লাঠি হাতে নিয়ে জুমার খুতবা দেয়া কি সুন্নত?
লাঠি অথবা এজাতীয় কোনো বিষয়, যেমন ধনুক, তরবারি ইত্যাদির উপর ভর দিয়ে খুতবা দেয়া বিষয়ে শরিয়তবিদদের দুটি অভিমত রয়েছে:
প্রথম অভিমত: এরূপ করা মুস্তাহাব, মালিকি, শাফেয়ি ও হাম্বলি মাযহাবের অধিকাংশ উলামা এ মতের পক্ষে গিয়েছেন।
ইমাম মালেক র. বলেন,’খুতবা দেন এমন ইমামদের জন্য এরূপ করা মুস্তাহাব। অর্থাৎ তারা লাঠিতে ভর করা অবস্থায় খুতবা দেবেন। এরূপই আমরা দেখেছি ও শুনেছি।‘ [ আল মুদাউওয়ানাতুল কুবরা :১/১৫১] মালিকি মাযহাবের পরবর্তী যুগের কিতাবপত্রে এ অভিমতকেই নির্ভরযোগ্য বলা হয়েছে। [ দেখুন: জাওয়াহেরুল ইকলীল: ১/৯৭ ও হাশিয়াতুদ্দাসুকি: ১/৩৮২ ]
ইমাম শাফেয়ি র. বলেন,’যে খুতবা প্রদান করবেন – তা যে প্রকৃতিরই হোক না কেন- তিনি কোনো কিছুর উপর ভর দেবেন, এটাই আমার কাছে পছন্দনীয়।‘ [ আল উম্ম:১২৭২] এ বিষয়ে শাফেয়ি মাযহাবের ফতোয়া এটাই। [ দ্র: নিহায়াতুল মুহতাজ : ২/৩২৬ ও হাশিয়াতু কালয়ুবি:১/২৭২ ]
হাম্মলি মাযহাবের ইমাম বাহুতি র. বলেন,’যে কোনো হাত দিয়ে তরবারি, ধনুক বা লাঠির উপর ভর দিয়ে খুতবা দেয়া সুন্নত।‘ [ কাশশাফুলকেনা:২/৩৬, আরো দ্র: আল ইনসাফ: ২/৩৯৭ ]
এই অভিমত যারা ব্যক্ত করেছেন তাদের কথা হল, লাঠির উপর ভর দিয়ে খুতবা দেয়া রাসূলুল্লাহ থেকে বহু হাদিসে প্রমাণিত। তন্মধ্যে একটি হল হাকাম ইবনে হাযামের হাদিসে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমার দিন (লাঠি অথবা ধনুকের উপর ভর দিয়ে খুতবা দিয়েছেন, অতঃপর তিনি আল্লাহর প্রশংসা ও গুণকীর্তন করেছেন…) [ আবু দাউদ: ১০৯৬, ইমাম নববি আল মাজমু গ্রন্থে হাদিসটি হাসান বলেছেন, (৪/৫২৬) সহিহু আবি দাউদ গ্রন্থে আলবানি র. হাদিসটিকে হাসান বলে আখ্যায়িত করেছেন। অবশ্য শরিয়তবিদদের কেউ কেউ হাদিসটি যয়িফ বলেছেন। ইবনে কাছির র. ইরশাদুল ফকিহ গ্রন্থে (১/১৯৬) বলেন,’এই হাদিসের সনদটি শক্তিশালী নয়।‘
দ্বিতয় অভিমত; এরূপ করা মাকরুহ, হানাফি মাযহাবের এটাই ফতোয়া, যদিও এ মাযহাবের কিছু ফকিহ এ মতের বিরুদ্ধে গিয়েছেন।
ফতোয়ায়ে তাতারখানিয়াতে আল মুহিতুল বুরহানি গ্রন্থের রচয়িতার বরাত দিয়ে বলা হয়েছে:
খতিব যদি লাঠি অথবা ধনুকের উপর ভর দিয়ে খুতবা দেন, তবে তা জায়েজ, কিন্তু এরূপ করা মাকরুহ; কারণ তা সুন্নতের খেলাফ। [ ফতোয়ায়ে তাতারখানিয়া:২/৬১]
হানাফি মাযহাবের আরেকটি ফতোয়াগ্রন্থ, ফতোয়ায়ে হিন্দিয়াতে এসেছে (১/১৪৮) :
ধনুক অথবা লাঠির উপর ভর দিয়ে খুতবা দেয়া মাকরুহ, খুলাসা ও আল মুহিত গ্রন্থদ্বয়ে এরূপই এসেছে। আর যেসব দেশ যুদ্ধের মাধ্যমে জয় হয়েছে সেসব দেশে খতিবগণ তরবারি ঝুলিয়ে খুতবা দিবে। তাহাবি গ্রন্থের ব্যাখ্যায় এরূপই রয়েছে।
