বাংলাদেশের ১০টি প্রাচীন মসজিদ: দেশের ঐতিহাসিক স্থাপত্যের নিদর্শন
মধ্যযুগীয় পূর্ব সময় থেকে বর্তমান বাংলাদেশ নামে এই স্বাধীন ভূ-খণ্ডটি অনেক মুসলিম শাসক শাসন করেছেন। সেই সময় থেকেই ধীরে ধীরে বিবর্তন হয়েছে এই জায়গাটির সভ্যতা ও সংস্কৃতি। তৈরি হয়েছে প্রাসাদ, বিশাল জলাশয়, দূর্গ, কূপ, সেতু এমনকি গোটা একটা শহর। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে এই তল্লাটে স্থাপনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষনীয় ছিল মসজিদগুলো। এখানকার ধর্মপ্রাণ মানুষগুলোর প্রার্থনাসহ রীতিনীতি, দরবার-শালিস সব কিছু এই মসজিদ কেন্দ্রীক ছিল। তারই ফলস্বরূপ সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে প্রার্থনা কেন্দ্রগুলো। এই ছবি ব্লগটি সাজানো হয়েছে বাংলাদেশের এই ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শন প্রাচীন মসজিদ নিয়ে।
১. ষাট গম্বুজ মসজিদ, বাগেরহাট
বাংলা সালতানাতের সময় সুন্দরবনের গভর্নর খান জাহান আলী এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। এটি সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক মুসলিম স্মৃতিস্তম্ভগুলোর মধ্যে একটি। সাতটি সারিতে সাজানো ৭৭ নিচু গম্বুজ এবং প্রতিটি কোণে একটি করে গম্বুজ নিয়ে মোট গম্বুজ সংখ্যা ৮১টি। এখানকার চারটি টাওয়ারের মধ্যে আযান দেয়ার জন্য দুটি ব্যবহার করা হত। বিস্তীর্ণ নামাযের জায়গায় ২১টি কাতারে একসাথে প্রায় তিন হাজার মুসল্লি নামাজ পড়তে পারেন। ৬০টি সরু পাথরের স্তম্ভ গম্বুজগুলোকে ধরে রাখে। এই কারণেই মূলত একে ষাট গম্বুজ মসজিদ বলা হয়ে থাকে।
২. বাঘা মসজিদ, রাজশাহী
১৫২৩ থেকে ১৫২৪ সালে হোসেন শাহী রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা আলাউদ্দিন শাহের পুত্র সুলতান নুসরাত শাহ মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদের গম্বুজ ভেঙ্গে পড়লে ১৮৯৭ সালে ধ্বংস হওয়া মসজিদটি পুনর্নির্মাণ করা হয়। মসজিদটি ২৫৬ বিঘা জমির উপর অবস্থিত। মসজিদের আঙিনা সমতল ভূমি থেকে প্রায় ১০ ফুট উঁচু।
মসজিদের ভেতরে ছয়টি স্তম্ভ রয়েছে। মসজিদের চারটি খিলানে আঁকা শিল্পকর্মগুলো সে সময়ের দুর্দান্ত নকশার পরিচয় বহন করে। বাঘা মসজিদের দেয়াল ২ দশমিক ২২ মিটার পুরু। মসজিদটিতে মোট ১০টি গম্বুজ, চারটি মিনার ও পাঁচটি প্রবেশপথ রয়েছে। মসজিদের ভেতরে ও বাইরে সর্বত্রই টেরাকোটার নকশা।
৩. খান মোহাম্মদ মৃধা মসজিদ, ঢাকা
মুঘল শাসক নায়েব নাজিমের শাসনামলে কাজী আবদুল্লাহর নির্দেশে ১৭০৪ থেকে ১৭০৫ সালে খান মোহাম্মদ মৃধা মসজিদটি নির্মাণ করেন। তিন গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদটি মাটি থেকে প্রায় ১৭ ফুট উঁচু একটি মঞ্চের ওপর নির্মিত। চারটি মিনারের এই অপূর্ব মসজিদটি যেন আজও মুঘল আভিজাত্যের সাক্ষ্য দিচ্ছে। লালবাগ কেল্লা থেকে মাত্র আধ-কিলোমিটার দূরে প্রাচীর ঘেরা এই মসজিদটি লালবাগ কেল্লার গাম্ভীর্যের প্রতিকৃতি।
নামাযের জায়গার ক্ষেত্রফল ১১৫২ বর্গফুট। মসজিদের প্রবেশদ্বারগুলো বহুমুখী খিলান এবং উভয় পাশে সংযুক্ত স্তম্ভ দ্বারা নির্মিত। বর্তমানে এটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে সংরক্ষিত আছে।
