শারঈ ইমারত
ফিৎনার আত্মপ্রকাশ :
বর্তমানে বিশ্বের মুসলমানরা বিভিন্ন ধরনের ফিৎনা-ফাসাদে নিমজ্জিত রয়েছে। আপনি যদি গভীর দৃষ্টিতে দেখেন তাহ’লে বহু মাযহাবী, নৈতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ফিৎনা আপনার গোচরে আসবে। যেগুলো এই সময় মুসলমানদের উপরে চেপে বসে আছে। যদিচ এটি মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণীর ফলশ্রুতি। তিনি বলেছিলেন, سَتَكُوْنُ فِتَنٌ ‘অচিরেই ফিৎনা সমূহ সৃষ্টি হবে’।[2] কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই দুর্ভাগারা ঐ শাস্তি পাচ্ছে, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রত্যেক ঐ জাতি পেয়ে থাকে, যারা কুরআন ও হাদীছের অনুসরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং তার মর্ম অনুযায়ী আমল করার ব্যাপারে তাল-বাহানা করে।
এখন এই শাস্তি থেকে যদি মুসলমানরা বাঁচতে চায়, তাহ’লে তার একটি মাত্র উপায় রয়েছে যে, তারা ঐ বুনিয়াদী অপরাধ থেকে বিরত থাকবে, যার কারণে তাদের উপরে এই ফিৎনা চেপে বসেছে। আর সেই কাজের জন্য প্রস্ত্তত হয়ে যাবে যার জন্য তাদেরকে কুরআন ও সুন্নাহ দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারা যদি কুরআন ও হাদীছ থেকে বিমুখ হ’তে থাকে, তাহ’লে অন্য যেকোন উপায় অবলম্বন করে দেখুক এবং এটা বিশ্বাস করে নিক যে, কোন একটি ফিৎনার দুয়ারও রুদ্ধ হবে না। বরং প্রত্যেক নিত্য নতুন প্রচেষ্টা আরো বহু ফিৎনার জন্ম দিবে এবং তারা কখনো সফলকাম হবে না।
ফিৎনা থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় :
ছহীহুল বুখারী ও অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থের ‘ফিতান’ অধ্যায়ে বহু ফিৎনার সংবাদ দেয়া হয়েছে এবং সেগুলোর ধারাবাহিক তালিকা প্রদান করতে গিয়ে সে সব ফিৎনা থেকে বাঁচার এই উপায় বলা হয়েছে যে, تَلْزَمُ جَمَاعَةَ الْمُسْلِمِيْنَ وَإِمَامَهُمْ ‘তুমি মুসলমানদের জামা‘আত এবং তাদের ইমামকে অাঁকড়ে ধরবে’।[3] এটিই হ’ল শারঈ প্রতিকার। উম্মাহর বিচক্ষণ ব্যক্তি মুহাম্মাদ (ছাঃ) যেটি বর্ণনা করেছেন। যার গুণ এই যে, وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى، إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُّوْحَى- ‘তিনি দ্বীনের ব্যাপারে প্রবৃত্তির তাড়নায় কোন কথা বলেন না। বরং তাকে যা প্রত্যাদেশ করা হয় তাই বলেন’ (নাজম ৫৩/৩-৪)।
সুতরাং এটি আল্লাহ প্রদত্ত প্রতিকার। যার উপর আমল করা বিশ্বের সকল মুসলমানের জন্য ফরয। আর এটাই বাস্তব সত্য যে, ঐ ব্যক্তিই ফিৎনা ও পথভ্রষ্টতা হ’তে নিরাপদ থাকবে যে ব্যক্তি একজন শারঈ আমীরের নেতৃত্ব মেনে নিবে।
আমীর নিয়োগ :
কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا أَطِيعُوا اللهَ وَأَطِيْعُوا الرَّسُوْلَ وَأُوْلِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর ও তোমাদের নেতৃবৃন্দের আনুগত্য কর’ (নিসা ৪/৫৯)।
