আত্মোপলব্ধি

ইবাদাতে আত্মতুষ্টির ভয়াবহতা

একজন মানুষ গুনাহ করছে আর সে গুনাহ তাকে জান্নাতে নিয়ে যাচ্ছে। আরেকজন ভালো ভালো কাজ করছে কিন্তু সে কাজ তাকে জাহান্নামে নিয়ে যাচ্ছে।
অদ্ভুত লাগে না শুনতে?
আমাদের একজন সালাফ এমনটাই বলেছেন। তাকে এ অদ্ভুত ব্যাপার কীভাবে হওয়া সম্ভব জিজ্ঞেস করা হলে তিনি তা ব্যাখ্যাও করেছেন। ইবনুল কায়্যিম (রহ) তার বইয়ে সে ব্যাখ্যার কথা লিখেছেন এভাবে—

“কেউ একটা গুনাহের কাজ করে ফেলতে পারে। আর তারপর সে গুনাহ নিয়েই সবসময় ভাবতে থাকে। দাঁড়ানো কিংবা বসা অবস্থায়, এমনকি চলাফেরার সময়েও তার সে গুনাহের কথা মনে পড়ে যায়। তখন সে লজ্জিত হয়। তওবা করে। (আল্লাহর কাছে) ক্ষমা চায় আর প্রচণ্ড অনুশোচনায় ভুগে। আর (এ অনুশোচনাই) একসময় তার নাজাতের উসীলা হয়ে যায়।

আবার কেউ একটা ভালো কাজ করতে পারে আর সে কাজ নিয়ে চিন্তা করতে থাকে। উঠতে, বসতে, হাঁটাচলার সময় তার সেই ভালো কাজের কথা মনে হয়। এভাবে আত্মপ্রশংসা আর অহংকার দ্বারা তার মন পূর্ণ হয়। শেষ পর্যন্ত (এ ভালো কাজই) তার সর্বনাশের কারণ হয়।

তাই কখনো কখনো গুনাহই বান্দাকে অনেক ভালো কাজ ও ইবাদতের দিকে নিয়ে যায়। তার আচরণ বদলে যায়। যার ফলে সে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহর সামনে লজ্জিত হয় এবং বিনয় প্রকাশ করে। লজ্জায় তার মাথা নত হয়ে যায়, অনুশোচনায় সে অনেক কান্নাকাটি করে আর তার রবের কাছে ক্ষমা চায়। এ প্রত্যেকটি কাজই ঐ ব্যক্তির জন্য উত্তম তার সেসব ইবাদতের চেয়ে যা তাকে অহংকারী করে, মানুষের সামনে নিজেকে জাহির করতে উব্ধুদ্ধ করে আর মানুষকে নীচু করে দেখার মানসিকতা তৈরী করে।

নিঃসন্দেহে আল্লাহর সামনে ঐ (পাপীর) গুনাহই বেশি উত্তম, ঐ গুনাহই নাজাতের উসীলা হয় সে ব্যক্তির ভালো কাজের চেয়ে— যে নিজের প্রশংসা করে, মানুষকে ছোট করে দেখে আর ভাবে যে সে আল্লাহর অনেক বড়ো খেদমত করে ফেলেছে। যদিও তার কথায় এমন কিছু প্রকাশ পায় না। কিন্তু আল্লাহ জানেন তার অন্তরে কী আছে।
এ ধরনের ব্যক্তি সেসব মানুষের ব্যাপারে বিদ্বেষ পুষে রাখে যারা তাকে অনেক সম্মান দেয় না আর তার সামনে হুজুর হুজুর করে না। সে যদি নিজেকে মন থেকে পরখ করে, তবে (এ কথার সত্যতা) স্পষ্ট দেখতে পাবে।” (মাদারিজুস সালেকীন, ১/৩০৭-০৮)

রাসূল (সা) তাই বলেছেন, “বান্দা পাপ করবে, আর আল্লাহ তাকে এর জন্য জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।” সাহাবিগণ অবাক হয়ে জানতে চাইলেন, “হে আল্লাহ্‌র রাসূল! পাপ কেমন করে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে?”
রাসূল (সা) বললেন, “সে পাপ (সারাক্ষণ) তার চোখের সামনে ভেসে বেড়াবে, ফলে সে (এ ধরনের পাপ থেকে) পালিয়ে বেড়াবে এবং এর জন্য তওবা করতে থাকবে। শেষ পর্যন্ত এ পাপই তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে।” (কিতাবুয যুহদ, হাদিস নংঃ ২১৯)

নতুন দ্বীন পালন করা ভাই-বোনদের মধ্যে অনেক সময় ধার্মিকতা নিয়ে প্রচণ্ড অহংকার দেখা যায়। প্রায়ই তাদের বলতে শোনা যায়, “অমুক এই জঘন্য কাজ করে। ও তো পুরাই জাহেল। আর তমুক ঐ হারাম কাজটা করে। সে তো একেবারেই ফাসিক।”

হ্যাঁ, খারাপ কাজের সমালোচনা তো হবেই। তবে তার আগে যে এই কাজে লিপ্ত তার মনোভাব বুঝতে হবে। যারা হারাম কাজে লিপ্ত থাকে তারা মূলত তিন ধরনের হয়। এক শ্রেণীর লোক আছে যারা প্রকাশ্যে খারাপ কাজ করে বেড়ায়, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদেশকে কাঁচকলা দেখায় আর মানসিকতার দিক থেকেও প্রচণ্ড অহংকারী হয়, তারা এখানে অবশ্যই হিসাবের বাইরে। তাদের খারাপ কাজ সম্পর্কে তো মানুষকে সতর্ক করতে হবেই।
দ্বিতীয় শ্রেণীর লোক আছে, যারা হারামে লিপ্ত হয়েছে কিন্তু তওবা করেছে। আর তৃতীয় শ্রেণীর লোক আছে, যারা তওবা করেনি বটে কিন্তু গুনাহগুলোকে গোপন রেখেছে। শেষ দুই প্রকারকে তাদের গুনাহ নিয়ে প্রকাশ্যে লজ্জা দিতে সালাফরা নিষেধ করেছেন।

ধার্মিকতা নিয়ে যারা সুপিরিউরিটি কমপ্লেক্সে ভুগে আর আরেক ভাইয়ের নিন্দা করে বেড়ায়, তাদের সম্পর্কে ইবনুল কায়্যিম (রহ) লিখেছেন—
“তোমার ভাইকে তার গুনাহের কারণে ছোট করার কারণে তোমার যে গুনাহ হচ্ছে তা তোমার ভাইয়ের গুনাহের চেয়েও বেশি। কারণ, এটা দ্বারা বুঝাচ্ছে, তুমি তোমার ধার্মিকতার জন্য আত্মতুষ্টিতে ভুগছ আর নিজেকে গুনাহ থেকে নিরাপদ ভাবছ। আর অন্যদিকে, তোমার ভাই গুনাহে লিপ্ত হয়ে পড়েছে।

কিন্তু এমনো তো হতে পারে, সে এই গুনাহের কারণে (আল্লাহর সামনে) নত হয়েছে। (এই গুনাহের কারণে) তার নত ও বিনয়ী হওয়া, নিজেকে বড়ো কিছু না ভাবা, (মানুষের সামনে) ধার্মিক ভাব প্রকাশ থেকে বিরত হওয়া, অহংকার আর আত্ম-গরিমা দূর হয়ে যাওয়া, আল্লাহর সামনে ভাঙ্গা হৃদয় নিয়ে মাথা নীচু করে দাঁড়ানো- এসব কিছু তোমার আনুগত্যের অহংকার, খুব ভালো কাজ করে ফেলেছ এমনটা ভাবা, আর এসব ভালো কাজ করে তুমি আহামরি কেউ হয়ে গেছো এটা আল্লাহ তা‘আলা ও মানুষকে বারবার মনে করিয়ে দেয়া- এসবের চেয়ে অনেক গুণে উত্তম।

সেই গুনাহগার আল্লাহর রহমতের কতোই না কাছে, আর সেই দাম্ভিকও আল্লাহর ক্রোধের কতোই না কাছে। যে গুনাহ নম্রতার দিকে নিয়ে যায় তা আল্লাহর কাছে সে ভালো কাজের চেয়ে উত্তম যা মানুষের অন্তরটাকে অহমে পূর্ণ করে দেয়। তুমি যদি সারা রাত ঘুমাও আর সকালে (কিয়ামুল লাইল না পড়ার) অনুশোচনা নিয়ে উঠো- এটা তার চেয়ে উত্তম, যে সারা রাত ইবাদত করেছে আর সকালে আত্মতুষ্টি নিয়ে উঠেছে।

কারণ, যে নিজের প্রশংসা করে, তার ইবাদত কখনো কবুল করা হয় না। সম্ভবত, হাসতে হাসতে তোমার ভুলত্রুটি স্বীকার করে নেয়া বেশি উত্তম তোমার ইবাদত করতে গিয়ে কান্না করে সে কান্নার জন্যে অহংকারী হওয়ার চেয়ে। গুনাহগারের বিলাপ আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয় দাম্ভিকের (আল্লাহর) প্রশংসা করার চেয়ে। হয়তো, এই গুনাহের কারণে আল্লাহ তার এমন অসুখ সারিয়ে দিচ্ছেন যে অসুখ তোমারও আছে। অথচ তুমি তা বুঝতে পারছো না।” (মাদারিজুস সালেকীন, ১/১৯৫)

বিকৃত ইঞ্জিলে এ সংক্রান্ত চমৎকার একটি ঘটনা আছে। বলা যায়, পুরো বাইবেলে এ ঘটনাটাই আমার সবচেয়ে প্রিয়। ঘটনাটা ফরীশী এবং কর আদায়কারীকে নিয়ে। সে সময় ইহুদিদের মধ্যে ফরীশীদের খুব ধার্মিক ভাবা হতো, আর খাজনা আদায়কারীদেরকে সবাই নিকৃষ্ট মনে করতো। কারণ, খাজনা আদায়কারীরা তাদের অর্থ রোমানদের হাতে তুলে দিতো। এই রোমানরা তখন তাদের শাসন করতো। খাজনা আদায়কারী আর ফরীশীর তুলনা দিতে গিয়ে ঈসা (আ) বলেছেন—

“দু’জন লোক ইবাদত করবার জন্য বায়তুল মোকাদ্দাসে গেলেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন ফরীশী ও অন্যজন খাজনা আদায়কারী। সেই ফরীশী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের বিষয়ে এই দু’আ করলেন, ‘হে আল্লাহ, আমি তোমাকে ধন্যবাদ জানাই যে, আমি অন্য লোকদের মত বাটপার, অসৎ ও জেনাকারী নই। এমনকি, ঐ খাজনা আদায়কারীর মতোও নই। আমি সপ্তাহে দুবার রোজা রাখি এবং আমার সমস্ত আয়ের দশ ভাগের এক ভাগ তোমাকে দেই।’

সেই সময় সেই খাজনা আদায়কারী কিছু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। (আল্লাহ্‌র ভয়ে) আসমানের দিকে তাকাবারও তার সাহস হল না। সে বুক চাপড়ে বলল, ‘হে আল্লাহ, আমি অনেক বড় পাপী। আমার প্রতি দয়া করো।’
আমি তোমাদের বলছি, সেই খাজনা আদায়কারীকে আল্লাহ ধার্মিক বলে গ্রহণ করলেন আর সে বাড়ী ফিরে গেল। কিন্তু সেই ফরীশীকে তিনি ধার্মিক বলে গ্রহণ করলেন না।

যে কেউ নিজেকে উঁচু করে তাকে নীচু করা হবে এবং যে নিজেকে নীচু করে তাকে উঁচু করা হবে।” [লূক ১৮:১০-১৪]


লিখেছেন: শিহাব আহমেদ তুহিন

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button