ধর্মীয় মতভেদ

শিয়াদের ‘আয়াতে তাতহীর’ ও ‘হাদিসে কিসা’ -এর অর্থ

প্রশ্ন: জনৈক শিয়া যুবক আমাকে বলল: (শিয়াদের) ইমামগণ নিষ্পাপ, “আয়াতে তাতহীর” দ্বারা আল্লাহ তাদেরকে নিষ্পাপ ঘোষণা করেছেন। কারণ আয়াতে তাতহীরে (أَهْلَ البَيْت) দ্বারা উদ্দেশ্য “আহলে বায়েত” তথা আলী, হাসান, হুসাইন ও ফাতেমা, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগণ তার অন্তর্ভুক্ত নয়। সে বলল: আয়াতে পুংলিঙ্গের “মীম” দ্বারা সম্বোধন ব্যবহার করা হয়েছে, যদি নবীর স্ত্রীগণ উদ্দেশ্য হত তাহলে স্ত্রী লিঙ্গের “নূন” ব্যবহার করা হত। এ সম্পর্কে সে “হাদিসুল কিসা” নামে একটি হাদিস শোনাল। তার বক্তব্য: উক্ত আয়াত ও হাদিস শিয়াদের বারো ইমামকে মাসুম ও নিষ্পাপ প্রমাণ করে।

আমার জিজ্ঞাসা:

(ক). কুরআনে কি “আয়াতে তাতহীর” নামে কোন আয়াত আছে? (খ). “আহলুল বাইত” দ্বারা উদ্দেশ্য কি? (গ). আহলে বায়েত দ্বারা যদি নবীগণের স্ত্রী উদ্দেশ্য হয়, পুংলিঙ্গের মীম দ্বারা কেন সম্বোধন করা হল? (ঘ). আয়াতের শানে নুযূল কী? (ঙ). “হাদিসুল কিসা” কি, অর্থসহ জানতে চাই? বিস্তারিত জানিয়ে বাধিত করবেন। আল্লাহ আপনাকে উত্তম বিনিময় দান করুন।

———–

উত্তর:

الحمد لله والصلاة والسلام على رسول الله وآله وأصحابه و من تبعهم بإحسان إلى يوم الدين. وبعد:

শিয়াদের দ্বারা কুরআনের যে কয়টি আয়াত বিকৃতি, অপব্যাখ্যা ও মিথ্যাচারের শিকার হয়েছে তার মধ্যে সূরা আহযাবের (৩৩)নং আয়াতের শেষাংশ অন্যতম, পূর্ণ আয়াতটি হচ্ছে:

﴿وَقَرۡنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجۡنَ تَبَرُّجَ ٱلۡجَٰهِلِيَّةِ ٱلۡأُولَىٰۖ وَأَقِمۡنَ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتِينَ ٱلزَّكَوٰةَ وَأَطِعۡنَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥٓۚ إِنَّمَا يُرِيدُ ٱللَّهُ لِيُذۡهِبَ عَنكُمُ ٱلرِّجۡسَ أَهۡلَ ٱلۡبَيۡتِ وَيُطَهِّرَكُمۡ تَطۡهِيرٗا ٣٣﴾ [سورة الأحزاب: 33]

“আর তোমরা নিজ গৃহে অবস্থান করবে এবং প্রাক-জাহেলী যুগের মত সৌন্দর্য প্রদর্শন করো না। আর তোমরা সালাত ‎কায়েম কর, যাকাত প্রদান কর এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর। হে নবী পরিবার, আল্লাহ তো কেবল চান ‎‎তোমাদের থেকে অপবিত্রতাকে দূরীভূত করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে”। সূরা আহযাব: (৩৩)

দ্বাদশ ইমামের ওপর ঈমান আনয়ন করা ও তাদেরকে নিষ্পাপ মানা শিয়াদের ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ আকিদা। তারা শিয়া ইমামিয়্যাহ, দ্বাদশ ইমামিয়্যাহ ও ইসনা আশারিয়্যাহ ইত্যাদি নামে প্রসিদ্ধ। বর্তমান ইরানে তাদেরই শাসন চলছে। এ আকিদার স্বপক্ষে তারা কুরআনের বিভিন্ন আয়াত দলিল হিসেবে পেশ করে। তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী ও প্রসিদ্ধ দলিল উক্ত আয়াতের শেষাংশ এবং প্রশ্নে উল্লেখিত হাদিসুল কিসা।

হাদিসুল কিসার অন্তর্ভুক্ত আলি, ফাতেমা ও হাসান-হুসাইনের মধ্যে তারা নিষ্পাপ হওয়া সীমাবদ্ধ রাখে না, তাদের সন্তান পর্যন্ত বিস্তৃত করে এ পরম্পরা। তবে হাসানের কোনো সন্তান, হুসাইনের সবসন্তান, তাদের সবপুত্র, পৌত্র ও প্রপৌত্রগণ এর মধ্যে দাখিল করে না! এ ধারা শুধু দ্বাদশ পুরুষ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রাখে, পরবর্তী প্রজন্মের কেউ ঈমান, আমল, ইলম ও তাকওয়ায় অধিক হলেও তাকে নিষ্পাপ দলে শামিল করে না! এক-গ্রুপ এক সন্তানকে ইমাম নির্বাচন করে তো অপর গ্রুপ অপর সন্তানকে। এভাবে শিয়াদের মাঝে নানা দল ও ফেরকার সৃষ্টি হয়, তাদের থেকে আবার বিভিন্ন গ্রুপ ও উপদলের জন্ম হয়। স্থান, কাল ও বিশেষ ব্যক্তিদের প্রভাবে বিভিন্ন সময় তারা বিভিন্ন নামে পরিচিতি লাভ করেছে। তাদের প্রধান প্রধান দলের মধ্যে রয়েছে যায়দিয়্যাহ, শিয়া ইমামিয়্যাহ ও ইসমা‘ঈলিয়্যাহ ইত্যাদি ফেরকা। নিম্নে তাদের সামান্য পরিচয় পেশ করলাম।

যায়দিয়্যাহ: হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর নাতি, আলি যাইনুল আবেদিনের ছেলে যায়েদের অনুসারীদের যাইদিয়্যাহ বলা হয়।

বংশধারা: যায়েদ (মৃ.১২২হি.) ইব্‌ন আলি যাইনুল আবেদিন (মৃ.৮৪হি.) ইব্‌ন হুসাইন (মৃ.৬১হি.) ইব্‌ন আলি (মৃ.৪০হি.) ইব্‌ন আবি তালিব।

ইসমা‘ঈলিয়্যাহ: আলি যাইনুল আবেদিনের প্রপৌত্র, মুহাম্মদ আল-বাকের এর নাতি, জা‘ফর সাদেক এর ছেলে ইসমাইলের [ভ্রান্ত] অনুসারীদের ইসমা‘ঈলিয়্যাহ বলা হয়।

বংশধারা: ইসমা‘ঈল (মৃ.৩৮/৪৩/৪৫হি.), [পিতার জীবদ্দশায় মৃত] ইব্‌ন জা‘ফর আস-সাদেক (মৃ.১৪৮হি.), ইব্‌ন মুহাম্মদ আল-বাকের (মৃ.১১৪হি.) ইব্‌ন আলি যাইনুল আবেদিন (মৃ.৯৫হি.), ইব্‌ন হুসাইন ইব্‌ন আলি ইব্‌ন আবি তালিব।

শিয়া ইমামিয়্যাহ: আলি যাইনুল আবেদিনের প্রপৌত্র, মুহাম্মদ আল-বাকের এর নাতি, জা‘ফর সাদেক এর ছেলে মুসা কাযেম এর অনুসারীদের শিয়া ইমামিয়্যাহ বা দ্বাদশ ইমামিয়্যাহ বলা হয়।

বংশধারা: মুসা কাযেম [মৃ১৮৩হি.], ইব্‌ন জা‘ফর আস-সাদেক …। [পূর্বানুরূপ]

যাইদিয়্যাহ, ইসমা‘ঈলিয়্যাহ ও ইমামিয়্যাহ তিন গ্রুপের চতুর্থ ইমাম আলি যাইনুল আবেদিন ইব্‌ন হুসাইন ইব্‌ন আলি ইব্‌ন আবি তালিব। তার এগারো ছেলে ও চার মেয়ে থেকে পঞ্চম ইমাম হিসেবে যায়েদ ইব্‌ন আলি যাইনুল আবেদীনকে যাইদিয়্যারা ইমাম হিসেবে গ্রহণ করে থাকে, আর ইসমা‘ঈলিয়্যাহ ও ইমামিয়্যারা গ্রহণ করে মুহাম্মদ আল-বাকের ইব্‌ন আলি যাইনুল আবেদিনকে।

[আলি যাইনুল আবেদিন: নাম: আলি, উপাধি: যাইনুল আবেদিন, তিনি খুব ইবাদত গুজার ছিলেন তাই এ নামে তাকে ডাকা হত, তার অপর উপাধি সাজ্জাদ, অধিক সিজদাকারী]।

শিয়া ইমামিয়্যাহ ও ইসমা‘ঈলিয়্যাহ উভয় ফেরকার ষষ্ঠ ইমাম মুহাম্মদ আল-বাকেরের ছেলে জা‘ফর আস-সাদেক। এ পর্যন্ত তারা উভয়ে ইমামিয়্যাহ নামে পরিচিত ছিল। জা‘ফর সাদেক (১৪৮হি.) মারা গেলে তাদের মধ্যে বিভেদ দেখা দেয়। এক গ্রুপ ইসমাইল ইব্‌ন জা‘ফর সাদেককে ইমাম হিসেবে গ্রহণ করে ইসমা‘ঈলিয়্যাহ নামে পরিচিতি লাভ করে। অপর গ্রুপ মুসা কাযেম ইব্‌ন জা‘ফর সাদেককে ইমাম নির্বাচন করে। তারা ইমামিয়্যাহ নামে পরিচিতি লাভ করে। অর্থাৎ সপ্তম ইমাম নির্বাচনে বিভেদ সৃষ্টি হলে তারা ইসমা‘ঈলিয়্যাহ ও ইমামিয়্যাহ দু’ভাগে বিভক্ত হয়।

শিয়া ইসমা‘ঈলিয়্যাহ গ্রুপের বিভিন্ন উপদল: “বাতেনিয়্যাহ”, “তা‘লিমিয়্যাহ” ও “সাব‘ইয়্যাহ”। শিয়া ইসমা‘ঈলিয়্যাহ গ্রুপটি বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়ে যায়। ইরাকে “কারামাতিয়্যাহ” ও মুজদাকিয়্যাহ; মিসরে “উবাইদিয়্যাহ”; খোরাসানে “মাইমুনিয়্যাহ”; সিরিয়ায় “নুসাইরিয়্যাহ”, “দারুজ”, “তায়ামুনাহ”, “নাযারিয়্যাহ” ও “সানানিয়্যাহ” ও ইন্ডিয়ায় “বুহরাহ” নামে পরিচিত। আর বাংলাদেশে তাহেরিয়্যাহ নামে খ্যাত। তারা “আগাখানিয়্যাহ” নামেও পরিচিত। ইয়ামানে তাদের নাম “আল-ইয়ামামিয়্যাহ”, যদিও প্রত্যেক ইয়ামামিয়্যাহ ইসমা‘ঈলিয়্যাহ নয়। তারা বলে, প্রত্যেক বস্তুর যাহির ও বাতিন রয়েছে, এমনকি কুরআনেও, যাহেরী বা প্রকাশ্য অর্থ সবাই জানলেও বাতেনি বা গোপন অর্থ তারা ব্যতীত কেউ বুঝে না। মূলত এ চিন্তাধারা গোমরাহ ফেরকাগুলোর ইসলাম ধ্বংস করার প্রধান হাতিয়ার। তাদের ন্যায় রাফেযী ও সূফীদেরকে বাতেনিয়্যাহ বলা হয়।

শিয়া যাইদিয়্যাহ গ্রুপের বিভিন্ন উপদল: “আল-জাওয়েরদিয়্যাহ”, “সুলাইমানিয়্যাহ”, “আস-সালেহিয়্যাহ”, বর্তমানে তারা “প্রজাতন্ত্র ইয়ামান” বা উত্তর ইয়ামানে বৃহৎ সংখ্যায় রয়েছে, বিশেষ করে সান‘আ, হাদিদা ও জাদাহ শহরে। সৌদি আরবের দক্ষিণাঞ্চল নাজরান শহরেও তারা রয়েছে অল্প সংখ্যায়।

শিয়া ইমামিয়্যাহ গ্রুপের বিভিন্ন উপদল: বর্তমান যুগে শিয়া বলতে ইমামিয়্যাদেরই বুঝায়, অন্যান্য শিয়ারা তাদের নিজস্ব নামেই পরিচিত। ইমামিয়্যাহ নামে তাদের প্রসিদ্ধির কারণ, তারা বলে যে রাসুলুল্লাহর পরে আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু-ই একমাত্র ইমাম। তারপর তার সন্তানরা। কেউ বলেছেন: তাদের বিশ্বাস কোনো যুগ ইমাম বিহীন নয়, প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য সর্বদা ইমাম থাকা জরুরী, তাই তাদেরকে ইমামিয়্যাহ বলা হয়। কেউ বলেছেন: তারা দীনের প্রত্যেক বিষয় ইমামের ওপর ন্যস্ত করে, তাদের নিকট ইমাম নবীর মত, তাদের ইমাম সবযুগে বিদ্যমান থাকেন, দীনি ও দুনিয়াবি প্রয়োজনে তারা তার শরণাপন্ন হয়। এ জন্য তাদেরকে ইমামিয়্যাহ বলা হয়। তারা রাফেযী, জা‘ফরিয়্যাহ ও মুতাওয়ালিয়্যাহ নামেও প্রসিদ্ধ। এ ছাড়া শিয়াদের আরো গ্রুপ রয়েছে। বর্তমান ইরানের বেশিরভাগ শিয়া হচ্ছে ইমামিয়্যাহ ফের্কার লোক। তাছাড়া পাকিস্তান ও ভারতে তাদের ব্যাপক অনুসারী রয়েছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ শিয়ারাও ইমামিয়্যাহ ফের্কার অর্ন্তভুক্ত।

