চারটি বিদায়ী উপদেশ
عَنِ الْعِرْبَاضِ بْنِ سَارِيَةَ قَالَ صَلَّى بِنَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَاتَ يَوْمٍ ثُمَّ أَقْبَلَ عَلَيْنَا فَوَعَظَنَا مَوْعِظَةً بَلِيغَةً ذَرَفَتْ مِنْهَا الْعُيُونُ وَوَجِلَتْ مِنْهَا الْقُلُوبُ فَقَالَ قَائِلٌ يَا رَسُولَ اللهِ كَأَنَّ هَذِهِ مَوْعِظَةُ مُوَدِّعٍ فَمَاذَا تَعْهَدُ إِلَيْنَا فَقَالَ : أُوصِيكُمْ بِتَقْوَى اللهِ وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ وَإِنْ كَانَ عَبْدًا حَبَشِيًّا فَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِى فَسَيَرَى اخْتِلاَفًا كَثِيرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِى وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ –
অনুবাদ : ইরবায বিন সারিয়াহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদিন আমাদের নিয়ে ছালাত আদায় করলেন। অতঃপর আমাদের দিকে ফিরে বসলেন। অতঃপর আমাদেরকে এমন মর্মস্পর্শী ভাষায় উপদেশ দিলেন যে, চক্ষু সমূহ অশ্রুসজল হয়ে গেল এবং হৃদয় সমূহ ভীত-বিহবল হয়ে পড়ল। এমন সময় একজন বলে উঠলো, হে আল্লাহ্র রাসূল! মনে হচ্ছে এটা যেন বিদায়ী উপদেশ। অতএব আপনি আমাদেরকে আরও বেশী উপদেশ দিন। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, আমি তোমাদেরকে আল্লাহভীতির উপদেশ দিচ্ছি। আমি তোমাদের আমীরের আদেশ শুনতে ও মান্য করতে উপদেশ দিচ্ছি যদিও তিনি একজন হাবশী গোলাম হন। কেননা আমার পরে তোমাদের মধ্যে যারা বেঁচে থাকবে, তারা সত্বর বহু মতভেদ দেখতে পাবে। তখন তোমরা আমার সুন্নাতকে এবং সুপথপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে অাঁকড়ে ধরবে। তাকে কঠিনভাবে ধরবে এবং মাড়ির দাঁত সমূহ দিয়ে কামড়ে ধরে থাকবে। সাবধান! দ্বীনের মধ্যে নতুন সৃষ্টিসমূহ হ’তে দূরে থাকবে। কেননা (দ্বীনের মধ্যে) যেকোন নতুন সৃষ্টি হ’ল বিদ‘আত। আর প্রত্যেক বিদ‘আত হ’ল পথভ্রষ্টতা’।[1]
সারমর্ম : সকল ক্ষেত্রে আল্লাহভীতি বজায় রাখা, আমীরের আদেশ মান্য করা, রাসূল (ছাঃ) ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত কঠিনভাবে আকড়ে ধরা এবং বিদ‘আত হ’তে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
হাদীছের ব্যাখ্যা :
(صَلَّى بِنَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَاتَ يَوْمٍ) ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদিন আমাদের নিয়ে ছালাত আদায় করলেন’। অর্থাৎ তিনি ছালাতে আমাদের ইমামতি করলেন। তিরমিযী ও ইবনু মাজাহ্র বর্ণনায় এ অংশটুকু নেই। সেখানে وعظنا رسول الله ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের একদিন ওয়ায করলেন’ বলে হাদীছ শুরু করা হয়েছে। ছাহেবে মিরক্বাত এখানে ذَاتَ يَوْمٍ -এর ব্যাখ্যায় বলেন যে, ঘটনাটি দিনের বেলায় ঘটেছিল।
(ثُمَّ أَقْبَلَ عَلَيْنَا بِوَجْهِهِ) অর্থ انحرف الينا انحرافا ‘আমাদের দিকে সরাসরি মুখ ফিরিয়ে বসলেন’।
(فَوَعَظَنَا مَوْعِظَةً بَلِيغَةً) অর্থ نصحنا نصيحة تامة فى الإنذار والتخويف ‘তিনি আমাদেরকে আখেরাতের ভীতিপূর্ণ সারগর্ভ উপদেশ প্রদান করেন’। যেমন আল্লাহ বলেন, فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ وَعِظْهُمْ وَقُلْ لَهُمْ فِي أَنْفُسِهِمْ قَوْلاً بَلِيغًا ‘আপনি ওদেরকে এড়িয়ে চলুন এবং ওদের সদুপদেশ দিন এবং এমন কথা বলুন, যা ওদের জন্য কল্যাণকর হয়’ (নিসা ৪/৬৩)।
