ধর্মীয় উত্সব/উপলক্ষ

প্রসঙ্গ: কুরবানী বিরোধিতা

প্রতি বছর ঈদ উল আজহার সময় এক শ্রেণীর মানুষকে দেখা যায় বিভিন্ন ভাবে কুরবানীর বিরোধিতা করতে। সরাসরি ঈদ উল আজহা নিয়ে কিছু না বললেও তারা পশু কুরবানী দেয়া আপত্তি তোলেন। পশুর প্রতি হিংস্রতা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, মনের পশু কুরবানী করা, ইত্যাদি নিয়ে অনেক কিছু বললেও তাদের মূল সমস্যাটা কোথায় এটা পরিষ্কার বোঝা যায়।

নিয়ম করে প্রতি বছর আপনি এই লোকগুলোকে দেখবেন নৈতিকতা, দয়াশীলতা এসবের ধোঁয়া তুলে আল্লাহ-র নির্ধারিত এই ইবাদাতকে আক্রমন করতে। তারা যেসব যুক্তি ও চেতনার কারণে পশু কুরবানীর বিরোধিতা করছেন বলে দাবি করেন আশ্চর্যজনকভাবে সেগুলো শুধুমাত্র ঈদ উল আজহার সময় মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। অন্যান্য সময় এই চেতনা এবং যুক্তি খুজে পাওয়া যায় না। তাদের উত্থাপিত যুক্তি এবং তাদের কর্মকাণ্ডের দিকে তাকালেই এই হিপোক্রেসির ধরণটা বোঝা যায়।

ঈদ উল আজহার সময় কি হচ্ছে যা নিয়ে তাদের সমস্যা? তাদের মূল অভিযোগগুলো কি কি?অনেকেই অনেক ভাবে প্রকাশ করেন, কিন্তু তাদের মূল কথা হল – “পশু কুরবানী করা নিষ্ঠুরতা, এটা বর্বরতা, এটাতে পরিচ্ছন্নতা বজায় থাকে না এবং পশু হত্যা করে এটা আবার কেমন ইবাদাত!” আমি সাধারণত নির্বোধদের কথা নিয়ে চিন্তা করে সময় নস্ট করি না, এবং আমার কাছে মনে হয় কুরবানী নিয়ে কথা বলা একটা বাহানা মাত্র। এই লোকদের মূল সমস্যা কুরবানী নিয়ে না, তাদের মূল সমস্যা ইসলাম নিয়ে।

আমার মতে এটা একটা দৃশ্যমান, সুপস্ট সত্য যেটা বুঝতে কারো কোন সমস্যা হবার কথা না। কিন্তু তা সত্ত্বেও এবছর আমি চিন্তা করলাম তাদের সব গুলো যুক্তি নিয়ে একটু সিরিয়াসলি চিন্তা করার, এবং যুক্তি প্রমানের ভিত্তিতে আমি যে উপসংহারে পৌঁছেছি সেটা আপনাদের সাথে শেয়ার করার।

প্রথম যুক্তি, জীব হত্যা মহাপাপ – তাই তারা কুরবানীর বিপক্ষে। এই যুক্তি অনুযায়ী এই মানুষগুলোর ভেজিটেরিয়ান হবার কথা। এবং অন্যান্য পশু হত্যার ব্যাপারে তাদের একই রকম আপত্তি থাকার কথা। যেমন ফ্রাইড চিকেন, পিৎযা, বীফ বার্গার, মাটন বিরিয়ানী এসব খাবার, এবং এরকম অন্যান্য খাবার যেখানে পশুর মাংস আছে, সেগুলো তাদের বর্জন করা উচিৎ। দুধ, মাখন এবং দই এবং সব ধরণের ডেইরি প্রডাক্ট বর্জন করা উচিৎ।

