ধর্মীয় মতভেদ

উসীলা কী?

উসীলার পরিচয়

যার মাধ্যমে কারও নৈকট্য অর্জন করা যায়, তাকে উসীলা বলা হয়। আর কুরআন ও হাদীছের পরিভাষায় যে সমস্ত বিষয় দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য হাসিল করা যায়, তাকে উসীলা বলা হয়। কুরআন মাযীদে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَابْتَغُوا إِلَيْهِ الْوَسِيلَةَ وَجَاهِدُوا فِي سَبِيلِهِ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ

হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তাঁর নিকট উসীলা প্রার্থনা কর এবং তাঁর পথে জিহাদ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। (সূরা মায়িদাঃ ৩৫)

সাহবা, তাবেয়ী এবং পূর্ববর্তী সম্মানিত উলামায়ে কিরাম থেকে উসীলার যে অর্থ বর্ণিত হয়েছে, তা হল ভাল আমল করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা। ইমাম ইবনে যারীর (রঃ) (وَابْتَغُوا إِلَيْهِ الْوَسِيلَةَ) এর ব্যাখ্যায় বলেন, আল্লাহর সন্তোষ জনক আমল করার মাধ্যমে তোমরা আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার চেষ্টা কর।

ইমাম ইবনে কাছীর (রঃ) ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করে বলেন, উসীলা অর্থ নৈকট্য। মুজাহিদ, হাসান, আবদুল্লাহ ইবনে কাছীর, সুদ্দী এবং ইবনে যায়েদ থেকেও অনুরূপ কথা বর্ণিত হয়েছে। কাতাদাহ (রঃ) বলেন, আল্লাহর আনুগত্যমূলক এবং সন্তোষ জনক কাজ করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন কর।

উপরোক্ত কথাগুলো বর্ণনা করার পর ইবনে কাছীর (রঃ) বলেন, উসীলার ব্যাখ্যায় যা বলা হলো, এতে ইমামদের ভিতরে কোন মতবিরোধ নেই। কাজেই আয়াতের মাঝে উসীলার অর্থ অত্যন্ত সুস্পষ্ট। (দেখুন তাফসীরে ইবনে কাছীর, ৩/১০৩)

উপরোক্ত আয়াতকে দলীল হিসাবে গ্রহণ করে যারা আম্বীয়ায়ে কিরাম, আওলীয়াদের ব্যক্তিসত্বা এবং তাদের সম্মানের উসীলা দেয়া বৈধ মনে করে, তাদের ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ বাতিল এবং কুরআনের আয়াতকে পরিবর্তনের শামিল। এমনকি কুরআনের আয়াতকে এমন অর্থে ব্যবহার করা, যার কোন সম্ভাবনা নেই এবং যার পক্ষে গ্রহণযোগ্য কোন মুফাসসিরের উক্তি নেই।

আমাদের দেশের কিছু তথাকথিত আলেম উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলে থাকে, আল্লাহ তায়ালা এখানে পীর ধরতে বলেছেন। পীরই হলো উসীলা। পীর না ধরলে কেউ জান্নাতে যেতে পারবে না। এ ধরণের ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ বানোয়াট। পূর্ব যুগের গ্রহণযোগ্য কোন আলেম এ ধরণের ব্যাখ্যা করেন নি।

সুতরাং উপরের আলোচনার উপর ভিত্তি করে আমরা বলতে পারি যে, উসীলা দু’প্রকার।

(১) শরীয়ত সম্মত উসীলা

(২) বিদ্‌আতী উসীলা

আমরা যদি কুরআন এবং সুন্নার দিকে ফিরে যাই এবং তাতে গভীরভাবে দৃষ্টি দেই, তাহলে দেখতে পাব যে, শরীয়ত সম্মত উসীলা তিন ভাগে বিভক্ত।

