ইসলাম ও বিজ্ঞান

আল-কুরআনে কার্বন, নাইট্রোজেন, ফসফরাস এবং পানি ও সূর্যের তরঙ্গচক্র

আমাদের চারপাশ কিভাবে পরিচালিত হচ্ছে? এর মেকানিজম কি? পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত অগণিত মানুষ জন্মেছে আবার মৃত্যুবরণ করেছে। অগণিত পশু-পাখি, গাছপালা জন্মেছে আবার মৃত্যুবরণ করছে। প্রশ্ন হ’ল- এত কোটি কোটি প্রাণী, উদ্ভিদ তাদের জীবন ধারণের জন্য খাদ্য গ্রহণ করেছিল, এখনো যারা জীবিত আছে তারাও খাদ্য গ্রহণ করে যাচ্ছে। কিন্তু পৃথিবীর খাদ্য উপাদানের পরিমাণের কোন পরিবর্তন হচ্ছে না কেন? পৃথিবীর এই রহস্য উদঘাটনে বিজ্ঞানীরা গবেষণা শুরু করেন। ১৮৫৬ সালে সর্বপ্রথম জুল রেইসেট নাইট্রোজেন চক্র সম্পর্কে ধারণা দেন। ১৭৭২ থেকে ১৭৯০ সালের মধ্যে গবেষণা করে জোসেপ প্রিস্টলি এবং এন্টইন ল্যাভয়সার কার্বনচক্র আবিষ্কার করেন। এভাবে ফসফরাস চক্রসহ আরো তথ্য আবিষ্কৃত হয়। এগুলোর উপর গবেষণা করে জানা যায় যে, এগুলো বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ভূমিতে প্রবেশ করে এবং পুনরায় ভূমি হ’তে বাইরে বেরিয়ে আসে। এছাড়া আসমান হ’তে বিভিন্ন ধরনের তাড়িত চৌম্বক রশ্মি যমীনের দিকে নেমে আসে যা কাজে লাগিয়ে মানুষ বিশ্ব জয় করছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বিশ্বসৃজন ও পরিচালনা সম্পর্কে বলেন,

هُوَ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ يَعْلَمُ مَا يَلِجُ فِي الْأَرْضِ وَمَا يَخْرُجُ مِنْهَا وَمَا يَنْزِلُ مِنَ السَّمَاءِ وَمَا يَعْرُجُ فِيهَا وَهُوَ مَعَكُمْ أَيْنَ مَا كُنْتُمْ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيْرٌ-

‘তিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছেন ছয় দিনে। অতঃপর উন্নীত হয়েছেন আরশে। তিনি জানেন যা কিছু ভূমিতে প্রবেশ করে ও যা কিছু সেখান থেকে নির্গত হয়। আর যা কিছু আকাশ থেকে অবতীর্ণ হয় ও যা কিছু সেখানে উত্থিত হয়। তিনি তোমাদের সাথে আছেন (জ্ঞানের মাধ্যমে), যেখানেই তোমরা থাক। আর তোমরা যা কিছু কর সবই আল্লাহ দেখেন’ (হাদীদ ৫৭/৪)

উক্ত আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা অনেক নিদর্শন পেশ করেছেন। যেমন- (১) আসমান ও যমীন ছয় দিনে সৃষ্টি করা। (২) যমীনে যা কিছু প্রবেশ করে তা থেকে যা বের হয় এবং (৩) আসমান থেকে যা কিছু অবতীর্ণ হয় এবং তাতে যা উত্থিত হয় এসবই তাঁর ইলমে রয়েছে।

উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা এই বিশ্ব পরিচালনার কিছু পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন। আয়াতে উল্লিখিত যমীনে যা কিছু প্রবেশ করে এবং যা কিছু বের হয় দ্বারা কিছু চক্র সম্পর্কে ইঙ্গিত করেছেন। অর্থাৎ যা অব্যাহতভাবে যমীনে প্রবেশ করে এবং যমীন হ’তে বের হয়।

