ইসলাম ও বিজ্ঞান

রক্ত ও মৃত জন্তুর গোশত ভক্ষণ হারাম হওয়ার বৈজ্ঞানিক কারণ

আমরা আমাদের ক্ষুধা নিবারণের জন্য শাক-সবজি, ফলমূল এবং বিভিন্ন ধরনের পশু-পাখির গোশত ভক্ষণ করে থাকি। কিন্তু আমরা কিভাবে জানবো যে, কোন ধরনের খাদ্য শরীরের জন্য উপযোগী এবং কোন ধরনের খাদ্য শরীরের জন্য ক্ষতিকারক। একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে গবেষণা করে বের করা সম্ভব নয় যে, কোন ধরনের খাদ্য গ্রহণ করা উচিত। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদের জন্য পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে হারাম এবং হালাল বর্ণনার মাধ্যমে সে কাজটি সহজ করে দিয়েছেন। এই প্রবন্ধে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে যে ধরনের পশুর গোশত খাওয়া হালাল এবং হারাম বর্ণিত হয়েছে তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রদান করব ইনশাআল্লাহ।

আমরা অনেকে মনে করি, আল্লাহ তা‘আলা যে সকল বস্ত্ত হারাম করেছেন তা কেবল আমাদের পরীক্ষা করার জন্য। যারা এই হারাম বস্ত্ত গ্রহণ করবে তারা ক্বিয়ামতের দিন শাস্তির সম্মুখীন হবে আর যারা তা হ’তে বিরত থাকবে তারা পুরস্কার প্রাপ্ত হবে। এই ধারণা পুরোপুরি সঠিক নয়। কারণ আল্লাহ তা‘আলা যতগুলো বস্ত্ত হারাম করেছেন প্রত্যেকটি বস্ত্ততে ক্ষতিকারক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা গ্রহণে শারীরিক ও মানসিক জটিলতার সম্মুখীন হ’তে হবে। অর্থাৎ হালাল ও হারামকৃত প্রতিটি বস্ত্তর পিছনে দুনিয়াবী কল্যাণ নিহিত রয়েছে।

আমরা যদি এই কল্যাণ জানতে পারি তবে আমাদের ঈমান বৃদ্ধি পাবে এবং তা পালন করার আগ্রহ আরো বেড়ে যাবে। আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীতে তাঁর বান্দাদের সুস্থভাবে জীবন যাপনের জন্য পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে মানুষের জন্য উপযোগী খাদ্যের বর্ণনা দিয়েছেন। আল্লাহ যে সকল পশুর গোশত হারাম ঘোষণা করেছেন তা ভক্ষণ করলে কি কি ক্ষতি হবে সেই বিবরণ নিম্নে পেশ করা হ’ল।-

আল্লাহ বলেন,إِنَّمَا حَرَّمَ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةَ وَالدَّمَ وَلَحْمَ الْخِنْزِيرِ وَمَا أُهِلَّ بِهِ لِغَيْرِ اللهِ فَمَنِ اضْطُرَّ غَيْرَ بَاغٍ وَلَا عَادٍ فَلَا إِثْمَ عَلَيْهِ إِنَّ اللهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ- ‘তিনি আললাহ্ তো কেবল তোমাদের উপর হারাম করেছেন মৃত জন্তু, রক্ত, শূকরের গোশ্ত এবং যার উপর আল্লাহর নাম ছাড়া অন্যের নাম উচচারিত হয়েছে, কিন্তু যে নিরুপায় অথচ নাফরমান এবং সীমালঙ্ঘনকারী নয় তার কোন পাপ হবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (বাক্বারাহ ৩/১৭৩)

এখানে তিনটি হারামের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে-

(১) মৃত জন্তু

(২) রক্ত এবং

(৩) শূকরের গোশত।

এক্ষণে আমরা দেখব মৃত জন্তু ও রক্তে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে কি কি ক্ষতি রয়েছে। মৃত জন্তু দুই প্রকার-

(১) শিকার করে হত্যাকৃত

(২) অন্যভাবে মৃত।

শিকার করে হত্যার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নির্দেশনা রয়েছে। 

