ধর্মীয় উত্সব/উপলক্ষ

অপার ফজিলতের শবে বরাত এখন বছর ঘুরে আসা মৌসুমি ঝগড়া! ব্যাপারটা কি?

রসুলুল্লাহ (স) বলেছেন, অর্ধ শা‘বানের রাতে মহা ক্ষমতাশীল আল্লাহ স্বীয় বান্দাহ্‌দের প্রতি তাকান। অতঃপর তিনি মু’মিনদের ক্ষমা করে দেন, কাফিরদের অবকাশ দেন, আর হিংসা-বিদ্বেষ পোষণকারীদের তাদের হিংসা-বিদ্বেষ সমেত ছেড়ে দেন যে পর্যন্ত না তারা তা পরিত্যাগ ও বর্জন করে।

এরকম তিনি আরও বলেছেন, অর্ধ শা‘বানের রাতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সৃষ্টির দিকে তাকান অতঃপর তিনি মুশরিক এবং হিংসা-বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সকল সৃষ্টিকে ক্ষমা করে দেন।

সনদ (বর্ণনাসূত্র) এবং মতন (মূল বক্তব্য) বিবেচনায় হাদিসদুটি গ্রহণযোগ্য সহীহ (যদিও মতবিরোধের উর্ধ্বে নয়)। সুতরাং এ রাতে কাফির-মুশরিক, এবং হিংসা-বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত অন্য সকল মু’মিন-মুসলিমদের আল্লাহ গণহারে ক্ষমা করেন। যেকারনে একে বলা হয় লাইলাতুল বারাত বা মুক্তির রাত। ফার্সী ভাষায় বলা হয় শবই বরাত। ফার্সীতে শব শব্দের অর্থ রাত ও বরাত মানে ভাগ্য। কিন্তু কোনভাবেই এইটা ভাগ্যের রাত নয়। মুক্তির রাত। সুতরাং এই রাতটির বিশেষ ফজিলত রয়েছে। যারা এর বিশেষ ফজিলতকে অস্বীকার করছে তারা ঠিক করছে না।

এখন এই রাতের বিশেষ আমাল কি? আমলের ব্যাপারে মোটামুটি দুটি হাদিস বেশি উল্লেখ করা হয়।

১।
হযরত আলা ইবনুল হারিস (রহ.) থেকে বর্ণিত, হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ (সা.) রাতে নামাজে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সেজদা করেন যে, আমার ধারণা হল তিনি হয়ত মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়েশা! অথবা বলেছেন, ও হুমাইরা, তোমার কি এই আশংকা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, না, ইয়া রাসূলুল্লাহ। আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার এই আশংকা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কিনা। নবিজি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জান এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তার রাসূলই ভাল জানেন। রাসূলুল্লাহ (ক্ষ) তখন ইরশাদ করলেন,‘এটা হল অর্ধ শাবানের রাত (শাবানের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত রাত)। আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে তার বান্দার প্রতি মনযোগ দেন এবং ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহ প্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই।‘ [শুআবুল ঈমান, বাইহাকি ৩/৩৮২-৩৬৮]

ইমাম বায়হাকির মতে হাদিসটি মুরসাল। বর্ননাকারী ‘আলা’ আয়িশা (রাঃ) থেকে শুনেননি। মুরসাল হাদিসের গ্রহনযোগ্যতা কয়েকটি শর্তের উপর নির্ভরশীল। মোটের উপর এটা কারও নিকট গ্রহণযোগ্য আবার কারও নিকট যয়ীফ।

মুসনাদে আহমাদে এরকম কিন্তু কিছুটা ভিন্ন টেক্সটের হাদিস উল্লেখ আছে যেমন,

আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) বলেন: এক রাতে আমি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে খুঁজে না পেয়ে তাঁকে খুঁজতে বের হলাম, আমি তাকে বাকী গোরস্তানে পেলাম। তখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে বললেন: ‘তুমি কি মনে কর, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তোমার উপর জুলুম করবেন?’ আমি বললাম: ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি ধারণা করেছিলাম যে আপনি আপনার অপর কোন স্ত্রীর নিকট চলে গিয়েছেন। তখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: ‘মহান আল্লাহ তা’লা শা‘বানের মধ্যরাত্রিতে নিকটবর্তী আসমানে অবতীর্ণ হন এবং কালব গোত্রের ছাগলের পালের পশমের চেয়ে বেশী লোকদের ক্ষমা করেন।

