসে। মুখে তিলাওয়াত-তাসবীহ চলে, আর ওদিকে মন পড়ে থাকে দোকানে-অফিসে। এক্ষেত্রে আমরা যা করবো, একঘেয়েমির অস্বস্তি থেকে সলাতকে হিফাযত করতে সলাতে পড়ার মাসনুন (সুন্নাহ-সম্মত) দুআ ও যিকর কয়েকটি করে শিখে নিবো।
✻ সলাতে কুরআন তিলাওয়াতের উদ্দেশ্য দ্রুত কুরআন পাঠ করা নয়, বা একেবারেই বেশি বেশি পাঠ করে কুরআন খতম করা নয়। বরং উদ্দেশ্য হলো, আপনি সামর্থ্য অনুযায়ী অল্প অল্প করে পাঠ করুন। যেটুকু পাঠ করছেন, তার অর্থ ও মর্ম জেনে পাঠ করুন। এই পদ্ধতি আল্লাহ তাআলার ইচ্ছায় আপনাকে বহুদূর নিয়ে যাবে। চেষ্টা করুন আজ থেকেই।
✻ যখন একাকী সলাত আদায় করছেন, তখন সলাতকে যথাসম্ভব দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করুন। রাহমাহ’র সরোবরে ডুব দিয়ে প্রশান্তি মেখে নিন যতোখুশি, যতোক্ষণ ইচ্ছে।
✻ গভীর রাতের সলাত যেন একাগ্রতার পেয়ালায় তৃপ্ত চুমুক। রাতের সুনসান নীরবতায় মহান রবের সামনে দণ্ডায়মান হওয়ার যে স্বাদ, তার কি কোনো তুলনা হয়? থাকে না ব্যস্ততার কোনো পিছুটান। সকলের অলক্ষ্যে বলে ইখলাসের পারদও থাকে ঊর্ধ্বমুখী। নিশুতি রাতে তাই রবের মমতামাখা ডাকে সাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে যান তাহাজ্জুদের জায়নামাজে।
✻ খুশু তথা ইবাদাতে একাগ্রতা ঈমানেরই অংশ। ঈমান যেমন বাড়ে-কমে, তার সাথে খুশুও বাড়ে-কমে। মূল জ্বালানিটা হলো ঈমান। তাই ঈমান বাড়াতে বেশি বেশি আল্লাহর শক্তি, ক্ষমতা আর বড়ত্বের আলোচনা করুন। সুতরাং, মসজিদে-বাসায়-কর্মস্থলে আল্লাহর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা এবং গায়েবের বিষয়গুলো (মৃত্যু-কবর-হাশর-জান্নাত-জাহান্নাম) আলোচনা করাকে ওযীফা বানিয়ে নিন।
✻ সলাতে নিবিড় একাগ্রতা এসে যাবার পর তা ধরে রাখার জিনিস। এই উৎসাহ ও উদ্যম প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি করার চেষ্টা থাকবে আমাদের। Attacking is the best defence. আমরা ধরে রাখার চেষ্টা করবো না, বরং বাড়ানোর চেষ্টায় লেগে থাকবো। তাহলে ধরে রাখা নিয়ে ভাবতে হবে না। এজন্য করণীয় হচ্ছে : এক. ঈমানের পারদ ঊর্ধ্বমুখী রাখার জন্য প্রতিনিয়ত ঈমানী দাওয়াহ ও আলোচনা করা। আর দুই. বিশেষ করে সলাতের দাওয়াহ করা। সলাতের ভেতর-বাহির, ফরজ-ওয়াজিব-সুন্নাত-মুস্তাহাব, খুশু-খুযুর দাওয়াহ দেওয়া।
✻ প্রতিটি মানুষেরই সময়, স্বাস্থ্য এ মানসিকতা একরকম থাকে না। সলাতেও তার প্রভাব পড়ে। একজন দক্ষ নাবিক যেমন দক্ষতা-অভিজ্ঞতা দিয়ে সব অনুকূল-প্রতিকূল সময়কে জয় করে লক্ষ্যের বন্দরে নোঙর ফেলে, আমাকে আপনাকেও সলাত আদায়ের সময় এসবকিছু মাথায় রেখে সর্বোচ্চ ফায়দাটুকু নিতে হবে।
✻ যখনই সলাতে কোনো কারণে একাগ্রতার ঘাটতি দেখা দিবে, ঠিক সেই মূহুর্তে বুদ্ধিমানের কাজ হলো সলাতকে দীর্ঘায়িত না করা। এমন সময়ে সলাত দীর্ঘ সময় কাটাতে গেলেই অভিশপ্ত শয়তান নানা ভুল-ত্রুটির ফাঁদে ফেলে আপনার সলাতকে একবারে হালকা বানিয়ে ছেড়ে দিবে। উদাসীনতা আর ভুলভালের ফর্দ আরও লম্বা হতে থাকবে। তাই এ সময়টাতে ছোট ছোট সূরা পাঠ করে, প্রয়োজনীয় তাসবীহ ও দুআ ইত্যাদি পাঠ করে সলাতের স্বাভাবিক সৌন্দর্য অটুট রাখতে হবে।
✻ আবার যখন সলাতে গভীর মনোযোগ, নিবিড় একাগ্রতা আর প্রকৃত স্বাদ পেতে শুরু করবেন তখন লম্বা লম্বা সময় সলাতে দাঁড়িয়ে যান। ধীরে সুস্থে পূর্ণ পরিতৃপ্তির সাথে সলাত আদায় করে ভাটার সময়ের অপ্রাপ্তিটুকু কড়ায় গণ্ডায় উসুল করে নিন।