আদী ইবনু হাতিম (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমি নবী করীম (ছাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আমি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিকারী কুকুরদের শিকার ধরার জন্য পাঠাই এবং তারা শিকার ধরে আমার কাছে নিয়ে আসে। আমি কি ঐ শিকারকৃত পশু ভক্ষণ করব? তখন তিনি বলেন, যদি তুমি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিকারী কুকুর (শিকারের জন্য) প্রেরণের সময় আল্লাহর নাম স্মরণ কর (বিসমিল্লাহ) বল, তবে তুমি তা ভক্ষণ কর, যা সে তোমার জন্য আটকিয়ে রাখে। আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম, যদি কুকুর তাকে (শিকারী পশুকে) হত্যা করে ফেলে? তিনি বলেন, যদিও সে তাকে হত্যা করে; যতক্ষণ না অন্য কোন কুকুর, যারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়, এ কাজে তোমার কুকুরের সাথে শরীক হয় (তা খেতে পার)। আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম, আমি পালকবিহীন তীরের সাহায্যে শিকার করি যা শিকারী জন্তুর দেহে বিদ্ধ হয়, আমি কি তা ভক্ষণ করতে পারি? তিনি বললেন, যদি তুমি আল্লাহর নাম স্মরণ করে পালকবিহীন তীর নিক্ষেপ কর এবং তা ঐ শিকারকৃত জন্তুর দেহে বিদ্ধ হয়ে তা ছিন্ন-ভিন্ন করে দেয়, তবে তুমি তা ভক্ষণ করতে পারবে। আর তীর যদি আড়-ভাবে শিকারী জন্তুর দেহে লাগার ফলে তা মারা যায়, আর রক্ত প্রবাহিত না হয়, তবে তা ভক্ষণ করবে না’।

অন্যত্র এসেছে, আদী ইবনু হাতিম (রাঃ) থেকে বর্ণিত, একদা আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞসা করি যে, আমি এসব প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর দিয়ে শিকার করে থাকি। তখন তিনি আমাকে বলেন, যখন তুমি তোমার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর শিকারের জন্য পাঠাবে এবং এ সময় আল্লাহর নাম স্মরণ করবে (বিসমিল্লাহ বলবে), তখন সে যা তোমার জন্য আটকিয়ে রাখবে, তা তুমি ভক্ষণ করতে পারবে, যদিও শিকারকৃত জন্তুকে মেরে ফেলে। তবে যদি কুকুরেরা তা থেকে কিছু খেয়ে ফেলে, তাহ’লে তুমি তা থেকে কিছু খাবে না। কেননা আমি ভয় করি যে, হয়ত সে (কুকুর) শিকারকৃত জন্তুকে নিজের জন্য শিকার করেছে’।

উপরের দু’টি হাদীছে লক্ষণীয় যে, শিকার দ্বারা নিহত পশুর ক্ষেত্রে দু’টি নির্দেশনা-

(১) তীর শিকারের গায়ে লাগার পর রক্ত বের না হ’লে সে পশুর গোশত ভক্ষণ করা যাবে না।

(২) কুকুর যদি শিকারকৃত পশুর কিছু অংশ খেয়ে ফেলে তবে ঐ পশুর গোশত খাওয়া যাবে না।

জীবিত পশুর শরীরে তীর লাগলে তা হ’তে রক্ত বের হবে কিন্তু মৃত পশুর শরীরে তীর লাগলে তা হ’তে রক্ত বের হবে না। কারণ মৃত্যুর পর দেহের রক্ত দ্রুত নষ্ট হয়ে যায় বা জমাট বেধে যায়। দেহের সক্রিয়তা বন্ধের সাথে সাথে দূষিত পদার্থ এসে রক্তে মিশ্রিত হ’তে থাকে। দূষিত পদার্থ যেমন- কার্বন ডাই অক্সাইড, ল্যাকটিক এসিড সহ অন্যান্য বস্ত্ত। জীবিত অবস্থায় এগুলো কিডনি ও ফুসফুসের মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত হয়। রক্তে ক্ষারের মাত্রা (pH) স্বাভাবিক অবস্থা থেকে পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং রক্ত জমাট বেধে যায়। ফলে মৃত দেহ হ’তে রক্ত বের হয় না। তাই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নির্দেশ দিয়েছেন পশুর শরীরে তীর বিদ্ধ হওয়ার পর যদি রক্ত প্রবাহিত না হয়, তবে সেই পশুর গোশত খাওয়া যাবে না কারণ তা আগে থেকেই মৃত।

মৃত পশুর গোশত খাওয়া কেন শরীরের জন্য ক্ষতিকারক?