১) আল্লাহর সুন্দর নাম এবং গুণাবলীর উসীলা দেয়াঃ

আল্লাহর সুন্দর নাম ও গুণাবলীকে দু’আর ভিতরে উল্লেখ করে তার উসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দু’আ করা শরীয়ত সম্মত। আল্লাহ বলেন,

وَلِلَّهِ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى فَادْعُوهُ بِهَا

আল্লাহর রয়েছে অনেক সুন্দর নাম। সুতরাং আল্লাহর কাছে সেই নামগুলোর উসীলা দিয়ে তোমরা তাঁর কাছে দু’আ কর। (সূরা আ’রাফঃ ১৮০) যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুঃশ্চিন্তা থেকে মুক্তির দু’আয় বলেছেন,

أَسْأَلُكَ أَلَّلهُمَّ بِكُلِّ اسْمٍ هُوَ لَكَ سَمَّيْتَ بِهِ نَفْسَكَ أَوْ عَلَّمْتَهُ أَحَدًا مِنْ خَلْقِكَ أَوْ أَنْزَلْتَهُ فِي كِتَابِكَ أَوِ اسْتَأْثَرْتَ بِهِ فِي عِلْمِ الْغَيْبِ عِنْدَكَ أَنْ تَجْعَلَ الْقُرْآنَ رَبِيعَ قَلْبِي

হে আল্লাহ! আপনার সেই সমস্ত নামের প্রত্যেকটির উসীলায় আমি প্রার্থনা জানাচ্ছি যেগুলো আপনি নিজের জন্য নির্ধারণ করেছেন, অথবা তা আপনার কোন সৃষ্টিকে অবগত করেছেন অথবা কুরআনে তা নাযিল করেছেন অথবা আপনার অদৃশ্য জ্ঞানে তা সংরক্ষিত করে রেখেছেন। আপনি আমার জন্য কুরআনকে হৃদয়ের উর্বরতা স্বরূপ করুন। এখানে আল্লাহর প্রতিটি নামের উসীলায় আল্লাহর কাছে দু’আ করা হয়েছে। তাছাড়া নির্দিষ্ট নাম উল্লেখ করে দু’আ করা যেমন এভাবে বলা যে,

يَا رَحْمَنُ اِرْحَمْنِى, يَاغَفَّارُ اِغْفِرْلِى

বাংলা উচ্চারণঃ ইয়া রাহমান! ইরহামনী, ইয়া গাফ্‌ফার! ইগফিরলী। হে পরম দয়ালু! আমাকে দয়া করুন। হে ক্ষমাশীল! আমাকে ক্ষমা করুন।

২) সৎ কাজের উসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দু’আ করাঃ

যেমন বান্দা এভাবে বলবে যে, হে আল্লাহ! আপনার প্রতি আমার ঈমান, ভালবাসা এবং আপনার রাসূলের প্রতি আনুগত্যের উসীলায় আমাকে ক্ষমা করুন। আল্লাহ আমাদেরকে সৎ কাজের উসীলা দিয়ে দু’আ করার নিয়ম শিক্ষা দিয়ে বলেন,

رَبَّنَا إِنَّنَا سَمِعْنَا مُنَادِيًا يُنَادِي لِلْإِيمَانِ أَنْ آمِنُوا بِرَبِّكُمْ فَآمَنَّا رَبَّنَا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَكَفِّرْ عَنَّا سَيِّئَاتِنَا وَتَوَفَّنَا مَعَ الْأَبْرَار

হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা নিশ্চিতরূপে শুনেছি একজন আহবানকারীকে ঈমানের প্রতি আহবান করতে যে, তোমাদের পালনকর্তার প্রতি ঈমান আন, তাই আমরা ঈমান এনেছি। হে আমাদের পালনকর্তা! অতঃপর আমাদের সকল গুনাহ ক্ষমা কর এবং আমাদের সকল দোষ-ত্রুটি দূর করে দাও, আর আমাদের মৃত্যু দাও নেক লোকদের সাথে। (সূরা আল- ইমরানঃ ১৯০-১৯৩) এখানে গুনাহ মাফের জন্য ঈমানের উসীলা দিয়ে দু’আ করা হয়েছে।

