জীবনের বাঁকে বাঁকে

কন্যার দু‘আ!

এক মহিয়সী আরব মহিলার জীবন থেকে নেয়া ঘটনা। ঘটনা খুব বেশিদিন আগের নয়। এই তো বছর দুয়েক আগের। তিনি বলেছেন:

-আমার বিয়ে যখন হলো, আমার স্বামী ছিলেন একজন টগবগে তরুন। প্রাণোচ্ছল যুবাপুরুষ। সবকিছুতেই আনন্দ খুঁজে পান। মন খারাপ হওয়া বা বিষন্নতা বলতে কিছুই ছিল না তার জীবনে। তার সঙ্গ পেয়ে আমার মতো গম্ভীর মেয়েও কলকলে তরুনীতে পরিণত হলাম। দু’জনের সংসার সব সময় আনন্দে কলকল করতো।

.

আমরা থাকতাম শহরের ছোট্ট একটি বাসায়। দু’কামরার। ছিমছাম। নির্ঝঞ্ঝাট। নিরুপদ্রব। তার চাকরিক্ষেত্র থেকে আমাদের বাসার দূরত্ব খুব বেশি ছিল না। অফিসের গাড়ি এসে তুলে নিয়ে যেতো। সেজন্যই এখানে থাকা। তার বাবা মা থাকতেন উল্টো দিকের এক গ্রামে। প্রতি সপ্তাহে দু’তিনদিন বাবা-মায়ের কাছেও রাতে থাকতে যেতো। তার মতো বাবা-মা অন্তপ্রাণ ছেলে এ-যুগে বিরল। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা আর আন্তরিকতা দেখে অবাক হয়ে যেতাম।

বুড়ো-বুড়ির যাতে কোনও প্রকারের কষ্ট না হয় সেদিকে তার প্রখর দৃষ্টি। না পারতেই সে আমাদের নিয়ে আলাদা বাসায় থাকছে। যাতায়াত সুবিধের কারনে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে একটা কন্যা দান করলেন। এবার একটা বড় বাসা নিয়ে বাবা-মাকেও এখানে নিয়ে এল। এভাবে বিয়ের পর চার বছর কোন ফাঁকে কেটে গেলো, টেরটিও পেলাম না। বিয়ের পঞ্চম বছরের মাথায়, অফিসে যাওয়ার পথে, তাদের গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়লো।

.

অনেক হতাহত হলো। আমার স্বামীর অবস্থা ভীষন গুরুতরো! আমার বৃদ্ধ শ্বশুর দিশেহারা হয়ে ছোটাছুটি শুরু করে দিলেন। দৌড়ঝাঁপ করে যথাসম্ভব চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন। অফিস থেকেও প্রয়োজনীয় সাহায্য দেয়া হলো। কিন্তু আঘাতটা মাথায় লাগাতে তার চেতনা ঠিকমতো ফিরে আসছিল না। সে প্রায় অর্ধমৃত। হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেয়া হলো। বাড়িতে নিয়ে এলাম।

.

শুরু হলো জীবনের কঠিনতম অধ্যায়। সংসারের খরচ জোগাড় করা, স্বামীর সেবা করা, বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ির দেখাশোনা করা। এদিকে মেয়েটাও বড় হয়েছে। ডাক্তাররা কোনও আশাই দিলো না। আমার বাড়ি থেকে চাপ দেয়া হলো, স্বামীর ঘর ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে। আমার বয়েস কম, আবার বিয়ের ব্যবস্থা করা হবে। পাত্রও তৈরী আছে।

.

আমার বিবেকে বাধা দিল। এভাবেই দিন গিয়ে মাস হলো। মাস পার হয়ে বছর ঘুরল। স্বামীর কোনও উন্নতি নেই। সেই আগের মতোই আছে নির্জীব! নিস্পন্দ! নিথর! বাবা মা আর কতোদিন অপেক্ষা করবেন? তারা আমার অবস্থা বুঝতে পারছিলেন। এখানে যে কোনও ভবিষ্যত নেই সেটা একটা বালকও বুঝতে পারবে। এভাবে কেটে গেলো পাঁচটি বছর।

.