এই আয়াতে তিন ব্যক্তির আনুগত্য করার নির্দেশ রয়েছে। ১. আল্লাহর ২. রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর এবং ৩. আমীরে জামা‘আতের। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর আনুগত্যকে তাঁর রাসূলের আনুগত্যের উপরে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছেন। তিনি বলেন,مَنْ يُطِعِ الرَّسُوْلَ فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ ‘যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করল সে আল্লাহরই আনুগত্য করল’ (নিসা ৪/৮০)। আর রাসূল (ছাঃ) নিজের আনুগত্যকে আমীরে জামা‘আতের আনুগত্যের উপরে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছেন। যেমন আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ أَطَاعَنِى فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ، وَمَنْ عَصَانِى فَقَدْ عَصَى اللهَ، وَمَنْ يُطِعِ الأَمِيْرَ فَقَدْ أَطَاعَنِى، وَمَنْ يَعْصِ الأَمِيْرَ فَقَدْ عَصَانِى- ‘যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করল সে আল্লাহর আনুগত্য করল। আর যে আমার অবাধ্যতা করল, সে আল্লাহর অবাধ্যতা করল। যে আমীরের আনুগত্য করল, সে আমার আনুগত্য করল। আর যে আমীরের অবাধ্যতা করল, সে আমার অবাধ্যতা করল’।[4]
উপরোল্লেখিত আয়াত ও হাদীছ দ্বারা আমীরের আনুগত্য করা সকল মুসলমানের উপর ফরয। আর এই শারঈ মূলনীতি বিদ্বানগণের নিকট স্বীকৃত যে, مَا لاَ يَتِمُّ الْوَاجِبُ إِلاَّ بِهِ فَهُوَ وَاجِبٌ ‘যে বস্ত্ত ব্যতীত কোন ওয়াজিব পূর্ণ হয় না, সেটিও ওয়াজিব’।[5] এজন্য আমীর নির্ধারণ করা ওয়াজিব। কেননা আমীর নির্ধারণ না করলে আমীরের আনুগত্য বাস্তবতা লাভ করতে পারে না। যেটি স্পষ্ট।
আমীর ব্যতীত জীবনযাপন করা হারাম :
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ لاَ يَحِلُّ لِثَلاَثَةِ نَفَرٍ يَكُونُونَ بِأَرْضِ فَلاَةٍ إِلاَّ أَمَّرُوا عَلَيْهِمْ أَحَدَهُمْ– আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, ‘কোন তিনজন ব্যক্তির জন্যেও কোন নির্জন ভূমিতে অবস্থান করা হালাল নয় তাদের মধ্যে একজনকে ‘আমীর’ নিযুক্ত না করা পর্যন্ত’।[6]
এর দ্বারা সুস্পষ্ট হয় যে, কোন স্থানেই আমীর বিহীন জীবন যাপন ও বসবাস করা বৈধ নয়। সেকারণ সব জায়গার মানুষের জন্য আমীরের অধীনে জীবন যাপন করা ওয়াজিব।
সফরেও আমীর নির্ধারণ করা যরূরী :
عَنْ أَبِى سَعِيدٍ الْخُدْرِىِّ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِذَا خَرَجَ ثَلاَثَةٌ فِى سَفَرٍ فَلْيُؤَمِّرُوا أَحَدَهُمْ- আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যখন তিনজন একত্রে সফরে বের হবে তখন তাদের মধ্যে একজনকে যেন তারা ‘আমীর’ নিযুক্ত করে নেয়’।[7]
হাদীছগুলো দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মুসলমানদের সংখ্যা যতই কম হোক এবং তারা যেখানেই থাকুক সফরে বা বাড়ীতে, লোকালয়ে বা জঙ্গলে সাময়িকভাবে হেŠক বা স্থায়ীভাবে, সর্বাবস্থায় তাদের উপর আবশ্যিক হ’ল, নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে আমীর নির্ধারণ করা। শহরে-নগরে ও গ্রামে-গঞ্জে যেখানে বসতি বেশী রয়েছে, সেখানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এটি ওয়াজিব।