দ্বাদশ ইমামিয়্যাহ: ইমামিয়্যাদের দ্বাদশ ইমাম হাসান আসকারি (মৃ.২৬০) এর মৃত্যুর পূর্বে তারা দ্বাদশ ইমামিয়্যাহ নামে পরিচিত ছিল না। আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু ও উমাইয়্যাদের খিলাফতকালে কেউ দ্বাদশ ইমামের তথ্য পেশ করেছেন জানা যায় নি।

“মুখতাসারুত তুহফা ইসনা আশারিয়্যাহ” গ্রন্থের লেখক বলেন: দ্বাদশ ইমামিয়্যাহ মতবাদ সৃষ্টি হয় ২৫৫হি. সনে। দেখুন: “মুখতাসারুত তুহফাহ”: (পৃ.২১), এ সিদ্ধান্তই যথাযথ মনে হয়, কারণ শিয়া পণ্ডিত কুলাইনি “আল-কাফি”: (১/৫১৪) গ্রন্থে, মুফিদ “আল-ইরশাদ”: (৩৯০) গ্রন্থে এবং তাবরাসি “আ‘লামুল ওরা”: (৩৯৩) গ্রন্থে বলেন: দ্বাদশ ইমামের জন্ম (২৫৬হি.), মৃত্যু বা আত্মগোপন (২৬০হি.)।

তাদের নিকট দ্বাদশ ইমাম এখনো জীবিত, তার বের হওয়ার অপেক্ষায় আছে তারা। যেহেতু দ্বাদশ ইমামিয়্যাহ মতবাদ প্রকাশ পায় হাসান আল-আসকারির মৃত্যুর পর, তাই নির্দিষ্টভাবে বলা যায় (২৬০হি.) পরবর্তী সময়েই এই “দ্বাদশ ইমামিয়্যাহ” মতবাদ সৃষ্টি হয়।

বস্তুত: সঠিক ইতিহাস অনুযায়ী শিয়াদের দ্বাদশ ইমামের জন্মই হয়নি, হাসান আসকারির কোন সন্তান ছিল না। তিনি নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান। সুতরাং তাদের ইমামের সংখ্যা ১১ জন হয়; ১২ হয় না। তারপরও তারা মিথ্যা বানিয়ে বলে যে হাসান আসকারীর কোনো এক দাসীর ঘরে এক সন্তান ছিল, যার নাম মুহাম্মাদ ইবন হাসান আসকারী। এটা তাদের বানানো ঘটনা, খোদ তাদের কতক লেখক থেকেও এ সত্য বের হয়ে এসেছে। এ হল শিয়াদের বিভিন্ন দল ও উপদলে বিভক্ত হওয়ার চিত্র। আল্লাহ যথার্থ বলেছেন:

﴿ وَأَنَّ هَٰذَا صِرَٰطِي مُسۡتَقِيمٗا فَٱتَّبِعُوهُۖ وَلَا تَتَّبِعُواْ ٱلسُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمۡ عَن سَبِيلِهِۦۚ ذَٰلِكُمۡ وَصَّىٰكُم بِهِۦ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ١٥٣ ﴾ [الانعام: ١٥٣]

“আর এটি তো আমার সোজা পথ। সুতরাং তোমরা তার অনুসরণ কর এবং অন্যান্য পথ অনুসরণ করো না, তাহলে তা তোমাদেরকে তার পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে”। সূরা আল-আন‘আম: (১৫৩)

শিয়া ইমামিয়্যারা সূরা আল-আহযাবের (৩৩)নং আয়াতের শেষাংশ দ্বারা দলীল পেশ করে যে, “আহলে বায়েত” নিষ্পাপ, যেমন আলি, ফাতেমা ও হাসান-হুসাইন। ইমামদের নিষ্পাপ বলার কারণ হিসেবে তারা বলে: ইমামত তথা নেতৃত্ব দেয়া ও আল্লাহর বিধান বাস্তবায়ন করা মহান দায়িত্ব, এ দায়িত্ব আদায়কারীদের নিষ্পাপ হওয়া জরুরী। ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহা ইমাম না হলেও নিষ্পাপ, যেহেতু তিনি আল্লাহর প্রিয়। নিষ্পাপ শুধু এ চার জনই নয়; তাদের সন্তানগণও, তবে সব সন্তান নয়, যদিও তারা আলি ও ফাতেমার বংশধর। বিশেষ করে হাসানের কোন সন্তানকে তারা নিষ্পাপ বলে না। হুসাইনের সন্তানের মধ্যে শুধু আলি যাইনুল আবেদিনকে নিষ্পাপ মানে। এর কারণ সম্ভবত হুসাইনের সে স্ত্রীর গর্ভে তার জন্ম নেয়া, যে পারস্যের বাদশাহর মেয়ে ছিল।

কতগুলো প্রশ্ন: বিনা বিতর্কে যদি মেনেও নেই উক্ত সূরা আল-আহযাবের ৩৩ নং আয়াত দ্বারা আহলে বায়েতকে নিষ্পাপ ঘোষণা করা হয়েছে, কিন্তু তাদের সন্তানরা নিষ্পাপ কেন? নিষ্পাপ হলে সবার সন্তানই নিষ্পাপ, কারো সন্তান নিষ্পাপ কারো সন্তান নিষ্পাপ নয়, কেউ নিষ্পাপ কেউ নিষ্পাপ নয়, এই বিভাজন কেন, অথচ সবার বংশ এক?! এই ধারা দ্বাদশেই সীমাবদ্ধ কেন? ইরানী মেয়ের গর্ভে জন্ম নেয়া যাইনুল আবেদিনই কেন ইমাম নির্বাচিত? দ্বাদশ ইমাম নির্ধারণে শিয়ারা একমত নয়, তাহলে কোন গ্রুপের মনোনীত ইমাম সঠিক? ইমাম নির্ধারণের মাপকাঠি কি? আল্লাহর প্রিয় ফাতেমা নিষ্পাপ হলে তার প্রিয় অন্যান্য বান্দা নিষ্পাপ নয় কেন?! এসব প্রশ্নের কোন সদুত্তর শিয়াদের নিকট নেই! এ থেকেই তাদের ভ্রষ্টতা ও বিচ্যুতির স্বরূপ প্রকাশ পায়। তাদের গোঁড়ামি, অযৌক্তিকতা ও ভ্রষ্টতা স্পষ্ট করার জন্য এ ভূমিকা জরুরী ভেবে উল্লেখ করলাম।

 

(ক). কুরআনে কি ‘আয়াতে তাতহীর’ নামে কোন আয়াত রয়েছে?

না, আমাদের জানা মতে, কুরআনুল কারীমে ‘তাতহীর’ নামে কোন আয়াতে নেই, যেমন রয়েছে আয়াতুল কুরসি ইত্যাদি। হ্যাঁ, সূরা আহযাবের (৩৩)নং আয়াতের শেষাংশকে শিয়া দ্বাদশ ইমামিয়্যাগণ আয়াতে তাতহীর বলেন, তাতে তাতহীর শব্দ রয়েছে তাই। দেখুন:

… وَأَطِعۡنَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥٓۚ إِنَّمَا يُرِيدُ ٱللَّهُ لِيُذۡهِبَ عَنكُمُ ٱلرِّجۡسَ أَهۡلَ ٱلۡبَيۡتِ وَيُطَهِّرَكُمۡ تَطۡهِيرٗا ٣٣

“… এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর। হে নবী পরিবার, আল্লাহ তো কেবল চান ‎‎তোমাদের থেকে অপবিত্রতাকে দূরীভূত করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে ‘তাতহীর’ বা পবিত্র করতে”। সূরা আহযাব: (৩৩)

এ ছাড়া অন্যান্য আয়াতেও তাতহীর শব্দ রয়েছে, কিন্তু সেগুলোকে শিয়ারা আয়াতে তাতহীর বলে না এবং যাদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে তাদেরকে নিষ্পাপ ও মাসুম বলে না। যেমন:

১. বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী তিন শো তেরোজন সাহাবি সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿إِذۡ يُغَشِّيكُمُ ٱلنُّعَاسَ أَمَنَةٗ مِّنۡهُ وَيُنَزِّلُ عَلَيۡكُم مِّنَ ٱلسَّمَآءِ مَآءٗ لِّيُطَهِّرَكُم بِهِۦ وَيُذۡهِبَ عَنكُمۡ رِجۡزَ ٱلشَّيۡطَٰنِ وَلِيَرۡبِطَ عَلَىٰ قُلُوبِكُمۡ وَيُثَبِّتَ بِهِ ٱلۡأَقۡدَامَ ١١ ﴾ [الانفال: ١١]

“স্মরণ কর, যখন তিনি তোমাদেরকে তন্দ্রায় আচ্ছন্ন করেন তার পক্ষ থেকে নিরাপত্তাস্বরূপ এবং আকাশ থেকে তোমাদের ওপর বৃষ্টি বর্ষণ করেন, আর যাতে এর মাধ্যমে তিনি তোমাদেরকে “তাতহীর” তথা পবিত্র করেন, আর তোমাদের থেকে শয়তানের কুমন্ত্রণা দূর করেন, তোমাদের অন্তরসমূহ দৃঢ় রাখেন এবং এর মাধ্যমে তোমাদের পা-সমূহ স্থির রাখেন”। সূরা আনফাল: (১১)

এ আয়াতে আহলে বদরকে পবিত্র করা এবং তাদের থেকে শয়তানের নাপাকি দূর করার কথা থাকলেও সবাই একমত যে, তারা মাসুম বা নিষ্পাপ নয়। অথচ এতে তাদের অতিরিক্ত সিফাত অন্তরসমূহ দৃঢ় রাখা ও পাসমূহ স্থির রাখার সংবাদ রয়েছে, যা কথিত আয়াতে তাতহীরে নেই। উল্লেখ্য, সূরা আল-আহযাবের رجس ও সূরা আল-আনফালের رجز শব্দদ্বয়ের অর্থ এক।

২. বরং সকল মুসলিম সম্পর্কে আল্লাহ তাতহীর শব্দ ব্যবহার করেছেন:

﴿مَا يُرِيدُ ٱللَّهُ لِيَجۡعَلَ عَلَيۡكُم مِّنۡ حَرَجٖ وَلَٰكِن يُرِيدُ لِيُطَهِّرَكُمۡ وَلِيُتِمَّ نِعۡمَتَهُۥ عَلَيۡكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَشۡكُرُونَ ٦ ﴾ [المائ‍دة: ٦]

“আল্লাহ তোমাদের ওপর কোন সমস্যা সৃষ্টি করতে চান না, বরং তিনি চান তোমাদের “তাতহীর” বা পবিত্র করতে এবং তার নিয়ামত তোমাদের ওপর পূর্ণ করতে, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কর”। সূরা মায়েদা: (৬)

এ আয়াতে সূরা আল-আহযাবের ন্যায় ইরাদা ও ‘তাতহীর’ উভয় শব্দ রয়েছে, অতিরিক্ত রয়েছে নিয়ামত পূর্ণ করার কথা, যা পাপ থেকে মুক্তি ও জান্নাতে প্রবেশ করাসহ যাবতীয় কল্যাণ শামিল করে, সুতরাং যদি ‘তাতহীর’ অর্থ নিষ্পাপ হয়, তাহলে প্রত্যেক মুসলিম এ আয়াত দ্বারা নিষ্পাপ হয়ে যায়। এটা তো কেউ দাবী করে না। যদি এটা না হয়, তবে সূরা আল-আহযাবের ৩৩ নং আয়াতেও নিষ্পাপ অর্থ প্রদান করবে না।

৩. কতক অপরাধী সাহাবির ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলা ‘তাতহীর’ শব্দ ব্যবহার করেছেন:

﴿وَءَاخَرُونَ ٱعۡتَرَفُواْ بِذُنُوبِهِمۡ خَلَطُواْ عَمَلٗا صَٰلِحٗا وَءَاخَرَ سَيِّئًا عَسَى ٱللَّهُ أَن يَتُوبَ عَلَيۡهِمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٞ رَّحِيمٌ ١٠٢ خُذۡ مِنۡ أَمۡوَٰلِهِمۡ صَدَقَةٗ تُطَهِّرُهُمۡ وَتُزَكِّيهِم بِهَا وَصَلِّ عَلَيۡهِمۡۖ إِنَّ صَلَوٰتَكَ سَكَنٞ لَّهُمۡۗ وَٱللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ ١٠٣﴾ [البقرة: 102-103]

“আর অন্য কিছু লোক তাদের অপরাধ স্বীকার করেছে, সৎকর্মের সঙ্গে তারা অসৎকর্মের মিশ্রণ ঘটিয়েছে। আশা করা যায়, আল্লাহ্‌ ‎তাদের তওবা কবুল করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।‎ তাদের সম্পদ থেকে সদকা নাও। এর মাধ্যমে তাদেরকে তুমি ‘তাতহীর’ তথা পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবে। আর তাদের জন্য দো‘আ কর, নিশ্চয় ‎‎তোমার দো‘আ তাদের জন্য প্রশান্তিকর। আর আল্লাহ্‌ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ”। সূরা তাওবা: (১০২-১০৩)‎

‘তাতহীর’ অর্থ যদি নিষ্পাপ হত, তাহলে অপরাধীদের জন্য ‘তাতহীর’ শব্দ ব্যবহার করা হত না! অথচ এখানে তাদের জন্য ‘তাতহীর’ শব্দের সাথে তার চেয়ে উচ্চতর প্রশংসার শব্দ ‘তাযকিয়াহ’ (تزكية) যুগপৎ ব্যবহার করা হয়েছে । কারণ মূলত: ‘তাতহীর’ অর্থ অপবিত্র বস্তু দূর করা, আর ‘তাযকিয়াহ’ অর্থ বরকত দান করা এবং উন্নতি ও প্রবৃদ্ধি প্রদান করা। কোন বস্তু থেকে নাপাক দূর করাই ‘তাতহীর’ বা পবিত্র করা, এর দ্বারা সৌন্দর্যমণ্ডিত করা জরুরী নয়। পক্ষান্তরে ‘তাযকিয়া’র জন্য বস্তু থেকে নাপাক দূর করে সজ্জিত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করা জরুরী। পবিত্র না করে সজ্জিত করার কোন মানেই নেই। এ আয়াত দ্বারা প্রমাণ হয় তারা শুধু পবিত্রই নয়, বরং পরিশুদ্ধি ও ঈমানের সৌন্দর্যে সৌন্দর্যমণ্ডিত হওয়ার উপযুক্ত, অথচ তারা ছিল অপরাধী। তাহলে তারা কি আহলে বায়েতের চেয়ে উত্তম, যদিও শিয়াদের অর্থ তাই প্রমাণ করে! অতএব প্রমাণিত হলো যে, ‘তাতহীর’ শব্দ দ্বারা নিষ্পাপ হওয়া বুঝায় না।

