অবরুদ্ধ পৃথিবীর আর্তনাদ!
ফিলিস্তীন! এক অবরুদ্ধ জনপদের নাম। এক বক্ষবিদারী শকুনের কুটিল নখরে আটকে থাকা রক্তমুখর মাংসপিন্ডের দলা। নিকষ আঁধারে ভয়ংকর বজ্রনিনাদের বিচ্ছুরণ। অব্যাহত বেজে চলা মৃত্যুর সাইরেন। হাযারো স্বজনহারার বিমুঢ় বেদনাগাঁথা। মাত্র ৪৫ বর্গ কি.মি. আয়তনের শহর। ২৩ লাখ জনগণের ঘনবসতি। তিনদিকে ইসরাঈলের সীমান্ত কাঁটাতার আর একদিকে দিগন্তহীন সাগর ঘেরা পৃথিবীর সর্ববৃহৎ কারাগার। মিসরের সাথে ১২ কিলোমিটারের একটা সীমান্ত আছে বটে; তবে সেটা কেবল মানুষ পারাপারের জন্য। পণ্যদ্রব্য ঢোকার সুযোগ আছে কেবল ইসরাঈলের মধ্য দিয়েই।
প্রাণ বাঁচানোর স্বার্থে পুরো গাযা শহরের গত ৭ই অক্টোবর ২০২৩ ভোরে ইসরাঈলের অভ্যন্তরে ফিলিস্তীনী মুক্তিকামী যোদ্ধাদের অতর্কিত হামলার পর ইসরাঈল বন্ধ করে দিয়েছে বিদ্যুৎ, তেল, গ্যাস, খাদ্যদ্রব্য পারাপারের সমস্ত ব্যবস্থাপনা। অবরুদ্ধ গাযা এখন পুরোপুরি অবরুদ্ধ। প্রতিনিয়ত বোমাবর্ষণে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া শহর। রাতের আঁধারে বোমার অগ্নি-ফুলকিই একমাত্র আলোর উৎস। ২৫ লাখ মানুষ সেখানে ক্ষুৎপিপাসায় গুণছে প্রায় নিশ্চিত মৃত্যুর প্রহর।
১৯৪৮ সালের ১৫ই মে অবৈধ ইসরাঈল রাষ্ট্রের জন্ম ফিলিস্তীনের মুসলমানদের জীবন থেকে স্থায়ীভাবে কেড়ে নিয়েছে স্বাধীনতার স্বাদ। কেড়ে নিয়েছে মুসলমানদের প্রথম ক্বিবলা, ইসলামের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থান মাসজিদুল আক্বছার প্রবেশাধিকার। ইহুদী দখলদারিত্বের ৭৫ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল। এই দীর্ঘ পরাধীনতার কালে প্রতিটি মুহূর্ত ফিলিস্তীনী মুসলমানদের জন্য ছিল আতংকের। নিজ ভূমে উদ্বাস্ত্ত হয়েছে লক্ষ লক্ষ পরিবার। শরণার্থী শিবিরই হয়েছে তাদের স্থায়ী আবাস। জাতিসংঘের দেয়া রেশনই তাদের জীবন ধারণের উপকরণ। এই দফায় ইসরাঈল প্রস্ত্ততি নিচ্ছে গাযায় স্থল হামলার। ফিলিস্তীনকে এথনিক ক্লিনজিং-এর মাধ্যমে জনশূন্য উপত্যাকায় পরিণত করার ভয়ংকর পরিকল্পনা নিয়ে তারা এখন এগিয়ে আসছে নৃশংস শ্বাপদের মত। সম্ভবতঃ ফিলিস্তীনের ইতিহাস লিখতে যাচ্ছে গাযায় সবচেয়ে বড় গণহত্যার পান্ডুলিপি।
আমার ঘনিষ্ট ফিলিস্তীনী বন্ধু ড. হাসান বাযাযো গাযার পরিস্থিতি নিয়ে হালনাগাদ সংবাদ জানাচ্ছিল ইসরাঈলী হামলা শুরুর পর থেকে। বোমার আঘাতে ধ্বংস হয়েছে তার বাড়িও। তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে সে বলছিল, ‘আমরা যে অবস্থায় আছি, মানুষ তা চিন্তাও করতে পারবে না। খাবার নেই, পানি নেই, বিদ্যুৎ নেই, গ্যাস নেই, ইন্টারনেট নেই। গাযার প্রত্যেক অধিবাসী এখন বিপর্যস্ত। মৃত্যু