‘খাওয়ারিজ’ ফেরকা
খারেজি: একটি ফেরকার প্রতীক, যারা শুধু পাপের কারণে মুসলিমদের কাফির বলে ও তাদের রক্ত হালাল জানে। তারা কট্টর ও গায়রে কট্টর বিভিন্ন দলে বিভক্ত।
মুসলিম জামা‘আত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পূর্বে তাদেরকে কুররা তথা অধিক কুরআন তিলাওয়াতকারী বলা হত, তাদের অধিক তিলাওয়াত ও ইবাদতের কারণে। অতঃপর তাদেরকে খাওয়ারিজ ও হারুরিয়া বলা হয়—ইরাকের একটি শহরের সাথে সম্পৃক্ত করে, যার নাম হারুরা—তবে তারা নিজেদের নামকরণ করে শোরা (তথা বিক্রয়কারী) বলে, অর্থাৎ তাদের ধারণায় তারা নিজেদের নফসকে আল্লাহর জন্য বিক্রি করে দিয়েছে।
মুসলিম উম্মাহ বিরোধী অন্যান্য ফেরকা থেকে খারেজিরা বিদ্রোহ, প্রতিরক্ষা ও আক্রমণ পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, যেরূপ তারা বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী বীরত্ব, সত্যবাদিতা ও ইবাদতের ক্ষেত্রে। তবে তাদের এসব গুণাবলী কোনো ভালো ভিত্তির উপর নেই, বরং গোমরাহি ও মূর্খতার উপর প্রতিষ্ঠিত।
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে তাদের বিষয়ে বিভিন্ন হাদীস প্রমাণিত, সেখানে তাদের কতক বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা, তাদের সাথে যুদ্ধের কঠিন নির্দেশ ও তাদের বিদ‘আত থেকে বাঁচার জন্য কঠোর হুশিয়ারি রয়েছে।
খারেজিদের গুরুত্বপূর্ণ কতক ফেরকা:
খারেজিরা অনেক ফেরকায় বিভক্ত, আমরা তার গুরুত্বপূর্ণ কতক ফেরকা উল্লেখ করবো, দীনের মধ্যে বাড়াবাড়ি বা সীমালঙ্ঘনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে। সীমালঙ্ঘন বিবেচনায় তাদের চরমপন্থি ফেরকা হচ্ছে ‘আযা-রিকা’, অতঃপর ‘নাজদা-ত’ এবং সবচেয়ে নমনীয় ফেরকা হচ্ছে ‘ইবাদ্বিয়া’।
১. ‘আযারিক্বা’:
নাফে ইবনে আযরাক্বের অনুসারীদের আযারিক্বা বলা হয়, যার বিষয়টি আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর যুগে আত্মপ্রকাশ করে।
তাদের গুরুত্বপূর্ণ আকিদা:
ক. উসমান ও আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমাকে কাফির বলা।
খ. কবিরা গুণাহকারীকে কাফির ও চিরস্থায়ী জাহান্নামী বলা।
গ. মুসলিমদের থেকে যারা তাদের বিরোধিতা করে তাদেরকে কাফির বলা, বরং তাদের নিকট যে হিজরত করে চলে আসে নি সেও কাফির, যদিও সে তাদের মাযহাবের অনুসারী হয়।
ঘ. তাদের বিরোধী মুসলিম দেশকে দারুল কুফর (কাফির রাষ্ট্র) হিসেবে ফতোয়া প্রদান করা।
ঙ. বিবাহিতের যিনা-ব্যভিচারের শাস্তি হিসেবে পাথর নিক্ষেপ অনুরূপভাবে অপবাদ আরোপের শাস্তি রহিত করা।
২. নাজদাত:
নাজদাহ ইবনে আমির আল-হানাফির অনুসারীদের নাজদাত বলা হয়, সে মূলত নাফে ইবনে আযরাক্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয় এবং তার কতক বাড়াবাড়ি শিথিল করে।
তাদের গুরুত্বপূর্ণ আকিদা:
ক. মুসলিমদের থেকে তাদের বিরোধীকে কাফির বলা— এমনকি তাদের পূর্বসূরী আযারিক্বা ফেরকাও এদের মতে কাফের —তবে মূর্খ ব্যতীত, মূর্খের ওযর তারা গ্রহণ করে যতক্ষণ না তার উপর প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত করা না হয়।
খ. তাদের বিরোধীদের দেশকে নেফাকের দেশ বলা, কুফরি দেশ নয়।
গ. অপরাধী ও শাস্তি উপযোগীদের পক্ষ নেওয়া, যদি তারা তাদের মাযহাব অনুসারী হয়, অবশ্য এটা বলে যে তারা চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামী।
ঘ. মুমিন ব্যক্তিকে—অর্থাৎ তাদের মাযহাবের অনুসারীকে—শুধু কবিরা গুনাহের কারণে কাফির না বলা, যেরূপ আযারিক্বা ফেরকা বলে থাকে। বরং কুফরি তখনই হবে, যখন পাপে অবিচল থাকবে, সে পাপ বড় হোক বা ছোট হোক।
৩. ইবাদ্বিয়া:
আব্দুল্লাহ ইবনে আবাদ্ব আত-তামিমির অনুসারীদের ইবাদ্বিয়া বলা হয়, সেও নাফে ইবনে আযরাক্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। একজন তাবেয়ী আবুশ শা‘শা জাবের ইবনে যায়েদকে তারা খুব সম্মান করে এবং তার সাথে তারা নিজেদের মাযহাবকে সম্পৃক্ত করে।
খারেজিদের থেকে একমাত্র ইবাদ্বিয়া ফেরকা বর্তমান পর্যন্ত চলমান আছে। প্রথম শতাব্দী শেষে যেসব ফেরকা ও বিদ‘আত সৃষ্টি হয়, তার দ্বারা তারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়, বিশেষভাবে মু‘তাযিলাদের দ্বারা।
তাদের গুরুত্বপূর্ণ আকিদা:
ক. আল্লাহর সিফাৎ অস্বীকার করা, এ ব্যাপারে তারা মু‘তাযিলাদের মাযহাব অনুসরণ করে।
খ. কুরআনুল কারিম মাখলুক বা সৃষ্ট।
গ. কবিরা গুণাকারী চিরস্থায়ী জাহান্নামী, তা থেকে সে কখনো বের হবে না, তবে এ কারণে তারা তাকে বড় কুফরিতে লিপ্ত বলে না।
ঘ. আখিরাতে আল্লাহর দীদার বা দর্শন সাব্যস্তকারী কাফির।
ঙ. শরীয়তের বিধি-বিধানের অপব্যাখ্যা করা, সুতরাং তারা আল্লাহর সিফাত বা গুণাবলীকে অপব্যাখ্যা করে, অনুরূপভাবে তারা ব্যাখ্যা করে সিরাত ও মীযানকে।
অধ্যয়নের জন্য মূল পাঠ
‘ইযালাতুল ই‘তিরাদ্ব আন-মুহিক্কি আলে-ইবাদ্ব’ গ্রন্থ থেকে নির্বাচিত অংশ।
“অতঃপর… এটা ইবাদ্বিয়া ওহবিয়ার আকিদা। মৌলিক ও আনুষঙ্গিক মাসআলায় তারাই আহলে হক (বা হক পন্থী):
অতএব, মৌলিক বিষয়ে তাদের আকিদা: ‘আল্লাহ ব্যতীত কোনো মাবুদ নেই’, মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ তার বান্দা ও রাসূল এবং তিনি যা নিয়ে এসেছেন সব সত্য এ সাক্ষ্য প্রদান করা।
আল্লাহ তা‘আলা বিদ্যমান, কোনো বস্তু তার সদৃশ নন এবং তিনিও কোনো বস্তুর সদৃশ নন, না ‘আরদ্বে (বস্তুনির্ভর গুণে) না জাওহারে (মূল সত্তায়)। আর না জাওহার ফারদে, (সুক্ষ্ম মূল অনুকণায়) যারা জাওহার ফারদে বিশ্বাস করেন। (তাদের কথাও বিশুদ্ধ নয়)