অনুরূপভাবে আসমান থেকে যা কিছু অবতীর্ণ হয় এবং যা কিছু উত্থিত হয়। নিম্নে যেসকল চক্র পৃথিবীর সূচনা হ’তে যমীনে চলমান রয়েছে এবং যা আসমান হ’তে অবতীর্ণ হয় এবং তা দ্বারা মানবজীবন কিভাবে উপকৃত হচ্ছে এ সম্পর্কে ধারাবাহিকভাবে আলোকপাত করা হ’ল।-

নাইট্রোজেন চক্র : পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রায় ৭৮% নাইট্রোজেন গ্যাস বিদ্যমান। আমাদের প্রতি নিঃশ্বাসে এই নাইট্রোজেন আমাদের শরীরে প্রবেশ করে এবং পুনরায় বের হয়ে আসে। কিন্তু এই নাইট্রোজেন আমাদের শরীরের ভিতরে কোন ধরনের বিক্রিয়া করে না। এর কারণ হ’ল নাইট্রোজেন একটি অত্যধিক নিষ্ক্রিয় প্রকৃতির গ্যাস। নাইট্রোজেনকে ভাংগতে ৩০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার প্রয়োজন হয় যা বজ্রপাতের কারণে উৎপন্ন হয়। বজ্রপাতের কারণে বায়ুতে থাকা নাইট্রোজেন এবং অক্সিজেন বিক্রিয়া করে নাইট্রাস অক্সাইড এবং নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড উৎপন্ন করে, যা বাতাসের অক্সিজেন এবং বৃষ্টির পানির সাথে বিক্রিয়া করে নাইট্রিক এসিড উৎপন্ন করে। এই এসিড বৃষ্টির পানির সাথে ভূ-পৃষ্ঠে পতিত হয়। এই এসিড মাটির ক্ষারীয় উপাদানের সাথে মিশ্রিত হয়ে নাইট্রেট লবণ তৈরী করে, যা গাছপালা সার হিসাবে গ্রহণ করে তাদের পুষ্টি এবং বৃদ্ধি সাধন করে। এই কারণে বজ্রবৃষ্টির পর গাছ-পালা, লতা-পাতা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এরপর এই নাইট্রোজেন লতা-পাতা, ফলমূল শাক-সবজির মাধ্যমে প্রোটিন হিসাবে প্রাণীর দেহে প্রবেশ করে। এ প্রোটিন জীব কোষের প্রধান উপাদান হওয়ায় প্রতিটি প্রাণীর দেহ গঠনে এটি অন্যতম প্রধান উপাদান হিসাবে কাজ করে।

এছাড়া শৈবাল ও মটর, শিম, ছোলা প্রভৃতি লিগুমিনাস জাতীয় উদ্ভিদের শিকড়ের গুটিতে সিমবায়োটিক জীবাণু দ্বারা বায়ুর নাইট্রোজেন শোষণ করে। এই ব্যাকটেরিয়া থেকে নিঃসৃত মলিবেডনাম ধাতু নাইট্রোজেনকে বিজারিত করে অ্যামোনিয়া গ্যাস এবং মাটির বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া দ্বারা কয়েক ধাপে নাইট্রেট আয়নে পরিণত করে, যা উদ্ভিদ মাটি হ’তে খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে। পরবর্তীতে এই উদ্ভিদ প্রাণীকূল প্রোটিন হিসাবে গ্রহণ করে এবং বর্জ্য প্রস্রাবে ইউরিয়া হিসাবে ত্যাগ করে। মানুষ ও অন্যান্য পশু-পাখি যখন মারা যায় এবং মাটিতে কবরস্থ করা হয় তখন মাটির ব্যাকটেরিয়া দ্বারা জারিত হয়ে নাইট্রেট আয়নে পরিণত হয়। এই আয়নের কিছু অংশ স্থলজ এবং জলজ উদ্ভিদ শোষণ করে, কিছু অংশ শিলাতে সংরক্ষিত হয় এবং বাকী অংশ ডি-নাইট্রিফাইং জীবাণুর প্রভাবে বিজারিত হয়ে বায়ুমন্ডলে ফিরে আসে। মূলতঃ এ কারণেই কবরস্থানে অধিক গাছপালা জন্মাতে দেখা যায়।