২০১৮ সালের ২রা ফেব্রুয়ারী নিউজ ২৪-এ একটি ঘটনা প্রকাশিত হয় যে, আফ্রিকার মোপজো গ্রামের প্রায় ৫০ জন লোককে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, যারা সাপে কাটা একটি মৃত গরুর গোশত খেয়েছিল। এদের মধ্যে ১৬ জন শিশু গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং এদের মধ্য থেকে ৮ জনকে নেলসন ম্যান্ডেলা একাডেমিক হাসপাতালের শিশু বিভাগে স্থানান্তরিত করা হয়। রোগীরা ডায়রিয়া, বমি, মাথাব্যথা এবং পেটে ব্যথা অনুভব করেছিল, যা মূলত বিষক্রিয়ার লক্ষণ।

গবেষণায় দেখা গেছে পশু যে কারণে মারা যায় পশুর মৃত্যুর পরও তার কারণ ঐ পশুর শরীরে বর্তমান থাকে। যেমন-

(১) বিষক্রিয়ায় মৃত্যু : যখন একটি পশু সাপের কামড়ে, কুকুরের কামড়ে, বিষাক্ত ফল খেয়ে বা রাসায়নিক বিষক্রিয়ায় মৃত্যুবরণ করে তখন ঐ পশুর শরীরে সেই বিষের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। ফলে মানুষ যখন ঐ পশুর গোশত ভক্ষণ করে তখন সে ঐ বিষে আক্রান্ত হয়।

(২) রোগ-বালাই : পশুরা বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। যেমন: জলাতংক, ব্লাস্টোমাইকোসিস (এক ধরনের ফাংগাল ইনফেকশন) ও ব্যাক্টেরিয়া জনিত রোগ ইত্যাদি। কোন পশু যখন একটি রোগে মারা যায় তখন ঐ রোগ পশুর শরীরে ছেয়ে যায়। ফলে যখন মানুষ ঐ পশুর গোশত ভক্ষণ করে তখন মানুষ ঐ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

(৩) সীসার গুলি : অনেক সময় গুলি করে পশু হত্যা করা হয় এবং এই সবগুলি অনেক সময় সীসার তৈরী হয়ে থাকে। এই গুলিতে হত্যাকৃত পশুর গোশতে সীসার প্রভাব বিদ্যমান থাকে। গবেষকরা জানিয়েছেন যে, যখন সীসার বুলেট দ্বারা একটি পশু হত্যা করা হয় এবং গোশত ভক্ষণ করা হয় তখন মানুষের শরীরে সীসার প্রভাব চলে আসে। আর সীসা হ’ল একটি বিষাক্ত ধাতু যা খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করলে মস্তিষ্কের বিকাশ ব্যাহত হয় এবং কিডনি নষ্ট হয়ে যায়।

(৪) ব্যাকটেরিয়া : যখন একটি প্রাণী মৃত পাওয়া যায়, তখন কেউ নিশ্চিত হ’তে পারে না যে পশুর শরীরের টিস্যু কতক্ষণ ধরে ক্ষয় হচেছ। এটি প্রধানত ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতিতে হয়, যা গোশতকে মানুষের খাওয়ার জন্য অনুপযোগী করে তোলে। Escherichia coli (E. coli) ব্যাকটেরিয়া প্রায়ই মানুষের মধ্যে অসুস্থতা সৃষ্টি করে। কাঁচা বা কম রান্না করা গোশতে এই ব্যাক্টেরিয়া তৈরী হয়। লিস্টেরিওসিস হ’ল আরেকটি খাদ্য-বাহিত ব্যাকটেরিয়া যা মৃত পশুর শরীরে তৈরী হয়। যা গুরুতর অসুস্থতার কারণ হ’তে পারে, বিশেষ করে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম।