“আল্লাহ যৌগিক ও একক বস্তু কোনোটিই নন, তার শুরু ও শেষ নেই। তিনি কোনো স্থানে হুলুল তথা প্রবেশ করা থেকে পবিত্র, অনুরূপভাবে বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করা থেকেও তিনি পবিত্র, তিনি অংশ ও দিক দ্বারা গুণান্বিত নন। আর কুরআন মখলুক বা সৃষ্ট, তবে তার ইলম আল্লাহর, যা নতুন নয়, কাদিম তথা চিরন্তন। সাবালক হওয়ার পর সকল ভালো লোকের সাথে বন্ধুত্ব ও সকল খারাপ লোকের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা ওয়াজিব। ইহকাল ও পরকালে আল্লাহকে দেখা যাবে না, না চোখে, না অন্তরে; কারণ অন্তরের দর্শনও আল্লাহর দিক ও সীমাবদ্ধতাকে আবশ্যক করে তুলে আর স্থান ও কালে তার অন্তরীণতা, রঙ ও যুক্তাবস্থাকে অপরিহার্য করে। আবার পরবর্তী অবস্থার জন্য আল্লাহর অপারগতা, অথবা দুর্বলতা ও মুখাপেক্ষিতা ইত্যাদি সৃষ্টজীবীয় বিশেষণকে আবশ্যক করে তুলে…. (সুতরাং আল্লাহকে কখনও দেখা যাবে না)…
আমাদের সাথীগণ বলেছেন, দীনের দাবি হচ্ছে মুশরিকের মত ফাসিক স্থায়ীভাবে জাহান্নামে থাকবে; কারণ আল্লাহর বাণী ব্যাপক, তিতিনি বলেন:
﴿ وَمَن يَعۡصِ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ فَإِنَّ لَهُۥ نَارَ جَهَنَّمَ خَٰلِدِينَ فِيهَآ أَبَدًا ٢٣ ﴾ [الجن: ٢٣]
“আর যে আল্লাহ ও তার রাসূলের অবাধ্যতা পোষণ করে, তার জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন। তাতে তারা চিরস্থায়ী হবে”।[2]
ফাসিকের জাহান্নামে চিরকাল না থাকার হাদিসগুলো বানোয়াট, অথবা তার সনদ ও মতন দুর্বল।[3] আমলের পরিমাণ এবং তার বিনিময়ে সাওয়াব ও শাস্তির নাম মীযান। আমাদের নিকট এগুলো দীনি বিষয়, কারণ আমল দেহহীন, দেহশীল নয়, দেহহীন বস্তু মাপা যায় না। আর পরকালীন সিরাত (পুল), সিরাতের ধারত্ব ও কাটাযুক্ত পেরেক ইত্যাদি হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার সুক্ষ্ম পর্যবেক্ষণকে, অর্থাৎ যদি তলোয়ারের ধার অথবা চুলের উপর স্থির থাকা সম্ভব হয়, তাহলে সে দিন কোনো কোনো বস্তুর অদৃশ্য থাকা সম্ভব হবে… আর আল্লাহর আরশে ইস্তেওয়া হওয়ার অর্থ হচ্ছে, রাজত্ব এবং তার ইচ্ছার বাইরে কোনো বস্তুর অবাধ্য না হওয়া। আল্লাহর চেহারা মানে হচ্ছে আল্লাহ, যেমন তুমি বল অমুকের চেহারার জন্য অথচ তোমার উদ্দেশ্য স্বয়ং ঐ ব্যক্তি। আল্লাহর হাত অর্থ কুদরত এবং তার চোখ অর্থ রক্ষণাবেক্ষণ।
আর নির্দিষ্ট আকার-আকৃতি ব্যতীত আল্লাহর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রমাণ করা এক ধরণের মূর্খতায় প্রত্যাবর্তন করা, অথচ তাওয়ীল (ব্যাখ্যা) দ্বারা তার থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব…”[4]
লেখক: ড. সফর ইবনে আব্দুর রহমান আল-হাওয়ালি
অনুবাদ : সানাউল্লাহ নজির আহমদ
সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
[2] সূরা জিন: (২৩)
[3] এটা তার আকিদা। সত্য কথা হচ্ছে এ সংক্রান্ত বহু হাদিস রয়েছে যার শুদ্ধতার ব্যাপারে উম্মত একমত, তার সংখ্যাও কম নয়।
[4] তাদের পরিভাষা ও গোমরাহী বুঝার জন্যে সামনে আলোচিত মু‘তাযিলা ও ইলমে কালামের অধ্যায় পড়ুন।