এই বর্ণনা হ’তে আরোও জানা গেল যে, আমরা মুসলমানরা মৃতদেরকে যেভাবে মাটিতে কবরস্থ করি তা বিজ্ঞানসম্মত এবং এর দ্বারা পরিবেশের কোন ক্ষতি হয় না বরং পরিবেশের উপকার হয়। এভাবে নাইট্রোজেন ভূমিতে প্রবেশ এবং বের হওয়ার মাধ্যমে পৃথিবীবাসীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

ফসফরাস চক্র : ফসফরাস পৃথিবীর ভূত্বকের মধ্যে পাওয়া যায়। প্রাথমিকভাবে পাললিক শিলাগুলিতে ফসফেট খনিজ হিসাবে রয়েছে। এই শিলাগুলি আবহাওয়া এবং ক্ষয় হওয়ার কারণে, শিলাতে বিদ্যমান ফসফেটগুলি মাটিতে প্রবেশ করে এবং নদীর মাধ্যমে সমুদ্রে প্রবেশ করে। মাটির উপরে এবং সমুদ্রে থাকা উদ্ভিদসমূহ সমস্ত জীবের বেঁচে থাকা এবং বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় জৈব যৌগ তৈরি করতে প্রয়োজনীয় ফসফেট শোষণ করে। পরবর্তীতে এই ফসফেট খাদ্যের মাধ্যমে প্রাণী দেহে প্রবেশ করে। উদ্ভিদ ও প্রাণী দ্বারা অর্জিত ফসফেট প্রাণীর মলত্যাগের মাধ্যমে এবং মৃত জীবের পচনের মাধ্যমে মাটি বা সমুদ্রে ফিরে আসে। এভাবে ফসফরাস চক্র চলতে থাকে। এভাবেই মাটি থেকে উদ্ভিদ এবং প্রাণী দেহে প্রবেশ করে। এরপর আবার মাটিতে ফিরে আসে। (A project of the University of California Museum of Paleontology, phosphorus cycle)

কার্বন চক্র : পৃথিবীর কর্ম সম্পাদনের জন্য কার্বন চক্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কার্বন সমুদ্র, বায়ুমন্ডল, মাটি এবং জীবিত বস্ত্তর মধ্যে স্থানান্তরিত হয় ঘণ্টা থেকে শতাব্দীর সময়ের স্কেলে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, ভূমিতে আলোক সংশ্লেষণকারী উদ্ভিদ সরাসরি বায়ুমন্ডল থেকে কার্বনডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে এবং সেই কার্বন পরমাণুগুলি উদ্ভিদের শরীরের অংশ হয়ে যায়। তৃণভোজীরা গাছপালা খায় এবং মাংসাশীরা তৃণভোজী প্রাণী গরু, ছাগল ইত্যাদি খায়, তাই কার্বন খাদ্যের মাধ্যমে এক দেহ হ’তে অন্য দেহে স্থানান্তারিত হয়। এদিকে প্রাণী এবং জীবাণুর শ্বাস-প্রশ্বাস কার্বনডাই অক্সাইড হিসাবে বায়ুমন্ডলে কার্বন ফিরিয়ে দেয়।

যখন জীবের মৃত্যু হয় তখন কার্বন ক্ষয় হয়ে বায়ুমন্ডলে ফিরে আসে বা তাদের কিছু বর্জ্যের সাথে মাটিতে মিশে যায়। দাবানলের সময় বায়োমাসের দহনও উদ্ভিদে সঞ্চিত বিপুল পরিমাণ কার্বন বায়ুমন্ডলে ছেড়ে দেয়।