সৎ আমলের উসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দু’আ করার ক্ষেত্রে তিন ব্যক্তির ঘটনাটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তারা একটি গুহার ভিতরে আশ্রয় নিয়েছিল। উপর থেকে একটি পাথর খসে পড়ে গুহার মুখ বন্ধ হয়ে গেলে গুহা থেকে তাদের বের হওয়া অসম্ভব হয়ে গেল। তারা একে অপরকে বলল, তোমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ভাল আমলগুলো আল্লাহর কাছে তুলে ধরে দু’আ কর। তারা প্রত্যেকেই নিজের সৎ আমল তুলে ধরে আল্লাহর কাছে দু’আ করেছিল। একজন পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ করার উসীলা দিল, দ্বিতীয় ব্যক্তি অন্যায় কাজ (ব্যভিচার) থেকে বিরত থাকার উসীলা দিল এবং তৃতীয়জন তার চাকরের বেতন পূর্ণভাবে প্রদান করার উসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দু’আ করল। তারা প্রত্যেকেই দু’আয় বলেছিল, হে আল্লাহ! আপনি যদি জানেন যে, এই আমলটুকু আপনার সন্তুষ্টির জন্য করেছি, তাহলে আপনি তার উসীলায় আমাদেরকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করুন। এভাবে দু’আ করার পর পাথরটি সরে গেল এবং তারা গুহা থেকে বের হয়ে আসল। হাদীছটি বুখারী শরীফে রয়েছে। লোক তিনজন বিপদে পড়ে আপন আপন সৎ আমলের উসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে বিপদ মুক্তির জন্য দু’আ করেছে। কোন নবী, ওলী বা সৎ লোকের উসীলা দিয়ে একথা বলে নি যে, হে আল্লাহ! অমুকের উসীলায় আমাদেরকে উদ্ধার কর।

৩) সৎ লোকের দু’আর উসীলা দেয়াঃ

বিপদা-পদে পতিত কোন মুসলিম নিজেকে আল্লাহর কাছে অপরাধী মনে করলে বিপদ থেকে শক্তিশালী মাধ্যম ধরে আল্লাহর কাছে দু’আ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলে আল্লাহ ভীরু কোন সৎ লোকের কাছে গিয়ে তার জন্য দু’আ করার আবেদন করা যায়েজ আছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর সুন্নাত এবং সাহাবীদের আমলের মাধ্যমে এ প্রকারের উসীলা প্রমাণিত আছে।

আনাস (রাঃ) বলেন, একদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জুমআর খুৎবা দিচ্ছিলেন। এমন সময় একজন গ্রাম্য লোক এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! গাছ-পালা শুকিয়ে যাচ্ছে, পানির পিপাসায় পশু-পাখি মারা যাচ্ছে। আল্লাহর কাছে বৃষ্টির জন্য দু’আ করুন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর দুই হাত উঠিয়ে দু’আয় বললেন,