(৫) পরজীবী : মৃত পশুর গোশত অনেক সময় পরজীবী দ্বারা আক্রান্ত হ’তে পারে যেমন- কৃমি। এই ধরনের গোশত দূষিত হয়। যেমন- টেপওয়ার্ম, বিশেষ করে টেনিয়া সাগিনাটা (গরুর গোশতের ফিতাকৃমি) এবং টেনিয়া সোলিয়াম (শূকরের গোশতের ফিতাকৃমি)। এই পরজীবীগুলি বিশেষভাবে অল্প রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য যেমন খুব অল্প বয়স্ক ও বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য ক্ষতিকারক। কারণ এটি লিভারকে প্রভাবিত করতে পারে এবং গুরুতর স্বাস্থ্য জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।

এমন বিভিন্ন কারণে পশু মারা যাতে পারে এবং মৃত পশুর শরীরে উপরোক্ত সমস্যা থাকতে পারে। তাই একজন মানুষ মৃত পশুর গোশত ভক্ষণ করলে বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হ’তে পারে।

রক্ত খাওয়া কেন শরীরের জন্য ক্ষতিকারক?

রক্ত মানুষের শরীরের আবশ্যিক উপাদান যা ব্যতীত একজন মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। রক্তের চারটি মৌলিক উপাদান হ’ল-

(১) প্লাসমা

(২) লোহিত রক্ত কণিকা

(৩) শেত রক্ত কণিকা

(৪) পলাটিলেটস।রক্তের কাজ হ’ল ফুসফুস এবং কোষে অক্সিজেন ও পুষ্টি সরবরাহ করা, অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণ রোধে রক্ত জমাট বাধা এবং সংক্রমণের বিরুদ্ধে কোষ ও এন্টিবডি সরবরাহ করা। মানুষের শরীরে অনেক সময় রক্ত স্বল্পতা দেখা যায়, তখন ডাক্তারের পরামর্শে শিরা দিয়ে শরীরে রক্ত প্রবেশ করানো হয়। এখন প্রশ্ন হ’ল যে রক্ত শরীরের একটি মৌলিক উপাদান, যা না থাকলে মানুষ বাঁচবে না সেই রক্ত পান করা কেন ক্ষতিকারক?

কাঁচা গোশতের মতো, রক্তেও ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া এবং প্যাথোজেন থাকতে পারে যা খাদ্যে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে এবং হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি, নোরোভাইরাস বা এইচআইভি-এর মতো রোগের কারণ হ’তে পারে। এই কারণে গোশত রান্নার পূর্বে ভালোভাবে ধৌত করতে হয় এবং সিদ্ধ করতে হয়। যখন কেউ রক্ত পান করবে তখন তার শরীর অতিরিক্ত পরিমাণ আয়রণ গ্রহণ করবে আর শরীর যখন অতিরিক্ত পরিমাণ আয়রণ গ্রহণ করে তখন তাকে বলা হয় Hemochromatosis। আর কেউ যখন Hemochromatosis রোগে আক্রান্ত হয় তখন তার হার্ট, লিভার, অন্তঃস্রাবী সিস্টেম যা হরমোন নিঃসৃত করে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ কার্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে, অগ্নাশয় যা এক ধরনের রস নিঃসৃত করে যা পাকস্থলির খাদ্য হজমে সাহায্য করে এরূপ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই আল্লাহ তা‘আলা রক্ত পান করা হারাম করেছেন।

ইঞ্জিনিয়ার আসীফুল ইসলাম চৌধুরী


১. আবূদাঊদ হা/২৮৪৮।
২. আবূদাঊদ হা/২৮৪৯।
৩. Life, News24, 07 feb, 2018.
৪. American society of Hematology.
৫. Healthline, Alana Biggers, MD, MPH.
উৎস: মাসিক আত-তাহরীক

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button