‘মু‘তাযিলা’ ফেরকা
মু‘তাযিলা ফেরকার প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছে ওয়াসিল ইবনে আতা ও আমর ইবনে উবাইদ। তাদের উভয়কে হাসান বসরি রাহিমাহুল্লাহ কুফার মসজিদে স্বীয় হালাকা থেকে বের করে দিয়ে ছিলেন। মু‘তাযিলা ফেরকার প্রথম বিদ‘আত ছিল ঈমান সংক্রান্ত, কারণ তারা বলে: কবিরা গুনাকারী মুমিনও নয়, কাফিরও নয়, কিন্তু সে দুই স্তরের মধ্যবর্তী স্তরে।
তারা তাকদীর অস্বীকার করার ক্ষেত্রে মা‘বাদ জুহানি ও গায়লানের সাথে ঐকমত্য পোষণ করে, অতঃপর তার সাথে যোগ করে আল্লাহর সিফাৎ অস্বীকার করা ও সাহাবিদের ছিদ্রান্বেষণ করা—আল্লাহ সাহাবীগণের উপর সন্তুষ্ট হোন—।
মু‘তাযিলাদের মাযহাবের ক্রমোন্নতি:
মু‘তাযিলাদের মাযহাব হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষে চিন্তা ভিত্তিক স্বতন্ত্র মতবাদের রূপ গ্রহণ করে, দুটি কারণে:
১. গ্রীক দর্শনের কিতাবসমূহের অনুবাদ, তার উপর মু‘তাযিলাদের গভীর মনোযোগ প্রদান, তার পঠন-পাঠনে গুরুত্বারোপ ও তার নীতি থেকে ইলমে কালামের[1] ভিত রচনা করা, ইত্যাদি কারণে তাদের মাযহাব স্বতন্ত্র রূপ ধারণ করে।
২. মু‘তাযিলাদের বড় এক সংখ্যক লোক ওয়াসিল ইবনে আতা ও আমর ইবনে উবাইদের ছাত্রদের নিকট শিষ্যত্ব গ্রহণ করা, তন্মধ্যে মশহুর হচ্ছে আবুল হুযাইল আল-‘আল্লাফ ও ইবরাহীম আন-নাযযাম।
তাদের উভয়ে মুসলিম উম্মাহর ঐকমত্যের বিপরীত বেশ কিছু কুফরি মতবাদ চালু করে, একই সময় তারা একে অপরকে প্রত্যাখ্যান করে ও কাফের বলে। বিদ‘আতিদের অবস্থা সর্বদা এরূপই হয়। সত্যিকথা হচ্ছে তাদের দু’জনের জীবনী যে অনুসন্ধান করবে, সে তাদের মধ্যে নিন্দিত চরিত্র, ভ্রান্ত বিশ্বাস ও আল্লাহর উপর স্পর্ধা দেখানোর ধৃষ্টতা দেখতে পাবে, যা তাকে বিশ্বাসী করে তুলবে তাদের নাস্তিকতা ও বদ্বীনি সম্পর্কে, ঐতিহাসিকগণ যা তাদের সম্পর্কে বলেছেন।
মু‘তাযিলা ও কুরআনকে মখলুক বলার ফিতনা:
মু‘তাযিলারা ফিতনা সৃষ্টি ও উম্মতকে কঠিন মুসিবত দ্বারা পরীক্ষায় ফেলার মূল কারণ; লৌহদণ্ড বা ক্ষমতার জোরে ও জেল-জুলুমের মাধ্যমে তারা উম্মতকে এটা বিশ্বাস করাতে বাধ্য করায় যে, কুরআন—যা আল্লাহর কালাম— তা মখলুক বা সৃষ্ট।
তারা এ মতবাদকে খলিফা মামুনের নিকট সুসজ্জিত করে পেশ করে, অতঃপর খলিফা মুতাসিমের নিকট, যে ইমাম আহমদ ও অন্যদের শাস্তি দেয়, যেন তিনি অত্র গোমরাহিতে তাদের সাথে ঐকমত্য পোষণ করেন[2]।
মু‘তাযিলাদের দলসমূহ:
মু‘তাযিলারা বিভিন্ন ফেরকায় বিভক্ত হয়েছে, তার এক ফেরকা অপর ফেরকাকে কাফির অথবা গোমরাহ বলে। তৃতীয় শতাব্দী থেকে মু‘তাযিলা ও শিয়া এক হয়। রাফেদী ও যাইদিয়ারা অদ্যাবধি মু‘তাযিলাদের আকিদার উপর বিদ্যমান।
অনুরূপ মু‘তাযিলাদের দ্বারা প্রভাবিত হয় আশ‘আরি মাযহাব, পরবর্তী যে আশ‘আরী মতবাদ সবচেয়ে বেশি প্রচার-প্রসার পায়।
আধুনিক তুলনামূলক গবেষণায় প্রমাণিত, মু‘তাযিলাদের মতবাদ মূলত পুরনো মূর্তিপূজক গ্রীক দর্শনের প্রতিস্থাপন। এ কথাই আহলে সুন্নাহর আলেমগণ অনেক আগে বলেছেন।
এসব কারণে দিনদিন মানুষ আহলে-সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের দিকে ঝোঁকছে, আর তাই সকল প্রশংসা আল্লাহর।
মু‘তাযিলাদের গুরুত্বপূর্ণ আকিদা: পাঁচটি মূলনীতি:
মু‘তাযিলাদের অনেক আকিদা রয়েছে, তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পাঁচটি মূলনীতি, যার উপর তাদের সকল ফেরকা একমত, যদিও কখনো কখনো তার ব্যাখ্যায় মতবিরোধ করে, যেমন:
১. তাওহীদ: তাদের নিকট তাওহীদের উদ্দেশ্য আল্লাহ তা‘আলার সিফাৎ তথা গুণাগুণ অস্বীকার করা, তারা বলে: আল্লাহ তার সত্তাগত জ্ঞানী, সত্তাগত শ্রবণকারী, সত্তাগত দ্রষ্টা, অথবা তিনি জ্ঞান ব্যতীত জ্ঞানী, শ্রবণ ব্যতীত শ্রবণকারী, চোখ ব্যতীত দ্রষ্টা… ইত্যাদি। অনুরূপ তাওহীদ দ্বারা কুরআনকে মখলুক বা সৃষ্ট বলাও তাদের উদ্দেশ্য।
তাদের সংশয় হচ্ছে, আমরা যখন আল্লাহর সিফাৎ প্রমাণ করি, তখন মূলত অনেক ইলাহের অস্তিত্ব স্বীকার করি, কারণ সিফাৎ বা গুণাগুণ সত্তা বহির্ভুত বিষয়।
তাদের এ সংশয় ভিত্তিহীন, কারণ মানুষের সিফাৎ মানুষ নয়, তাহলে আল্লাহর সিফাৎ কিভাবে ইলাহ হয়, অথচ আল্লাহর জন্য রয়েছে উত্তম উদাহরণ?! সিফাৎ অস্বীকার করা মূলত আল্লাহর কিতাব ও রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতে মিথ্যারোপ করা।
২. আদল: আদল (তথা ন্যায়পরায়ণতা) দ্বারা তাদের উদ্দেশ্য আল্লাহ মন্দ সৃষ্টি করেন না ও তার ইচ্ছাও করেন না। তিনি বান্দার তাকদীরে পাপ নির্ধারণ করেন নি, কিন্তু তারা নিজেরা নিজেদের কর্ম সৃষ্টি করে। যে পাপ আল্লাহ চান না এবং যা তিনি নির্ধারণ করেন নি বান্দাগণ তাই কাজে পরিণত করে।
তাকদীরের ক্ষেত্রে এটাই তাদের দর্শন, তাদের সংশয়ের মূল কারণ আল্লাহর দুই প্রকার ইচ্ছায় (আল্লাহর ইরাদাতুল কাওনিয়া ও ইরাদাতুশ শারইয়্যাতে) কোনো পার্থক্য না করা: (কারণ আল্লাহর ইচ্ছা দু’ প্রকার)
ক. ‘ইরাদাতুল কাউনিয়া’ বা আল্লাহর সর্বব্যাপী পার্থিব ইচ্ছা, যা (কুরআন ও সুন্নায়) ‘মাশীয়্যাহ’ নামে খ্যাত। অর্থাৎ ব্যাপক চাওয়া। অতএব আল্লাহ যা চান ও যার অস্তিত্ব ইচ্ছা করেন করেন তা ব্যতীত জগতে কিছুই হয় না। চাই সেটা তার পছন্দনীয় বিষয় হোক বা না হোক।
খ. ‘ইরাদাতুশ শারইয়্যাহ’ বা আল্লাহর শরীয়তগত ইচ্ছা, যা ভালোবাসার অর্থে। অতএব আল্লাহ যা কিছু নির্দেশ করেন ও শরীয়ত হিসেবে প্রবর্তন করেন তা করা তিনি মহব্বত করেন, চাই বান্দারা তাতে তার আনগত্য করুন বা অবাধ্যতা পোষণ করুন। তবে তাদের আনুগত্য বা অবাধ্যতা আল্লাহর সার্বিক সর্বব্যাপী (ব্যাপক) ইচ্ছার বাইরে যাবে না।
মুতাযেলি যদি বলে: ‘আল্লাহ কি কুফর চান’? আমরা তাকে উত্তর দিবো বিস্তারিতভাবে:
ক. যদি তোমার প্রশ্ন দ্বারা উদ্দেশ্য হয়: তিনি কুফরি চান ও কুফর নির্ধারণ করেন, তাহলে উত্তর হবে, হ্যাঁ। আমরা দেখি ও জানি কাফেরদের সংখ্যা অনেক, আল্লাহর রাজত্বে তার ইচ্ছা ব্যতীত কিছু হয় না, তার তাকদীর (অর্থাৎ নির্ধারণ) ব্যতীত কোনো বস্তু অস্তিত্ব লাভ করে না।
খ. আর যদি তোমার প্রশ্ন দ্বারা উদ্দেশ্য হয়, তিনি কুফর পছন্দ করেন, তার অনুমোদন ও নির্দেশ দেন, তাহলে উত্তর হবে: না, কারণ তিনি বলেছেন:
﴿ وَلَا يَرۡضَىٰ لِعِبَادِهِ ٱلۡكُفۡرَۖ ٧ ﴾ [الزمر: ٧]
“আর তিনি স্বীয় বান্দার জন্য কুফর পছন্দ করেন না”।[3] দ্বিতীয়ত তিনি রাসূল প্রেরণ ও কিতাব নাযিল করেছেন কুফর থেকে সতর্ক করার জন্যই।
৩. ওয়াদা ও হুশিয়ারি: মু‘তাযিলাদের নিকট ওয়াদা ও সতর্ক বার্তার দাবি অনুযায়ী পাপীদের শাস্তি প্রদান করা আল্লাহর উপর ওয়াজিব, তিনি তাদের ক্ষমা করবেন না, তাদের ব্যাপারে সুপারিশ কবুল করবেন না এবং কখনো তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করবেন না।
৪. দু’ স্তরের মধ্যবর্তী স্তর: অর্থাৎ এ বিশ্বাস পোষণ করা যে, কবিরা গুনাহকারী যেমন যিনাকারী ও মদ পানকারী না মুমিন না কাফির, বরং সে ঈমান ও কুফরের মধ্যবর্তী স্তরে।
৫. সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করা: এ নীতির উদ্দেশ্য, তারা যে তাওহিদ ও আদল ইত্যাদি বিশ্বাস করে, তার দিকে আহ্বান করা ও মুসলিম শাসকবর্গ যারা তাদের মতবাদের অনুসারী নয় অথবা তাদের মাযহাবের অনুসারী কিন্তু জালেম বা বিরুদ্ধাচারী তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ করা।
তাদের সবচেয়ে বিপজ্জনক নীতি: মত ও বিবেককে বিচারক সাব্যস্ত করা এবং কুরআন ও সুন্নাহ পরিত্যাগ করা। এ নীতির ভিত্তিতে তারা বাতিল আকিদা তৈরি করেছে, যেমন কবরের আযাব, পুলসিরাত ও মীযান অস্বীকার করা, এ জাতীয় প্রমাণিত গায়েবি অনেক বিষয় তারা অস্বীকার করে।