৪. সাত গম্বুজ মসজিদ, ঢাকা
গভর্নর শায়েস্তা খান দ্বারা নির্মিত সাত গম্বুজ মসজিদ ঢাকার উত্তর-পশ্চিম উপকণ্ঠে মোহাম্মদপুর এলাকায় অবস্থিত। এটি ১৭ শতকে বাংলাদেশে প্রবর্তিত প্রাদেশিক মুঘল স্থাপত্যশৈলীর একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত। মসজিদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল এর নামাযের জায়গাকে আচ্ছাদিত করে সাতটি গম্বুজাকার মুকুট।
মাটি থেকে এর উচ্চতা ১৫ ফুট। সাত গম্বুজ মসজিদের বাইরের অংশটি ঢাকা মুঘল আমলের সমস্ত স্মৃতিস্তম্ভের মধ্যে সবচেয়ে উদ্ভাবনী। মিহরাবের অলঙ্করণগুলো হাজী খাজা শাহবাজের মসজিদে মিহরাবের অলঙ্করণের কথা মনে করিয়ে দেয়। নামাযের ঘরটির উপর সাধারণ তিনটি গম্বুজ ছাড়াও, চারটি ফাঁপা দ্বি-গম্বুজ বিশিষ্ট টাওয়ার রয়েছে, যার জন্য এর নাম সাত গম্বুজ মসজিদ হয়েছে। মসজিদের ইট-চুনের দেয়ালগুলো ৬ ফুট গভীর।
৫. উচাইল শঙ্করপাশা শাহী মসজিদ, হবিগঞ্জ
শংকরপাশা শাহী জামে মসজিদ হবিগঞ্জের একটি প্রাচীন মসজিদ। মসজিদে খোদাইকৃত শিলালিপি থেকে পাওয়া যায় যে, মসজিদটি ১২০৮ সালে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মজলিস আমিনের দ্বারা সম্পন্ন হয়েছিল। কালক্রমে এলাকাটি ঘন গাছপালা এবং বনভূমিতে আবদ্ধ হয়ে পড়ে।
সম্প্রতি আবারও এই মসজিদের সন্ধান পাওয়া যায়। এটি মূলত একতলা ভবনের চারটি গম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ। এর মূল ভবনে একটি বড় গম্বুজ এবং বারান্দায় তিনটি ছোট গম্বুজ রয়েছে। দেয়ালগুলোর পুরুত্ব প্রায় ১০ ফুট। নামাযের কক্ষের চার কোণে এবং বারান্দার দুই কোণে ছয়টি অলঙ্কার করা স্তম্ভ রয়েছে। মসজিদটির তিনটি দরজা, যার মাঝখানেরটি অন্যগুলোর চেয়ে অনেক বড়।
৬. জিলাদপুর মসজিদ, মৌলভিবাজার
আনুমাণিক ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে নির্মিত এই তিন গম্বুজ মসজিদ শ্রীমঙ্গলের বিলাশ নদীর তীরে অবস্থিত। মসজিদটির সাথে মজার একটি গল্প লোক মুখে শোনা যায়। একদিন গ্রামবাসীরা সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা একটি মসজিদ নির্মাণ করবে। মসজিদ নির্মাণের সমস্ত পরিকল্পনা করে সেদিন সবাই ঘুমাতে যায়। পরের দিন ঘুম থেকে উঠে ঘটনাস্থলে যেয়ে তিন গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদটি দেখে তাজ্জব হয়ে যায়। এই ঘটনা থেকে মসজিদটিকে জিলাদপুর গ্রামবাসী গায়েবী মসজিদ বলা শুরু করে, কারণ তাদের বিশ্বাস যে সেই রাতে জ্বীনরা এসে এই মসজিদ বানিয়েছে।
মসজিদটি তিন একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এবং একসাথে দেড় শতাধিক মুসল্লি নামায পড়তে পারে। মসজিদটি নিয়মিত রং এবং সংস্কার করা হয়।
৭. ছোট সোনা মসজিদ, নওয়াবগঞ্জ