আমীর নিযুক্ত না করলে জাহেলিয়াতের মৃত্যু হবে :
عَنِ ابْنِ عُمَرَ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ مَنْ مَاتَ وَلَيْسَ عَلَيْهِ إِمَامُ جَمَاعَةٍ فَإِنَّ مَوْتَتَهُ مَوْتَةٌ جَاهِلِيَّةٌ- ইবনু ওমর (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করল এমন অবস্থায় যে, তার কোন আমীরে জামা‘আত নেই, তার মৃত্যু জাহেলিয়াতের মৃত্যু হল’।[8] ছহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ مَاتَ وَلَيْسَ فِى عُنُقِهِ بَيْعَةٌ مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةً ‘যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করল এমন অবস্থায় যে, তার গর্দানে (আমীরের) বায়‘আত নেই, সে জাহেলিয়াতের মৃত্যুবরণ করল’।[9] মু‘আয (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ مَاتَ بِغَيْرِ إِمَامٍ مَاتَ مِيْتَةً جَاهِلِيَّةً ‘যে ব্যক্তি আমীর বিহীন মৃত্যুবরণ করল, সে জাহেলিয়াতের মৃত্যুবরণ করল’।[10]
ইসলাম পূর্ব যুগের নাম ‘জাহেলিয়াত’। সে যুগে সবাই স্বাধীন ও প্রবৃত্তির দাস ছিল এবং শিরক, কুফর ও পাপাচারে নিমজ্জিত ছিল। আল্লাহ সম্পর্কে অবগত তাদের কোন পথপ্রদর্শক ও দিকনির্দেশক ছিল না। যার অধীনে থেকে তারা হেদায়াত লাভ করত। অনুরূপভাবে বর্তমানে মানুষ স্বাধীন ও প্রবৃত্তির দাস এবং ইমামের অধীনে জীবন যাপন করে না। সুতরাং যে ব্যক্তি ইমাম ও আমীর নির্ধারণ করবে না, সে জাহেলিয়াতের মৃত্যুবরণ করবে।
যখন মুহাম্মাদ (ছাঃ) রিসালাতের মর্যাদায় অভিষিক্ত হন, তখন তিনি ইসলাম ধর্মকে জগদ্বাসীর সম্মুখে পেশ করেন। অতঃপর যারা সেই ইসলাম কবুল করেছিল, তাদের মধ্যে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে সবাইকে সুসংগঠিত করে দেওয়া হয়েছিল এবং তাদের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে আমীর নিযুক্ত করা হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণ থেকে শুরু করে তাবেঈন, তাবে তাবেঈন ও আইম্মায়ে মুহাদ্দেছীন পর্যন্তও এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে। অতঃপর মানুষ স্বাধীন হয়ে যায়। বিশেষ করে যেখানে অনৈসলামী সরকার ছিল, সেখানে মানুষ সে পদ্ধতির উপর চলে স্বাধীন হয়ে যায় এবং স্রেফ দুনিয়াবী সরকারকে যথেষ্ট মনে করে জীবন যাপন করে। আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধানের নিয়ম-শৃঙ্খলা থেকে বেপরওয়া হয়ে যায়। ব্যস, এটাই হ’ল জাহেলিয়াত। যা থেকে বাঁচা ওয়াজিব।
সকাল ও সন্ধ্যার পূর্বে ইমাম বানাও :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنِ اسْتَطَاعَ مِنْكُمْ أَنْ لاَ يَنَامَ نَوْماً وَلاَ يُصْبِحَ صَبَاحًا إِلاَّ وَعَلَيْهِ إِمَامٌ فَلْيَفْعَلْ ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ ক্ষমতা রাখে যে, সে ঘুমাবে না এবং সকাল করবে না, কিন্তু এ অবস্থায় যে, তার একজন নেতা থাকবে। তবে