তারা সহি হাদিসগুলো ত্যাগ করে, কারণ সেগুলো তাদের প্রবৃত্তির বিপক্ষে। সহি হাদিস তাদের মত ও পথের বিপক্ষে হলে তারা সাহাবি, তাবেঈ ও সকল রাবিকে মিথ্যাবাদী বলে।
আর যেসব আয়াত তাদের মতের বিরোধী, সেগুলোতে তারা শরীয়ত ও অভিধান ত্যাগ করে ব্যাখ্যা দেয় এবং যেভাবে চায় সেভাবে তার তাবিল ও অপব্যাখ্যা করে।
অধ্যয়নের জন্য মূলপাঠ
হাদিস সম্পর্কে মু‘তাযিলাদের অভিমত:
‘উসূলে খামসাহ’, ‘মুগনি’ ও অন্যান্য গ্রন্থের প্রণেতা: কাদি আব্দুল জাব্বার হামদানি মু‘তাযেলি বলেন,
“সংবাদের হয় সত্যতা জানা যাবে, অথবা মিথ্যা জানা যাবে, অথবা সত্য ও মিথ্যা কিছু জানা যাবে না…”।
তিনি বলেন: “দ্বিতীয় প্রকার, অর্থাৎ যে সংবাদের মিথ্যা জানা যায়, তা দু’প্রকার: তার মিথ্যা অবশ্যম্ভাবীভাবে জানা যাবে অথবা গবেষণার দ্বারা জানা যাবে, যদি অবশ্যম্ভাবীভাবে জানা যায় যেমন কেউ আমাদের সংবাদ দিল যে আসমান আমাদের নিচে ও জমিন আমাদের উপরে। এ জাতীয় অন্যান্য সংবাদ।
আর যেসব সংবাদের মিথ্যা গবেষণার দ্বারা জানা যায়, যেমন মুজবিরাহ ও মুশাব্বিহাদের সংবাদ, যা তারা তাদের বাতিল মাযহাব প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে বলে থাকে, যাতে রয়েছে জাবর, তাশবিহ ও তাজসীম[4] ইত্যাদি গোমরাহ চিন্তাধারা।
আর যেসব সংবাদের সত্য বা মিথ্যা জানা যায় না সেগুলো খবরে ওয়াহিদের মত এবং অনুরূপ পন্থায় প্রাপ্ত সংবাদ। সেসব খবরে ওয়াহিদের উপর আমল করা বৈধ যদি তা শর্ত মোতাবেক বর্ণিত হয়, তবে ইতিকাদ বা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে তা গ্রহণযোগ্য নয়…।
তিনি বলেন: এখানে আরেকটি মূলনীতি, সেটা হচ্ছে, যেসব সংবাদ এরূপ হবে তা পরখ করা ওয়াজিব, যদি তার দাবি আমল করা হয়, তবে আমল করা হবে যদি শর্ত মোতাবেক বর্ণিত হয়। কিন্তু যদি তার দাবি আকিদা-বিষয়ক হয় তখন তাতে দেখতে হবে সেটি বিবেকী দলিল সমর্থন করে কী না, যদি সমর্থন করে তবে তা কবুল করা হবে এবং তার চাহিদা মোতাবেক বিশ্বাস স্থাপন করা হবে, তার মর্যাদার কারণে নয়, বরং বিবেকী দলিল সমর্থন করার কারণে।
আর যদি (সে সব সংবাদ) বিবেক সমর্থন না করে, তাহলে প্রত্যাখ্যান করাই ওয়াজিব এবং চূড়ান্তভাবে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে যে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা বলেন নি, যদিও বলে থাকেন তবে সেটা তিনি অন্য কারো কথা বর্ণনা করেই বলেছেন।
এটা তখনই বলা হবে যখন অযৌক্তিক পদ্ধতি ব্যতীত তাওয়ীল বা ব্যাখ্যার সুযোগ না থাকে, কিন্তু যদি তাওয়ীল বা ব্যাখ্যার সুযোগ থাকে তাহলে তাওয়ীল বা ব্যাখ্যা করা ওয়াজিব।[5]
ইলমে কালাম বা কালাম শাস্ত্র
আল্লাহ তা‘আলা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নূর ও হিদায়েত দিয়ে প্রেরণ করেছেন এবং নাযিল করেছেন তার উপর কিতাব ও হিকমত, ফলে তিনি আহকাম ও আকিদার ক্ষেত্রে মানুষদেরকে সত্য ও সঠিক পথ বাতলে দেন। আল্লাহ তার নিকট যা ওহি করেছেন তার কোনো বস্তু তিনি গোপন করেন নি । তিনি ততক্ষণ সর্বোত্তম বন্ধুর সাথে মিলিত হননি যতক্ষণ না উম্মতকে পরিষ্কার পথের উপর রেখেছেন, যার থেকে ধ্বংসপ্রাপ্ত ব্যতীত কেউ বিচ্যুত হয় না ।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দীনের মৌলিক ও আনুষঙ্গিক প্রত্যেক বিষয় সাহাবিদের শিক্ষা দিয়েছেন এবং তারাও তার থেকে প্রত্যেক বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করেছেন। এমন কোনো গোমরাহি ও সংশয় নেই, যা খণ্ডন ও নিরসন করার দলিল কুরআন ও হাদিসে নেই, তবে যে জানে সে জানে, যে জানে না সে জানে না।