৪. আল্লাহ তা‘আলা মসজিদে কুবার অধিবাসীদের সম্পর্কে বলেছেন:

﴿فِيهِ رِجَالٞ يُحِبُّونَ أَن يَتَطَهَّرُواْۚ وَٱللَّهُ يُحِبُّ ٱلۡمُطَّهِّرِينَ ١٠٨﴾ [البقرة: 108]

“সেখানে এমন লোক আছে, যারা উত্তমরূপে ‘তাতহীর’ তথা পবিত্রতা অর্জন করতে ভালবাসে। আর আল্লাহ পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালবাসেন”। সূরা তাওবা: (১০৮) অথচ তারা নিষ্পাপ ও মাসুম ছিল না, কিন্তু আয়াত তাদের সম্পর্কে সাক্ষী দিচ্ছে যে, তারা পবিত্রতা পছন্দ করে, আর আল্লাহ পবিত্রতা অর্জনকারীদের পছন্দ করেন।

৫. আল্লাহ তা‘আলা ঋতুমতী নারীদের সম্পর্কে বলেছেন:

﴿فَٱعۡتَزِلُواْ ٱلنِّسَآءَ فِي ٱلۡمَحِيضِ وَلَا تَقۡرَبُوهُنَّ حَتَّىٰ يَطۡهُرۡنَۖ فَإِذَا تَطَهَّرۡنَ فَأۡتُوهُنَّ مِنۡ حَيۡثُ أَمَرَكُمُ ٱللَّهُۚ ٢٢٢ ﴾ [البقرة: ٢٢٢]

“সুতরাং তোমরা হায়েযকালে স্ত্রীদের থেকে দূরে থাক এবং তারা পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত তাদের নিকটবর্তী হয়ো না। অতঃপর যখন তারা ‘তাতহীর’ তথা ভালোভাবে পবিত্র হবে তখন তাদের নিকট আস, যেভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন”। সূরা বাকারা: (২২২)

এ আয়াতের অর্থ কখনো এরূপ নয় যে, তাদের সাথে সহবাস কর না যাবত না তারা মাসুম ও নিষ্পাপ হয়, যখন নিষ্পাপ হয় তাদের সাথে সহবাস কর! ‘তাতহীর’ শব্দের অর্থ যদি নিষ্পাপ হওয়া বুঝাতো তাহলে এটাই আয়াতের ব্যাখ্যা হওয়া উচিত ছিল, তখন ইসলামী শরীয়তে নিষ্পাপ নারী ব্যতীত সহবাস বৈধ হত না। কিন্তু এ কথা তো কেউই বলে না!!

৬. ঋতুমতী নারীদের নিকটবর্তী হওয়ার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে উক্ত আয়াতের শেষে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلتَّوَّٰبِينَ وَيُحِبُّ ٱلۡمُتَطَهِّرِينَ ٢٢٢ ﴾ [البقرة: ٢٢٢]

“নিশ্চয় আল্লাহ তাওবাকারীদেরকে ভালবাসেন এবং ভালবাসেন ‘তাতহীর’ তথা অধিক পবিত্রতা অর্জনকারীদেরকে”। [সূরা আল-বাকারা: (২২২)] অথচ সবার নিকটই পবিত্রতা অর্জনকারী এসব স্বামী ও নিষ্পাপ হওয়ার মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই।

৭. ইয়াহূদী ও মুনাফিকদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ لَمۡ يُرِدِ ٱللَّهُ أَن يُطَهِّرَ قُلُوبَهُمۡۚ لَهُمۡ فِي ٱلدُّنۡيَا خِزۡيٞۖ وَلَهُمۡ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيمٞ ٤١ ﴾ [المائ‍دة: ٤١]

“এরাই হচ্ছে তারা, যাদের অন্তরসমূহকে আল্লাহ ‘তাতহীর’ তথা পবিত্র করতে চান না। তাদের জন্য রয়েছে দুনিয়াতে লাঞ্ছনা এবং আখেরাতে তাদের জন্য রয়েছে মহাআযাব”। সূরা মায়েদা: (৪১)

এ আয়াতের অর্থ কখনো এরূপ নয় যে, আল্লাহ তাদের নিষ্পাপ করতে চান না, অর্থাৎ আল্লাহ তাদের অন্তরকে পাপের ইচ্ছা ও গুনাহের প্রতি ধাবিত হওয়া থেকে মুক্ত করতে চান এরূপ অর্থ নয়। আবার এ সূরার অপর আয়াত وَلَٰكِن يُرِيدُ لِيُطَهِّرَكُمۡ (৫/৬) এর অর্থ “কিন্তু তিনি (আল্লাহ) চান তোমাদের (ঈমানদারদের)কে ‘তাতহীর’ তথা পবিত্র করতে।” এ আয়াতের অর্থ ‘কিন্তু আল্লাহ তোমাদেরকে পাপ থেকে নিষ্পাপ করতে চান” এরূপ নয়। অতএব সূরা আল-আহযাবের ৩৩ নং আয়াতেও ‘তাতহীর’ অর্থ নিষ্পাপ নয়।

৮. লূত আলাইহিস সালাম তার মেয়েদের সম্পর্কে বলেছেন:

﴿ قَالَ يَٰقَوۡمِ هَٰٓؤُلَآءِ بَنَاتِي هُنَّ أَطۡهَرُ لَكُمۡۖ ٧٨ ﴾ [هود: ٧٨]

“সে বলল, হে আমার কওম, এরা আমার মেয়ে, তারা তোমাদের জন্য পবিত্র”। সূরা হুদ: (৭৮), এখানে ‘আতহার’ বা সবচেয়ে পবিত্র শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু এর দ্বারা তার মেয়েদের নিষ্পাপ ও মাসুম ঘোষণা করা হয় নি।

 

আমরা দেখলাম উল্লেখিত আয়াতসমূহে ‘তাতহীর’ শব্দ কেবল ‘পবিত্র’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, যাদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে তারা কেউ নিষ্পাপ নয়। শিয়ারা এসব আয়াতকে আয়াতে ‘তাতহীর’ বলে না। বস্তুত উম্মুল মুমেনিনগণের প্রসঙ্গে নাযিল হওয়া আয়াতের শেষাংশকে ‘আয়াতে তাতহীর’ বলা কুরআনের অপব্যাখ্যা, গোঁড়ামি ও মূর্খতা ভিন্ন কিছু নয়।

 

আল্লাহর إرادة বা ইচ্ছার অর্থ:

কুরআনুল কারীমের সূরা আল-আহযাবের ৩৩ নং আয়াতে ‘তাতহীর’ এর ইচ্ছা, চাওয়া বা ইরাদা অর্থ আল্লাহর নির্দেশ, মহব্বত ও সন্তুষ্টি। অর্থাৎ আল্লাহ তোমাদের থেকে নাপাকি দূর করতে পছন্দ করেন। এমন নয় যে, এ আয়াতের কারণে তাদের থেকে নাপাকি দূর হয়ে গেছে এবং তারা পবিত্র হয়ে গেছেন। এর স্পষ্ট উদাহরণ হচ্ছে আল্লাহ সবার জন্য চান বা ইরাদা করেন জান্নাতে প্রবেশ করুক, এখানে তার চাওয়া অর্থ পছন্দ বা মহব্বত করা। যারা আল্লাহর পছন্দকে প্রাধান্য দিবে তাদের জন্য রয়েছে পুরষ্কার, আর যারা তার অপছন্দকে গ্রহণ করবে তাদের জন্য রয়েছে তিরষ্কার। পরকালে এ মানদণ্ডেই আল্লাহ তাদের জন্য জান্নাত বা জাহান্নামের ফয়সালা করবেন। তাই এসব আয়াতে ইচ্ছা বা চাওয়া অর্থ আল্লাহর পছন্দ ও মহব্বত, যা ঘটা জরুরী নয়, কারণ আল্লাহ তা ওয়াজিব করেন নি। এটাকে বলা হয়, আল্লাহর শরীয়তগত ইচ্ছা, যা হওয়া আল্লাহ পছন্দ করেন, কিন্তু তা হওয়া বাধ্যতামূলক নয়। সুতরাং আয়াতে বর্ণিত “তোমাদেরকে ভালোভাবে পবিত্র করতে ইচ্ছা করেন” এর দ্বারা পবিত্র হয়ে যাওয়া বাধ্যতামূলক নয়। বরং এতে তার সন্তুষ্টি রয়েছে, কেউ এর বাইরে চলতে চাইলে সেটা আল্লাহর পছন্দনীয় পথ হবে না, কিন্তু সেটা হওয়া সম্ভব। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বান্দার জন্য কুফরী পছন্দ করেন না, আল্লাহ বলেন,

﴿ إِن تَكۡفُرُواْ فَإِنَّ ٱللَّهَ غَنِيٌّ عَنكُمۡۖ وَلَا يَرۡضَىٰ لِعِبَادِهِ ٱلۡكُفۡرَۖ وَإِن تَشۡكُرُواْ يَرۡضَهُ لَكُمۡۗ ﴾ [الزمر: ٧]

“যদি তোমরা কুফরী কর তবে (জেনে রাখ) আল্লাহ্ তোমাদের মুখাপেক্ষী নন। আর তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য কুফরী পছন্দ করেন না। এবং যদি তোমরা কৃতজ্ঞ হও তবে তিনি তোমাদের জন্য তা-ই পছন্দ করেন।” [সূরা আয-যুমার: ৭] কিন্তু তারপরও বান্দা কুফরী করছে, আবার তিনি পছন্দ করেন যে তার বান্দারা শুকরগুজার হবে, কিন্তু তারা তা করছে না। সুতরাং বোঝা গেল যে আল্লাহর ইচ্ছা দু’ প্রকার। এক. শরী‘আতগত ইচ্ছা, তাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি রয়েছে, কিন্তু তা সংঘটিত হওয়া অবশ্যম্ভাবী নয়। দুই. প্রকৃতিগত ইচ্ছা, যাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি থাকতে হবে এমন নয়, কিন্তু তা সংঘটিত হওয়া অবশ্যম্ভাবী। সে হিসেবে মৌলিকভাবে ‘আল্লাহর ইচ্ছা’র কয়েকটি অবস্থা হতে পারে।

  • যার ইচ্ছা আল্লাহ করেন (প্রকৃতিগতভাবে), কিন্তু তাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি নেই, যেমন, কোনো কোনো বান্দার পক্ষ থেকে কুফরী সংঘটিত হওয়া। এটি প্রকৃতিগত ইচ্ছা, শরীয়তগত ইচ্ছা নয়।
  • যার ইচ্ছা আল্লাহ করেন, আর তাতে আল্লাহর সন্তুষ্টিও রয়েছে, যেমন, ঈমানদারের ঈমান আনা। এখানে আল্লাহর প্রকৃতিগত ইচ্ছা ও শরীয়তগত ইচ্ছা উভয়টিই সংঘটিত হয়েছে।
  • যার ইচ্ছা আল্লাহ করেন (শরীয়তগতভাবে), আর তাতে আল্লাহর সন্তুষ্টিও রয়েছে, যেমন কাফের এর ঈমান আনা। খারাপ মানুষকে ভালো করা, অপবিত্রকে পবিত্র করা, ইত্যাদি। কিন্তু আল্লাহর এ জাতীয় ইচ্ছা ঘটা অবশ্যম্ভাবী নয়। হতেও পারে আবার নাও হতে পারে।

সুতরাং সূরা আল-আহযাবের ৩৩ নং আয়াতে বর্ণিত ‘আল্লাহ কর্তৃক পবিত্র করার ইচ্ছা’টি মূলত ‘আল্লাহর ইচ্ছা’র প্রকারসমূহের মধ্যে এই শেষোক্ত প্রকারের। যা হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। আর সে জন্যই বলা যায় যে, আল্লাহ তা‘আলা নবী-পরিবার, পরিজনকে পবিত্র করতে ইচ্ছা করেছেন বলেই তারা পবিত্র হয়ে গেছে ব্যাপারটি এমন নয়, বরং তা হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। আর সে জন্যই দেখা যায়, পরবর্তীকালের নবী পরিবারের কোনো কোনো বংশধরের মধ্যে কুফরী, নিফাক ও শির্কী কর্মকাণ্ড পর্যন্ত সংঘটিত হয়েছিল।

 

رجس বা নাপাকির অর্থ:

কথিত আয়াতে তাতহীরে আল্লাহ তা‘আলা আহলে বায়েত থেকে রিজস দূর করতে চান। পবিত্র কুরআনে রিজ্‌স বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِنَّمَا ٱلۡخَمۡرُ وَٱلۡمَيۡسِرُ وَٱلۡأَنصَابُ وَٱلۡأَزۡلَٰمُ رِجۡسٞ مِّنۡ عَمَلِ ٱلشَّيۡطَٰنِ فَٱجۡتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُونَ ٩٠ ﴾ [المائ‍دة: ٩٠]

“হে মুমিনগণ, নিশ্চয় মদ, জুয়া, প্রতিমা-বেদী ও ভাগ্যনির্ধারক তীরসমূহ তো নাপাক [রিজ্‌স] শয়তানের কর্ম”। সূরা আনআম: (৯০), এখানে রিজ্‌স অর্থ নাপাক ও হারাম খাদ্য-পানীয় এবং শয়তানি কর্ম। অন্যত্র ইরশাদ করেন:

﴿قُل لَّآ أَجِدُ فِي مَآ أُوحِيَ إِلَيَّ مُحَرَّمًا عَلَىٰ طَاعِمٖ يَطۡعَمُهُۥٓ إِلَّآ أَن يَكُونَ مَيۡتَةً أَوۡ دَمٗا مَّسۡفُوحًا أَوۡ لَحۡمَ خِنزِيرٖ فَإِنَّهُۥ رِجۡسٌ أَوۡ فِسۡقًا أُهِلَّ لِغَيۡرِ ٱللَّهِ بِهِۦۚ ١٤٥﴾ [الانعام: ١٤٥]

“বল, আমার নিকট যে ওহী পাঠানো হয়, তাতে আমি আহারকারীর ওপর কোন হারাম পাই না, যা সে আহার করে। তবে যদি মৃত কিংবা প্রবাহিত রক্ত অথবা শূকরের গোশত হয়, কারণ নিশ্চয় তা অপবিত্র কিংবা অবৈধ যা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য যবেহ করা হয়েছে”। সূরা আন‘আম: (১৪৫)

আবার কখনো কখনো “রিজস” শব্দ দ্বারা শির্ক বুঝানো হয়। আল্লাহ তা’আলা বলেন:

﴿ فَٱجۡتَنِبُواْ ٱلرِّجۡسَ مِنَ ٱلۡأَوۡثَٰنِ ٣٠ ﴾ [الحج : ٣٠]

“সুতরাং মূর্তিপূজার অপবিত্রতা থেকে বিরত থাক”। সূরা হজ: (৩০)

কখনো “রিজস” শব্দ দ্বারা অকল্যাণ, গোমরাহী ও অনিষ্ট বুঝানো হয়, আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَمَن يُرِدۡ أَن يُضِلَّهُۥ يَجۡعَلۡ صَدۡرَهُۥ ضَيِّقًا حَرَجٗا كَأَنَّمَا يَصَّعَّدُ فِي ٱلسَّمَآءِۚ كَذَٰلِكَ يَجۡعَلُ ٱللَّهُ ٱلرِّجۡسَ عَلَى ٱلَّذِينَ لَا يُؤۡمِنُونَ ١٢٥ ﴾ [الانعام: ١٢٥]

“আর যাকে ভ্রষ্ট করতে চান, তার বুক সঙ্কীর্ণÑসঙ্কুচিত করে দেন, যেন সে ‎আসমানে আরোহণ করছে। এমনিভাবে আল্লাহ অকল্যাণ দেন তাদের উপর, ‎যারা ঈমান আনে না”। সূরা আন‘আম: (১২৫)‎ অন্যত্র তিনি ইরশাদ করেন:

﴿ وَيَجۡعَلُ ٱلرِّجۡسَ عَلَى ٱلَّذِينَ لَا يَعۡقِلُونَ ١٠٠ ﴾ [يونس : ١٠٠]

“এবং ‎যারা বুঝে না তিনি আযাব চাপিয়ে দেবেন তাদের উপর”। সূরা ইউনুস: (১০০) অর্থাৎ যারা আল্লাহর আদেশ-নিষেধ বুঝে না, তার উপদেশ ও নসিহতের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করে না, তাদের ওপর আল্লাহ অনিষ্ট ও গোমরাহী অবধারিত করে দেন।

কখনো “রিজস” শব্দ দ্বারা শাস্তি বুঝানো হয়, আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ قَالَ قَدۡ وَقَعَ عَلَيۡكُم مِّن رَّبِّكُمۡ رِجۡسٞ وَغَضَبٌۖ ٧١ ﴾ [الاعراف: ٧٠]

“সে বলল, ‘নিশ্চয় তোমাদের উপর তোমাদের রবের পক্ষ থেকে আযাব ও ক্রোধ ‎পতিত হয়েছে”। সূরা আরাফ: (৭০)

উপরোক্ত আয়াতসমূহে রিজ্‌স শব্দ শয়তানি কর্ম যেমন মদ, জুয়া, প্রতিমা-বেদী ও ভাগ্যনির্ধারক তীরসমূহ; হারাম, অপবিত্র ও অবৈধ বস্তু যেমন মৃত কিংবা প্রবাহিত রক্ত অথবা শূকরের গোশত; মূর্তিপূজার অপবিত্রতা, অকল্যাণ, অশ্লীলতা ও আযাব ইত্যাদি অর্থ প্রদান করেছে, কোথাও নিষ্পাপ অর্থ প্রদান করেনি।

অতএব আমরা নিশ্চিত যে, কথিত আয়াতে তাতহীর দ্বারা নবী পরিবার বা আলি পরিবার কাউকে নিষ্পাপ বা মাসুম প্রমাণ করা উদ্দেশ্য নয়, বরং আল্লাহর ইচ্ছা, পছন্দ ও মহব্বত করেন যে, তারা কুফর-শিরক, শয়তানী কর্ম, চারিত্রিক অশ্লীলতা, হারাম খাদ্য-পানীয় এবং প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য নাপাক বস্তু থেকে পাক-পবিত্র হোক। তাদের সম্পর্কে খারাপ জনশ্রুতি, কলঙ্ক ও কোন দুর্নাম না থাক। তারা আল্লাহর আদেশ ও নিষেধগুলো যথাযথ পালন করুক এবং তাদের ঘরে আল্লাহর যে আয়াত ও হিকমত পাঠ করা হয়, তা তিলাওয়াত করুক ও তার উপদেশ থেকে উপকৃত হোক।

 

সাহাবিদের সম্পর্কে আয়াতে তাতহীর থেকে আরো উচ্চতর প্রশংসা রয়েছে কুরআনে:

শিয়াদের কথিত আয়াতে তাতহীরে আহলে বায়েতের যে প্রশংসা রয়েছে, তার চেয়ে অধিক প্রশংসা রয়েছে সাহাবিদের সম্পর্কে অন্যান্য আয়াতে। অথচ তাদেরকে মাসুম বা নিষ্পাপ বলা হয় না। তার একটি উদাহরণ যেমন:

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِن جَآءَكُمۡ فَاسِقُۢ بِنَبَإٖ فَتَبَيَّنُوٓاْ أَن تُصِيبُواْ قَوۡمَۢا بِجَهَٰلَةٖ فَتُصۡبِحُواْ عَلَىٰ مَا فَعَلۡتُمۡ نَٰدِمِينَ ٦ وَٱعۡلَمُوٓاْ أَنَّ فِيكُمۡ رَسُولَ ٱللَّهِۚ لَوۡ يُطِيعُكُمۡ فِي كَثِيرٖ مِّنَ ٱلۡأَمۡرِ لَعَنِتُّمۡ وَلَٰكِنَّ ٱللَّهَ حَبَّبَ إِلَيۡكُمُ ٱلۡإِيمَٰنَ وَزَيَّنَهُۥ فِي قُلُوبِكُمۡ وَكَرَّهَ إِلَيۡكُمُ ٱلۡكُفۡرَ وَٱلۡفُسُوقَ وَٱلۡعِصۡيَانَۚ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلرَّٰشِدُونَ ٧ فَضۡلٗا مِّنَ ٱللَّهِ وَنِعۡمَةٗۚ وَٱللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٞ ٨﴾ [الحجرات: ٦، ٨]

“হে ঈমানদারগণ, যদি কোন ফাসিক তোমাদের কাছে কোন সংবাদ নিয়ে আসে, তাহলে তোমরা তা যাচাই করে ‎নাও। এ আশঙ্কায় যে, আমরা অজ্ঞতাবশত কোন কওমকে আক্রমণ করে বসবে, ফলে তোমরা তোমাদের ‎কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হবে। আর তোমরা জেনে রাখ যে, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর রাসূল রয়েছেন। সে যদি ‎অধিকাংশ বিষয়ে তোমাদের কথা মেনে নিত, তাহলে তোমরা অবশ্যই কষ্টে পতিত হতে। কিন্তু আল্লাহ তোমাদের ‎কাছে ঈমানকে প্রিয় করে দিয়েছেন এবং তা তোমাদের অন্তরে সুশোভিত করেছেন। আর তোমাদের কাছে কুফরি, ‎পাপাচার ও অবাধ্যতাকে অপছন্দনীয় করে দিয়েছেন। তারাই তো সত্য পথপ্রাপ্ত। আল্লাহর পক্ষ থেকে করুণা ও ‎নিয়ামত স্বরূপ। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়”। সূরা হুজুরাত: (৬-৮)‎

শিয়াদের ন্যায় যদি আমরা দলিল হিসেবে অস্পষ্ট ও মুতাশাবেহ আয়াত গ্রহণ করতাম, তাহলে উল্লেখিত সাহাবিদের নিষ্পাপ বলতাম। আমাদের এ দলিল তাদের দলিলের চেয়ে শক্তিশালী ও স্পষ্ট ছিল। কারণ এখানে স্পষ্ট রয়েছে যে, তাদের নিকট কুফর, পাপাচার ও ফাসেকিসহ সকল পাপ ও গুনাহ অপছন্দনীয় করে দেয়া হয়েছে। অধিকন্তু তাদের নিকট ঈমান পছন্দনীয় ও তাদের অন্তরে তা সৌন্দর্যমণ্ডিত করে দেয়া হয়েছে। এ আয়াতে বর্ণিত গুণাগুণ সাহাবীদেরকে নিষ্পাপ ও মাসুম পর্যায়ে নিয়ে যায়[1]। তাদেরকে আরো বলা হয়েছে ‘রাশেদুন’ তথা সত্য পথপ্রাপ্ত। এরসাথে যদি তাদের আনুগত্য করার নির্দেশ সম্বলিত আয়াত একত্র করি, যেমন:

﴿وَٱلسَّٰبِقُونَ ٱلۡأَوَّلُونَ مِنَ ٱلۡمُهَٰجِرِينَ وَٱلۡأَنصَارِ وَٱلَّذِينَ ٱتَّبَعُوهُم بِإِحۡسَٰنٖ رَّضِيَ ٱللَّهُ عَنۡهُمۡ وَرَضُواْ عَنۡهُ وَأَعَدَّ لَهُمۡ جَنَّٰتٖ تَجۡرِي تَحۡتَهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُ خَٰلِدِينَ فِيهَآ أَبَدٗاۚ ذَٰلِكَ ٱلۡفَوۡزُ ٱلۡعَظِيمُ ١٠٠﴾ [التوبة: 100]

“আর মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা প্রথম অগ্রগামী এবং যারা তাদেরকে অনুসরণ করেছে সুন্দরভাবে, আল্লাহ্‌ তাদের প্রতি ‎সন্তুষ্ট হয়েছেন আর তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। আর তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত করেছেন জান্নাতসমূহ, যার তলদেশে নদী ‎প্রবাহিত, তারা সেখানে চিরস্থায়ী হবে”। এটাই মহাসাফল্য”। [সূরা তাওবা: (১০০)] এখানে মুহাজির ও আনসারদের অনুসারীদের আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে, যা প্রকৃতপক্ষে তাদের অনুসরণ করার নির্দেশ। অতএব তাদের নিষ্পাপ বলতে বাধা কোথায়, সব আলামত তো এখানেই রয়েছে[2]!

(খ). “আহলুল বাইত” দ্বারা উদ্দেশ্য কি?

আরবিতে أَهْلُ الْبَيْتِ [আহলুল বাইত] দ্বারা সর্বপ্রথম স্ত্রী, অতঃপর পর্যায়ক্রমে একই ঘর ও এক ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে বসবাসকারী যেমন ছেলে-মেয়ে, পিতা-মাতা ইত্যাদি বুঝানো হয়। অতঃপর আত্মীয় স্বজন এবং একই বংশের লোকদের বুঝানো হয়।

কুরআনে আহল দ্বারা মৌলিক অর্থ স্ত্রীই বুঝানো হয়েছে, যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿فَلَمَّا قَضَىٰ مُوسَى ٱلۡأَجَلَ وَسَارَ بِأَهۡلِهِۦٓ﴾ [القصص: ٢٩]

“অতঃপর মূসা যখন মেয়াদ পূর্ণ করল এবং সপরিবারে যাত্রা করল”। [সূরা কাসাস: (২৯)] নিশ্চিতভাবে এখানে আহাল দ্বারা মূসা আলাইহিস সালামের স্ত্রী উদ্দেশ্য, কারণ তার সাথে আর কেউ ছিল না। মিসরের বাদশাহর স্ত্রী তার স্বামীকে বলেছিল:

﴿مَا جَزَآءُ مَنۡ أَرَادَ بِأَهۡلِكَ سُوٓءًا إِلَّآ أَن يُسۡجَنَ أَوۡ عَذَابٌ أَلِيمٞ ٢٥﴾ [يوسف:٢٥]

“যে লোক তোমার পরিবারের সাথে মন্দকর্ম করতে চেয়েছে, তাকে কারাবন্দী করা বা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দেয়া ছাড়া তার আর কী দণ্ড হতে পারে? [সূরা ইউসুফ: (২৫)] এখানে আহল দ্বারা নিশ্চিতভাবে স্ত্রী উদ্দেশ্য।

(أهل البيت) আহলুল বায়েতের দ্বিতীয় শব্দ البيت অর্থ ঘর। সূরা আল-আহযাবের এ অংশে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীদের সম্বোধন করে البيت একবচন ও بيوت বহুবচন শব্দটি তিনবার উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন:

(ক). وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ

(খ).إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمْ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيتِ

(গ). وَاذْكُرْنَ مَا يُتْلَى فِي بُيُوتِكُنَّ

কয়েক আয়াত পর আবারও البيت শব্দের উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু সেখানে البيت শব্দটির সম্পর্ক জুড়ে দেয়া হয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে, এর ন্যায় তার স্ত্রীদের সাথে সম্পৃক্ত করা হয় নি, যেমন আল্লাহর বাণী:

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَدۡخُلُواْ بُيُوتَ ٱلنَّبِيِّ إِلَّآ أَن يُؤۡذَنَ لَكُمۡ ٥٣ ﴾ [الاحزاب : ٥٣]

“হে মুমিনগণ, তোমরা নবীর ঘরসমূহে প্রবেশ করো না; অবশ্য যদি তোমাদেরকে অনুমতি দেয়া হয়”। সূরা আহযাব: (৫৩), এ আয়াতের শেষে আল্লাহ বলেন:

﴿وَإِذَا سَأَلۡتُمُوهُنَّ مَتَٰعٗا فَسۡ‍َٔلُوهُنَّ مِن وَرَآءِ حِجَابٖۚ ذَٰلِكُمۡ أَطۡهَرُ لِقُلُوبِكُمۡ وَقُلُوبِهِنَّۚ ٥٣ ﴾ [الاحزاب : ٥٣]

“আর যখন নবীপত্নীদের কাছে তোমরা কোন সামগ্রী চাইবে তখন পর্দার আড়াল থেকে চাইবে; এটি তোমাদের ও তাদের অন্তরের ‎জন্য অধিকতর পবিত্র”। সূরা আহযাব: (৫৩), আয়াতের এ অংশ থেকে প্রমাণিত যে, নবীর ঘরের প্রথম সদস্য তার স্ত্রীগণ।‎

 