এই হাদীছ দ্বারা দ্রুত আমীর নির্বাচনের বিধান স্পষ্ট হ’ল। এজন্য যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মৃত্যুবরণ করেন তখন ছাহাবায়ে কেরাম দ্রুত নেতা নির্বাচনের জন্য সচেষ্ট হন এবং রাসূল (ছাঃ)-এর গোসল, কাফন-দাফন প্রভৃতি ঐ সময় পর্যন্ত স্থগিত রাখেন, যতক্ষণ না আমীর নির্বাচন করা হয়। যখন আমীর নিযুক্ত হয়ে যান তখন তার অধীনে তারা সব কাজ আঞ্জাম দেন। যদি দ্রুত আমীর নির্ধারণ করা যরূরী না হ’ত, তাহ’লে প্রথমে কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করা হ’ত। ‘সুতরাং হে জ্ঞানীগণ! তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করো’ (হাশর ৫৯/২)।
আমীর ছাড়া কোন ইসলাম নেই :
ওমর (রাঃ) থেকে মওকূফ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, لاَ إِسْلاَمَ إِلاَّ بِجَمَاعَةٍ، وَلاَ جَمَاعَةَ إِلاَّ بِإِمَارَةٍ، وَلاَ إِمَارَةَ إِلاَّ بِطَاعَةٍ ‘ইসলাম হয় না জামা‘আত ছাড়া, জামা‘আত হয় না আমীর ছাড়া, ইমারত হয় না আনুগত্য ছাড়া’।[12] এই হাদীছটি হুকুমগতভাবে মারফূ। এর দ্বারা প্রমাণিত হ’ল যে, জামা‘আত ছাড়া ইসলাম কিছুই নয় এবং আমীর ব্যতীত জামা‘আত কায়েম হ’তে পারে না। যার ফল এটাই যে, আমীর ছাড়া ইসলাম গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা আমীর ছাড়া মানুষ বল্গাহীন হয়ে নিজের প্রবৃত্তির চাহিদা ও শয়তানী পথে চলতে শুরু করবে এবং সবাই দলে দলে বিভক্ত হয়ে যাবে। ঐক্য ও শৃংখলা কায়েম থাকবে না। আর এটাই হ’ল জাহেলিয়াত। যা ইসলামের বিপরীত।
নিম্ন স্তরের আমীরেরও আনুগত্য করো :
উম্মুল হুছাইন (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি বিদায় হজ্জে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি,إِنْ أُمِّرَ عَلَيْكُمْ عَبْدٌ مُجَدَّعٌ أَسْوَدُ يَقُودُكُمْ بِكِتَابِ اللهِ تَعَالَى فَاسْمَعُوْا لَهُ وَأَطِيعُوْا- ‘যদি তোমাদের উপর একজন নাক-কান কাটা কৃষ্ণকায় গোলামকেও আমীর নিযুক্ত করা হয়, যিনি তোমাদেরকে আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী পরিচালনা করেন, তোমরা তার কথা শোন এবং আনুগত্য কর’।[13] এর দ্বারা প্রমাণিত হল যে, আমীরের আনুগত্য করা ফরয। আর ঐ ব্যক্তির আমীর হওয়া উচিত যিনি কুরআন ও হাদীছের আলেম হবেন এবং আল্লাহর বিধান অনুযায়ী লোকদের পরিচালনা করতে পারবেন।
জামা‘আতী যিন্দেগীর হুকুম :
সকল মুসলমানের উপরে ফরয হ’ল, তারা পরস্পর ঐক্যবদ্ধ হয়ে জামা‘আতী যিন্দেগী যাপন করবে। ফিরকা ও দলে দলে বিভক্ত হবে না। কুরআন মাজীদে এরশাদ হয়েছে, وَاعْتَصِمُوْا بِحَبْلِ اللهِ جَمِيْعًا وَّلاَ تَفَرَّقُوْا ‘তোমরা সকলে সমবেতভাবে আল্লাহর রজ্জুকে ধারণ কর এবং পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হয়ো না’ (আলে ইমরান ৩/১০৩)। আর এটা প্রমাণ করা হয়েছে যে, আমীর ব্যতীত জামা‘আত এবং জামা‘আতী যিন্দেগী হয় না। এজন্য আমীর থাকা যরূরী। সুতরাং প্রথমে আমীর নির্বাচন করো অতঃপর তাঁর অধীনে জামা‘আতী যিন্দেগী যাপন করো।
সভাপতি বানানো :