সবচেয়ে মহান যে ইলম নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে শিক্ষা দেন ও তাদের নিকট পৌঁছান এবং উম্মত যে মহান ইলম অর্জন করা ও শিখানোর জন্য বেশি আগ্রহী ছিল সেটা হচ্ছে নাম ও সিফাতসহ আল্লাহর তা‘আলার পরিচয় এবং বান্দার উপর অপরিহার্য তাওহীদ ও আনুগত্যের ইলম। অতঃপর অন্যান্য গায়েবি বিষয়ের উপর গুরুত্বারোপ করেন মানুষ যা স্বীয় বিবেক দ্বারা জানতে পারে না, এমনকি সেটা পর্যন্ত তাদের – ইলম পৌঁছতে সক্ষমও নয় আর ওহি ব্যতীত সেটার বিষয়ে সত্য জানার সুযোগও নেই।
কিন্তু ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত কতক লোক সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যায় এবং সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ না করে অন্য পথে সত্যান্বেষণ করতে শুরু করে। তাদের কেউ কেউ এমন আছে যাদেরকে কুরআন ও হাদিসের জ্ঞান তুষ্ট হতে পারে নি, আবার কেউ কেউ এমন আছে যে তার রব সংক্রান্ত আকিদা কুরআন ও সুন্নাহ ব্যতীত অন্যান্য উৎস থেকে গ্রহণ করা শুরু করে, আবার কেউ কেউ এমন আছে যে পুরনো দর্শন ও বিলুপ্তপ্রায় ধর্মের ফিতনায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ে, যদিও তার উদ্দেশ্য ছিল ঐসব বিলুপ্তপ্রায় ধর্মের অনুসারী ও দার্শনিকদের সাথে তর্ক করা ও ইসলামের পক্ষে প্রতিরোধ করা, তবে কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশিত পদ্ধতি ব্যতীত, তাই সে বিবেক দ্বারা তর্কে লিপ্ত হয়, প্রবৃত্তি দ্বারা প্রতিহত করতে শুরু করে এবং , দীনের এক অংশকে সাব্যস্ত করতে গিয়ে অপর অংশকে পরিত্যাগ করে বসে, কিছু বিষয়কে সপ্রমাণ করতে গিয়ে অপর বিষয়কে অস্বীকার করে বসে।
অধিকন্তু বিদ‘আতি ও বাতিল ফেরকার অনুসারীরা তাদের বিদ‘আত ও মতবাদকে শক্তিশালী করার জন্য এসব দর্শনকে মাধ্যম হিসেবে খুঁজে পায়।
ইলমে কালামে গ্রীক দর্শনের প্রভাব:
পৌত্তলিক গ্রীক দর্শন রোমসম্রাজ্য ও তার অনুগত অঙ্গরাজ্যে প্রচলিত ছিল, যেমন শাম ও মিসর। মুসলিমরা এসব দেশ জয় করে ও তার অধিবাসীরা ইসলামে দীক্ষিত হয়, তবে তাদের কারো নিকট গ্রীক দর্শনের ধ্বংসাবশেষ থেকে যায় জ্ঞাত কিংবা অজ্ঞাতসারে।
গ্রীক দর্শন নানামুখী, তবে তার প্রত্যেকটির নীতি হচ্ছে আল্লাহ সম্পর্কে বিনা ইলমে কথা বলা এবং যেখানে বিবেকের দখল নেই সেখানে ঘাঁটাঘাঁটি করা। গ্রীক দার্শনিকরা ছিল পৌত্তলিক, নবীদের আদর্শ থেকে বহুদূরে, যেমন প্লেটো ও এরিষ্টেটল।
গ্রীক দর্শনের ধ্বংসাবশেষ জাহেল বিদ‘আতিদের নিকট ব্যাপক সমাদৃত হয়, যেমন জা‘দ ইবনে দিরহাম, সে সর্বপ্রথম আল্লাহর সিফাৎ অস্বীকার করে এবং তার ছাত্র জাহাম ইবনে সাফওয়ান, সে জাহমিয়া ফেরকার প্রতিষ্ঠাতা এবং ওয়াসেল ইবনে আতা, সে মু‘তাযিলা ফেরকার প্রতিষ্ঠাতা।
অতঃপর মু‘তাযিলা ফেরকা আত্মপ্রকাশ করে, তারা ব্যাপকহারে গ্রীক দর্শন ও গ্রীক তর্কশাস্ত্র আমদানি করে। তারা কুরআন ও সুন্নাহ নীতি ত্যাগ করে কতক নীতিমালা তৈরি করে, যার নামকরণ করে ‘ইলমুল কালাম’, বা কালাম শাস্ত্র, তার ভিত্তিতে তারা আকিদা উপস্থাপন করে, তার উপর ভিত্তি করেই আকিদার উপর দলিল দেয় ও তার উপর ভিত্তি করেই আকিদার পক্ষে প্রতিরোধ করে।
এরপর মামুন যখন খলিফা হয়, তখন সে অনুবাদ সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে এবং দর্শন শাস্ত্রের অনেক কিতাব আমদানি করে। সে নিজে ‘খালকে কুরআন’ নামক বিদ‘আতি মতবাদে বিশ্বাসী হয়। মু‘তাযিলা ও অন্যান্য ফেরকার লোকদের তার নৈকট্য দেয়, এভাবে ফিতনা বিরাট আকার ধারণ করে ও দীনের ব্যাপারে বাদানুবাদ বৃদ্ধি পায়।
তখন থেকে ‘ইলমে কালামে’র বিদ‘আত বৃদ্ধি পায়, অন্যান্য ইলমে তা প্রবেশ করে, অবশেষে পরবর্তীকালে ইলমে কালামকে ‘ইলমে তাওহীদ’ নামকরণ করা হয়!