তাদেরকে যে কোন সময় গ্রাস করবে। অথচ গোটা বিশ্ব নিশ্চুপ। কেউ তাদের সাহায্য করার নেই। কেউ এই গণহত্যা বন্ধে এগিয়ে আসেনি। পশ্চিমারা ইসরাঈলের পাশে সবকিছু নিয়ে দাঁড়ালেও মুসলিম দেশগুলো ফিলিস্তীনের পাশে নেই। এই অসহায় মৃত্যু উপত্যকায় বসে তার মন্তব্য- ‘গোটা বিশ্বের কোথায় এমন ঘটনা আর ঘটেনি; সম্ভবতঃ মানবেতিহাসেও এমন ঘটনার সাক্ষ্য পাওয়া যাবে না’। এখন কোথায় যাবে? তার সংক্ষিপ্ত উত্তর- আল্লাহর কাছে।
ইসরাঈলের অব্যাহত নিষ্পেষণ চলমান থাকা সত্ত্বেও মিডিয়া যথারীতি ইসরাঈলের পক্ষেই। ফিলিস্তীনী স্বাধীনতাকামীদের এখনও বলা হচ্ছে জঙ্গী! অথচ পাপীষ্ট নরাধম ইসরাঈলী দানবরা পার পেয়ে যাচ্ছে নির্বিঘ্নে। মিথ্যার সুকৌশল বুননে আর গোয়েবলসীয় তত্ত্বের স্বার্থক প্রয়োগে নিজেদের অপকর্মের বৈধতা দেয়ার জন্য তারা তৈরী করেছে হাযারো বিভ্রান্তিকর ভাষ্য। আবার যে পশ্চিমা বিশ্ব হলোকাস্ট ঘটিয়ে লক্ষ ইহুদী হত্যা করেছিল, তারাই এখন মধ্যপ্রাচ্যের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার জন্য নিষ্ঠুর স্বার্থবাদী রাজনীতিকে সামনে রেখে ইহুদীদের সবচেয়ে বড় বন্ধু সেজে বসেছে।
ফলে পিঠ ঠেকে যাওয়া ফিলিস্তীনীদের এখন আর কোন পথ নেই। এতবছরেও ফিলিস্তীনী সমস্যার কোন রাজনৈতিক সমাধান না হওয়ায় তাদের সামনে একটাই পথ- হয় প্রতিরোধ, নয় শাহাদাত। সম্প্রতি নেতানিয়াহু জাতিসংঘে গিয়ে নতুন ইসরাঈল রাষ্ট্রের যে মানচিত্র উপস্থাপন করেছে, তাতে গাযার কোন উল্লেখই ছিল না। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের আরবদেশগুলোর সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে নিজের মত ইসরাঈলী ভুখন্ড সাজানোর পরিকল্পনাও তাদের চলমান। তাদের মৌন সমর্থন পর্যন্ত তারা আদায় করে নিয়েছিল। কিন্তু মুসলিম শাসকরা বিস্মৃত হ’লেও ফিলিস্তীনীদের আত্মবিস্মৃতির সুযোগ ছিল না। নিজেদের আত্মপরিচয় টিকিয়ে রাখতে, আল-আক্বছার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে তাই তাদের সর্বস্ব বিলিয়ে দেয়া ছাড়া আর কোন পথ খোলা ছিল না। পাল্টা আক্রমণকালে তারা জানত এতে ইসরাঈলীদের ক্ষয়ক্ষতি যা হবে, তার চেয়ে বহুগুণ ভয়ংকর প্রতিশোধের শিকার হ’তে হবে তাদের। তবুও পরিণতির ভয়ে ছিল না পিছু ফেরার সুযোগ। যে জনপদের প্রতিটি বাড়ি শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে, সে জনপদের মানুষের বুকে জ্বলা তুষের আগুণের মর্ম আর কেউ না বুঝলে তারা তো বোঝে। সেই মর্মজ্বালাই তাদেরকে এই মরিয়া আক্রমণে বাধ্য করেছে। কবি মাহমূদ দারবীশের কথায়-
‘দুনিয়া ঘনিয়ে আসছে আমাদের দিকে
ধরীত্রী ঠেসে ধরছে একেবারে শেষ কোনাটায়..