কুরবানীকে আক্রমণ করার পেছনে তারা যে সময় শ্রম দিচ্ছেন তার কয়েক গুণ বেশী দেয়া উচিৎ ফাস্ট ফুড ফ্র্যাঞ্চাইযগুলোর পেছনে। বিশেষ করে কেফসির মতো ফ্রাইড চিকেনে স্পেশালাইয করা ফ্যাঞ্চাইয গুলো তো মহা পাপের কাজ জীবহত্যাকে গ্লোবাল ব্যবসা হিসেবে নিয়েছে। কত লাখ কোটি মুরগী আর গরুর জেনোসাইডের জন্য এসব ফাস্ট ফুড ফ্র্যাঞ্চাইয দায়ী সেটা হিসেব করতেই তো কয়েক দিন লেগে যাবার কথা। এই গোত্রের জীবপ্রেমীদের কাছে আমার মতে সবচাইতে ঘৃণ্য সত্ত্বা হওয়া উচিৎ কেএফসির মত ফ্র্যাঞ্চাইয গুলো। কিন্তু এই মানুষগুলোকে কুরবানী ছাড়া আর কখনোই – “পশুর মাংস খাওয়া নিষ্ঠুরতা, পশু হত্যা করা নিষ্ঠুরতা” – এই নীতির উপর কাজ করতে দেখবেন না। এবং এ নিয়ে কথা বলতেও দেখবেন না।

সকল জীবহত্যা মহাপাপ, এই যুক্তিতে যদি উনারা বিশ্বাসী হয়ে থাকেন তাহলে ভেজিটেরিয়ান হবার রাস্তাও প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। কারণ তখন শুধু গাছ থেকে যে ফলগুলো ঝড়ে গেছে আর যেসব গাছগাছালি মরে গেছে সেগুলো খেয়ে জীবন ধারণ করতে হবে। উদ্ভিদেরও জীবন আছে। উদ্ভিদের ফল-ফূলের উপর উদ্ভিদের অধিকার আছে, যেরকম গাভীর অধিকার আছে ওলানের দুধের ওপর। কুরবানী বিরোধীরা কি এই নীতি অনুসরণ করেন? তারা কি শ্যাওলা খেয়ে জীবন কাঁটিয়ে দেন? তারা কি সকল জীবহত্যা মহাপাপ এটা বিশ্বাস করে হাতে ঝাড়ু নিয়ে ঘুরে বেড়ান? যাতে করে হাটার সময় সামনের রাস্তা থেকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবদের সরিয়ে দেওয়া যায়, যেন কোনটা পদপৃষ্ঠ হয়ে না মারা যায়?

এই মানুষগুলো কি স্নেইকস্কীন, অ্যালিগেইটর স্কীন ওয়ালেট, ফার কোট এগুলোরও বিরুদ্ধে? তারা কি স্নেইক স্কীন ওয়ালেট বিক্রেতাকে কিডনী ব্যবসায়ীর সমগোত্রের মনে করেন? যেসব সেলেব্রিটি এগুলো ব্যবহার করে তাদের পিশাচ গোত্রের মনে করেন? কিম্বা সিটি করপোরেশান জলাতঙ্ক আক্রান্ত কুকুর মেরে ফেলার সময় কি তারা এই কুকুরদের যথাযথ চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত এবং বৃদ্ধাশ্রম তৈরি করার দাবিতে আন্দোলন করেন?

নাকি তাদের সমস্যা জীবহত্যা না, তাদের সমস্যা শুধুমাত্র ইসলামের কুরবানীর বিধান – অর্থাৎ ইসলাম নিয়ে?