অবশ্য আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত তাদের বিরুদ্ধে যর্থার্থ অবস্থান গ্রহণ করে, আর তাদের সেসব মূলনীতি ও কায়েদাগুলোকে যিনি সবচেয়ে বেশি চূর্ণ-বিচূর্ণ ও বিনষ্ট করে দেন তিনি হচ্ছেন শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ। বেশি
বর্তমান যুগে ইলমে কালাম দু’টি গুরুত্বপূর্ণ কারণে ধ্বংসোন্মুখ হয়ে পড়েছে:
এক. সে দর্শন শাস্ত্রের পতন, যার উপর গ্রীক দর্শনের মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, কারণ আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান গ্রীক দর্শন যেসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তার অধিকাংশ বাতিল প্রমাণ করে, খোদ পাশ্চাত্যের লোকেরা পর্যন্ত ইতিহাস চর্চার প্রয়োজন ব্যতীত প্লেটো ও এরিষ্টেটলকে স্মরণ করছে না।
দুই. বর্তমান যুগে ইসলামের পুনর্জাগরণ, যার অধিকাংশ লোক সালাফি চিন্তাকে ধারণ করেছে।
এতদসত্ত্বেও মুসলিম অধ্যুষিত বিভিন্ন দেশের গতানুগতিক কতিপয় সংস্থা-প্রতিষ্ঠান ইলমুল কালাম বা কালাম শাস্ত্রের আদর্শকে আঁকড়ে থেকে তার পঠন-পাঠনে অনড় রয়েছে।
ইলমে কালামের উদ্দেশ্য:
ইলমে কালামের ধারকরা ইলমে কালামের সংজ্ঞায় বলেন: ‘ইলমে কালাম এমন এক ইলম, যার দ্বারা ব্যক্তি দলিল উপস্থাপন ও সন্দেহ দূর করে দীনি আকিদাকে অপরের উপর বিজয়ী করতে সমর্থ হয়”। এ সংজ্ঞাতে তারা তাদের তথাকথিত উদ্দেশ্যের বর্ণনা দিয়েছে, আর তা হচ্ছে, বিবেক ও যুক্তির মাধ্যমে আকিদা প্রমাণ ও তার পক্ষে প্রতিরোধ করা।
এ উদ্দেশ্যে তারা গ্রীক দর্শন ও মানতেক (তর্কশাস্ত্র) শিখে এবং বিতর্ক ও বাদানুবাদে তাদের পদ্ধতি অনুসরণ করে। তাদের ধারণা, নাস্তিকদের সন্দেহ ও অস্বীকারকারীদের তুষ্ট করার এটাই সঠিক পদ্ধতি।
সত্যি কথা হচ্ছে, তাদের অনেকের উদ্দেশ্য এটাই ছিল যদি তাদের কর্ম ও নীতির বিশুদ্ধতার প্রশ্ন ত্যাগও করি, কিন্তু তাদের অনেকে খোদ নাস্তিক ছিল, কিন্তু মুসলিম সমাজে সন্দেহের বিস্তার ও মুসলিমদের আকিদা নড়বড়ে করার জন্য সে এ ইলম অর্থাৎ ইলমুল কালাম বা কালাম শাস্ত্রকে আড়াল হিসেবে গ্রহণ করে।
পূর্বসূরি আলেমগণের নিকট ইলমে কালাম ও তার ধারকদের বিধান:
সালাফ বা আদর্শ পূর্বসূরিদের নিকট ইলমে কালাম বিদ‘আতি ইলম, তা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা বৈধ নয় খণ্ডন করার উদ্দেশ্য ব্যতীত। ইলমে কালাম শুধু এ কারণে বিদ‘আত নয় যে, এটা নতুন ইলম ও নতুন পরিভাষা, বরং এর বিদ‘আত হওয়ার কারণ হচ্ছে, এটি আকিদা উপস্থাপন ও তার পক্ষ থেকে প্রতরোধ করার ক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহর নীতি-আদর্শ স্পষ্টভাবে বিরোধিতা করেছে।, অতিশীঘ্র যা আমরা স্পষ্ট করবো।
এ জন্য ইসলামের ইমামগণ যেমন: আবু হানিফা, মালিক, শাফে‘ঈ, আহমদ ইবনে হাম্বল, ইবনে মুবারক ও বুখারি প্রমুখ আলেমগণ ইলমে কালামের ধারকদের প্রত্যাখ্যান, তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন ও তাদের থেকে মানুষদের সতর্ক করার ক্ষেত্রে ঐকমত্য পোষণ করেছেন, যেরূপ তারা ইলমে কালামের ধারকদের বিপক্ষে বিভিন্ন হুকুম জারি করেছেন, ইলমে কালামে লিপ্ত হওয়ার তারতম্য অনুসারে। বস্তুত ইলমে কালামের ধারকরা দু’ভাবে বিভক্ত:
১. জাহমিয়াহ ও দার্শনিকগণ, যারা আল্লাহর সকল নাম ও সিফাৎ এবং অকাট্যভাবে প্রমাণিত অনেক আকিদা অস্বীকার করে, সালাফগণ তাদের উপর কুফরি ও দীন থেকে বের হয়ে যাওয়ার হুকুম জারি করেছেন।
২. তাদের চেয়ে স্বল্প আকারে কালাম শাস্ত্র লিপ্ত অপরাপর কালাম শাস্ত্রবিদগণ; সালাফে সালেহীন তাদের উপর গোমরাহি, বিদ‘আত এবং সুন্নত ও সঠিক রাস্তা থেকে বিচ্যুতির হুকুম প্রদান করেছেন।
সালাফে সালেহীন কর্তক ইলমে কালামের ধারক-বাহক ও তাদের গৃহীত পদ্ধতি প্রত্যাখ্যান করার কারণ:
১. আকিদা প্রমাণিত হয় ওহি (কুরআন ও সুন্নাহ) দ্বারা, মানুষের বিবেক ও তাদের মত দ্বারা নয়, আর দীনে ইসলাম নির্ভর করে অনুসরণ ও আত্মসমর্পণের উপর। আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রমাণিত হলেই মুসলিম ইসলামের সংবাদ ও নির্দেশকে সত্য জানে ও বিশ্বাস করে, তর্ক ও বিবেকের সন্তুষ্টির প্রয়োজন নেই।
কাফির সাধারণত জেদি ও ঝগড়াটে হয়, তার সাথে যত তর্ক করা হোক, যত দলিল সে প্রত্যক্ষ করুক, তার স্বভাবের পরিবর্তন হয় না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَلَوۡ فَتَحۡنَا عَلَيۡهِم بَابٗا مِّنَ ٱلسَّمَآءِ فَظَلُّواْ فِيهِ يَعۡرُجُونَ ١٤ لَقَالُوٓاْ إِنَّمَا سُكِّرَتۡ أَبۡصَٰرُنَا بَلۡ نَحۡنُ قَوۡمٞ مَّسۡحُورُونَ ١٥ ﴾ [الحجر: ١٤، ١٥]
“আর আমি যদি তাদের জন্য আসমানের কোনো দরজা খুলে দিতাম, অতঃপর তারা তাতে আরোহণ করতে থাকত, তবুও তারা বলত, নিশ্চয় আমাদের দৃষ্টি কেড়ে নেওয়া হয়েছে, বরং আমরা তো জাদুগ্রস্ত সম্প্রদায়”।[6]
অতএব তর্ক দাওয়াতের নীতি নয়, অথচ কালামশাস্ত্রবিদরা তা-ই করে থাকে , তর্ক হচ্ছে জেদি ব্যক্তিকে দমন করার একটি পদ্ধতি মাত্র:
২. নিশ্চয় ওহি সুবিদিত ও নির্ভুল উৎস, পক্ষান্তরে গায়েবের হাকিকত জানার ক্ষেত্রে বিবেক স্বীয় অজ্ঞতা ও ত্রুটিসহ বিভিন্ন ও বিপরীতমুখী। এ জন্য দার্শনিক ও কালামশাস্ত্রবিদরা কোনো বিষয়ে যেন ঐকমত্যে পৌছুতে পারেন নি। হ্যাঁ, সেসব ক্ষেত্র ব্যতীত যাতে সকল বনি আদম সাধারণত একমত পোষণ করে থাকেন, যারা কোনো দর্শন কিংবা কালাম কোনো কিছুই বুঝে না।
এই যে ‘আল্লাফ ও তার সাথী নাযযাম, সর্বপ্রথম তারা ইলমে কালামের উপর কিতাব লিখে, প্রথম তারা উভয়ে এক ফেরকাভুক্ত ছিল যেমন পূর্বে বলা হয়েছে, তবুও প্রত্যেকে অপরকে প্রত্যাখ্যান করে ও কাফির বলে।
এ জন্য ইমাম আহমদ যখন একসাথে সকল ফেরকাকে দমন ও উম্মতকে একমাত্র বিশুদ্ধ উৎসের দিকে প্রত্যাবর্তন করানোর ইচ্ছা করেন, তখন তিনি মুসনাদ গ্রন্থ প্রণয়ন করেন, তাতে তিনি প্রায় চল্লিশ হাজার হাদিস জমা করেন।
৩. কুরআন ও সুন্নাহ এমন দলিল ও অকাট্য প্রমাণাদি সমৃদ্ধ যার চেয়ে বড় কোনো দলিল ও প্রমাণ থাকতে পারে না। যার বিবেক যত বেশি শক্তিশালী ও পরিপূর্ণ সে সেসব দলিল ও প্রমাণ অধিক বুঝে ও তার থেকে অধিক বিধান আহরণ করতে সক্ষম হয়। ইসলাম শুধু কতিপয় বর্ণিত হাদিসের নাম নয় যার পশ্চাতে কোনো দলিল নেই, আর যা মানুষ শুধু অন্ধ ও গতানুগতিকভাবে বর্ণনা করেছে, যেমন কালাম শাস্ত্রবিদরা ধারণা করে থাকে!