اللَّهُمَّ أَغِثْنَا اللَّهُمَّ أَغِثْنَا اللَّهُمَّ أَغِثْنَا

হে আল্লাহ! আমাদের জন্য বৃষ্টি বর্ষণ করুন! হে আল্লাহ! আমাদের জন্য বৃষ্টি বর্ষণ করুন! হে আল্লাহ! আমাদের জন্য বৃষ্টি বর্ষণ করুন!। মানুষেরাও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর সাথে হাত উঠাল এবং দু’আ করল। আনাস (রাঃ) বলেন, আল্লাহর শপথ! আকাশে তখন কোন মেঘের লক্ষণ ছিল না। পাহাড়ের পিছন থেকে ঢালের মত একখন্ড মেঘ এসে আকাশের উপরে উঠে ছড়িয়ে পড়ল এবং প্রচুর বৃষ্টিপাত হল। আনাস (রাঃ) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিম্বার থেকে নামার পূর্বেই দেখলাম যে, তাঁর দাড়ি বেয়ে বৃষ্টির পানি ঝড়ে পড়ছে। অতঃপর আমরা নামায আদায় করে বৃষ্টির পানির উপর দিয়ে বাড়ীতে গেলাম। পরবর্তী জুমআর দিন পর্যন্ত বৃষ্টি অব্যাহত থাকল। পরবর্তী জুমআয় সেই একই ব্যক্তি অথবা অন্য একলোক এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! কাচা ঘর-বাড়ী ভেঙ্গে যাচ্ছে, বৃষ্টির পানিতে রাস্তাঘাট ডুবে যাচ্ছে, আল্লাহর কাছে বৃষ্টি বন্ধ করার জন্য দু’আ করুন। কথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাসলেন এবং দুই হাত উঠিয়ে আল্লাহর কাছে দু’আ করলেন। তিনি দু’আয় বললেন,

اللَّهُمَّ حَواليَْنَا وَلَا عَلَيْنَا

হে আল্লাহ! আমাদের উপর নয় বরং চারপাশের উঁচু বনভূমি এবং বৃক্ষরাজি উৎপন্ন হওয়ার স্থানে বৃষ্টি বর্ষণ করুন। সাথে সাথে মদীনার আকাশ পরিস্কার হয়ে গেল এবং মদীনার চারপাশে বৃষ্টি বর্ষণ হতে থাকল। (মুসলিম)

সাহাবীদের আমল থেকেও এধরণের উসীলা দেয়া প্রমাণিত আছে। আনাস (রাঃ) বলেন, অনাবৃষ্টি দেখা দিলে উমার (রাঃ) আব্বাস (রাঃ) এর মাধ্যমে বৃষ্টি প্রার্থনা করতেন। তিনি বলতেন, হে আল্লাহ! আপনার নবী জীবিত থাকতে আমরা তাঁর মাধ্যমে বৃষ্টি প্রার্থনা করলে আপনি আমাদের জন্য বৃষ্টি বর্ষণ করতেন। এখন আপনার নবীর চাচার মাধ্যমে বৃষ্টি প্রার্থনা করছি। আপনি আমাদের জন্য বৃষ্টি বর্ষণ করুন। এখানে নবীর মাধ্যমে বা নবীর চাচার মাধ্যমে বৃষ্টি চাওয়ার অর্থ হলো বৃষ্টির জন্য দু’আ করার আবেদন করা। এ নয় যে, তাদের সম্মানের উসীলা দিয়ে বৃষ্টি চাইতেন।

সম্মানের উসীলা দেয়া যদি যায়েজ হতো, তাহলে তাঁরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বাদ দিয়ে কখনই আব্বাস (রাঃ) এর কাছে যেতেন না। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সম্মান মৃত্যুর পর শেষ হয়ে যায় নি। কাজেই এখানে উসীলা অর্থ দু’আর উসীলা দেয়া। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দু’আ করেছেন এবং আব্বাস (রাঃ)ও সবার সাথে দু’আ করেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্যুর পর তাঁর উম্মতের জন্য দু’আ করতে অক্ষম বলেই তাঁরা আব্বাস (রাঃ)কে দু’আ করতে বলেছেন।

বিদ্‌আতী উসীলাঃ

উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা দলীল-প্রমাণসহ বৈধ উসীলা ও তার প্রকার ভেদ সম্পর্কে জানতে পারলাম। উপরোক্ত প্রকারগুলো ব্যতীত কারও অধিকার বা সম্মানের উসীলা কিংবা পীরের উসীলা দেয়াসহ যত ধরণের উসীলা রয়েছে, সবই বিদ্‌আত। কারণ এগুলোর পক্ষে আল্লাহর কিতাব, রাসূলের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুন্নাত সাহাবী এবং তাবেয়ীদের কারও নিকট হতে কোন দলীল নেই।

মন্তব্য করুন

Back to top button