ইমাম ইবনুল কাইয়েমের কথাও প্রমাণ করে যে মিন্বারে খুতবা দেয়ার সময় লাঠির উপর ভর দেয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত নয়।
তিনি বলেন:’ তিনি তরবারি বা অন্য কিছু নিয়ে খুতবা দিতেন না। মিন্বার নির্মাণের পূর্বে তিনি ধনুক অথবা লাঠির উপর ভর দিতেন। যুদ্ধের ময়দানে তিনি ধনুকের উপর ভর দিয়ে খুতবা দিতেন, আর মসজিদে লাঠির উপর। তরবারির উপর ভর দিয়ে খুতবা দিয়েছেন বলে কোনো বর্ণনায় নেই। কিছু মূর্খ লোক মনে করে থাকে যে তিনি সর্বদা তরবারির উপর ভর দিয়ে খুতবা দিয়েছেন-যা ইঙ্গিত করে যে এই দীনে-ইসলাম তরবারির দ্বারা কায়েম হয়েছে- চরম মূর্খতার ফলেই তারা এরূপ বলে থাকে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এমন কোনো বর্ণনা আসেনি যে তিনি তরবারি, ধনুক অথবা অন্য কিছু নিয়ে মিন্বারে উঠতেন। এমনকী মিন্বার নির্মাণের পূর্বেও যে তিনি তরবারি হাতে নিয়ে খুতবা দিয়েছেন, এ কথা কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায় না। মিন্বার নির্মাণের পূর্বে তিনি লাঠি বা ধনুকের উপর ভর দিতেন।‘ [ যাদুল মাআদ : ১/৪২৯ ]
শায়খ ইবনে উসাইমীন র. বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তরবারি, ধনুক অথবা লাঠির উপর ভর দিয়ে খুতবা দিতেন একথা প্রমাণের পক্ষে যে হাদিস উল্লেখ করা হয় তা সন্দেহযুক্ত। যদি ধরেও নিই যে হাদিসটি সহিহ, তবুও ইবনুল কাইয়েম র. বক্তব্য বিষয়টি পরিষ্কার করে দিচ্ছে। তিনি বলেছেন: মিন্বার নির্মাণের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো কিছুর উপর ভর দিয়েছেন বলে কোনো বর্ণনায় আসেনি।
এর ব্যাখ্যায় বলা যায়: কোনো কিছুর উপর ভর দেয়া প্রয়োজনের সময় হতে পারে। উদাহরণত খতিব যদি এমন দুর্বল হয় যে তাকে লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়াতে হবে, তবে সে লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়াবে। এবং এসময় তা সুন্নত বলে পরিগণিত হবে। কেননা তা দাঁড়ানোর ব্যাপারে সাহায্য করে। আর খুতবার সময় দাঁড়ানো সুন্নত। পক্ষান্তর যদি প্রয়োজন না থাকে তাহলে লাঠি বহনের আদৌ দরকার নেই। [ আশশারহুল মুমতে: ৫/৬২-৬৩ ]
শায়খ আলবানি র. ইবনুল কাইয়েম র. এর কথা সমর্থন করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুতবা দেয়ার সময় ধনুক অথবা লাঠির উপর ভর দিতেন এ কথা তিনি অস্বীকার করেছেন। [ দ্র: আসসিললাতুয যায়িফা : ৯৬৪ ]
আল্লাহই উত্তম জ্ঞানী।
– মুহাম্মাদ ছালেহ আল মুনাজ্জিদ
We are cordially request not to share any add.