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাহাবিগণ বিভিন্ন শ্রেণির কাফির যেমন ইয়াহূদী, খৃস্টান ও মুশরিকদের সাথে কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা তর্ক করেছেন, এভাবেই তাদেরকে তারা নিশ্চুপ ও পরাজিত করেছেন, সকল যুগে আহলে সুন্নাহর আলেমগণ তার উপর চলেছেন, তারা শুধু কুরআন , সুন্নাহ ও পূর্বপুরুষদের বাণী পেশ করে বিরোধীদের নিশ্চুপ ও লাজওয়াব করেছেন, অন্য কোনো উৎসের সাহায্য ছাড়াই।
উম্মতে মুসলিমার উপর ইলমে কালামের প্রভাব:
উম্মতে মুসলিমার উপর ইলমে কালামের ক্ষতিকর প্রভাব যেরূপ অতীতে ছিল বর্তমানেও আছে, যেমন:
১. গায়েবী জগতকে উপস্থিত জগতের অনুগত করা: এ নীতিতে বিশ্বাসী তর্ক শাস্ত্রবিদ বা কালামশাস্ত্রবিদরা আল্লাহ, পরকাল ও সকল গায়েবী বিষয় সম্পর্কে তাদের তৈরি পরিভাষা ও মাপকাঠি দ্বারা আলোচনা করে, যেগুলো তারা উপস্থিত জগতের বস্তু প্রমাণ করার জন্য তৈরি করেছে, যেমন: জাওহার, ‘আরদ, কাম্মিয়াহ, কাইফিয়্যাহ, হুদুস ও তাগাইয়ূর।
২. অকাট্যভাবে প্রমাণিত বিষয়ে সন্দেহ ও সংশয় ছড়ানো, যার উপর বিনা প্রশ্ন ও বিনা তর্কে ঈমান আনা জরুরি, যেমন: আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণের বিষয়টি অনুরূপভাবে জগত সৃজিত এ মর্মে দলিল পেশ করার বিষয়।
৩. স্পষ্ট বিবেক ও বিশুদ্ধ দলিলের মাঝে অযথা বিরোধ সৃষ্টি করা, যেমন: বিবেক বিরোধী দাবি করে অকাট্য বিশুদ্ধ হাদিসকে মিথ্যা বলা, আবার কখনো কখনো বানোয়াট হাদিস পেশ করে তারা বলে: এ সম্পর্কে হাদিস বর্ণিত হয়েছে, যদিও তা বিবেক বিরোধী।
৪. ঈমানি ফযিলতকে নিরস বিবেকি বিষয় ও অর্থহীন দীর্ঘ বিতর্কের রূপ দেওয়া, যার কোনো ভূমিকা নেই ঈমান বৃদ্ধি ও আখলাক পরিশুদ্ধির ক্ষেত্রে।
৫. নাস্তিক ও ইসলাম বিদ্বেষীদের জন্য ইসলামের উপর কটূক্তি করার দ্বার খুলে দেওয়া, কারণ তর্ক শাস্ত্রবিদরা ধারণা করে তারা যেসব বিষয় প্রমাণ ও সাব্যস্ত করে সেটাই ইসলাম। আর নাস্তিকরা যখন তাদের প্রমাণ করা বিষয়ের দুর্বলতা ও ভ্রান্তি দেখে এবং তার ছিদ্রান্বেষণের সুযোগ পায়, তখন তারা এসব দুর্বলতা ও ভ্রান্তি স্বয়ং ইসলামের সাথে যুক্ত করে—আল্লাহর নিকট আমরা এমন কাজ থেকে পানাহ চাই—।
৬. উম্মতকে বিভক্ত করা এবং এমন বিষয়ে মুসলিমদের মাঝে বিতর্কের দরজা উন্মুক্ত করা যার সম্পর্কে আল্লাহ কোনো প্রমাণ নাযিল করেন নি এবং যা জানার পশ্চাতে মানুষের সওয়াবও হয় না। তর্ক শাস্ত্রবিদদের প্রত্যেক দল অপর দলকে কাফির বলে, বরং কখনো ছাত্র উস্তাদকে, ছেলে পিতাকে কাফির বলে।
অধ্যয়নের জন্য মূলপাঠ
মানুষের হাকিকত নিয়ে দার্শনিকদের মতভেদ:
শায়খ আবুল হাসান আশ‘আরি বলেন, (যিনি স্বীয় যুগে কালাম শাস্ত্রবিদদের প্রধান ছিলেন, অতঃপর আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতে ফিরে আসেন) : “মানুষের হাকিকত সম্পর্কে লোকদের মতভেদ কী?