এই কার্বন হ’ল উদ্ভিদ এবং প্রাণী দেহ গঠনের মূল উপাদান। পৃথিবীর মোট কার্বনের পরিমাণ নির্ধারিত। যখন নতুন জীবন গঠিত হয়, কার্বন প্রোটিন এবং ডিএন-এর মত মূল অণু গঠন করে। যখন মায়ের গর্ভে সন্তানের দেহ গঠন শুরু হয় তখন মায়ের দেহ হ’তে প্রয়োজনীয় কার্বন সন্তান দেহ গ্রহণ করে। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরে শিশু তার খাদ্যের মাধ্যমে কার্বন গ্রহণ করে। পরবর্তীতে তার মৃত্যুর মাধ্যমে প্রকৃতির কার্বন প্রকৃতির মাঝে ফিরে আসে।

সূর্যরশ্মি : সূর্যরশ্মি প্রায় ৩০০,০০০ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ডে (১৮৬,০০০ মাইল প্রতি সেকেন্ডে) মহাকাশে ভ্রমণ করে। যখন সূর্যের আলো পৃথিবীতে আঘাত করে, তখন এটি অধিকাংশই প্রতিফলিত হয় বা শোষিত হয়। প্রতিফলিত আলো আবার মহাকাশে বাউন্স করে এবং শোষিত আলো শক্তির উৎস হিসাবে কাজ করে।

আগত সূর্যরশ্মির কিছু অংশ পৃথিবীর মাটি শোষণ করে এবং বাকী অংশ প্রতিফলিত হয়ে বায়ুমন্ডল এবং ভূ-পৃষ্ঠে ফিরে আসে। সূর্য পৃথিবীকে তার অধিকাংশ শক্তি সরবরাহ করে। পৃথিবীতে পৌঁছানো সূর্যের আলোর প্রায় ৭১% ভূ-পৃষ্ঠ এবং বায়ুমন্ডল দ্বারা শোষিত হয়। পৃথিবী যে পরিমাণ আলোকরশ্মি শোষণ বা প্রতিফলন করে, এর উপর ভিত্তি করে পৃথিবীর শক্তির পরিমাণ নির্ধারিত হয়। এর উপর ভিত্তি করেই পৃথিবী তার কাজ সম্পাদন করে। ভূ-পৃষ্ঠ শোষিত এই রশ্মি পুনরায় দীর্ঘ তরঙ্গ, অবলোহিত রশ্মি এবং তাপ হিসাবে বায়ুমন্ডলে ফিরে আসে। ভূ-পৃষ্ঠ যত বেশী সূর্যালোক শোষণ করে, এটি তত বেশী উষ্ণ হয় এবং আরও শক্তি তাপ হিসাবে পুনরায় বায়ুমন্ডলে বিকিরণ করে। এই পুনরায় বিকিরণ করা তাপ গ্রিনহাউস গ্যাস কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং মেঘ দ্বারা শোষিত হয় এবং পুনরায় বিকিরণ করে এবং গ্রীনহাউস প্রভাবের (কার্বন-ডাই-অক্সাইড বায়ুর তুলনায় ভারী এবং তাপ ধরে রাখার ক্ষমতা) মাধ্যমে বায়ুমন্ডলকে উষ্ণ করে।

যেহেতু পৃথিবী একটি গোলক, পৃথিবীর সমস্ত অংশ একই পরিমাণে সৌর বিকিরণ পায় না। যেহেতু পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে উপবৃত্তাকার পথে আবর্তন করছে তাই পৃথিবী হ’তে সূর্যের দূরত্ব সবসময় একই থাকে না এবং পৃথিবীর নিজ অক্ষে আবর্তনের কারণে পৃথিবী পৃষ্ঠে সূর্যালোক বিভিন্ন কোণে আপতিত হয়। এই কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে সূর্যালোকের শোষণ এবং প্রতিফলন বিভিন্ন পরিমাণে হয়। ফলে আমরা বছরে বিভিন্ন ঋতু দেখতে পাই এবং বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন ধরনের ফল-মূল, শাক-সবজি উৎপাদন হ’তে দেখা যায়। এইভাবে আল্লাহ তা‘আলা সূর্যালোককে বিভিন্ন কোণে ভূমির ভিতরে প্রবেশ করিয়ে তার বান্দাদের জন্য সারা বছর বিভিন্ন ধরনের খাদ্যের ব্যবস্থা করেন।