কেউ হয়তো বলতে পারেন – “আমাদের সমস্যা জীবহত্যা নিয়ে না, আমাদের মাংস খেতেও সমস্যা না,আমাদের সমস্যা চোখের সামনে এই পশু গুলো জবাই করা নিয়ে। এটা নিষ্ঠুরতা”। এরকম বলার সমস্যা হল এখানে ব্যবহৃত লজিকে ভুল আছে এবং তারা যে নৈতিকতা অনুসরণ করছেন সেখানে ভুল আছে। পশু হত্যা যদি ভুল হয় তাহলে সেটা লুকিয়ে করা হোক আর প্রকাশ্যে হোক তা ভুল। ধরুন কেউ বলছে, মানুষ হত্যা করা ভুল যদি সেটা প্রকাশ্যে করা হয়। যদি গোপনে করা হয় তাহলে মানুষ হত্যা করা ঠিক আছে। এ কথাকে কি গ্রহণ করা যাবে? কোন কাজ প্রকৃতিগতভাবেই ভুল হলে, সে কাজ অগোচরে করা হলেও সেটা ভুলই থাকে।

আপনার সামনে করা হচ্ছে না – এর সাথে ভালো-মন্দের, নৈতিকতার কোন সম্পর্ক নেই। এটার সাথে সম্পর্ক আছে আপনার ব্যক্তিগত স্বস্তিবোধ বা অস্বস্তিবোধের – কনভিনিয়েন্সের। চিন্তা করুন, আজকে থেকে ৫০-৬০ বছর আগেও পশু জবাই, শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার জীবনের সাধারণ এবং নিয়মিত একটা বিষয় ছিল। আমাদের দাদারা কিন্তু এই বিলাসিতার সুযোগ পাননি যে টাকা দেবেন আর কাঁটা- ছেলা- রান্না করা মাংস সামনে চলে আসবে। তারা নিজের হাতে, সন্তানসন্ততির সামনে পশু-পাখি জবাই বা জীবহত্যা করেছেন। শুধু কুরবানীর সময়ই না, প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন সময়ে।

আজ আপনি এতোটা সাহেব হয়ে গেছেন যে মাংস খেতে পারবেন কিন্তু পশু জবাই দেখতে পারবেন না –এটা আপনার সমস্যা। ১.৮ বিলিয়ন মুসলিমকে আপনার দুর্বল কলিজার স্বার্থে আপনি কুরবানী বাতিল করতে বলতে পারেন না। না আপনি এই কারণে কুরবানীর সমালোচনা করতে পারেন।

কুরবানী বিরোধীদের বহুল ব্যবহৃত আরেকটি যুক্তি হল, ধর্মের জন্য পশু হত্যার মত এমন বিধান আর কোন ধর্মে নেই। ইসলাম একটা নিষ্ঠুর ধর্ম আর তাই এটা শুধু ইসলামেই আছে। গত কালকে একটি স্ট্যাটাস দেখলাম, একজন ইনিয়ে বিনিয়ে বর্ণনা করছে এক অ্যামেরিকা প্রবাসী কিশোরী কিভাবে বাংলাদেশে এসে এই “নিষ্ঠুরতা” দেখে মৃতপ্রায় হয়ে গেছে। ইন্টারেস্টিং ব্যাপারটা হচ্ছে প্রতি বছর থ্যাংকস গিভিং [Thanksgiving] উপলক্ষে অ্যামেরিকায় চার কোটি পঞ্চাশ লক্ষ টার্কি [পাখিটা, দেশটা না। টার্কি দেশটাকে অ্যামেরিকা ভালো পায়] হত্যা করা হয়। আর ক্রিসমাস উপলক্ষে হত্যা করা হয় আরও ২ কোটি ২০ লাখ টার্কি।

এই প্রায় সাত কোটির মতো টার্কির সবগুলোকে জবাই করা হয় না, ইলেক্ট্রিক শক দিয়ে, ঘাড় মটকে, ভারি বস্তু দিয়ে আঘাত করেও হত্যা করা হয়। অথচ থ্যাংকস গিভিং-কে কারো কাছে নিষ্ঠুর মনে হয় না। একই ভাবে অন্যান্য ধর্মেও পশু উৎসর্গ করার বিধান আছে। মুশরিকদের ধর্মে অশ্বমেধ যজ্ঞের মতো বিভিন্ন যজ্ঞের বিধান আছে যেখানে পশু উৎসর্গ করা হয়। ইহুদিদের ধর্মে “সেখিটা”-র বিধান আছে, যেটা অনেকটা মুসলিমদের কুরবানীর মতোই। অথচ আমাদের দেশের কুরবানী বিরোধিদের সমস্যা শুধু ইসলামের কুরবানী নিয়ে।