কিছু লোক ব্রিটিশ ও পার্থিব নিয়ম-নীতির প্রতি খেয়াল করে নিজেদের আঞ্জুমান (সংগঠন), জমঈয়ত বা কমিটি গঠন করার সময় তাদের মধ্য থেকে কোন বড় ব্যক্তিকে ছদর বা সভাপতি নির্বাচন করে থাকেন। যদি অমুসলিম হিন্দু, ইহূদী, খ্রিষ্টান ও অন্যরা এটা করে, তাহ’লে সেটাকে তাদের রীতি বলা হবে। এটা ইসলামের রীতি হবে না। যদি মুসলমান এমনটা করে তাহ’লে এটা শারঈ পদ্ধতির বিপরীত হবে। কেননা ইসলামী শরী‘আত ইমারতের ধারাবাহিকতা কায়েম করেছে। আমীর ও মামূর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। হাদীছে এসেছে, مَنْ أَحْدَثَ فِى أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ ‘যে ব্যক্তি আমাদের শরী‘আতে নতুন কিছুর উদ্ভব ঘটালো, যা তাতে নেই সেটি প্রত্যাখ্যাত’।[14] এজন্য ইমারত শরী‘আতসম্মত এবং সভাপতি অগ্রহণযোগ্য। তিনটি স্বর্ণযুগে সভাপতির আদলে কোন সংগঠন কায়েম হয়নি। এটা অমুসলিমদের পদ্ধতি। হাদীছে এসেছে,ليس منا من عمل سنة غيرنا ‘যে অন্যদের (অমুসলিমদের) রীতি অনুযায়ী আমল করল, সে আমাদের দলভুক্ত নয়’।[15]
মতভেদ ও দলাদলি থেকে বাঁচো :
আহলে কিতাবদের রীতি-নীতির অনুসরণ থেকেও কুরআন আমাদেরকে নিষেধ করেছে। মহান আল্লাহ বলেন,وَلا تَكُونُوْا كَالَّذِيْنَ تَفَرَّقُوْا وَاخْتَلَفُوْا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَأُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيْمٌ ‘তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হয়েছে এবং স্পষ্ট প্রমাণাদি এসে যাওয়ার পরেও তাতে মতভেদ করেছে। এদের জন্য রয়েছে ভয়ংকর শাস্তি’ (আলে ইমরান ৩/১০৫)। এই শাস্তি ঐ লোকদেরও হবে যারা আহলে কিতাবদের মতো দলে দলে বিভক্ত হচ্ছে। অতএব সকল কুরআন-সুন্নাহর অনুসারী মুসলিমের উপরে এটা আবশ্যক যে, অনৈক্য, হিংসা-অহংকার ও মতভেদ থেকে বেঁচে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যাক এবং শারঈ পদ্ধতিতে জামা‘আতী নিয়ম-নীতি প্রতিষ্ঠিত করুক। তারা জামা‘আতকে অস্বীকারকারী ও পরিত্যাগকারী হয়ে আমলকারীদের উপর অন্যান্য ভ্রান্ত ফিরকাগুলির মতো দোষারোপকারী না হোক।
সুতরাং মতভেদের সময়ও সত্যের মানদন্ড হিসাবে সেটাকেই সামনে রাখতে হবে কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর অনুসারী আলেমগণ অন্য ফিরকাগুলোকে যাচাইয়ের সময় যেটা রেখেছিলেন। অর্থাৎ ফিরক্বায়ে নাজিয়াহ ওটাই যেটা مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِى (আমি ও আমার ছাহাবীগণ যার উপরে আছি) এর অনুকূলে রয়েছে। অর্থাৎ মুক্তিপ্রাপ্ত দল সেটাই, যেটা ঐ তরীকার উপরে চলে, যার উপরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীগণ চলেছেন। সুতরাং কোন সন্দেহ নেই যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এবং তাঁর ছাহাবায়ে কেরাম ইমারতের উপরে আমল করে ঐক্যবদ্ধ ছিলেন। তাদের সর্বসম্মত আমল এটাই ছিল। ইমারতে শারঈর পদ্ধতি ছেড়ে রাষ্ট্রীয় সংগঠন বা জাতীয় সংগঠন বা ধর্মীয় সংগঠন নিজ প্রবৃত্তি অনুযায়ী স্বাধীন পদ্ধতিতে কায়েম করা হ’লে সেটা তিনটি স্বর্ণযুগের বিপরীত হবে।
ছিরাতে মুস্তাক্বীমের দিকে দাওয়াত :