এই চক্রগুলো যমীনে চলমান থাকার কারণে পৃথিবীর মোট কার্বন, নাইট্রোজেন এবং ফসফরাসের কোনরূপ ঘাটতি ঘটেনি। উপরের বিশ্লেষণ হ’তে আল্লাহ তা‘আলার আরেকটি ছিফাত সুস্পষ্ট হয় তা হ’ল আল্লাহই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা বা খালেক। এর কারণ হ’ল যদি একাধিক স্রষ্টা থাকত তবে একজন মানুষের সৃষ্টি হ’তে মৃত্যুর পর মাটিতে মিশে যাওয়া পর্যন্ত কার্বন চক্র, নাইট্রোজেন চক্র এবং ফসফরাস চক্রের মধ্যে সুনিপন একটি লিংক করা সম্ভব হ’ত না। উপরের এই বর্ণনা কেবল একজন সৃষ্টিকর্তার দিকেই ইঙ্গিত করে। আল্লাহ বলেন, لَوْ كَانَ فِيهِمَا آلِهَةٌ إِلَّا اللهُ لَفَسَدَتَا فَسُبْحَانَ اللهِ رَبِّ الْعَرْشِ عَمَّا يَصِفُونَ- ‘যদি আকাশ ও পৃথিবীতে আল্লাহ ব্যতীত বহু উপাস্য থাকত, তাহ’লে উভয়টিই ধ্বংস হয়ে যেত। অতএব তারা যা বলে, তা থেকে আরশের মালিক আল্লাহ মহা পবিত্র’ (আম্বিয়া ২১/২২)

আমরা আসমান হ’তে কেবল বৃষ্টি পতিত হওয়া দেখতে পাই। কিন্তু আরো অনেক কিছু অবতীর্ণ হয়, যা খালি চোখে দেখা যায় না। আজ বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি যে, আসমান হ’তে বিভিন্ন ধরনের রশ্মি অবতীর্ণ হয়, যা মানব জীবনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন-

রেডিওওয়েভ : এটি হ’ল এক ধরনের তাড়িতচৌম্বক তরঙ্গ, যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য খুব বেশী। মানুষ যোগাযোগ করার জন্য এই তরঙ্গ ব্যবহার করে থাকে। এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ১মি. থেকে শুরু করে ১০০ মেগা মিটার পর্যন্ত হ’তে পারে। এর কম্পাংক ৩ হার্টয থেকে ৩ মেগাহার্টয পর্যন্ত হ’তে পারে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এর বিবিধ ব্যবহার রয়েছে। যথা: রেডিও-টেলিভিশন ব্রডকাস্ট, এফএম রেডিও, এএম রেডিও, এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল, মোবাইল ফোন, রাডার, সাবমেরিন, রিমোর্ট কন্ট্রোল খেলনার গাড়িতে এই রেডিও ওয়েব ব্যবহার করা হয়। এই রেডিওওয়েব ব্যবহার করে গ্রহ, ধূমকেতু, গ্রহাণু এবং অন্যান্য মহাকাশীয় বস্ত্তর একটি স্বচ্ছ দৃশ্য পাওয়া যায়। এই বিকিরণগুলি বৃষ্টি, কুয়াশা, সূর্যালোক ইত্যাদির মত প্রতিকূল আবহাওয়া দ্বারা প্রভাবিত হয় না। রেডিও তরঙ্গের এই বৈশিষ্ট্যটি বেতার জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করে মহাকাশীয় বস্ত্তগুলির গঠন, অবস্থান, গতি এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলি অধ্যয়ন করতে সক্ষম হচ্ছে। সুতরাং বলা যায় বর্তমান বিশ্ব এই রেডিওওয়েব ছাড়া সম্পূর্ণ অচল।