উত্থাপিত আরেকটি যুক্তি হল- কুরবানীর সময় পরিচ্ছন্নতার ব্যাঘাত ঘটে। কথাটা আংশিক সত্য। কিন্তু এজন্য কুরবানী কতোটা দায়ী আর আমরা কতোটা দায়ী এটা চিন্তা করার মতো বিষয়। আমাদের দেশে বৃষ্টি হলে নালা-ড্রেনে বন্যা হয়, আর রাস্তাঘাটে চকলেট মিল্কের নহর বয়ে যায়। আমাদের দেশে আমরা ডাস্টবিনগুলোকে শো-পিস হিসেবে ব্যবহার করি আর ময়লা ডাস্টবিনের চারপাশে ফেলি। আমাদের দেশে আরবী দেয়াল লিখনী দিয়েও মানুষকে রাস্তাঘাটে মূত্র বিসর্জন দেয়া থেকে বিরত রাখা যায় না। । আমাদের দেশে সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য তৈরি হাতিরঝিলে দুর্গন্ধের কারণে যাওয়া যায় না। আমাদের দেশে আমরা নিজেরাই বুড়িগঙ্গা নামের এক কালাপানি বানিয়ে নিয়েছি।

সুতরাং এটা অবশ্যই সত্য যে কুরবানীর সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে সাধারন অবস্থার চাইতে কিছুটা বেশীই সতর্ক হতে হয়। আমাদের মধ্যে অধিকাংশই এই এই বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করি না – এটাও সত্য। কিন্তু এটার জন্য ইসলাম কতোটা দায়ী আর জাতি হিসেবে আমাদের পরিষ্কার –পরিচ্ছন্নতা বোধ কতোটা দায়ী এটা নিয়ে চিন্তা করার মতো সময় কিম্বা বুদ্ধি কোনটাই সম্ভবত কুরবানী বিরোধীদের নেই। তা নাহলে বছরে একবার ঘটা একটা জিনিষ নিয়ে চিল্লাপাল্লা না করে, তারা সারা বছর ধরে চলা নোংরামি ও অপরিচ্ছন্নতার বিরুদ্ধে অবশ্যই কিছু বলতেন। পরিচ্ছন্নতা নিয়ে কনসারন থেকেই যদি কুরবানীর বিরোধিতা করা হয়, তাহলে অবশ্যই এই ব্যাপারগুলো নিয়েও তারা প্রশ্ন তুলতেন, প্রতিবাদ করতেন।

শেষ একটা যুক্তি তারা দেখাতে পারে,” আমরা প্রয়োজনে জীবহত্যা, সমর্থন করি। পরিচ্ছন্নতার কিছুটা ব্যাঘাত ঘটাকেও মেনে নেই। কিন্তু এই কুরবানী করে কি প্রয়োজন পূরণ হচ্ছে?” এই প্রশ্নের খুব সহজ উত্তর হল- আপনি যখন বীফ বার্গার খাচ্ছেন তখন আপনি বিলাস দ্রব্যের চাহিদা পূরণ করছেন। এই বার্গার না খেলে আপনার কিছু যায় আসবে না। তাও আপনি খাচ্ছেন, আপনাকে খাওয়ানোর জন্য পশু হত্যা করা হচ্ছে। আর কুরবানীর মাংস দেয়া হচ্ছে গরীব-মিসকিনদের, যারা সারা বছরে হয়তো শুধু ঈদ উপলক্ষেই ‘বীফ’ আর ‘মাটন’ খেতে পারছে। আর বাকি সারা বছর হয়তো তাঁদের কাঁটিয়ে দিতে হচ্ছে ‘ভেজ’ আর উচ্ছিষ্ট ‘চিকেন’ খেয়ে। যদি মাসে বারকয়েক বীফ বার্গার খাবার জন্য গরু জবাই করা বৈধ ”প্রয়োজন” বলে বিবেচিত হয়, তবে এই কুরবানীর গোশতের অধিকাংশই যে গরীব-মিসকিনরা খেতে পারছে এটা “প্রয়োজন’ হিসেবে যথেষ্ট। প্রকাশ্যে জবাই, পরিচ্ছন্নতার ব্যাঘাত, জীবহত্যা – এই সব যুক্তির বিপরীতে এটাই যুক্তি হিসবে যথেষ্ট।