এই মসজিদটি সুলতান হোসেন শাহের আমলে ১৪৯৩ থেকে ১৫১৯ সালে ওয়ালী মাহমুদ কর্তৃক নির্মিত হয়েছে। সেই সময়ে বেশ রাজকীয় নগরী গৌড়ে নির্মিত হয়েছিল এই মসজিদটি। চারটি দেয়ালই বাহ্যিকভাবে এবং কিছুটা অভ্যন্তরীণভাবেও গ্রানাইট পাথরের খণ্ড দিয়ে সাজানো। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে পরে সংরক্ষণ কাজের ফলে এই পাথরগুলো পশ্চিম প্রাচীরের দক্ষিণ দিক থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে। মসজিদের অভ্যন্তরে মোট পনেরটি ইউনিট রয়েছে, যার মধ্যে তিনটি আয়তক্ষেত্রাকার ইউনিট চৌচালা ভল্ট দিয়ে আচ্ছাদিত এবং বাকি বারোটি বর্গাকার ইউনিট প্রতিটি গম্বুজ দ্বারা আবৃত।
আলংকারিক মিহরাব এবং মসজিদের আঙিনা খুলে ফেলার পর মসজিদটি তার জৌলুস হারিয়েছে।
৮. কদম মোবারক মসজিদ, চট্রগ্রাম
মসজিদ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের জামালখান ওয়ার্ডে অবস্থিত। মুঘল সম্রাট মুহাম্মদ শাহের শাসনামলে ১৭২৩ সালে স্থানীয় ফৌজদার মুহাম্মদ ইয়াসিন এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। তিনটি গম্বুজ এবং দুটি খিলান সহ ছাদযুক্ত আয়তাকার মসজিদটি একটি উঁচু মঞ্চে নির্মিত হয়েছে। নামাযের কক্ষে তিন গম্বুজ বিশিষ্ট ছাদ রয়েছে এবং প্রাঙ্গণগুলো খিলান দিয়ে আবৃত।
মসজিদের পাঁচটি দরজা রয়েছে; তিনটি সম্মুখের দেয়ালে এবং বাকি দুটি প্রতিটি কক্ষের সাথে সংযুক্ত। মসজিদের অভ্যন্তরীণ দেয়ালগুলো আয়তাকার প্যানেল এবং কুলুঙ্গি দিয়ে অলঙ্কৃত ছিল। কদম মোবারক মসজিদ বর্তমানে একটি আবাসিক মাদরাসা, একটি কবরস্থান এবং একটি নতুন মসজিদ ভবন ইত্যাদিসহ একটি আধুনিক মসজিদ কমপ্লেক্স।
৯. বজরা শাহী মসজিদ, নোয়াখালী
১৮ শতকের এই মসজিদটি নোয়াখালী থেকে ২০ কিলোমিটার উত্তরে বজরা গ্রামে অবস্থিত। মাইজদীর আশেপাশের এলাকায় এটি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ। স্থানটি পূর্ব দিকে একটি অলঙ্কৃত প্রবেশদ্বারসহ প্রাচীর দ্বারা ঘেরা। পুরো মসজিদটাই একটি দিঘীর পশ্চিম দিকে উঁচু ভূমিতে অবস্থিত।
আয়তাকার মসজিদটির তিনটি গম্বুজ রয়েছে যার মাঝখানেরটি দু’পাশেরগুলোর চেয়ে বড় এবং চার কোণে অষ্টভুজাকৃতির টাওয়ার রয়েছে। পূর্ব দিকের সম্মুখভাগে তিনটি দরজা রয়েছে, কেন্দ্রীয়টি বাকিগুলোর চেয়ে বড়। প্রতিটি অর্ধগম্বুজ ভল্টের নিচে খোলা এবং সরু মিনার দ্বারা ঘেরা। দুটি বহুমুখী খিলান দ্বারা অভ্যন্তরটি তিনটি কুলুঙ্গিতে বিভক্ত।
১০. কুসুম্ব মসজিদ, মান্দা, নওগাঁ
নওগার কুসুম্বা গ্রামে অবস্থিত এই ঐতিহ্যবাহী মসজিদটিকে প্রায়ই বাংলাদেশের কালো মানিক বলা হয়। ১৫৫৮ থেকে ১৫৫৯ সালে শেষ সুরি শাসক সুলতান গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ-১ এর শাসন আমলে নির্মিত হয়েছিলো। নির্মাণের ভার পড়েছিলো রাজ্যের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সুলেমানের উপর। আয়তাকার মসজিদটির ছাদে রয়েছে ছয়টি গম্বুজ। এই মসজিদটি নির্মাণে যে পাথরগুলো ব্যবহার করা হয়েছিল তা ছিল কালো-ব্যাসল্ট ইট। এগুলো বিহার থেকে মসজিদ নির্মাণের জন্য আনা হয়েছিল। পাথর পরিবহন করা হয়েছিল জলপথ দিয়ে।
মসজিদটি সুরি শাসনের অধীনে নির্মিত হলেও এটি রোহিঙ্গা মুসলমানদের স্থাপত্যশৈলী দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। কুসুম্বা মসজিদ বাংলাদেশ ও মায়ানমারের অন্যান্য মসজিদের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে।