‘ইসমাইলিয়াহ’ ফেরকা
বাতেনি উবাইদি রাজত্বের উত্তরসূরি হচ্ছে ইসমাইলিয়াহ, তারা ইসমাইল ইবনে জাফর সাদিকের সাথে নিজেদেরে সম্পৃক্ত করে থাকে, যিনি শৈশবে নিঃসন্তান মারা যান। কিন্তু এক ইয়াহূদী যিন্দিক, যার নাম মায়মুন আল-কাদ্দাহ, সে দাবি করে ইসমাইল মারা যায়নি, আত্মগোপন করেছে, তিনি বর্তমান ইমাম বা ইমামুজ্জামান।
অতঃপর সে দাবি করে ইসমাইলের একজন সন্তান হয়েছিল তার নাম মুহাম্মদ ইবনে ইসমাইল। শিয়াদের সামনে (মায়মুন আল-কাদ্দাহ) মুহাম্মদ ইবনে ইসমাইল ইবনে জাফর হিসেবে প্রকাশ পায় ।
তার ছেলে (আব্দুল্লাহ ইবনে মায়মুন আল-কাদ্দাহ)-কে মুহাম্মদ ইবনে ইসমাইলের সন্তান প্রচার করে, মূলত এ আব্দুল্লাহ উবাইদি শাসকদের প্রকৃত পিতা, তারা ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু আনহার সন্তান নয়, বরং ইয়াহূদী বংশোদ্ভূত।
ইসমাইলিরা উবাইদিদের ইমামতে ঐকমত্য ছিল, যখন তাদের খলিফা (মুস্তানসির বিল্লাহ) (৪৮৭হি.) মারা গেল, তখন তারা দু’দলে ভাগ হয়:
১. এক দল বলে: মুস্তানসির থেকে ইমামত বা দীনী নেতৃত্ব তার ছেলে (মুসতা‘লি)-র নিকট প্রত্যাবর্তিত হয়েছে, তাদেরকে বুহরাহ বলা হয়। তারা দক্ষিণ ভারত, কেনিয়া ও ইয়ামানে বাস করে। তাদের নেতাকে বলা হয় সুলতানুল বুহরাহ। তাদেরকে সাইফিয়ূনও বলা হয়।
২. দ্বিতীয় দল বলে: মুস্তানসির থেকে ইমামত বা দীনী নেতৃত্ব তার ছেলে (নাযার ইবনুল মুস্তানসির)-এর নিকট প্রত্যাবর্তন করেছে, বর্তমান তারা আগাখানিয়া নামে প্রসিদ্ধ। পাকিস্তান, ভারত ও শাম দেশে তাদের বসবাস, তাদের সংখ্যাই বেশি।
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, ইসমাইলিদের সাথে ইংরেজদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ, ইংরেজদের বন্ধু হিসেবে তারা প্রসিদ্ধ।
বর্তমান আগাখানির মা ইংরেজ, তার স্ত্রীও ইংরেজ, আর সে প্যারিসে বাস করে।
ইসমাইলিদের গুরুত্বপূর্ণ আকিদা:
১. কুরআন ও সুন্নাহর প্রত্যেক জাহিরের (প্রকাশ্য অর্থের) বাতিন (গোপন অর্থ) আছে, ইমামগণ ব্যতীত কেউ বাতিন জানে না।
২. আল্লাহর সিফাৎ অস্বীকার করা, এমন কি তাদের আকিদা মতে এতটুকুও বলা যাবে না: আল্লাহ আছে বা নেই, তাকে কোনো বিশেষণ দ্বারা বিশেষায়িত করা যাবে না।
৩. মুহাম্মদ ইবনে ইসমাইল ইবনে জাফর ইসলাম রহিত করেছে।
৪. কুরআন ও ওহির অধিকাংশ বরকত আকলে কুল্লি[1] থেকে এমন প্রত্যেক ব্যক্তির উপর নাযিল হয়, যার মধ্যে ওহি গ্রহণ করার যোগ্যতা আছে।
৫. তারা আকিদা ও শরীয়তের অদ্ভুত ব্যাখ্যা করে, যার মূল হচ্ছে হরফগুলো নির্দিষ্ট সংখ্যার প্রতীক, অতঃপর তারা ইচ্ছামত সংখ্যার ব্যাখ্যা প্রদান করে।
৬. কিয়ামত ও পুনরুত্থান অস্বীকার করা ও পুনর্জন্মে ঈমান আনা।
৭. বিশ্বাস করা যে, পৃথিবীর পরিকল্পনা ও বিভিন্ন ঘটনা সৃষ্টির ক্ষেত্রে সাত তারার প্রভাব রয়েছে।
৮. স্বেচ্ছাচারিতা, কমিউনিজম সমাজ ব্যবস্থা (অবাধ যৌনাচার) ও (যথেচ্ছা) অর্থ ব্যবস্থায় বিশ্বাসী। তাদের ইমাম এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিবেন।
এগুলো স্মরণ রাখুন, আরেকটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা জরুরি যে, ইসমাইলিদের অনেক স্তর ও ক্রম এবং অনেক উৎসব ও অনুষ্ঠান রয়েছে, যা ইয়াহূদীদের আচার-অনুষ্ঠানের সাথে অদ্ভুতভাবে মিল রাখে।
অধ্যয়নের জন্য মূলপাঠ
ইয়ামানের ক্বারামতিদের নেতা আলী ইবনে ফাদল (মৃ.৩০৩হি.) সম্পর্কে জনৈক ক্বারামতি কবির কবিতা:
১. হে অমুক, তুমি ঢোল হাতে নাও এবং খেল, তোমার পাপিয়াকে গাইতে দাও, অতঃপর তুমি নাচ।
২. বনু হাশেমের দায়িত্ব নিয়ে ছিলেন একজন নবী, আর এ[2] হচ্ছে বনু ইয়া‘রাবের নবী।
৩. বিগত প্রত্যেক নবীর একটি শরীয়ত ছিল, আর এটা হচ্ছে এ নবীর শরীয়ত।
৪. তিনি আমাদের থেকে সালাতের ফরয রহিত করেছেন, রহিত করেছেন সিয়াম, কোনো কষ্ট দেন নি।
৫. মানুষেরা যখন সালাত পড়ে তুমি সেটার জন্য উঠবে না, যদি তারা সিয়াম রাখে তুমি খাও ও পান কর।
৬. সাফার নিকট সাঈ ও ইয়াসরাবে (মদিনায়) কবর যিয়ারত[3] করার ইচ্ছা করো না।
৭. আত্মীয় কিংবা অনাত্মীয়দের উরস থেকে তোমার নফসকে বিরত রেখ না,
৮. কেন সে অনাত্মীয়র জন্য হালাল ও বাবার জন্য হারাম হলো।
৯. ফসলের মালিক কি সে নয়, যে তা লালন করেছে[4] এবং তা শুষ্ক মৌসুমে সিঞ্চন করেছে।
১০. মদ তো আসমানের পানির ন্যায় হালাল, মাযহাবের পক্ষ থেকে তা হালাল করা হয়েছে।[5]
লেখক: ড. সফর ইবনে আব্দুর রহমান আল-হাওয়ালি
অনুবাদ : সানাউল্লাহ নজির আহমদ
সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
[1] ‘আকলে কুল্লি’-র শাব্দিক অর্থ পূর্ণ বিবেক। এখানে উদ্দেশ্য সম্ভত আল্লাহ। অনুবাদক। বরং তারা আল্লাহকে ‘আস-সাবেক’ বলে, তার কাছ থেকে আল-আকলুল কুল্লীর উপর ফায়েয হয়, তার কাছ থেকে ‘পূর্ণ মানুষ’ তথা ইমামদের কাছে নির্দেশনা আসে। [সম্পাদক]
[2] আলি ইবনে ফাদল।
[3] জ্ঞাতব্য যে, আমাদের দীনে মসজিদ জিয়ারত করা হয়, কবর যিয়ারত করা হয় না, কিন্তু দীন সম্পর্কে মূর্খ ক্বারমতিরা কবর যিয়ারত সম্পর্কে বলছে। এ কথা সফরের সাথে সংশ্লিষ্ট।
[4] অর্থাৎ মেয়েকে লালন পালনকারী পিতাই তার বিয়ের বেশী হকদার, এটাই অগ্নিপূজকদের ধর্ম ছিল, তাদের উপর আল্লাহর লানত।
[5] ‘কাশফুল আসরারিল বাতিনাহ’ ও ‘আল-‘আসজাদ আল-মাসবুক’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত, যা ড. সুহাইল যাক্কার তাহকিক করেছেন। দেখুন: (পৃ.৩০ ও ৪২১)