আমরা আন্তরিকভাবে মুসলিম ভাইদেরকে ছিরাতে মুস্তাক্বীমের দিকে দাওয়াত দিচ্ছি-تَعَالَوْا إِلَى كَلِمَةٍ سَوَاءٍ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ (আলে ইমরান ৩/৬৪)। ‘এসো তোমরা সবাই ঐ কথায় একমত হয়ে যাও, যা আমাদের ও তোমাদের মাঝে স্বীকৃত। তা এই যে, জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য ইক্বামতে দ্বীন বিশুদ্ধ ইমারতের পদ্ধতিতে জামা‘আতবদ্ধ হয়ে পূর্ণ করা। আমাদের সবার উচিত হ’ল, ইক্বামতে দ্বীন তথা তাওহীদ ও সুন্নাতের প্রতিষ্ঠার জন্য সম্মিলিত শক্তি নিয়ে চেষ্টা করা। আর সম্মিলিত শক্তি সংগঠনের মাধ্যমে হয়। আর সংগঠন ইমারতবিহীন হ’তে পারে না। এজন্য ইমারত কায়েম করা যরূরী। ইমারতবিহীন অন্যান্য দ্বীনী বিষয়সমূহ যেমন দরস-তাদরীস (পঠন-পাঠন), ওয়ায ও তাবলীগ পরিপূর্ণ নয়। হাদীছে এসেছে, لاَ يَقُصُّ إِلاَّ أَمِيرٌ أَوْ مَأْمُورٌ أَوْ مُخْتَالٌ ‘আমীর অথবা আমীরের পক্ষ থেকে নির্দেশপ্রাপ্ত ব্যক্তি অথবা কোন অহংকারী ব্যতীত অন্য কেউ ওয়ায-বক্তৃতা করে না’।[16] এভাবেই হবে বিবদমান সকল বিষয়ে ফায়ছালা। যেমন এরশাদ হয়েছে, لاَ يُصْلِحُ النَّاسَ إِلاَّ أَمِيرٌ ‘আমীর ব্যতীত মানুষের মধ্যে কেউ ইছলাহ করে না’…।[17] আমীর ব্যতীত অন্যান্য রীতি-পদ্ধতি ও পঞ্চায়েত সমূহের ফায়ছালাগুলো শরী‘আতসম্মত ফায়ছালা নয় বলে গণ্য হবে। এভাবে ছালাত এবং যাকাত আদায়ও ইমাম ও আমীরের সাথে গ্রহণযোগ্য হবে। অন্যায় কাজ থেকে নিষেধও আমীরের অধীনে সম্পাদিত হবে। হজ্জও আমীরের নির্দেশে হবে। যুদ্ধ-জিহাদের অবস্থা এলে সেটিও আমীরের মাধ্যমে করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّمَا الْإِمَامُ جُنَّةٌ يُقَاتَلُ مِنْ وَرَائِهِ ‘ইমাম হ’লেন ঢালস্বরূপ। তাঁর পিছনে থেকে যুদ্ধ করা হয়’।[18]
মোটকথা, সামর্থ্য অনুযায়ী আমীরের কাজ অনেক। আর এর উপরেই ইসলামের প্রতিষ্ঠা নির্ভরশীল। এজন্য আমীর নির্বাচন করা অনেক বড় ফরয। এটা পরিত্যাগ করে বর্তমানে মুসলমানেরা ইসলাম ধর্মের চরিত্র থেকে দূরে সরে যাচ্ছে এবং আমল করা থেকে বিরত হচ্ছে। বনু ইসরাঈলের মতো মিথ্যা বাহানা তালাশ করে এবং ওযরখাহী করে বলে যে, ইমারত কায়েম করলে দ্রুত সরকার গঠন করতে হবে, কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করা ফরয হবে এবং শারঈ হুদূদ বা দন্ডবিধি সমূহ কায়েম করা আবশ্যিক হবে ইত্যাদি। অথচ এগুলি ইমারতের জন্য শর্ত নয়।
হ্যঁা, উক্ত বিষয়গুলি বাস্তবায়নের জন্য ইমারত শর্ত। যা সাধ্যানুযায়ী নিজ নিজ কর্মকালে হয়ে থাকে। কুরআন মাজীদে রয়েছে, لَا يُكَلِّفُ اللهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا ‘আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের অতিরিক্ত কাজে বাধ্য করেন না’ (বাক্বারাহ ২/২৮৬)। হাদীছে এসেছে, إِذَا أَمَرْتُكُمْ بِأَمْرٍ فَأْتُوا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ ‘যখন আমি তোমাদেরকে কোন কাজের নির্দেশ দেই, তখন তোমরা সাধ্যানুযায়ী তা বাস্তবায়ন করো’।[19]
দেখুন! তিনজন ব্যক্তি হ’লেও সফরে ও জঙ্গলে আমীর নির্বাচনের নির্দেশ রয়েছে। তাহ’লে সেখানে কোন ধরনের যুদ্ধ, সরকার ও হুদূদ বাস্তবায়িত হবে?
