আত্মোপলব্ধি

এখন শীতকাল

কিছু কিছু ঋতু আছে যা একেবারে ডাক-ঢোল পিটিয়ে, সাজ সাজ রবে আমাদের কাছে এসে ধরা দেয়। শীতকাল ঠিক এমনই একটা ঋতু। গাছেরা যেন গা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে। বন-ঝাঁড়-জঙ্গল গমগম করে ঝরা পাতার মর্মর শব্দে। সকাল আর সন্ধ্যের কুয়াশাচ্ছন্ন সময়, পত্র-পল্লবে মিশে থাকা শিশির বিন্দু, গা জুড়োনো নরোম রোদ এবং চারদিকে পিঠা-পুলির ঘ্রাণ—মন মাতিয়ে রাখার জন্যে শীত ঋতুর জুড়ি মেলাই ভার!

তবে, এটাও ঠিক যে—শীত হলো চরম এক আলসে ঋতু। রোদ আর আলোর অপর্যাপ্ততা, ভারি বাতাস এবং ঠাণ্ডার আবহ দেহ আর মনকে ভার করে তোলে। কাজেকর্মে চটপটে ভাবটা ক্ষীণ হয়ে আসে বেশ। বয়স্কদের জন্য এই ঋতু তো অত্যন্ত বেদনাদায়ক বটেই!

আজকালকার সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে শীতকালকে কেন্দ্র করে নানান ধরণের ফ্যাসিনেশান চোখে পড়ে। অবিবাহিতরা হাপিত্যেশে ভুগেন—আরেকটা শীতকাল চলে এলো, বিয়ে করা হলো না। এই মজা-মস্করাগুলো খেলাচ্ছলে হলে ঠিক আছে, কিন্তু শীতকাল মানেই শুধু বিয়ে আর পিঠা-পুলির ঋতু নয়। আমাদের সালাফ, অর্থাৎ নেককার পূর্বসূরীদের জীবনে শীতকাল ছিলো অত্যন্ত দামি একটা ঋতু। শীতকাল তাদের জীবনে বসন্তকাল হয়ে ধরা দিতো।

যুগ তো পাল্টেছে। এখন শীতকাল আসলে আমরা বিয়ের আলাপে মশগুল হই। পিঠা-পুলির উৎসবে শামিল হই। শীতের দিনে সাজেক, সেন্টমার্টিন, শিলিগুড়ি বা দার্জিলিং বেড়াতে যাওয়ার যোগাড়যন্ত করি। আমাদের পূর্বসূরীদের জীবনেও শীতকাল আসতো এবং সেই শীতকালে তারা আমগ্ন ডুবে থাকতো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার ইবাদাতে। কারণ শীতকাল এমন একটা ঋতু যে ঋতুতে ইবাদাত করা অত্যন্ত সহজ। শীতকালের দিনগুলো হয় খুবই সংক্ষিপ্ত—চোখের পলকে যোহর, যোহর থেকে আসর, আসর থেকে মাগরিব আর মাগরিব থেকে ইশা। অন্যদিকে, শীতকালের রাতগুলো হয় সুদীর্ঘ। রাত তিনটেয় ঘুম ভেঙে গেলে মনে হয় যেনো সেই কবে থেকে ঘুমোচ্ছি! দিন ছোট হওয়ার কারণে শীতকালে নফল সিয়াম রাখা সহজ হয়। বেশি ক্ষুধা লাগে না। রোদের সীমাহীন তেজ না থাকায় তৃষ্ণায় বুক ফাটে না। অন্যদিকে রাত বড় হওয়ায় পর্যাপ্ত ঘুমিয়ে নিয়ে, শেষ রাতে উঠে তাহাজ্জুদ আদায় করা যায়।

শীতকাল আসলে উবাইদ ইবন উমাইর রাহিমাহুল্লাহ বলতেন, ‘ওহে লোকসকল! তোমাদের ইবাদাতের জন্য রাত এখন দীর্ঘ, আর সিয়াম পালনের জন্য দিন এখন বড়ো সংক্ষিপ্ত। বেখেয়াল হয়ো না। সুযোগ লুপে নাও’।

খেয়াল করলে দেখবেন, শীতকালে রাত নয়টা বাজলে মনে হয় যেন কতো গভীর রাত হয়ে গেছে। অথচ, এই ক’দিন আগেও, রাত নয়টাকে আপনার কাছে সন্ধ্যা মনে হতো। ঘড়ির কাঁটায় এগারোটা না বাজলে তো রাত নেমেছে বলে মনেই হতো না। আর এখন রাত দশটা মানেই নিঝুম রাত!

