জেনারেশনের দোষ
মনটা খারাপ হয়ে গেল ফোনে কথা বলার পর। পরিচিত এক আত্মীয়ের বাচ্চা নাকি দামি মোবাইল চেয়েছিল, সেটা ওর বাবা দেয়নি বলে রাগ করে বাচ্চাটা বাসায় ফেরেনি দুই দিন হল!
সবাই সব জায়গায় খুঁজল, আমার বাসায় আসছে কি না খোঁজ নিল। মায়ের মন কি মানে? কী কান্না! মনটা খারাপ হয়ে গেল!
আসলেই বাচ্চা যদি এমন করে, কোনও মা-বাবা কি মানতে পারে? ঠিকমতো পড়াশোনা করে না, টিকটক করে, এলাকায় নাকি এমন ছোটখাটো একটা গ্রুপও বানিয়ে ফেলেছে!
ছেলেমেয়ে নেচেগেয়ে কী সব টিকটক বানায়, এই জন্য দামি মোবাইল লাগবে, কিন্ত ছেলের বাবা তো মানতে রাজি না। বাচ্চার মা বলল, ‘আপা, সময়টাই এমন, জেনারেশনের দোষ। তাই ছেলে যখন যা চায় তাই দিই। এইবার ওর বাবা দিল না, তাই ছেলে রাগ করে বাসা থেকে গায়েব!’
আসলে আমরা সবাই সময়টাকে দোষারোপ করি। জেনারেশনই নাকি এমন যে মোবাইল ছাড়া এদের চলে না! পড়াশোনা শুধু এখন মুখের কথা।
নিজে নিজে ভাবলাম আসলে সময় বা জেনারেশন কীভাবে খারাপ হতে পারে?
যেই জেনারেশন বা প্রজন্ম শুরু করে মানুষ। সেই জেনারেশন মানুষকে খারাপ করবে কীভাবে?
আমার বাসায় যদি আমি বাচ্চার সাথে খারাপ ব্যবহার করি, তার কথা মনোযোগ দিয়ে না শুনি, তাহলে আমার বাচ্চাটা কি পরে আমার কোন কথা শুনবে, বা ভাল ব্যবহার করবে? আর এই খারাপ ব্যবহারের জন্য আমি নিজে দোষী না হয়ে জেনারেশনকে দায়ী করব?
বাসায় টেলিভিশন চালিয়ে মুভি, সিরিয়াল আমি দেখব, আর আমার বাচ্চা যদি এই মুভি সিরিয়ালের নায়ক-নায়িকাদের মত চলাফেরা করতে চায়, তাহলে জেনারেশন খারাপ এই ভেবে বাচ্চাকে উল্টা শাসন করব?
যেখানে আমার উচিত ছিল এমন কিছু একেবারেই না দেখা, যেটা দেখলে আমার বাচ্চার মানসিক ক্ষতি হতে পারে, সেখানে আমি নিজে এখানে সাধু সেজে বাচ্চাকে বকা দিচ্ছি।
স্কুল বা কলেজ, কম্বাইনড হওয়ার পরও ভাল ও নামিদামি বলে কম্বাইনড স্কুল কলেজে সন্তানদের ভর্তি করাচ্ছি। সেই ছেলেমেয়ে একসাথে লেখাপড়া করার পাশাপাশি যখন একে অন্যের ফ্রেন্ড হয়ে হেসে গায়ে ঢুলে পড়ছে, কথায় কথায় দুষ্টামির ছলে গায়ে হাত দিচ্ছে, এগুলো দেখে মডার্ন যামানা বলে চালিয়ে দিচ্ছি, আর কোনও অঘটন ঘটলে তখন দিনকাল খারাপ বলে, কপালের লিখন বলে হা-হুতাশ করছি।
এখানে আসল দোষটা কার, সেটাই খুঁজে পাচ্ছি না!
নিজে কোনরকম নামায পড়ছি, কিন্ত সন্তান ঠিকমতো ধর্মীয় সব কিছু পালন করছে কি না, সেটা দেখার সময় নেই! আমার নিজের সময়ই চলে যাচ্ছে মোবাইলের পেছনে, আর বলছি সব ডিজিটাল যুগের জন্য হচ্ছে!
ফেসবুকে সবার খোঁজ নিতে নিতে নিজের বাচ্চার সাথে সময় কাটানোর মতো সময় হয় না। মা-বাবা যে সন্তানের প্রথম শিক্ষক, সেটা যেন ভুলতে বসেছি। মোটা অংকের টাকা দিয়ে টিচার রেখেছি সবকিছু শেখানোর জন্য।
লেখাপড়া শেষে তারা যখন অনৈতিক কাজে ঢুকে যাচ্ছে, তখন লেখাপড়ার গুণ নেই বলে নিজের দোষ ঢাকার চেষ্টা করছি। যেখানে মা-বাবা হিসেবে আমাদের উচিত ছিল সন্তানকে নৈতিকতা শিক্ষা দেয়ার।
আসলে দোষটা জেনারেশনের না, দোষটা মা-বাবা হিসেবে আমাদের। সমবয়সী দুটো বাচ্চার বাসায় গেলাম আমি, এক বাচ্চা মোবাইল হাতে নিয়ে ব্যস্ত, বাসায় কে এসেছে সেটা দেখার তার কোন সময় নেই! কিন্ত আরেকটা বাচ্চা দরজা খুলে সালাম দিয়ে হাসিমুখে কুশল বিনিময় করল, পাশে বসে গল্প করল!
এখানে দুইটা বাচ্চারই কিন্ত জেনারেশন এক, তাহলে আসল দোষটা কার?
#রৌদ্রময়ী