আবুল হুযাইল বলেন: মানুষ হচ্ছে প্রকাশ্য দৃশ্যমান ব্যক্তি, যার দু’টি হাত ও দু’টি পা রয়েছে। তিনি বর্ণনা করেন, আবুল হুযাইল মানুষের চুল ও নখকে মানব সত্তার অংশ গণনা করেন না, যার উপর মানুষের নাম প্রযোজ্য হয়।
তিনি আরো বর্ণনা করেন, এক সম্প্রদায় বলেছে মানুষের শরীরই মানুষ, তার আনুষঙ্গিক অঙ্গ মানুষ নয়, তবে ন্যূনতম কোনো একটি আনুষঙ্গিক অঙ্গ ব্যতীত মানুষকে মানুষ বলা বৈধ নয়।
বিশর ইবনে মুতামির বলেন: মানুষ শরীর ও রূহ, তারা উভয় মিলে মানুষ। কার্য সম্পাদনকারী সত্তাই মানুষ, যা মূলত শরীর ও রূহ।
আবুল হুযাইল বলতেন, মানুষের শরীরের প্রত্যেক অঙ্গ পৃথকভাবে কার্য সম্পাদন করে না, আর না সে অপর অঙ্গের সাথে মিলে কার্য সম্পাদন করে, তবে তিনি বলতেন এসব অঙ্গই হচ্ছে কার্য সম্পাদনকারী।
দ্বারার ইবনে উমর বলেন: মানুষ বিভিন্ন বস্তুর সমন্বয়ে: রঙ, স্বাদ, গন্ধ, শক্তি ও এ জাতীয় অন্যান্য বস্তু। এসব বিষয় একত্র হলেই মানুষ, এগুলো ব্যতীত মানুষের কোনো জাওহার বা মৌলিক কিছু নেই।
হুসাইন আন-নাজ্জার শক্তিকে মানুষের অঙ্গ মানতে নারাজ, অধিকাংশ তর্ক শাস্ত্রবিদও তা মানতে নারাজ।
উবাদাহ ইবনে সুলাইমান বলেন: মানুষের অর্থ হচ্ছে সে বাশার বা মানব সন্তান, অতএব মানুষের যে অর্থ আদম সন্তানের একই অর্থ। আর প্রকৃত যুক্তিতে মানব সন্তান অর্থই মানুষ। সে আরো বলেছে, মানুষ বহু জাওহার ও আ’রাদ তথা মূল ও আনুষঙ্গিক বস্তুর সমন্বিত রূপ।
বারগুস বলেন: মানুষ হচ্ছে রঙ, স্বাদ, গন্ধ ও এ জাতীয় বিভিন্ন উপাদানের সমন্বিত রূপ।
যারকান বর্ণনা করেন, হিশাম ইবনে হাকাম বলেন: মানুষ দু’টি অর্থের সমন্বিত রূপ, শরীর ও রূহ। তবে শরীর মৃত, শরীর ছাড়াই রূহ বোধসম্পন্ন, ক্রিয়াশীল। আর রূহ নূরসমূহ হতে একটি নূর।
আবুবকর আল-আসাম্ম বলেন: যা দেখা যায় তাই মানুষ। মানুষ একক বস্তু তার কোনো রূহ নেই, সে একক জাওহার। সে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও দৃশ্যমান বস্তু ব্যতীত সব অস্বীকার করে।
নাযযাম বলেন: মানুষ সে তো রূহ, তবে সে রূহ শরীরে প্রবেশকৃত ও তার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত । মানুষের প্রত্যেক অংশ রূহের প্রত্যেক অংশে বিদ্যমান, আর শরীর তার জন্য এক মুসবিত, খাঁচা ও তাকে চাপ প্রয়োগকারী।
মা‘মার বলেন: মানুষ এমন এক ক্ষুদ্র অংশ, যা বিভক্ত হয় না, সে-ই জগতে পরিচালনানাকারী, প্রকাশ্য শরীর তার হাতিয়ার মাত্র, সে প্রকৃতপক্ষে কোনো স্থানে নেই, সে কোনো বস্তুকে স্পর্শ করে না এবং কোনো বস্তুও তাকে স্পর্শ করে না।
অন্যান্যরা বলেছে: মানুষ এমন একটি ক্ষুদ্র অংশ যা কখনো বিভক্ত হয় না, তবে তার পক্ষে স্পর্শ করা, পৃথক হওয়া, নড়াচড়া ও নীরব থাকা সম্ভব। সে এ শরীরের কোনো অঙ্গের অংশ এবং তাতেই সে প্রবেশকারী, তার স্থান হচ্ছে অন্তর। আর তারা (তর্কশাস্ত্রবিদরা) মানুষের উপর সকল আ‘রাদ (গুণাগুণ) আরোপ হতে পারে বলে মনে করে। । এটা সালেহির কথা।
ইবনুর রাওয়ান্দি বলেন : মানুষ মূলত অন্তরে থাকে, তবে সে রূহ নয়, রূহ এ শরীরে অবস্থানকারী”।[7]
লেখক: ড. সফর ইবনে আব্দুর রহমান আল-হাওয়ালি
অনুবাদ : সানাউল্লাহ নজির আহমদ
সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
[1] ইলমে কালামের বর্ণনা সামনে আসছে।
[2] কিন্তু ইমাম আহমাদ তাদের সাথে ঐকমত্য পোষণ করেন নি। বরং পর্বতের ন্যায় এর বিপরীত সহীহ আকীদা-বিশ্বাস নিয়ে একাই দাঁড়িয়ে ছিলেন। আর তা হচ্ছে কুরআন আল্লাহর বাণী, যা আল্লাহর একটি গুণ। [সম্পাদক]
[3] সূরা যুমার: (৭)
[4] মু‘তাযিলারা আহলে সুন্নাহকে জাবরিয়া, মুশাব্বিহাহ ও মুজাস্সিমাহ বলে।
[5] উসুলুল খামসাহ: (পৃ.৭৬৮-৭৭০), কায়রো, ১৯৬৫ই.
[6] সূরা হিজর: (১৪-১৫)
[7] মাকালাতুল ইসলামিয়্যিন: (৩২৯-৩৩২), তাহকিক হিলমুন রিটর, তৃতীয় প্রকাশ: ১৪০০হি.