শেষ প্রান্তে ঠেকে গেলে যাবটা কোথায়?
শেষ আসমানে ঠেকে গেলে পাখিগুলো উড়বে কোথায়?’
এই অসম যুদ্ধের ফলাফল আমাদের অজানা নয়। বিশ্বরাজনীতির কঠিন মারপ্যাচে এবং মুসলিম বিশ্বের যথারীতি নিশ্চুপ ভূমিকায় এই হামলার চূড়ান্ত পরিণতি যে খুবই ভয়ংকর হবে, তা সহজেই অনুমেয়। বিশেষতঃ এই আক্রমণকে উপলক্ষ্য করে গাযার অধিবাসীদেরকে বিতাড়িত করা এবং রাফার শরণার্থী শিবিরে বন্দী রাখা এবং সেই সাথে সম্পূর্ণ ফিলিস্তীনকে নিজেদের অধিকারে নেয়ার সহজ সুযোগ গ্রহণ করবে ইসরাঈল। আল-আক্বছা, আল-কুদসকে চিরতরে মুসলমানদের হাতছাড়া করতে তাদের বদ্ধ-পরিকর সংকল্প এখন বাস্তব রূপ নিবে। অবরুদ্ধ ফিলিস্তীনের ভবিষ্যৎ এখন ভীষণ অন্ধকার।
পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, আমরা সর্বান্তকরণে কামনা করি আল্লাহ যেন ফিলিস্তীনের মুসলিম ভাইদেরকে এই মহাপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার তাওফীক দান করেন। কেউ না থাকলেও তাদের জন্য আল্লাহ রয়েছেন, এটাই তাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। ইসরাঈলের বিশাল সামরিক শক্তির বিপরীতে ফিলিস্তীনীরা শক্তিতে যত ক্ষুদ্রই হোক আল্লাহর রহমতের চেয়ে বড় শক্তিশালী আর কিছু নয়। সুতরাং আমরা তাঁরই রহমত কামনা করি। সেই সাথে মুসলিম বিশ্বের দায়িত্বশীলবর্গের জন্য দো‘আ করি, তারা যেন নিজ রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার চেয়ে মুসলিম উম্মাহর জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে পারেন। ন্যায় ও ইনছাফের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেন। কেননা আল-আক্বছা কেবল ফিলিস্তীনের নয়, সমগ্র মুসলমানদের। ফিলিস্তীনের পরাজয় অর্থ সমগ্র মুসলিম বিশ্বের পরাজয়। কোন মুসলিমের সর্বশেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত তারা তাদের এই রক্তের অধিকার ছাড়তে পারে না। আল্লাহ রাববুল আলামীন ফিলিস্তীনকে রক্ষা করুন। ফিলিস্তীনের মুসলিম ভাই-বোনদের রক্ষা করুন। সারাবিশ্বের মুসলমানকে ফিলিস্তীনের মুক্তি আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালনের তাওফীক দান করুন- আমীন!
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
মাসিক আত-তাহরীক