ইমাম বুখারী ও ইমাম ইবনে মাজাহ একে যয়ীফ বলেছেন।

২।
হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, পনের শাবানের রাত (চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত) যখন আসে তখন তোমরা এ রাতটি ইবাদত-বন্দেগীতে কাটাও এবং দিনের বেলা রোজা রাখ। কেননা, এ রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তাআলা প্রথম আসমানে আসেন এবং বলেন, কোন ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কোন রিযিক প্রার্থী? আমি তাকে রিযিক দেব। এভাবে সুব্হে সাদিক পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা মানুষের প্রয়োজনের কথা বলে তাদের ডাকতে থাকেন। [সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস ১৩৮৪]

এই হাদিসটি কেউ কেউ বলেছেন যয়ীফ। যেমন ইমাম নববী। কেউ কেউ বলেছেন জাল। কেননা এ হাদীসের সনদে ইবনে আবি সাবুরাহ নামে এক ব্যক্তি আছেন, যিনি অধিকাংশ হাদীস বিশারদের নিকট হাদীস জালকারী হিসাবে পরিচিত। ইমাম আহমাদ (র) বলেছেন সে হাদিস বানাতো।

সুতরাং আমালের ব্যাপারে আমাদের আগে উসুল ঠিক করতে হবে। যে ফজিলতের জন্য যয়ীফ হাদিস গ্রহণ করবে সে আমাল করতে পারে আর যে তা গ্রহণ করবে না সে এই উপলক্ষে কোন আমাল করবে না। সহজ কথা। অতীতের অনেক স্কলার ফজিলতের ক্ষেত্রে যয়ীফ হাদিস গ্রহন করেছেন আবার অনেকে করেননি।

কিন্তু দুখজনকভাবে কেউ কেউ শবে বরাত উপলক্ষে আমালকে এমনভাবে উপস্থাপন করছে যে সেগুলো যয়ীফ হাদিসের উপর ভিত্তি করে এসেছে সেটুকু উল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করছে না। সহীহ ফজীলত আর যয়ীফ আমালের এক অপূর্ব কম্বিনেশন কে এমনভাবে উপ্সথাপন করছে যেন আমালের হাদিসও সহীহ।

যারা যইফ হাদিসের উপর আমাল করার নীতি অবলম্বন করেন তারা সবাই কি আদৌ জানে যে যয়ীফ হাদিস কি? নাকি ইমাম নববী (র) এর একটা কওলকেই (ফজিলতের ক্ষেত্রে যয়ীফ হাদিসের উপর আমাল করা যাবে) দ্বীন ধরে নিয়েছেন? যয়ীফ হাদিসের সারাংশ এই যে সেটা রসুল (স) থেকে প্রমাণিত নয়। হতেও পারে তিনি বলেছেন আবার হতেও পারে তিনি আদৌ বলেন নি। অর্থাৎ হাদিসটা মিথ্যা বলা যায় না ঠিকই কিন্তু মিথ্যা সন্দেহের অবকাশ আছে। অনুরুপভাবে এটাকে সত্য বলা যায় না ঠিকই কিন্তু সত্য হতেও পারে। ৫০-৫০। মোট কথা প্রমাণিত নয়। কি আশ্চর্য! অনেকে বলেন “যয়ীফ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত!” যেখানে হাদিসই প্রমাণিত নয়!

নিজের মতের “অনেক” আলিম আর বিপরীত মতের “কিছু” আলিম বলেছেন-এই সাধারণ উক্তির কোন মূল্য নাই। কোন আলিম কি কি বলেছেন তার আরবী ইবারাত দেখতে হবে। “বিদেশে আছে” “বিদেশে এমন হয়” বলে চালিয়ে দেওয়ার যুগ অতীত হয়েছে। কোন দেশে আছে? কিভাবে আছে বিস্তারিত জানার সময় এসেছে। দেখেন না ইমাম নববীর কথা ঠিকই আসল কিন্তু ইমাম ইবনে হাজার আসকালানীর নিশেধাজ্ঞা আসল না! আবার ঘার মাসেহের সময় তার কথা ঠিকই লাগবে আর ইমাম নববীর কথা তখন ভুলে যাওয়া হবে।

বার বার এটা বলছি যে যে যার উসুল অনুযায়ী আমাল করবেন ঠিক আছে কিন্তু সহীহ আর যয়ীফ মনে রেখে। মিলিয়ে দিয়েন না। আপনি যয়ীফকে এমনভাবে উপস্থাপন করবেন না যে তাতে কোন সন্দেহ নাই। রসুলুল্লাহ (স) বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার নামে কোনো হাদীস বলবে এবং তার মনে সন্দেহ হবে যে, হাদীসটি মিথ্যা, সেও একজন মিথ্যাবাদী।” [সুনান ইবন মাযাহ/৩৯ (সহীহ)]। এখন আপনিই বলুন যখন সন্দেহ করে হাদিস বর্ণনা করা যায় না, আমাল করা কিভাবে যায়!