আসল কথা এই যে, ঐ সমস্ত লোকজন ইমারতকে দুনিয়ার বাদশাহী ও সরকার সমূহের ক্ষমতার উপরে অনুমান করে নিয়েছে। যা সম্পূর্ণ ভুল। নবুঅতী পদ্ধতিতে ইমারত ও খেলাফত উদ্দেশ্য। যা নিঃস্ব অবস্থায় শুরু হয়। যেমন হাদীছে এসেছে,بَدَأَ الْإِسْلاَمُ غَرِيبًا وَسَيَعُودُ كَمَا بَدَأَ غَرِيبًا فَطُوبَى لِلْغُرَبَاءِ- ‘ইসলাম স্বল্পসংখ্যক লোকের মাধ্যমে শুরু হয়েছে। অচিরেই সে তার পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসবে। সুতরাং সুসংবাদ সেই স্বল্পসংখ্যক লোকদের জন্য’।[20] যতক্ষণ পর্যন্ত কোন আমীর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অর্জন না করতে পারবেন, ততক্ষণ তাকে ধর্মীয় বিষয়গুলি জামা‘আতবদ্ধভাবে সম্পাদন করে যেতে হবে।
অনুবাদ : নূরুল ইসলাম
[1]. মাওলানা আব্দুল কাদের হিছারী, ফাতাওয়া হিছারিয়াহ ওয়া মাক্বালাতে ইলমিইয়াহ, সংকলনে : মাওলানা ইবরাহীম খলীল (লাহোর : মাকতাবা আছহাবুল হাদীছ, ২০১২), পৃঃ ৬-৩৩।
[11]. ইবনু আসাকির ৩৬/৩৯৬; আহমাদ হা/১১২৬৫, সনদ যঈফ। সনদ যঈফ হ’লেও মর্ম ছহীহ। যা রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পর দ্রুত খলীফা নির্বাচনের ঘটনা দ্বারা প্রমাণিত।
[12]. দারেমী হা/২৫১, সনদ যঈফ। এ মর্মে ছহীহ মরফূ হাদীছ রয়েছে। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন, জামা‘আতবদ্ধ জীবন হ’ল রহমত এবং বিচ্ছিন্ন জীবন হ’ল আযাব’ (ছহীহাহ হা/৬৬৭)। আর ইমাম বা আমীর ব্যতীত জামা‘আত হয় না, এটা অন্যান্য হাদীছ সমূহ দ্বারা প্রমাণিত।
[15]. যঈফাহ হা/৪০৫৭। সনদ যঈফ হ’লেও একই মর্মে ছহীহ হাদীছে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি যে জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে, সে ব্যক্তি তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হবে’ (আবুদাঊদ হা/৪০৩১; ছহীহুল জামে‘ হা/৬১৪৯; মিশকাত হা/৪৩৪৭)।
[16]. আবুদাঊদ হা/৩৬৬৫, হাসান ছহীহ; মিশকাত হা/২৪০ ‘ইলম’ অধ্যায়। ইবনু মাজাহর বর্ণনায় (ইবনু মাজাহ হা/৩৭৫৩) এসেছে, مُرَاءٍ অর্থাৎ রিয়াকার ব্যক্তি যার কথায় ও কাজে কোন নেকী নেই।
[17]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/৭৫০৮, সনদ যঈফ। কথাটি রাসূল (ছাঃ)-এর নয়। বরং হযরত আলী (রাঃ)-এর। পূর্ণ হাদীছটি হ’ল, আলী (রাঃ) বলেন, মানুষের মধ্যে ফায়ছালা করেনা আমীর ব্যতীত। তিনি সৎ হৌন বা অসৎ হৌন। লোকেরা বলল, সৎ আমীর বুঝলাম। কিন্তু অসৎ আমীরের বিষয়টি কেমন? জবাবে তিনি বললেন, আল্লাহ তার মাধ্যমে রাস্তা-ঘাট নিরাপদ রাখেন, শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করান, যুদ্ধলব্ধ ফাই জমা করেন, দন্ডবিধিসমূহ কায়েম করেন, বায়তুল্লাহর হজ্জ করান, যেখানে মুসলমানরা নিরাপত্তার সাথে আল্লাহর ইবাদত করে, যতদিন না তাঁর মৃত্যু এসে যায়’। হাদীছটির সনদ যঈফ হ’লেও ছহীহ মরফূ‘ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত। যেখানে বলা হয়েছে, ‘আমীর হ’লেন ঢাল স্বরূপ। তার পিছনে থেকে যুদ্ধ করা হয়’ (বুখারী হা/২৯৫৭)।