অতএব এ আয়াতে ‘বুয়ূতে নবী’ বা নবীর ঘর ও পূর্বের আয়াতে ‘আহলাল বাইত’ বা ঘরের পরিবার মূলত একই ঘর। ঘরের সম্পর্ক কখনো স্ত্রী তথা আহলের সাথে, কখনো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে করা হয়েছে। নবীর ঘর তার স্ত্রীদের ঘর, তার স্ত্রীদের ঘর তার ঘর। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আলাদা কোন ঘর ছিল না। বিবেকও সমর্থন করে না যে, তার ঘর তার স্ত্রীদের ঘর হবে না। অতএব ঘর একটিই অর্থাৎ নবীর ঘর, এর পরিবার সবাই আহলুল বাইত। রহমত, বরকত ও সম্মান এ ঘরেই নাযিল হয়। নবীর সম্মানে তার স্ত্রীদের বিষয় যে গুরুত্ব রাখে, আলির ঘর কখনোই সে গুরুত্ব রাখে না। আলির ঘরে যেহেতু নবীর সন্তান রয়েছে, তাই তিনি চেয়েছেন তার পরিবারের ন্যায় আলির পরিবার বরকত, রহমত ও পবিত্রতা লাভ করুক। এ জন্যই তিনি আল্লাহর নিকট দো‘আ করেছেন। সুতরাং আহলুল বাইত দ্বারা স্ত্রীদের ব্যতীত অন্য অর্থ নেয়া চরম গোঁড়ামি এবং বিবেক, ভাষা ও পরিভাষার বিপরীতে অবস্থান নেয়া।

যুক্তি সঙ্গত কোন কারণ ব্যতীত আহলূল বায়েতের মৌলিক ও প্রকৃত অর্থ ত্যাগ করা ব্যাকরণের ভাষায় বৈধ নয়। শিয়ারা “আহলে বায়েত” এর যে অর্থ নেয় তা প্রকৃত অর্থ নয়। কোন শব্দের প্রকৃত অর্থ না নিয়ে দূরবর্তী অর্থ নেয়ার জন্য দু’টি শর্ত অবশ্যই জরুরী:

১. মৌলিক অর্থ গ্রহণ করা সম্ভব নয় এমন বাধা থাকা।

২. দূরবর্তী অর্থের কোন আলামত অথবা দলিল থাকা।

এখানে এ দু’টি বিষয়ের কোনটি নেই, না বাধা, না আলামত, একমাত্র প্রবৃত্তি, গোঁড়ামি ও মূর্খতা ব্যতীত! বরং যুক্তি ও ব্যাক্যরীতি মৌলিক অর্থই প্রমাণ করে, যা আমরা আয়াতের শানে নুযূলে উল্লেখ করব ইনশাআল্লাহ।

আহল এর দূরবর্তী অর্থ:

দূরবর্তী অর্থে ‘আহাল’ আত্মীয়-স্বজন বুঝায়, বরং একই বংশের সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে। যেমন ইউসুফ আলাইহিস সালাম তার ভাইদের বলেছিলেন:

﴿ وَأۡتُونِي بِأَهۡلِكُمۡ أَجۡمَعِينَ ٩٣ ﴾ [يوسف: ٩٢]

“আর তোমরা তোমাদের পরিবারের সকলকে নিয়ে আমার কাছে চলে আস”। সূরা ইউসুফ: (৯৩) পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ পরিবারের অর্থের বর্ণনা দিয়েছেন, যেমন:

﴿فَلَمَّا دَخَلُواْ عَلَىٰ يُوسُفَ ءَاوَىٰٓ إِلَيۡهِ أَبَوَيۡهِ وَقَالَ ٱدۡخُلُواْ مِصۡرَ إِن شَآءَ ٱللَّهُ ءَامِنِينَ ٩٩ وَرَفَعَ أَبَوَيۡهِ عَلَى ٱلۡعَرۡشِ وَخَرُّواْ لَهُۥ سُجَّدٗاۖ ١٠٠﴾ [يوسف: ٩٨، ٩٩]

“অতঃপর যখন তারা ইউসুফের নিকট প্রবেশ ‎করল, তখন সে তার পিতামাতাকে নিজের কাছে ‎‎স্থান করে দিল এবং বলল, ‘আল্লাহর ইচ্ছায় ‎আপনারা নিরাপদে মিসরে প্রবেশ করুন’। আর সে তার পিতামাতাকে রাজাসনে উঠাল এবং ‎তারা সকলে তার সামনে সেজদায় লুটিয়ে পড়ল”। সূরা ইউসুফ: (৯৯-১০০), অর্থাৎ ইউসূফ আলাইহিস সালামের এগারো ভাই ও পিতা-মাতা।

মূসা আলাইহিস সালামের বোন বলেছেন। আল্লাহর বাণী:

﴿ فَقَالَتۡ هَلۡ أَدُلُّكُمۡ عَلَىٰٓ أَهۡلِ بَيۡتٖ يَكۡفُلُونَهُۥ لَكُمۡ وَهُمۡ لَهُۥ نَٰصِحُونَ ١٢﴾ [القصص: ١٢]

“তারপর মুসার বোন এসে ‎বলল, ‘আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি ‎পরিবারের সন্ধান দেব, যারা এ শিশুটিকে ‎‎তোমাদের পক্ষে লালন পালন করবে এবং তারা ‎তার শুভাকাঙ্ক্ষী হবে”। সূরা কাসাস: (১২)

এখানে “আহলে বায়েত” দ্বারা গৃহকর্ত্রী মূসা আলাইহিস সালামের মা অবশ্যই উদ্দেশ্য, কারণ দুগ্ধ দান একমাত্র তারই কাজ, কিন্তু পরিবারের সবাই যেহেতু তার প্রতি আন্তরিক ও তার কল্যাণ কামী, তাই নারী-পুরুষ সবাইকে শামিল করে পরবর্তীতে ক্রিয়ার পুংলিঙ্গ ও বহুবচন ব্যবহার করা হয়েছে।

 

দূরবর্তী অর্থে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কয়েকটি হাদিসে আহলে বায়েত দ্বারা বংশের লোকদের বুঝিয়েছেন:

যায়েদ ইব্‌ন আরকাম রাদিয়াল্লাহু আনহুকে প্রশ্ন করা হয়েছিল: “তার স্ত্রীগণ কি আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত? তিনি বলেন: তার স্ত্রীগণ আহলে বায়তের অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু যে আহলে বায়তের ওপর সদকা হারাম, তারা হলেন: আলি, জাফর, আকিল ও আব্বাসের পরিবার”। মুসলিম: (৪৪৩২) অতএব আব্বাস, আব্দুল মুত্তালিব, আকিল ইব্‌ন আবি তালেব ও জা‘ফর ইব্‌ন আবি তালেবের পরিবার।

আব্দুল মুত্তালিবের সন্তানও আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত। মুসলিমে এসেছে: রবিআ ইব্‌ন হারেস ইব্‌ন আব্দুল মুত্তালিব ও আব্বাস ইব্‌ন আব্দুল মুত্তালিব, তাদের সন্তান আব্দুল মুত্তালিব ইব্‌ন রাবিআ ও ফজল ইব্‌ন আব্বাসকে সদকার বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট প্রেরণ করেন, তিনি তাদেরকে বলেন: “সদকা মুহাম্মাদের পরিবারের জন্য উচিত নয়, তা শুধু মানুষের ময়লা”। মুসলিম: (১৭৯১), এখানে তাদেরকে তিনি মুহাম্মদের পরিবার আখ্যা দিয়েছেন।

এ দু’টি হাদিস থেকে প্রমাণ হল যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাদা আব্দুল মুত্তালিব ও চাচা আবু তালেবের সন্তানগণ মুহাম্মাদের আহলের অন্তর্ভুক্ত, শুধু আলি, ফাতেমা, হাসান-হুসাইন নয়। তাদের জন্য সদকা হারাম।

মোদ্দাকথা: আহলে বায়েতের মৌলিক ও প্রকৃত অর্থ স্ত্রী, অতঃপর সন্তান, পিতা-মাতা ও বংশকে অন্তর্ভুক্ত করে। যেমন আমরা যখন কাউকে সপরিবারে আমন্ত্রণ করি, তার স্ত্রীই প্রথম উদ্দেশ্য হয়। সন্তান থাকলে স্ত্রীসহ সন্তানও উদ্দেশ্য হয়। তার পরিবারে যদি পিতা-মাতা ও কোন আত্মীয় থাকে, হোক দূরের, সেও অন্তর্ভুক্ত হয়। সে যাদের অভিভাবক, যাদের ভরণপোষণ তার দায়িত্বে এবং যারা তার অধীন ও তত্ত্বাবধানে রয়েছে সবাই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। কখনো আরো ব্যাপক অর্থে বংশের জন্য পরিবার ব্যবহার হয়, অনুরূপ আহলে বাইত শব্দটি।

 

(গ). আহলে বায়েত দ্বারা যদি নবীগণের স্ত্রী উদ্দেশ্য হয়, পুংলিঙ্গের “মীম” দ্বারা কেন সম্বোধন করা হল?

একই আয়াতের প্রথমাংশে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীদের সম্বোধন করে স্ত্রী লিঙ্গের “নুন” ব্যবহার করা হয়েছে, যেমন: ﴿ وَقَرۡنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجۡنَ تَبَرُّجَ ٱلۡجَٰهِلِيَّةِ ٱلۡأُولَىٰۖ وَأَقِمۡنَ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتِينَ ٱلزَّكَوٰةَ وَأَطِعۡنَ ٱللَّهَ وَرَسُولَه ইত্যাদি, অতঃপর আয়াতের দ্বিতীয়াংশে পুংলিঙ্গের মীম ও সর্বনাম ব্যবহার করা হয়েছে, যেমন: إِنَّمَا يُرِيدُ ٱللَّهُ لِيُذۡهِبَ عَنكُمُ ٱلرِّجۡسَ أَهۡلَ ٱلۡبَيۡتِ وَيُطَهِّرَكُمۡ تَطۡهِيرٗا ٣٣ ﴾ এর কারণ, আয়াতের প্রথমাংশের আদেশ ও নিষেধে শুধু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগণ উদ্দেশ্যে ছিল, কিন্তু এসব আদেশ ও নিষেধের মূল উদ্দেশ্য তাদেরকে পবিত্র করা, তার পরিবার থেকে দুর্নাম ও কু-শ্রুতি দূর করা, যেখানে পরিবারের প্রধান হিসেবে রাসূল নিজেও শামিল, তাই তাকে প্রাধান্য দিয়ে সকলকে অন্তর্ভুক্ত করে পুংলিঙ্গের (মীম) ব্যবহার করা হয়েছে।

একই কারণে সূরা হুদে ইবরাহিম আলাইহিস সালামের স্ত্রীকে সম্বোধন করে স্ত্রী লিঙ্গের নুন দ্বারা আয়াতের শুরু হলেও শেষে পুংলিঙ্গের মীম ব্যবহার করা হয়েছে। দেখুন: আল্লাহর বাণী:

﴿ قَالُوٓاْ أَتَعۡجَبِينَ مِنۡ أَمۡرِ ٱللَّهِۖ رَحۡمَتُ ٱللَّهِ وَبَرَكَٰتُهُۥ عَلَيۡكُمۡ أَهۡلَ ٱلۡبَيۡتِۚ ٧٣ ﴾ [هود: ٧٣]

“তারা বলল, ‘আল্লাহর সিদ্ধান্তে তুমি আশ্চর্য হচ্ছ, হে নবী পরিবার তোমাদের ওপর আল্লাহর রহমত ও তার বরকত”। সূরা হুদ: (৭৩) আয়াতে যদিও মূল উদ্দেশ্য ইবরাহিম আলাইহিস সালামের স্ত্রী, কিন্তু বরকত ও রহমত যেহেতু উভয়কে শামিল করে, তাই ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে প্রাধান্য দিয়ে পুংলিঙ্গের মীম ব্যবহার করা হয়েছে।

 

(ঘ). আয়াতের শানে নুযূল কী?

আহযাব (খন্দক) যুদ্ধ শেষে সাথে সাথেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু কুরাইজার বিষয়টি মীমাংসা করেন। বনু কুরাইজার ইয়াহূদীরা খন্দকের যুদ্ধের জন্য মক্কার কাফেরদের উস্কানি দিয়ে ছিল ও তাদের সাথে চুক্তি করেছিল, অথচ তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মদীনার নিরাপত্তা বিষয়ে চুক্তিবদ্ধ ছিল। মক্কার কাফেররা যখন ব্যর্থ অভিযান শেষে বিফল ফিরে গেল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চুক্তি ভঙ্গকারী ইহুদীদের দিকে মনোযোগ দেন। তাদেরকে বিতাড়িত করেন, তাদের জমি, ঘর ও সহায়-সম্পদ গণিমত হিসেবে গ্রহণ করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَأَنزَلَ ٱلَّذِينَ ظَٰهَرُوهُم مِّنۡ أَهۡلِ ٱلۡكِتَٰبِ مِن صَيَاصِيهِمۡ وَقَذَفَ فِي قُلُوبِهِمُ ٱلرُّعۡبَ فَرِيقٗا تَقۡتُلُونَ وَتَأۡسِرُونَ فَرِيقٗا ٢٦ وَأَوۡرَثَكُمۡ أَرۡضَهُمۡ وَدِيَٰرَهُمۡ وَأَمۡوَٰلَهُمۡ وَأَرۡضٗا لَّمۡ تَطَ‍ُٔوهَاۚ وَكَانَ ٱللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٗا ٢٧ ﴾ [الاحزاب : ٢٦، ٢٧]

“আর আহলে কিতাবদের মধ্যে যারা তাদের সহযোগিতা করেছিল, আল্লাহ তাদেরকে অবতরণ করালেন তাদের দুর্গসমূহ থেকে ‎এবং তাদের অন্তরসমূহে ভীতির সঞ্চার করলেন। ফলে তোমরা হত্যা করছ একদলকে, আর বন্দী করছ অন্য দলকে। আর তিনি ‎‎তোমাদেরকে উত্তরাধিকারী করলেন তাদের ভূমি, তাদের ঘরÑবাড়ী ও তাদের ধনÑসম্পদের এবং এমন ভূমির যাতে তোমরা ‎পদার্পণও করনি। আল্লাহ সব কিছুর উপর সর্বশক্তিমান”। [সূরা আহযাব: (২৬-২৭)] এসব গনিমত গরিব মুসলিমগণ লাভ করে অভাবমুক্ত হলেন, বিশেষ করে মুহাজিরগণ। তারা নিজেদের ঘর ও পরিবারে সাধ্যানুসারে সচ্ছলতা দিলেন। তাদের নারীদের ও পরিবার দেখে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগণ অনুরূপ ভরণপোষণ তলব করল, অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা পরবর্তী আয়াত নাযিল করেন:

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ قُل لِّأَزۡوَٰجِكَ إِن كُنتُنَّ تُرِدۡنَ ٱلۡحَيَوٰةَ ٱلدُّنۡيَا وَزِينَتَهَا فَتَعَالَيۡنَ أُمَتِّعۡكُنَّ وَأُسَرِّحۡكُنَّ سَرَاحٗا جَمِيلٗا ٢٨﴾

‎“হে নবী, তুমি তোমার স্ত্রীদেরকে বল, ‘যদি তোমরা ‎‎দুনিয়ার জীবন ও তার চাকচিক্য কামনা কর তবে ‎আস, আমি তোমাদের ভোগ-বিলাসের ব্যবস্থা ‎করে দেই এবং উত্তম পন্থায় তোমাদের বিদায় ‎করে দেই”। [সূরা আহযাব: (২৮)] পূর্বের আয়াতে যেসব সম্পদের উল্লেখ রয়েছে, তার ইচ্ছা পোষণ করেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগণ তার নিকট সচ্ছলতা তলব করেছিল। এ আয়াতে তার সমাধান দেয়া হয়েছে। এ হচ্ছে পূর্বাপর আয়াতের যোগসূত্র। এ আয়াতে দুনিয়াবি যে জীবন ও চাকচিক্য দেয়ার কথা বলা হয়েছে, তা মূলত পূর্বের আয়াতে উল্লেখিত বনু কুরাইজা থেকে প্রাপ্ত গণিমতের সম্পদ। এরপর পরবর্তী আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা বলে:

﴿ وَإِن كُنتُنَّ تُرِدۡنَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ وَٱلدَّارَ ٱلۡأٓخِرَةَ فَإِنَّ ٱللَّهَ أَعَدَّ لِلۡمُحۡسِنَٰتِ مِنكُنَّ أَجۡرًا عَظِيمٗا ٢٩ يَٰنِسَآءَ ٱلنَّبِيِّ مَن يَأۡتِ مِنكُنَّ بِفَٰحِشَةٖ مُّبَيِّنَةٖ يُضَٰعَفۡ لَهَا ٱلۡعَذَابُ ضِعۡفَيۡنِۚ وَكَانَ ذَٰلِكَ عَلَى ٱللَّهِ يَسِيرٗا ٣٠ ۞وَمَن يَقۡنُتۡ مِنكُنَّ لِلَّهِ وَرَسُولِهِۦ وَتَعۡمَلۡ صَٰلِحٗا نُّؤۡتِهَآ أَجۡرَهَا مَرَّتَيۡنِ وَأَعۡتَدۡنَا لَهَا رِزۡقٗا كَرِيمٗا ٣١ يَٰنِسَآءَ ٱلنَّبِيِّ لَسۡتُنَّ كَأَحَدٖ مِّنَ ٱلنِّسَآءِ إِنِ ٱتَّقَيۡتُنَّۚ فَلَا تَخۡضَعۡنَ بِٱلۡقَوۡلِ فَيَطۡمَعَ ٱلَّذِي فِي قَلۡبِهِۦ مَرَضٞ وَقُلۡنَ قَوۡلٗا مَّعۡرُوفٗا ٣٢ وَقَرۡنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجۡنَ تَبَرُّجَ ٱلۡجَٰهِلِيَّةِ ٱلۡأُولَىٰۖ وَأَقِمۡنَ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتِينَ ٱلزَّكَوٰةَ وَأَطِعۡنَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥٓۚ إِنَّمَا يُرِيدُ ٱللَّهُ لِيُذۡهِبَ عَنكُمُ ٱلرِّجۡسَ أَهۡلَ ٱلۡبَيۡتِ وَيُطَهِّرَكُمۡ تَطۡهِيرٗا ٣٣ وَٱذۡكُرۡنَ مَا يُتۡلَىٰ فِي بُيُوتِكُنَّ مِنۡ ءَايَٰتِ ٱللَّهِ وَٱلۡحِكۡمَةِۚ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ لَطِيفًا خَبِيرًا ٣٤ ﴾ [الاحزاب : ٢٨، ٣٤]

“আর যদি তোমরা আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও ‎পরকালীন নিবাস কামনা কর, তবে তোমাদের মধ্য ‎‎থেকে সৎকর্মশীলদের জন্য আল্লাহ অবশ্যই মহান ‎প্রতিদান প্রস্তুত করে রেখেছেন। ‎হে নবী-পত্নীগণ, তোমাদের মধ্যে যে কেউ ‎প্রকাশ্য অশ্লীল কাজ করবে, তার জন্য আযাব দ্বিগুণ ‎করা হবে। আর এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ। আর তোমাদের মধ্যে যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর ‎রাসূলের আনুগত্য করবে এবং নেক আমল করবে ‎আমি তাকে দু’বার তার প্রতিদান দেব এবং আমি ‎তার জন্য প্রস্তুত রেখেছি সম্মানজনক রিযক। হে নবী-পত্নীগণ, তোমরা অন্য কোন নারীর মত ‎নও। যদি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর, তবে ‎‎(পরপুরুষের সাথে) কোমল কণ্ঠে কথা বলো না, ‎তাহলে যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে সে প্রলুব্ধ হয়। ‎আর তোমরা ন্যায়সঙ্গত কথা বলবে। আর তোমরা নিজ গৃহে অবস্থান করবে এবং প্রাক-‎জাহেলী যুগের মত সৌন্দর্য প্রদর্শন করো না। আর ‎‎তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত প্রদান কর ‎এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর। হে ‎নবী পরিবার, আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের ‎‎থেকে অপবিত্রতাকে দূরীভূত করতে এবং ‎‎তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে। আর তোমাদের ঘরে আল্লাহর যে, আয়াতসমূহ ও ‎হিকমত পঠিত হয়-তা তোমরা স্মরণ রেখো। ‎নিশ্চয়ই আল্লাহ অতি সূক্ষ্মদর্শী, সম্যক অবহিত। সূরা আহযাব: (২৮-৩৪)

এভাবেই আল্লাহ তা’আলা আহলে বায়েত তথা নবী পরিবারে সৃষ্ট জটিলতা সমাধান করেছেন। শানে নুযূল ও পূর্বাপর যোগসূত্রসহ এসব আয়াতে চিন্তা করলে যে কারো নিকট শিয়াদের অপব্যাখ্যা ও ইসলামের নামে হীনস্বার্থ সিদ্ধির মুখোশ খসে পড়বে। তারা যেহেতু দুনিয়া তলব করেছিল, তাই আল্লাহ তাদেরকে ইখতিয়ার দিয়েছেন দুনিয়া গ্রহণ কর, অথবা আল্লাহ, রাসূল ও আখেরাতকে গ্রহণ কর। নবীর পরিবারে কাউকে বেঁধে রাখা হয়নি। তারা যখন আল্লাহ, রাসূল ও আখেরাতকে গ্রহণ করল আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়া-আখেরাত উভয় দান করলেন। অতঃপর আল্লাহ তাদেরকে সংশোধন, পরিশুদ্ধি ও পবিত্রতা অর্জনের বিভিন্ন আদেশ, নিষেধ ও উপদেশ প্রদান করেন: “হে নবী পরিবার তোমরা এরূপ কর, এরূপ কর না, এরূপ করলে দ্বিগুণ সাওয়াব, এরূপ না করলে দ্বিগুণ শাস্তি”।

কারণ আল্লাহ চান নবীর ঘর ও তাতে বসবাসকারী সবাই অপবিত্রতা ও দোষ মুক্ত হোক, যা নবীর আদর্শ ও সম্মানকে ভূলুণ্ঠিত করতে পারে। অতএব যে নবী পরিবার ও তার সাথে সম্পৃক্ত হবে, তার স্বভাব ও চরিত্র নবীর আদর্শ মোতাবেক হওয়া চাই। যার ইচ্ছা নেই সে যেন তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয় অতঃপর যা ইচ্ছা করুক। এ জন্য নবীকে জিজ্ঞাসা করা হবে না, তখন তার সাওয়াব ও শাস্তি অন্যান্য মুসলিমদের মত হবে। যদি নবীর সাথে সম্পর্ক রাখ ও অপরাধে জড়িত হও, তাহলে শাস্তি দ্বিগুণ হবে যেমন পুরষ্কার দ্বিগুণ। এটা শুধু নবীর ঘরের সম্মান ও মর্যাদার কারণেই। যেমন মসজিদে সালাত আদায় করলে সাওয়াব দ্বিগুণ, সেখানে অপরাধের শাস্তিও দ্বিগুণ। আল্লাহর ঘরে চুরি করা আর রাস্তায় চুরি করা সমান নয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগণ তার পরিবার ও তার সাথে সম্পৃক্ত, তাদের সাওয়াবের পুরষ্কার যেরূপ দ্বিগুণ, পাপের শাস্তিও দ্বিগুণ।

অতঃপর আল্লাহ তা’আলা বলেন:

﴿… وَأَطِعۡنَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥٓۚ إِنَّمَا يُرِيدُ ٱللَّهُ لِيُذۡهِبَ عَنكُمُ ٱلرِّجۡسَ أَهۡلَ ٱلۡبَيۡتِ وَيُطَهِّرَكُمۡ تَطۡهِيرٗا ٣٣ وَٱذۡكُرۡنَ مَا يُتۡلَىٰ فِي بُيُوتِكُنَّ مِنۡ ءَايَٰتِ ٱللَّهِ وَٱلۡحِكۡمَةِۚ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ لَطِيفًا خَبِيرًا ٣٤ ﴾ [الاحزاب : ٣٣، ٣٤]

“… এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর। হে ‎নবী পরিবার, আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের ‎‎থেকে অপবিত্রতাকে দূরীভূত করতে এবং ‎‎তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে। আর তোমাদের ঘরে আল্লাহর যে, আয়াতসমূহ ও ‎হিকমত পঠিত হয়-তা তোমরা স্মরণ রেখো। ‎নিশ্চয়ই আল্লাহ অতি সূক্ষ্মদর্শী, সম্যক অবহিত। সূরা আহযাব: (২৮-৩৪)

অতএব যাদের উদ্দেশ্য করে এবং যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ আয়াত নাযিল হয়েছে, শিয়ারা কিভাবে তাদেরকে এর থেকে খারিজ করে!? অথচ শাব্দিক অর্থে তারাই আহলে বায়েতের প্রথম সদস্য, প্রেক্ষাপট বিবেচনায় তাদের ব্যতীত কাউকে এর অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব নয়। কিন্তু যে আরবি ভাষা বুঝে না, অথবা যার অন্তরে রয়েছে প্রবৃত্তি ও আল্লাহর রাস্তা থেকে বিরত রাখার ইচ্ছা, তার চোখ অন্ধ, বিবেক রুদ্ধ ও চিন্তা ব্যাধিগ্রস্ত। দেখুন শিয়ারা কিভাবে আল্লাহর কুরআনকে তিলাওয়াত করে:

হে নবী তোমার স্ত্রীদেরকে বল … يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ قُل لِّأَزۡوَٰجِكَ …
আর যদি তোমরা কামনা কর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল … وَإِن كُنتُنَّ تُرِدۡنَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُ …
‎হে নবী-পত্নীগণ, তোমাদের মধ্যে যে করবে … يَٰنِسَآءَ ٱلنَّبِيِّ مَن يَأۡتِ مِنكُنَّ …
আর তোমাদের মধ্যে যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর ‎রাসূলের আনুগত্য করবে … وَمَن يَقۡنُتۡ مِنكُنَّ لِلَّهِ وَرَسُولِهِ …
হে নবী-পত্নীগণ, তোমরা অন্য কোন নারীর মত ‎নও … يَٰنِسَآءَ ٱلنَّبِيِّ لَسۡتُنَّ …
আর তোমরা নিজ গৃহে অবস্থান করবে … وَقَرۡنَ فِي بُيُوتِكُنَّ …
‎এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর … وَأَطِعۡنَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُ …
হে ‎নবী পরিবার / আহলে বায়েত [আলি, ফাতেমা, হাসান ও হুসাইন !] আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের ‎‎থেকে অপবিত্রতাকে দূরীভূত করতে এবং ‎‎তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।

إِنَّمَا يُرِيدُ ٱللَّهُ لِيُذۡهِبَ عَنكُمُ ٱلرِّجۡسَ أَهۡلَ ٱلۡبَيۡتِ ]يا علي ويا فاطمة ويا الحسن ويا الحسين[ وَيُطَهِّرَكُمۡ تَطۡهِيرٗا

 

[হে নবী পত্নীগণ] আর স্মরণ কর তোমাদের ঘরে যে পঠিত হয় … وَٱذۡكُرۡنَ مَا يُتۡلَىٰ فِي بُيُوتِكُنَّ …
শিয়াদের এটা কি পাগলামি নয়!? আয়াতের পূর্বাপর নবীর স্ত্রীদের কথা, বারবার তাদেরকেই সম্বোধন, মাঝখানে তারা আলি, ফাতেমা ও হাসান-হুসাইনকে কিভাবে দাখিল করল?!

 

(ঙ). “হাদিসুল কিসা” কি, অর্থসহ জানতে চাই?