একটা কমন সেন্স চিন্তা করেন। যদি রসুলুল্লাহ (স) তার জীবনে শবে বরাত উদযাপন করতেন, আবু বকর , উমার, উসমান আলী (রা) এরা উদযাপন করতেন তাহলে কয়েকটা মাত্র যয়ীফ হাদিসের উপর আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হয়? এধরনের একটা অকেশন সেটার জন্য কি অন্যান্য সাহাবাগনের উদযাপন ইতিহাস থাকে না? যদিও আমালের জন্য একটা সহীহ হাদিস যথেষ্ট সেখানে আপনিই বলেন এত বড় বিষয়ের কতগুলো সহীহ রেওয়ায়েত থাকা স্বাভাবিক ছিলো!

আপনি কি ভেবে দেখছেন না যে যদি রসুলুল্লাহ (স) সাহাবাদের এই রাতে ইবাদাত করতে উদবুদ্ধ করতেন তাহলে নিজ পরিবারকেও ইবাদাতের জন্য জানালেন না!

আর যারা দুর্বল হাদিসের ভিত্তিতে নয় বরং সহীহ ফজিলতের জন্যই এই রাতে আমাল করতে চান তাদের জন্য বড় সুসংবাদ আছে। কারন ঠিক এরকম সুযোগ বছরে কেবল এক রাত নয় বহু রাতই আছে। ঐ দিনগুলোকেও আপনারা রাতের কিয়াম দ্বারা উদযাপন করতে পারেন।
.
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “প্রতি বৃহস্পতিবার ও সোমবার আমলের ফিরিস্তি পেশ করা হয়। তখন আল্লাহ আযযা ওয়া জাল – সেদিন প্রত্যেক এমন বান্দাকে ক্ষমা করেন, যারা তার সঙ্গে কোন কিছুকে শরীক করে না। তবে এমন ব্যক্তিকে নয়, যার (দ্বীনি) ভাই ও তার মধ্যে শক্রতা আছে। তখন বলা হবে, এই দু’জনকে অবকাশ দাও যতক্ষন না তারা আপোষের দিকে ফিরে আসে, এই দু’জনকে অবকাশ দাও যতক্ষন না তারা আপোষের দিকে ফিরে আসে।” [সহিহ মুসলিম / ৬৩১৩]

এইটা কিন্তু নিরেট সহীহ অর্থাৎ ইখতিলাফের ছোয়াহীন। আমালের জন্য অধিক উপযুক্ত। আল্লাহ সহজ করুক।

— S M Nahid Hasan

২টি মন্তব্য

  1. উসুলে হাদিস অনুযায়ী যয়ীফ হাদিসকে যখন কোনো সহিহ হাদিস সমথর্ন করে, যখন তা একাধিক সনদে বর্ণিত হয়; তখন তা আর যয়ীফ থাকেনা, বরং হাসান লি-গইরিহি হয়।

  2. লেখাটি ভালো লেগেছে। তবে লেখার প্রথমে উল্লিখিত দুটি হাদীছের ব্যাপারে বলা হয়েছে- সনদ ও মতন বিবেচনায় হাদীছদুটি গ্রহণযোগ্য সহীহ; বন্ধনীতে এও বলা হয়েছে- তবে মতবিরোধের ঊর্ধ্বে নয়। প্রশ্ন হলো:
    ১. হাদীছদুটি যদি গ্রহণযোগ্য সহীহ হয়, তাহলে এ রাতের আমল দালিলিকভাবে প্রমানিত নয় কি?
    ২. হাদীছদুটি যদি গ্রহণযোগ্য সহীহ হয়, তাহলে তাতে মতবিরোধের সুযোগ থাকবে কেন?
    ৩. হাদীছদুটি যদি গ্রহণযোগ্য সহীহ হয়, তাহলে লেখাটির বাকি অংশ হাদীছদুটির সাথে সাংঘর্ষিক নয় কি?

মন্তব্য করুন

Back to top button