আব্বা একদিন মুফতির ফতোয়া নিয়ে এলেন। স্বামীকে ছেড়ে যেতে শরীয়তে কোনও বাধা নেই। বেশ জোরাজুরি করলেন। রাগারাগি করলেন। আমি কেন যেন সায় দিতে পারলাম না। মেয়ে হেফযখানায় পড়ে। হেফয প্রায় শেষ হয়ে এসেছে!

আমরা পালাক্রমে রুগীর সেবা করি। একদিন আমি রাত জাগি, আরেকদিন মেয়েটা। তার বয়েস অল্প হলেও সময়ের ফেরে অনেক কিছু শিখে ফেলেছে। বুঝতেও শিখেছে। আমরা মা মেয়ে দু’জনেই আল্লাহর কাছে হরওয়াক্ত দু‘আ করে যাচ্ছি। মানুষটাকে যেন আল্লাহ সুস্থ করে দেন। সাধ্যমতো সাদাকা করছি। শাশুড়ী তো জায়নামায থেকেই নড়েন না বলতে গেলে। শ্বশুর বুড়ো হলেও সংসারের টুকিটাকি কাজ করতে পারেন। তিনিও ছেলের জন্যে কিছু করতে মুখিয়ে থাকেন।

মেয়েটার হেফয শেষ হলো। ছোটখাট একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো। আমরা-আমরাই। ঘরের মানুষেরা মিলে। বাইরের মানুষ বলতে মেয়ের হেফযখানার শিক্ষক। তিনি এসে দু‘আ করে গেলেন। আল্লাহর কাছে দু‘আ করতে বললেন। সাদাকা চালিয়ে যেতে বললেন। বাবা মাকে দু‘আ করতে বললেন। তাদের দু‘আ অনেক কাজে লাগবে!

সেদিন রাত জাগার পালা ছিল মেয়ের। বাবাকে ওষুধ খাইয়ে খাটের বাজুতে মাথা রেখে ঘুমুচ্ছিল। মধ্যরাতে আবার ওষুধ খাওয়াবে! কী মনে করে, মাধা ঝাড়া দিয়ে উঠলো। সূরা বাকারা তিলাওয়াত শুরু করে দিল। শেষ করতে করতে আবার চোখে ঘুম নেমে এল। ঘুমন্ত অবস্থাতেই তার মনে হলো, কে একজন তার নাম ধরে ডেকে বলছে:

-ওঠো ওঠো! ঘুমিও না! তোমার দয়ালু রব জেগে আছেন, তুমি কেন ঘুমিয়ে আছো? এখন দু‘আ কবুলের সময়! ওজু করে নামায পড়ো। আল্লাহর কাছে দু‘আ করো! তুমি যা চাইবে তিনি দিয়ে দেবেন!

.

মেয়ে ধড়মর করে উঠে বসলো। তাড়াতাড়ি ওজু সেরে নামাযে দাঁড়াল! আল্লাহর কাছে দু’হাত তুলে দু‘আ করলো। আকুল কান্নায় ভেসে বাবার সুস্থ্যতা কামনা করলো। আবার আগের মতো বাবার খাটের পাশটিতে এসে বসলো। এক সময় ঘুম এসে গেলো। ফজরের নামাযের সময় একটা আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো:

-এই মেয়ে তুমি কে? এখানে কেন ঘুমিয়ে আছো?

চোখ মেলে দেখে বাবা তার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। চোখে প্রশ্ন। আবার প্রশ্ন করলেন: তুমি কে?

.

উত্তর দিবে কী, মেয়েটা আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলো। চেঁচিয়ে আমাকে ডাকল। দাদা-দাদুকে ডাকল! আব্বু আব্বু কথা বলছেন! আব্বু কথা বলছেন! সবাই ঘুম চোখে ছুটে এল। হাসি-কান্নায় একাকার! আল্লাহর আজীব কারিশমা! তার কুদরত বোঝা বান্দাহর সাধ্যে কুলোবে না! আমাদের সংসারটা আবার আগের মতো হয়ে গেলো। আনন্দ আর সুখ ফিরে এল! আল্লাহ কেন পরীক্ষা দিয়েছিলেন, কেন মাফ করে দিলেন, সেটা নিয়ে আমাদের কোনও মাথাব্যথা নেই! তিনি খুশি হলেই আমরা খুশি!


কৃতজ্ঞতাঃ শায়েখ Atik Ullah Atik (হাফিজাহুল্লাহ্)

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button