কিন্তু এটা ইসলামের যুক্তি না। আর কুরবানী বিরোধীদের প্রশ্নটাও আসলে এই জায়গাতে না। তাদের আপত্তি আসলে কুরবানী নিয়ে না, কুরবানীর পশু, পন্থা, সময় কিছু নিয়েই না। তাদের সমস্যা হল তাঁকে নিয়ে যিনি কুরবানীর আদেশ দিয়েছেন। তাদের সমস্যা ঐ দ্বীন নিয়ে যা কুরবানী থেকে শিক্ষা নিতে বলেছে। তাদের সমস্যা ঐ মানুষটিকে ﷺ নিয়ে যিনি এই জাতিকে কুরবানীর ব্যপারে শিক্ষা দিয়েছেন।

তাই আপনি দেখবেন কুরবানী বিরোধীরা প্রশ্ন করবে – “এ কেমন স্রস্টা যে বলে কুরবানী করে আনুগত্য প্রকাশ করতে?” কিম্বা দেখবেন তারা বলছে “মনের পশুকে কুরবানী দিয়েছি তাই প্রচলিত কুরবানী করি না”। এই মানুষগুলোর সমস্যা স্রস্টাকে নিয়ে, স্রষ্টার বিধানকে নিয়ে। আল্লাহ যা বলছেন সেটা তাদের পছন্দ হচ্ছে না। আল্লাহ যা আদেশ করছেন এই হতভাগ্যরা সেটা মানতে পারছে না। তাই বিভিন্ন ভাবে তারা ঘুরিয়ে, পেঁচিয়ে কুরবানীর বিধানকে প্রশ্ন করার চেস্টা করছেন।

পৃথিবীতে এমন কোন জাতি নেই যারা স্রষ্টার জন্য কুরবানী করার গুরুত্ব বোঝে না। এটা সর্বকালের সকল মানুষের সত্য। এমনকি মুশরিকরাও এটা বোঝে। তারাও স্রস্টার উদ্দেশ্যে বলি দেয়, যদিও তারা শিরক করে এবং একাধিক ইলাহ-র জন্য বলি দেয়। তাই অধিক যৌক্তিক প্রশ্ন হল, তুমি কেমন সৃষ্টি যে তোমার স্রষ্টার জন্য তুমি কিছু টাকা খরচ করে একটা পশু কুরবানী করতে পারছো না? তুমি কেমন সৃষ্টি যে তোমার জীবনদাতা, রিযকদাতা, যার অনুগ্রহ মাতৃগর্ভ থেকে কবর পর্যন্ত তোমাকে ঘিরে রেখেছে তার জন্য নিজের সামান্য অস্বস্তি সরিয়ে রাখতে পারো না? স্রষ্টাকে পরীক্ষা করবেন সৃষ্টিকে, স্রষ্টাকে পরীক্ষা করা সৃষ্টির ইখতিয়ারের বিষয় না। কেন স্রষ্টা এই বিধান দিলেন, কি রকমের স্রষ্টা এরকম বিধান দিতে পারেন – এই প্রশ্ন করার অধিকার সৃষ্টির নেই।

এই মানুষগুলোর অন্তর কুফর দিয়ে ঢাকা। এবং তাদের অন্তরে মোহর দেয়া। তাদের নিজেদের অবিশ্বাসের ঠুনকো জগত নিয়ে সন্দেহ ঢাকার জন্য তাই ক্রমাগত ইসলামকে আক্রমণ করে যায়। তারা মনে করে ইসলামের প্রতি আক্রমণাত্মক হওয়া হয়তো বা তাদের নিজেদের ভেতরের ইনসিকিউরিটিকে কমাবে। তারা ইসলামকে আক্রমণ করে নিজেদের দুর্বলতাকে ঢাকতে চায়। কুরবানী নিয়ে তাদের এতো যে আপত্তি, এগুলোর সাথে জীবহত্যা, পশু অধিকার, জীবে দয়া করা বা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে চাওয়ার কোন সম্পর্ক নেই। আমাদের কারো যেন এই সত্যটা বোঝার ক্ষেত্রে ভুল না হয়। আমরা কুরবানী করি কারণ এটা আল্লাহর নির্দেশ। যুক্তি হিসেবে, প্রয়োজনীয়তা হিসেবে এটুকুই যথেষ্ট। আর এই লোকগুলো কুরবানী করে না কারণ তারা না পারে আল্লাহ-কে মানতে না পারে তাঁর নির্দেশ মানতে।

তাদের আপত্তি কুরবানী নিয়ে না, তাদের আপত্তি মালিকুল মূলক আল্লাহ আযযা ওয়া জাল-কে নিয়ে। তাদের আপত্তি ইসলাম নিয়ে, তাদের আপত্তি ঈমান নিয়ে। মুমিন তার রাব্ব-এর জন্য কুরবানী করে অন্তরে যে সুকুন অনুভব করে, ঈমানের যে প্রশান্তি সে অনুভব করে, এ হতভাগা কাফিররা সেই আনন্দ থেকে বঞ্ছিত। শুধু তাই না সে এ কারনে মুমিন ঈমানের প্রশান্তি অনুভব করুক – এটাও সে সহ্য করতে পারে না। আর তাই সে বিভিন্ন ভাবে ইবাদাতকে আক্রমণ করার মাধ্যমে ঈমানকে আক্রমণ করতে চায়।

দুঃখজনক ভাবে অনেক মুসলিম এ ধরণের কথা শুনে বিভ্রান্ত হন। এই বিভ্রান্তির কারন এই লোকগুলোর বক্তব্যের যুক্তিগত উৎকর্ষ না। মানুষ বিভ্রান্ত হন প্রথমত এমন কিছু লোককে সম্মানের আসনে বসানোর কারণে, যারা সম্মানিত হবার যোগ্য না।

এরকমের অনেক লোক আছে যাদের আমরা জাতি হিসেবে মাথায় তুলেছি কিন্ত এদের থাকার কথা পায়ের তলায়। এই লোকগুলো সুযোগ পেলেই ইসলামকে আক্রমন করে এবং ইসলামের বিধিবিধান নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এদেরকে সম্মানের আসনে বসানোর কারণে, যখন এরা কুরবানী নিয়ে একটা আপত্তি তোলে তখন আমরা বিভ্রান্ত হই। আবার অনেক ক্ষেত্রে মানুষ বিভ্রান্ত হন কারণ যে কথাটা বলছে সে সুন্দর কথার মোড়কে, আবেগ ব্যবহার করে এমনভাবে বিষয়য়টিকে উপস্থাপন করছে যাতে করে মানুষ সঠিকভাবে বিষয়টি নিয়ে চিন্তা ও বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত হচ্ছে।

আর তৃতীয়ত, আমাদের অনেকের মধ্যেই ইসলাম নিয়ে সুস্পস্ট ধারণা না থাকায় এবং হীনমন্যতা কাজ করায়, আমরা ইসলামকে সমর্থন করে কিছু বলার সময় সঙ্কোচ বোধ করি। আমরা ইসলামকে নিয়ে কথা বলতেও অনেকে সঙ্কোচ বোধ করি। ফলে আমাদের চুপ থাকার কারণে আরও কিছু মানুষ বিভ্রান্ত হয়। আমরা এভাবে বিভ্রান্ত হই, এবং আমরা এসব কারণে ইসলামকে ডিফেন্ড করা থেকে বিরত থাকি। অথচ এই লোকগুলো প্রতি বছর নিয়ম করে ঈদ উল আজহার সময় আল্লাহ-র নির্দিষ্ট এই ইবাদাতকে আক্রমন করে।

আমার এই লেখার উদ্দেশ্য বাংলাদেশের ঐসব নাস্তিক এবং কাফিরদের জবাব দেয়া না, যারা কুরবানীর সমালোচনা করে। নির্বোধ এবং মূর্খদের সাথে তর্কে জেতার মাঝে কোন চ্যালেঞ্জ নেই, ক্রেডিটও নেই। আমার এই লেখার উদ্দেশ্য আল্লাহ-র বিধান, আল্লাহ-র দ্বীন ইসলাম, আল্লাহ-র নাবী মুহাম্মাদ ﷺ এর সমর্থনে একজন মুসলিম হিসেবে কিছু লেখা। ইসলামের শত্রুরা নিয়মিত আল্লাহ, তাঁর দ্বীন ও তাঁর রাসূল ﷺ -কে আক্রমণ করছে। সেটা কুরবানী নিয়ে হোক, হিজাব নিয়ে হোক, বহুবিবাহ নিয়ে হোক কিম্বা জিহাদ নিয়ে। কুরবানী বিষয়ে যেসব ভিত্তিহীন বুদ্ধি প্রতিবন্ধীর কথার মতো যুক্তিগুলো নিয়ে আলোচনা করলাম, আপনি দেখবেন অনেক লোকই খুব বড় গলায় এই কথা গুলো বলছে, স্ট্যাটাস দিচ্ছে। যদি কাফির তার কুফরের জন্য এতো সময় ও শ্রম দিতে পারে, যদি সে তার কুফর নিয়ে এতোটা আত্মবিশ্বাসী হতে পারে, তবে আমরা মুসলিমরা কেন হাক্ব উচ্চারণ করতে, আল্লাহ-র দ্বীনের সমর্থনে কথা বলতে সঙ্কোচ বোধ করবো?

আমার এই লেখার উদ্দেশ্য আমার ভাই ও বোনদের মধ্যে ইসলামের সমর্থনে কথা বলার ইচ্ছাটুকু তৈরি করার চেস্টা করা। সেটা যতো সহজ বা ছোট বিষয়ই হোক না কেন। যখন ইসলামকে আক্রমণ করা হবে তখন যেন আমরা সঙ্কোচ না করি। আমরা যেন অন্য কেউ বলবে এজন্য চুপ করে না থাকি। আমরা যেন কুফরের জন্য যারা কাজ করে তাদের জন্য কাজটা সহজ করে না দেই।আমার এই লেখার উদ্দেশ্য আমার ভাইবোনদের এটুকু মনে করিয়ে দেয়া যে, সবার আগে আমাদের যাদের সমর্থনে কথা বলা উচিত তাঁরা হলেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ । আমাদের লেখনী দ্বারা সমর্থিত হবার সর্বাধিক দাবিদার আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ । সর্বাগ্রে যাদের মিথ্যাচারের দাঁতভাঙ্গা জবাব দেয়া উচিত তারা হল কাফির এবং নাস্তিক। সবচাইতে বেশী যাদের মুখোষ উন্মোচন করা দরকার তারা হল যারা মুসলিম নাম নিয়ে ইসলামের বিধানের এবং শারীয়াহ-র বিরোধিতা করে। এমন যেন না হয় যে কাফিররা আদর্শ প্রচারে মুমিনের চাইতে বেশী নিবেদিত প্রাণ হয়ে যায়। এমন যেন না হয় যে কাফির দুনিয়ার কাছে মুমিনের চেয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে যায়। আল্লাহ আমাদের দ্বীনের মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন, আমাদের উপর রহমত করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ। আমরা যেন এই দ্বীনের সমর্থনে কখনো পিছপা না হই।

“তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যানের জন্যেই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে…” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১১০]

 – আসিফ আদনান

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button