মাইক্রোওয়েব : সূর্য হ’তে আগত আরেক ধরনের তাড়িতচৌম্বক তরঙ্গ হ’ল মাইক্রোওয়েব। এর কম্পাংক ৩০০ মেগাহার্টয হ’তে ৩০০ গিগাহার্টয পর্যন্ত বিস্তৃত। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এর বিবিধ ব্যবহার বিদ্যমান। যথা: ওভেন, জিপিএস, রাডার, ব্লুটুথ, ওয়াইফাই, মেডিকেল যন্ত্রাদি, মিলিটারী অস্ত্রে এই মাইক্রোওয়েব ব্যবহার করা হয়। এছাড়া গামা রশ্মি, অবলোহিত রশ্মি অবতীর্ণ হয়, যা মানবজীবনে বিবিধ উপকার সাধন করছে।

পানিচক্র : পৃথিবীতে জীবন ধারনের জন্য পানি প্রয়োজন। পানি তিনটি অবস্থায় থাকে। যথা: কঠিন, তরল, বায়বীয়। পৃথিবীর জলবায়ু ব্যবস্থার মধ্যে বায়ু, মেঘ, মহাসাগর, হরদ, গাছপালা, স্নোপ্যাক ইত্যাদির মাধ্যমে পানি সংযোগ স্থাপন করে।

পানি জলীয়বাষ্প আকারে উপরে উত্থিত হয় এরপর মেঘ হিসাবে ঘনীভূত হয় এবং পরবর্তীতে বৃষ্টি এবং তুষার আকারে ঝরে পড়ে। পানি ভূমির ভিতর দিয়ে চলাচল করে যা উদ্ভিদ শোষণ করে এবং পাতার সাহায্যে বায়ুমন্ডলে জলীয়বাষ্প আকারে ছড়িয়ে দেয়। মানুষ তার প্রয়োজনে পানি পান করে, কল-কারখানার কাজে ব্যবহার করে।

উল্লেখ্য, ব্যবহারের কারণে পানি দূষিত হয়। এই দূষিত পানি মাটিতে গিয়ে পড়ে, বিশাল একটা অংশ সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। তখন এই পানি মাটির সাহায্যে পুনরায় বিশুদ্ধ হয়। সমুদ্রের পানি জলীয়বাষ্প আকারে উপরে উঠে মেঘে পরিণত হয়। এইভাবে পানিচক্র পৃথিবীর শুরু থেকে চলে আসছে। দূষিত পানি ভূমিতে যাচ্ছে বিশুদ্ধ হচ্ছে এবং পুনরায় ব্যবহারযোগ্য পানিতে পরিণত হচ্ছে। এভাবে অবিরাম এই প্রক্রিয়া চলছে।

পরিশেষে বলব, আমরা আল্লাহ তা‘আলার এই বিশ্ব পরিচালনার এক অনন্য পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে পারলাম। মূলতঃ বিজ্ঞানীরা আল্লাহ তা‘আলা যে পদ্ধতিতে এই বিশ্ব পরিচালনা করছেন সেই মেকানিজম অনুসরণ করে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করছে। যেমন- নাইট্রোজেনচক্র, ফসফরাসচক্র ব্যবহার করে কৃত্রিম সার তৈরী করছে। পানিচক্র ব্যবহার করে পানি বিশুদ্ধ করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে। অথচ আমরা আল্লাহ তা‘আলার এই সুমহান পরিচালনা সম্পর্কে জানতে পারার পরও পরকাল সম্পর্কে গাফেল রয়েছি। এই সকল বৈজ্ঞানিক নিদর্শন দেখে আমাদেরকে আল-কুরআন এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাতের উপর দৃঢ় ঈমান আনতে হবে এবং সে অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করতে হবে। তবেই আমরা কল্যাণ লাভ করতে পারব। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন!

ইঞ্জিনিয়ার আসীফুল ইসলাম চৌধুরী
আত-তাহরীক


১. উচ্চ মাধ্যমিক রসায়ন ২য় পত্র, ১ম অধ্যায়, হাজারী ও নাগ।
২. Britannica ready reference Encyclopedia, vol : 2.
৩. National Oceanic and Atmospheric Administration, water cycle.

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button