আল্লাহর রাসূল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ হলো তিনি রাতের খাবার দ্রুত খেতেন। সন্ধ্যার দিকেই খেয়ে নিতেন যেটুক খাওয়ার। ইশার পরে খুব কম কথা বলতেন এবং দ্রুত ঘুমিয়ে পড়তেন। তাড়াতাড়ি খাওয়া আর তাড়াতাড়ি ঘুমোনোর উপকারিতা হলো এই—মাঝ রাত হতে হতেই আপনার শরীর হালকা হয়ে যাবে এবং খুব সহজেই বিছানা ছেড়ে উঠা যাবে।

শীতকালে আমরা নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই অভ্যেশটা রপ্ত করতে পারি—তাড়াতাড়ি খাওয়া আর তাড়াতাড়ি ঘুমোনো। ইশার ঠিক আগে বা পরে খেয়ে নিয়ে যদি আমরা রাত দশটার মধ্যে ঘুমিয়ে যেতে পারি, দশটা থেকে যদি রাতের চারটা অবধিও ঘুমোই, তাহলে গুনে গুনে পাক্কা ছয় ঘণ্টা আমাদের ঘুম হবে! ছয় ঘণ্টা ঘুম একজন স্বাভাবিক মানুষের জন্য একেবারেই যথেষ্ট! এখন তো ফযর ওয়াক্ত শুরু হয় প্রায় পাঁচটার দিকে, তাই চারটায় জাগলে আমাদের হাতে কাঁটায় কাঁটায় একঘণ্টা থাকে কিয়ামুল লাইল তথা তাহাজ্জুদ আদায়ের জন্য। পনেরো অথবা বিশ মিনিট যদি ফ্রেশ হওয়া, অযূ করা এসবে লেগে যায়, বাকি চল্লিশ মিনিট থাকছে জায়নামাযে দাঁড়ানোর জন্য। প্রতিদিন শেষ রাতে চল্লিশ মিনিট আপনি তাহাজ্জুদে দাঁড়াচ্ছেন—কী এক চমৎকার ব্যাপার, তাই না?

শীতকালে যেহেতু রাত দীর্ঘ হয় এবং তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়া সহজ হয় গ্রীষ্মকালের তুলনায়, ওদিকে ফযরও শুরু হয় বেশ দেরিতে, তাই শীতকালে তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করা একদমই সহজ যদি একটু আন্তরিকভাবে চেষ্টা করা হয়।

শীতের দিনগুলো তুলনামূলক নাতিদীর্ঘ, অর্থাৎ ছোট হওয়ায় দিনের বেলা সিয়াম পালনে কোনো কষ্ট অনুভূত হয় না। যারা সিয়াম পালন করতে ইচ্ছুক, তারা যদি রাত চারটায় জাগার বদলে সাড়ে তিনটায় জাগেন, তাহলে সাহুর খেয়ে কিয়ামুল লাইলে দাঁড়ানোর জন্যে পর্যাপ্ত সময় হাতে থাকবে। শীতের দিন এতো দ্রুত, চোখের পলকে কেটে যায় যে—অনেকসময় আপনার খেয়ালও থাকবে না যে আপনি সিয়াম রেখেছেন।

শীতকালে দিনের বেলা সিয়াম আর রাতের বেলা তাহাজ্জুদ আদায় অনেক সহজ হয়ে যায়। আল্লাহর যেসকল বান্দা সারাবছর ইবাদাতে পিছিয়ে থাকে, তাদের জন্য চমৎকার সুযোগ নিয়ে আসে এই শীত ঋতু। আর তাছাড়া, শীত ঋতুতে গরিবদের সাহায্য সহযোগিতাও করার সুযোগ আসে ব্যাপকভাবে। আমাদের দেশের নানান জায়গায় শীতের তীব্রতায় কষ্ট পায় হাজারো মানুষ। একটা কম্বল, অল্প চাল-ডাল হয়তো তাদের মুখে ফোটাতে পারে অনিন্দ্য হাসি। সিয়াম আর কিয়ামুল লাইলের বাইরে, এ-সমস্ত গরিব মানুষগুলোর পাশেও আমরা দাঁড়াতে ভুলবো না, ইন শা আল্লাহ।

শীত হলো ইবাদাতে মগ্ন হওয়ার ঋতু। এখন শীতকাল। ফ্যান্টাসি নয়, এই শীত হয়ে উঠুক রবের নৈকট্য হাসিলের অপূর্ব উপাখ্যান।

– আরিফ আজাদ

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button