কথিত হাদিসুল কিসা উম্মুল মুমেনিন আয়েশা, উম্মে সালামা ও ওয়াসেলাহ ইব্‌ন আসকা রাদিয়াল্লাহু আনহুম প্রমুখ থেকে বিভিন্নভাবে বর্ণিত রয়েছে। তুলনামূলক বিশুদ্ধ ও প্রসিদ্ধ কয়েকটি বর্ণনা পেশ করছি: আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:

‎”خَرَجَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ غَدَاةً، وَعَلَيْهِ مِرْطٌ مُرَحَّلٌ مِنْ شَعْرٍ أَسْوَدَ، فَجَاءَ الْحَسَنُ بْنُ عَلِيٍّ، فَأَدْخَلَهُ، ثُمَّ جَاءَ الْحُسَيْنُ فَدَخَلَ مَعَهُ، ثُمَّ جَاءَتْ فَاطِمَةُ فَأَدْخَلَهَا، ثُمَّ جَاءَ عَلِيٌّ فَأَدْخَلَهُ، ثُمَّ قَالَ: إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا “

“একদা সকালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বের হলেন, তার গায়ে ছিল কালো পশমের চাদর, হাসান ইব্‌ন আলি আসল তাকে তাতে দাখিল করলেন, অতঃপর হুসাইন আসল তাকে তার সাথে দাখিল করলেন, অতঃপর ফাতেমা আসল তাকে দাখিল করলেন, অতঃপর আলি আসল তাকেও দাখিল করলেন। অতঃপর তিলাওয়াত করলেন:

﴿إِنَّمَا يُرِيدُ ٱللَّهُ لِيُذۡهِبَ عَنكُمُ ٱلرِّجۡسَ أَهۡلَ ٱلۡبَيۡتِ وَيُطَهِّرَكُمۡ تَطۡهِيرٗا﴾ [الاحزاب : 33 ]

“হে নবী পরিবার, আল্লাহ তো কেবল চান ‎‎তোমাদের থেকে অপবিত্রতাকে দূরীভূত করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে”। [মুসলিম: ৪৪৫৭]

হাদিসটি আমাদের কথার বিপরীত নয়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দোয়া থেকে স্পষ্ট হয় যে, তাদের চার জন্য বা তার কোন আত্মীয় সম্পর্কে এ আয়াত নাযিল হয় নি, যদি নাযিল হত তবে দোয়ার প্রয়োজন ছিল না, কারণ আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত বিষয় প্রার্থনা করা মানে দেয়ার মত কোনো বস্তু প্রার্থনা করা। যেমন কোন নবী নবুওয়তের জন্য দোয়া করেন নি কারণ তা বৃথা।

 

ইমাম তিরমিযি রহ. বর্ণনা করেন:

عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ، أَنّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ جَلَّلَ عَلَى الْحَسَنِ، وَالْحُسَيْنِ، وَعَلِيٍّ، وَفَاطِمَةَ كِسَاءً، ثُمَّ قَالَ: ” اللَّهُمَّ هَؤُلَاءِ أَهْلُ بَيْتِي وَخَاصَّتِي أَذْهِبْ عَنْهُمُ الرِّجْسَ، وَطَهِّرْهُمْ تَطْهِيرًا “، فَقَالَتْ أُمُّ سَلَمَةَ: وَأَنَا مَعَهُمْ يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ: ” إِنَّكِ إِلَى خَيْرٍ “.

উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসান, হুসাইন, আলি ও ফাতেমাকে কাপড় দ্বারা ঢেকে নেন, অতঃপর বলেন: “হে আল্লাহ এরা আমার আহলে বায়েত ও বিশেষ ব্যক্তি, তাদের থেকে নাপাকি দূর করুন, তাদেরকে পূর্ণরূপে পবিত্র করুন”। উম্মে সালামা বললেন: হে আল্লাহর রাসূল, আমি কি তাদের অন্তর্ভুক্ত? তিনি বললেন: “তুমি কল্যাণের ওপর রয়েছে”। ইমাম তিরমিযি বলেন: এ হাদিসটি হাসান ও সহিহ। এ অধ্যায়ে এ হাদিসটিই সবচেয়ে উত্তম। তিরমিযি: (৩৮৩৫) এ হাদিসের একজন্য বর্ণনাকারী শাহর ইব্‌ন হাওশাব খুব দুর্বল, শুবা ও ইয়াহইয়া ইব্‌ন মায়িন তার হাদিস গ্রহণ করতেন না।

ইমাম আহমদ রহ. উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণনা করেন:

” اللَّهُمَّ أَهْلِي، أَذْهِبْ عَنْهُمْ الرِّجْسَ، وَطَهِّرْهُمْ تَطْهِيرًا، اللَّهُمَّ أَهْلُ بَيْتِي، أَذْهِبْ عَنْهُمْ الرِّجْسَ، وَطَهِّرْهُمْ تَطْهِيرًا، اللَّهُمَّ أَهْلُ بَيْتِي أَذْهِبْ عَنْهُمْ الرِّجْسَ وَطَهِّرْهُمْ تَطْهِيرًا “، قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، أَلَسْتُ مِنْ أَهْلِكَ؟ قَالَ: ” بَلَى، فَادْخُلِي فِي الْكِسَاءِ “، قَالَتْ: فَدَخَلْتُ فِي الْكِسَاءِ بَعْدَمَا قَضَى دُعَاءَهُ لِابْنِ عَمِّهِ عَلِيٍّ وَابْنَيْهِ وَابْنَتِهِ فَاطِمَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ

“হে আল্লাহ আমার আহাল, তুমি তাদের থেকে নাপাকি দূর কর, তাদেরকে পূর্ণরূপে পবিত্র কর। হে আল্লাহ আমার আহলে বায়েত, তাদের থেকে নাপাকি দূর কর, তাদেরকে পূর্ণরূপে পবিত্র কর। হে আল্লাহ আমার আহলে বায়েত, তাদের থেকে নাপাকি দূর কর, তাদেরকে পূর্ণরূপে পবিত্র কর। আমি বললাম: হে আল্লাহর রাসূল, আমি কি আপনার আহলে বায়েত না? তিনি বললেন: অবশ্যই, চাদরে প্রবেশ কর”। তিনি বলেন: আমি চাদরে প্রবেশ করি তখন তিনি চাচাত ভাই আলি, দুই ছেলে ও মেয়ে ফাতেমার জন্য দোয়া শেষ করেছেন। আহমদ: (২৫৯৫১) এ হাদিসেও দুর্বল বর্ণনাকারী শাহর ইব্‌ন হাওশাব রয়েছে।

ইমাম তাবারি রহ. বর্ণনা করেন:

وَاثِلَةَ بْنِ الأَسْقَعِ … إِنِّي عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَاتَ يَوْمٍ إِذْ جَاءَ عَلِيٌّ، وَفَاطِمَةُ، وَالْحَسَنُ، وَالْحُسَيْنُ، فَأَلْقَى عَلَيْهِمْ كِسَاءً لَهُ، ثُمَّ قَالَ: اللَّهُمَّ هَؤُلاءِ أَهْلُ بَيْتِي، اللَّهُمَّ أَذْهِبْ عَنْهُمُ الرِّجْسَ وَطَهِّرْهُمْ تَطْهِيرًا “، فَقُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، وَأَنَا، قَالَ: ” وَأَنْتَ “، قَالَ: فَوَاللَّهِ إِنَّهَا لأَوْثَقُ عَمَلِي فِي نَفْسِي”

ওয়াসেলাহ ইব্‌ন আসকা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: “..একদা আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে উপস্থিত ছিলাম, আলি, ফাতেমা, হাসান ও হুসাইন আসল, তিনি তাদের ওপর নিজ কাপড় ছড়িয়ে দিলেন। অতঃপর বললেন: “হে আল্লাহ এরা আমার আহলে বায়েত, তাদের থেকে নাপাকি দূর কর এবং তাদেরকে পূর্ণরূপে পাক কর”। আমি বললাম: হে আল্লাহর রাসূল আমিও? তিনি বললেন: “তুমিও”। তিনি বললেন: আল্লাহর শপথ সেটা আমার নিকট আমার খুব গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। মুজামুল কাবির লি তাবরানি: (১৭৬৫৫), হাদিসটি হাসান, কুলসুম ইব্‌ন জিয়াদের কারণে এতে দুর্বলতা এসেছে।

ইমাম বায়হাকি রহ. বর্ণনা করেন:

عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ، قَالَتْ: فِي بَيْتِي أُنْزِلَتْ إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا، قَالَتْ: فَأَرْسَلَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَى فَاطِمَةَ، وَعَلِيٍّ، وَالْحَسَنِ، وَالْحُسَيْنِ، فَقَالَ: ” هَؤُلاءِ أَهْلُ بَيْتِي ” وَفِي حَدِيثِ الْقَاضِي، وَالسُّلَمِيِّ: هَؤُلاءِ أَهْلِي قَالَتْ: فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ، أَمَا أَنَا مِنْ أَهْلِ الْبَيْتِ؟ قَالَ: بَلَى إِنْ شَاءَ اللَّهُ تَعَالَى “، قَالَ أَبُو عَبْدِ اللَّهِ: هَذَا حَدِيثٌ صَحِيحٌ سَنَدُهُ ثِقَاتٌ رُوَاتُهُ، قَالَ الشَّيْخُ: وَقَدْ رُوِيَ فِي شَوَاهِدِهِ، ثُمَّ فِي مُعَارَضَتِهِ، أَحَادِيثُ لا يَثْبُتُ مِثْلُهَا، وَفِي كِتَابِ اللَّهِ الْبَيَانُ، لِمَا قَصَدْنَاهُ إِلَى إِطْلاقِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الآلَ، وَمُرَادُهُ مِنْ ذَلِكَ أَزْوَاجُهُ، أَوْ هُنَّ دَاخِلاتٌ فِيهِ

উম্মে সালামা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমার ঘরে নাযিল হয়েছে:

﴿إِنَّمَا يُرِيدُ ٱللَّهُ لِيُذۡهِبَ عَنكُمُ ٱلرِّجۡسَ أَهۡلَ ٱلۡبَيۡتِ وَيُطَهِّرَكُمۡ تَطۡهِيرٗا﴾ [الاحزاب : 33 ]

তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফাতেমা, আলি ও হাসান-হুসাইনকে ডেকে পাঠান। অতঃপর বলেন: “এরা আমার আহলে বায়েত”। কাদি ও সুলামির বর্ণনাকৃত হাদিসে রয়েছে: এরা আমার আহাল [পরিবার], তিনি বলেন: আমি বললাম হে আল্লাহর রাসূল, আমি কি আহলে বায়েতের অন্তর্ভুক্ত নয়? তিনি বললেন: অবশ্যই, ইনশাআল্লাহ। আবু আব্দুল্লাহ বলেন: এ হাদিসের সনদ বিশুদ্ধ, এর বর্ণনাকারী সবাই নির্ভরযোগ্য। এর স্বপক্ষে শাহেদ ও বিপরীতে বিপরীত বর্ণনা রয়েছে, কিন্তু সেগুলো এর মত বিশুদ্ধ নয়। আমাদের উদ্দেশ্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের “আল” বা পরিবার ব্যাপক, যার অর্থ তার স্ত্রীগণ অথবা তার স্ত্রীগণ তার অন্তর্ভুক্ত”। সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকি: (২৬২৮)

ইমাম তাহাভি রহ. বলেন:

عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ، قَالتْ: جَاءَتْ فَاطِمَةُ بِطَعَامٍ لَهَا إلَى أَبِيهَا، وَهُوَ عَلَى مَنَازِلِهِ، فَقَالَ: ” أَيْ بُنَيَّةُ، ائْتِينِي بِأَوْلادِي وَابْنَيَّ وَابْنِ عَمِّكِ “، قَالَتْ: ثُمَّ جَلَّلَهُمْ، أَوْ قَالَتْ: حَوَى عَلَيْهِمُ الْكِسَاءَ، فَقَالَ: ” هَؤُلاءِ أَهْلُ بَيْتِي وَحَامَّتِي، فَأَذْهِبْ عَنْهُمُ الرِّجْسَ، وَطَهِّرْهُمْ تَطْهِيرًا ” قَالَتْ أُمُّ سَلَمَةَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، وَأَنَا مَعَهُمْ، قَالَ: ” أَنْتِ مِنْ أَزْوَاجِ النَّبِيِّ عَلَيْهِ السَّلامُ وَأَنْتِ عَلَى خَيْرٍ “، أَوْ ” إلَى خَيْرٍ “.

উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: ফাতেমা কিছু খানা নিয়ে তার পিতার নিকট আসল। তিনি তখন নিজ ঘরেই ছিলেন। তিনি বললেন: “হে মেয়ে, আমার নিকট আমার সন্তান ও আমার দু’ছেলে এবং তোমার চাচাত ভাইকে নিয়ে আস”। তিনি বলেন: অতঃপর তাদেরকে ঢেকে নেন, অথবা বলেছেন: তাদের ওপর কাপড় ফেলে দেন এবং বলেন: “এরা আমার আহলে বায়েত ও বিশেষ ব্যক্তি, এদের থেকে নাপাকি দূর করুন এবং তাদেরকে পূর্ণরূপে পবিত্র করুন। উম্মে সালামা বলেন: হে আল্লাহর রাসূল, আমি কি তাদের সাথে? তিনি বললেন: তুমি নবীর স্ত্রী, তুমি কল্যাণের ওপর রয়েছে”। মুশকিলুল আসার লিত তাহাভি: (৬৫৩)

আহলে বায়তের অর্থ উম্মে সালামার নিকট অস্পষ্ট ছিল না, তিনি আহলে বায়তের শামিল ভাল করেই জানতেন। কারণ তার ভাষা আরবি, আয়াতেও কোন জটিলতা বা অস্পষ্টতা নেই। তিনি জানতেন আয়াতে নিষ্পাপ হওয়ার ঘোষণা নেই, বরং তাতে রয়েছে আল্লাহর পছন্দ ও সন্তুষ্টির কথা, অর্থাৎ “হে নবী পত্নীগণ/আহলে বায়েত আল্লাহ তো কেবল পছন্দ করেন তোমাদের ‎‎থেকে অপবিত্রতাকে দূরীভূত করতে এবং ‎‎তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে”। এটা শুধু সংবাদ, যার আমল যে পরিমাণ তার থেকে সে পরিমাণ নাপাকি দূর হবে, সে পরিমাণ সে পবিত্রতা হাসিল করবে। উম্মে সালাম যখন দেখলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফাতেমা, হাসান-হুসাইন ও আলির জন্য দোয়া করছেন, সে দোয়ায় তিনিও অংশ গ্রহণ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে দোয়া লাভের এটা সুবর্ণ সুযোগ ছিল। কোন সাহাবিই এ সুযোগ ছাড়তেন না। কায়স ইব্‌ন সাদ ইব্‌ন উবাদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন:

«زارنا رسول الله صلى الله عليه وسلم في منزلنا فقال: السلام عليكم ورحمة الله، قال: فرد سعد رداً خفيفاً يعني: أباه قلت: ألا تأذن لرسول الله صلى الله عليه وسلم قال: ذره يكثر علينا السلام، فقال: السلام عليكم ورحمة الله، فرد سعد رداً خفيفاً، ثم قال: السلام عليكم ورحمة الله، ثم رجع رسول الله صلى الله عليه وسلم وأتبعه سعد فقال: يا رسول الله! إني كنت أسمع تسليمك وأرد رداً خفيفاً لتكثر علينا من السلام، فانصرف معه صلى الله عليه وسلم» رواه أبو داود

“একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের বাড়িতে আসলেন, তিনি বললেন: السلام عليكم ورحمة الله সাদ আস্তে উত্তর দিলেন, অর্থাৎ তার পিতা। আমি বললাম: আপনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনুমতি দিচ্ছেন না? তিনি বললেন: চুপ থাক, আমাদের ওপর সালামের সংখ্যা বাড়ুক। অতঃপর তিনি বললেন: السلام عليكم ورحمة الله সাদ আস্তে উত্তর দিলেন। অতঃপর বললেন: السلام عليكم ورحمة الله অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রওয়ানা করলেন, সাদ তার পিছু নিলেন এবং বললেন: হে আল্লাহর রাসূল, আমি আপনার সালাম শুনতে ছিলাম ও আস্তে উত্তর দিতে ছিলাম যেন, আমাদের ওপর সালামের সংখ্যা বাড়ে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাথে রওয়ানা করলেন”। আবু দাউদ: (৪৫১৩)

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে বুখারি ও মুসলিম বর্ণনা করেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«يَدْخُلُ مِنْ أُمَّتِي الْجَنَّةَ سَبْعُونَ أَلْفًا بِغَيْرِ حِسَابٍ، فَقَالَ رَجُلٌ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، ادْعُ اللَّهَ أَنْ يَجْعَلَنِي مِنْهُمْ، قَالَ: اللَّهُمَّ اجْعَلْهُ مِنْهُمْ، ثُمَّ قَامَ آخَرُ، فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، ادْعُ اللَّهَ أَنْ يَجْعَلَنِي مِنْهُمْ، قَالَ: سَبَقَكَ بِهَا عُكَّاشَةُ»

আমার উম্মত থেকে সত্তুর হাজার বিনা হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করবে, এক ব্যক্তি বলল: হে আল্লাহর রাসূল, আমার জন্য দোয়া করুন যেন, আল্লাহ আমাকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করেন, তিনি বললেন: হে আল্লাহ তাকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন। অতঃপর এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলে: হে আল্লাহর রাসূল, আমার জন্য দোয়া করুন যেন, আল্লাহ আমাকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করেন, তিনি বললেন: উক্কাশা তোমাকে অতিক্রম করে গেছে”। বুখারি: (৬০৮৬), মুসলিম: (৩২২)

এভাবে সাহাবিগণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দোয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করতেন, উম্মে সালামার বিষয়টিও অনুরূপ ছিল। এতে যদি ব্যতিক্রম কিছু থাকত, তাহলে অবশ্যই অন্যান্য স্ত্রীগণ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতেন।

 

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দোয়ার বরকতে আলি, ফাতেমা ও হাসান-হুসাইন আহলে বায়েতের অন্তর্ভুক্ত, আয়াতের কারণে নয়। কারণ আয়াত নাযিলের পর একটি বিরতিসহ এ ঘটনা ঘটে। হাদিসে কিসার মূল বিষয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের জন্য দোয়া করেছেন যেন আল্লাহ তাদের থেকে নাপাকি দূর করেন ও তাদেরকে পরিপূর্ণরূপে পবিত্র করেন। এর চূড়ান্ত দাবি হচ্ছে তারা মুত্তাকীদের অন্তর্ভুক্ত, তারা নাপাকি মুক্ত ও পবিত্র। নাপাকি ত্যাগ করে পবিত্রতা অর্জন করা প্রত্যেক মুমিনের ওপরই ওয়াজিব, কারণ আল্লাহ সকল মুমিনের ক্ষেত্রে চান তারা পবিত্রতা অর্জন করুক, শুধু আহলে বায়েতের ক্ষেত্রে নয়, যদিও তারা এর বেশী হকদার। নবীর স্ত্রী হিসেবে আল্লাহ আহলে বায়েতের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন, তাদের জন্য দ্বিগুণ সাওয়াবের সুসংবাদ ও শাস্তির হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চেয়েছেন ফাতেমা, আলি ও হাসান-হুসাইন আল্লাহর বিশেষ খেতাবের অন্তর্ভুক্ত হোক, তারা আহলের বায়েতের ন্যায় ফজিলত অর্জন করুক। এটা তার মনুষ্য দুর্বলতা, রক্তের টান। যেমন ছিল চাচা আবু তালেবের প্রতি তার হৃদয়ের টান এবং পিতা আজরের প্রতি ইবরাহিমের অধিক আগ্রহ। যেমন নূহ আলাইহিস সালাম হাজারো কাফের থেকে নিজ সন্তানকেই আহ্বান করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿وَنَادَىٰ نُوحٌ ٱبۡنَهُۥ وَكَانَ فِي مَعۡزِلٖ يَٰبُنَيَّ ٱرۡكَب مَّعَنَا وَلَا تَكُن مَّعَ ٱلۡكَٰفِرِينَ ٤٢ ﴾ [هود: ٤٢]

এবং নূহ তার পুত্রকে ডাক দিল, আর সে ছিল আলাদা স্থানে- ‘হে আমার পুত্র, আমাদের সাথে আরোহণ কর এবং কাফেরদের সাথে থেকো না”। সূরা হুদ: (৪২)

ইমাম মুসলিম রহ. বর্ণনা করেন:

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: «لَمَّا أُنْزِلَتْ هَذِهِ الآيَةُ وَأَنْذِرْ عَشِيرَتَكَ الأَقْرَبِينَ، دَعَا رَسُولُ اللَّهِ ﷺ قُرَيْشًا، فَاجْتَمَعُوا، فَعَمَّ، وَخَصَّ، فَقَالَ: يَا بَنِي كَعْبِ بْنِ لُؤَيٍّ، أَنْقِذُوا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ، يَا بَنِي مُرَّةَ بْنِ كَعْبٍ، أَنْقِذُوا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ، يَا بَنِي عَبْدِ شَمْسٍ، أَنْقِذُوا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ، يَا بَنِي عَبْدِ مَنَافٍ، أَنْقِذُوا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ، يَا بَنِي هَاشِمٍ، أَنْقِذُوا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ، يَا بَنِي عَبْدِ الْمُطَّلِبِ، أَنْقِذُوا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ، يَا فَاطِمَةُ، أَنْقِذِي نَفْسَكِ مِنَ النَّارِ، فَإِنِّي لَا أَمْلِكُ لَكُمْ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا، غَيْرَ أَنَّ لَكُمْ رَحِمًا سَأَبُلُّهَا بِبَلَالِهَا»

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, যখন এ আয়াত নাযিল হল:

﴿ وَأَنذِرۡ عَشِيرَتَكَ ٱلۡأَقۡرَبِينَ ٢١٤ ﴾ [الشعراء : ٢١٤]

“আর তুমি তোমার নিকট আত্মীয়দের সতর্ক কর”। সূরা আশ-শুআরা: (২১৪) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরাইশদের আহ্বান করলেন, ফলে তারা জমা হল: তিনি সাধারণভাবে ও খাসভাবে আহ্বান করে বললেন: হে বনু কাব ইব্‌ন লুআই, তোমরা তোমাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত কর। হে বনু মুররাহ ইব্‌ন কাব, তোমরা তোমাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত কর। হে বনু আবদে শামস, তোমরা তোমাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত কর। হে বনু আবদে মানাফ, তোমরা তোমাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত কর। হে বনু হাশেম, তোমরা তোমাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত কর। হে বনু আব্দুল মুত্তালিব, তোমরা তোমাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত কর। হে ফাতেমা, তুমি নিজেকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত কর। কারণ আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর কোন বিষয়ে অধিকার রাখি না, তবে তোমাদের সাথে রক্তের সম্পর্ক রয়েছে, আমি তা [দুনিয়ায়] পূর্ণরূপে আদায় করব”। মুসলিম: (৩০৮)

ইমাম বুখারি রহ. আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«يَا بَنِي عَبْدِ مَنَافٍ اشْتَرُوا أَنْفُسَكُمْ مِنَ اللَّهِ، يَا بَنِي عَبْدِ الْمُطَّلِبِ اشْتَرُوا أَنْفُسَكُمْ مِنَ اللَّهِ، يَا أُمَّ الزُّبَيْرِ بْنِ الْعَوَّامِ عَمَّةَ رَسُولِ اللَّهِ يَا فَاطِمَةُ بِنْتَ مُحَمَّدٍ اشْتَرِيَا أَنْفُسَكُمَا مِنَ اللَّهِ لَا أَمْلِكُ لَكُمَا مِنَ اللَّهِ شَيْئًا سَلَانِي مِنْ مَالِي مَا شِئْتُمَا»

হে বনু আবদে মানাফ, তোমরা তোমাদেরকে আল্লাহর থেকে খরিদ কর। হে বনু আব্দুল মুত্তালিব, তোমরা তোমাদেরকে আল্লাহর কাছ থেকে খরিদ কর। হে আল্লাহর রাসূলের ফুফি, হে ফাতেমা বিন্‌তে মুহাম্মদ, তোমরা নিজেদেরকে আল্লাহর কাছ থেকে খরিদ কর, আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর কোন বিষয়ে অধিকার রাখি না, তোমরা আমার সম্পদ থেকে যা ইচ্ছা আমার কাছে চাও”। বুখারি: (৩২৮৬)

আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদেরকে নির্দেশ প্রদান করে বলেন:

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ قُوٓاْ أَنفُسَكُمۡ وَأَهۡلِيكُمۡ نَارٗا ٦ ﴾ [التحريم: ٦]

“হে ঈমানদারগণ, তোমরা নিজেদেরকে ও তোমাদের পরিবার-পজিনকে আগুন হতে বাঁচাও”। সূরা আত্-তাহরীম: (৬)

এ জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতে যাওয়ার সময় তাদেরকে বলতেন:الصلاة يا أهل البيت “হে আহলে বায়েত, সালাত”। তিরমিযি: (৩১৪৯) তাদেরকে আল্লাহর নির্দেশ, ইবাদত ও আনুগত্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন, যেহেতু এভাবেই নাপাকি দূর হয় এবং তাতহীর বা পবিত্রতা হাসিল হয়। এর অর্থ কখনো নিষ্পাপ ঘোষণা করা নয়।

এ দোয়ার অর্থ নেতৃত্ব বা ইমামতের হকদার ঘোষণা করা উদ্দেশ্য নয়, ইমামতের বিষয় আলাদা, তার জন্য প্রয়োজন যোগ্যতা, আমানতদারী ও ওহীর জ্ঞান। যার মধ্যে নেতৃত্বের যোগ্যতা নেই, তাকে তার দায়িত্ব দেয়া উম্মতের সাথে খিয়ানত করা, এ খেয়ানত কোন নবী কখনো করতে পারেন না। এ জন্যই আমরা দেখি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপস্থিতিতে সালাতের ইমামতি করেন আবু বকর। ইমামত করার নির্দেশ তিনি আবু বকরকেই প্রদান করেন। অতএব নেতৃত্বের ওসিয়ত তিনি কিভাবে করবেন, তিনি জানেন না তার পরবর্তী বংশধর কেমন হবে। আল্লাহর বাধ্য-না অবাধ্য, যোগ্য না অযোগ্য!!!

 

শিয়া পণ্ডিতরা বিভিন্ন বিকৃতি, অপব্যাখ্যা ও মিথ্যাচার দ্বারা এ আয়াত প্রথমে আসহাবে কিসার জন্য সাবেত করে, অতঃপর তাদের নিষ্পাপ প্রমাণ করে। তারা অন্যান্য আয়াত বেমালুম ভুলে যায় যেখানে সাহাবিদের ফযিলত, তাতহীর, তাযকিয়ার ঘোষণা রয়েছে এবং তাদের ওপর আল্লাহর সন্তুষ্টির ঘোষণা ও তাদের আনুগত্য করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। যার পশ্চাতে তাদের মূল উদ্দেশ্য ইসলামের নামে ইসলাম থেকে দূরে রাখা, আহলে বায়েতের মহব্বতের নামে নবীর দীনকে ধ্বংস করা ও সঠিক পথ থেকে মুসলিম উম্মাহকে বিভ্রান্ত করা। আল্লাহ তাদের ষড়যন্ত্র থেকে ইসলাম ও মুসলিম জাতিকে হিফাজত করুন।

 

সানাউল্লাহ নজির আহমদ

সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া


[1] কিন্তু আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত নবী-রাসূলগণ ব্যতীত অপর কাউকে মা‘সুম জ্ঞান করেন না। কারণ, তারা কারও গুণাগুণ বাড়িয়ে নবীদের পর্যায়ে উঠিয়ে দেন না; যেমনটি শিয়ারা করে থাকে। [সম্পাদক]

[2] তারপরও কিন্তু আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত নবী-রাসূল ছাড়া কাউকেই নিষ্পাপ বলে বিশ্বাস করেন না। সাহাবায়ে কিরাম রা. কেও তারা নিষ্পাপ বলেন না। তবে তারা ন্যায়পরায়ণ ও কোনো প্রকার সমালোচনার ঊর্ধ্বে। সুতরাং নবী-রাসূল ব্যতীত কাউকেই নিষ্পাপ বা মা‘সুম বলার কোন সুযোগ নেই। [সম্পাদক]

১টি মন্তব্য

  1. আসসালামুআলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু। ধন্যবাদ ভাইজান , সম্ভবত আমি আপনার লেখার সবটকুই পড়ার চেস্টা করেছি তাতে অনেক কিছুই অবগত হইলাম। আপনার লেখায় একটা বিষয় আমি পরিষ্কার যে শিয়াদের মনোনীত ১১ ইমাম সবাই নবী বংশের। সকলেই আলী(রাঃ) ও ফাতেমা রাঃ উনাদেরই ওয়ারিশ যাদের ইতিহাস ও অনেক বিস্তীর্ণ। একটা কথা বলার ছিলো ইতিহাসবিদগন উনাদের সম্পর্কে মুসলিম জাহানকে আরো ভালোভাবে জানানো প্রয়োজন ছিলো না? যতটুকু জানলাম তারা সবাই ইসলামেরই গুনো গান গাইতো এবং ইসলামের দাওয়াত কাজে নিয়োজিত ছিলো। দয়া করে পরবর্তীতে তাদের সম্পর্কে একটু বিস্তারিত লিখলে উপকৃত হতাম। আল্লাহ হাফেজ।

মন্তব্য করুন

আরও দেখুন
Close
Back to top button