(ذَرَفَتْ مِنْهَا الْعُيُونُ وَوَجِلَتْ مِنْهَا الْقُلُوبُ) ‘তার ফলে চক্ষুসমূহ অশ্রুসজল হয়ে গেল এবং হৃদয়সমূহ ভীত বিহবল হয়ে পড়ল’। যেমন আল্লাহ বলেন, وَإِذَا سَمِعُوْا مَا أُنزِلَ إلى الرَّسُوْلِ تَرَى أَعْيُنَهُمْ تَفِيْضُ مِنَ الدَّمْعِ مِمَّا عَرَفُوْا مِنَ الْحَقِّ يَقُولُوْنَ رَبَّنَا آمَنَّا فَاكْتُبْنَا مَعَ الشَّاهِدِيْنَ- ‘আর তারা যখন শোনে রাসূলের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, তখন আপনি তাদের চক্ষুসমূহকে অশ্রুসজল দেখতে পাবেন এ কারণে যে, তারা সত্যকে চিনে নিয়েছে। তারা বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে সাক্ষ্যদাতাদের (অর্থাৎ মুসলমানদের) মধ্যে লিপিবদ্ধ করুন’।[2]
এখানে প্রথমে ‘চক্ষু অশ্রুসজল হওয়া এবং পরে ‘হৃদয় ভীত-বিহবল হওয়া’ বলার অর্থ এটা নয় যে, দু’টি আগপিছ হয়। বরং দু’টিই এক সাথে হয়ে থাকে এবং হৃদয়ের গভীরে প্রভাব বিস্তারের বহিঃপ্রকাশ ঘটে চোখের পানির মাধ্যমে। চোখের পানিই তার মনের কথা বলে দেয়।
(فَقَالَ رَجُلٌ يَا رَسُولَ اللهِ كَأَنَّ هَذِهِ مَوْعِظَةُ مُوَدِّعٍ) অতঃপর একজন বলল, হে আল্লাহ্র রাসূল! মনে হচ্ছে এটা যেন বিদায়ী উপদেশ’। হাকেম এবং আহমাদ-এর বর্ণনায় এসেছে قُلْنَا ‘আমরা বললাম’। বস্ত্ততঃ শ্রোতাদের উপরে গভীর প্রভাব বিস্তারকারী উপদেশ লক্ষ্য করেই ছাহাবীগণ এটাকে বিদায়ী উপদেশ বলে ধারণা করেছিলেন। অন্য হাদীছে রয়েছে إِنَّ مِنَ الْبَيَانِ لَسِحْرًا ‘নিশ্চয়ই কিছু কিছু বক্তব্যে জাদু রয়েছে’।[3] সম্ভবতঃ ঐদিন অমন অবস্থাই ঘটেছিল। (كَأَنَّ َهَذِهِ مَوْعِظَةُ مُوَدِّعٍ) ‘যেন এটি বিদায়ী উপদেশ’। অর্থ, كأن هذه نصيحة الذى يريد الوداع ‘মনে হচ্ছে এটি ঐ ব্যক্তির উপদেশ, যিনি বিদায় গ্রহণ করবেন’ توديع থেকে مودَّع ‘বিদায় গ্রহণকারী’ (فَأَوْصِنَا) ‘অতএব আপনি আমাদের আরও উপদেশ দিন’। মৃত্যুকালীন বিদায়ী উপদেশকে وصية বলা হয়। ‘নছীহত’ হল সাধারণ উপদেশ এবং ‘অছিয়ত’ হ’ল জোরালো উপদেশ বা নির্দেশ। বিদায়ী উপদেশকে যেহেতু বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে, সেকারণ তাকে ‘অছিয়ত’ বলা হয়। সেজন্য ছাহাবায়ে কেরাম এখানে ‘অছিয়ত’ শব্দ ব্যবহার করেছেন’ অর্থাৎ إذا كان الأمر كذلك فمرنا بما فيه كمال صلاحنا فى عاجلنا وآجلنا ‘যদি সেটাই হয়, তাহ’লে আপনি আমাদের নির্দেশ দিন ঐসব বিষয়ে যাতে আমাদের ইহকালে ও পরকালে সার্বিক কল্যাণ নিহিত রয়েছে।
(فَقَالَ : أُوصِيكُمْ بِتَقْوَى اللهِ) ‘অতঃপর তিনি বললেন, আমি তোমাদেরকে আল্লাহভীতির উপদেশ দিচ্ছি’। যেমন আল্লাহ বলেন, وَلَقَدْ وَصَّيْنَا الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلِكُمْ وَإِيَّاكُمْ أَنِ اتَّقُوا اللهَ ‘আর নিশ্চয়ই আমরা নির্দেশ দিয়েছিলাম তোমাদের পূর্বেকার কিতাবধারী (ইহুদী-নাছারা)-দেরকে এবং (নির্দেশ দিচ্ছি) তোমাদেরকে এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহ্কে ভয় কর’… (নিসা ৪/১৩১)। ছাহেবে মিরক্বাত বলেন, اتقوا الله أي بأقسامها الثلاثة وهي تقوى الشرك والمعصية وتقوى ما سوى الله ‘আল্লাহকে ভয় কর’ অর্থ তার তিনটি প্রকার সহ ভয় কর। আর তা হ’ল, (১) শিরক হ’তে বেঁচে থাকা (২) গোনাহ হ’তে বিরত থাকা এবং (৩) আল্লাহ ব্যতীত অন্য সবকিছু হ’তে দূরে থাকা’। তিনি বলেন, এটি হ’ল مِنْ جَوَامِعِ الْكَلِمِ অর্থাৎ সারগর্ভ বাক্য সমূহের অন্যতম, (যেটা হ’ল পবিত্র কুরআন এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য)। কেননা তাক্বওয়া হ’ল আদেশ সমূহ মান্য করা ও নিষেধ সমূহ হ’তে বিরত থাকার নাম। এটি হ’ল আখেরাতের পাথেয়, যা মানুষকে আল্লাহ্র রহমতে চিরস্থায়ী আযাব থেকে মুক্তি দেবে এবং তাকে স্থায়ী শান্তির নিবাস জান্নাতে পৌঁছে দেবে। যেমন প্রখ্যাত আরবীয় কবি আ‘শা বলেন-
إِذَا أَنْتَ لَمْ تَرْحَلْ بِزَادٍ مِنَ التُّقَى + ولاَقَيْتَ بَعْدَ الْمَوْتِ مَنْ قَدْ تَزَوَّدَا
نَدِمْتَ عَلَى أَنْ لاَ تَكُوْنَ كَمِثْلِهِ + وأَنَّكَ لَمْ تُرْصِدْ لَمَا كَانَ أَرْصَدَا
‘যখন তুমি তাক্বওয়ার পাথেয় সহ আখেরাতে যাত্রা করবে না, অথচ মৃত্যুর পরে এমন ব্যক্তির সাথে তোমার সাক্ষাত হবে, যিনি ঐ পাথেয় নিয়ে হাযির হয়েছেন, তখন তুমি লজ্জিত হবে এ কারণে যে, তুমি তার মত হ’তে পারনি এবং তুমি তার মত অর্জন করোনি, যা সে অর্জন করেছে’ (দীওয়ানুল আ‘শা)। আর তাক্বওয়া হ’ল ব্যক্তি ও আল্লাহ্র মধ্যকার ব্যক্তিগত বিষয়’।
আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে বহু স্থানে তাক্বওয়া অর্জনের গুরুত্ব ও উপকারিতা বর্ণনা করেছেন। যেমন তিনি বলেন, وَمَنْ يَتَّقِ اللهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا- وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لاَ يَحْتَسِبُ– وَمَنْ يَتَّقِ اللهَ يَجْعَلْ لَهُ مِنْ أَمْرِهِ يُسْرًا– وَمَنْ يَتَّقِ اللهَ يُكَفِّرْ عَنْهُ سَيِّئَاتِهِ وَيُعْظِمْ لَهُ أَجْرًا–
‘যে ব্যক্তি আল্লাহ্কে ভয় করে, আল্লাহ তার (কাংখিত) পথ খুলে দেন’। ‘এবং তাকে রূযী দান করেন এমন উৎস হ’তে যে বিষয়ে তার কোনরূপ পূর্ব ধারণা ছিল না’। ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ্কে ভয় করে, আল্লাহ তার কাজ-কর্ম সহজ করে দেন’। ‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার পাপরাশি মোচন করেন এবং তাকে মহা পুরস্কার দান করেন’ (তালাক ৬৫/২, ৩, ৪, ৫)। তিনি আরো বলেন, وَتَزَوَّدُوا فَإِنَّ خَيْرَ الزَّادِ التَّقْوَى وَاتَّقُونِ يَا أُولِي الْأَلْبَابِ ‘তোমরা (হজ্জের সময় সঙ্গে) পাথেয় নাও। নিশ্চয়ই সর্বোত্তম পাথেয় হ’ল আল্লাহভীতি। আর তোমরা আমাকে ভয় কর, হে জ্ঞানী সমাজ (বাক্বারাহ ২/১৯৭)।
জনৈক ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে উপদেশ কামনা করলে তিনি বলেছিলেন, أُوصِيكَ بِتَقْوَى اللهِ فَإِنَّهُ رَأْسُ كُلِّ شَىْءٍ ‘আমি তোমাকে আল্লাহভীতির উপদেশ দিচ্ছি। কেননা নিশ্চয়ই তা সকল কিছুর মূল’।[4]
(وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ) অর্থ, أوصيكم بسمع كلام الخليفة والأئمة واطاعتهم فى المعروف ‘আমি তোমাদের নির্দেশ দিচিছ তোমাদের খলীফা ও নেতৃবৃন্দের আদেশ শ্রবণের জন্য এবং ন্যায় কাজে তাদের আনুগত্য করার জন্য’। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, لاَ طَاعَة لِمَخْلُوقٍ فِي مَعْصِيَةِ الْخَالِق وَإِنَّمَا الطَّاعَةُ فِى الْمَعْرُوفِ ‘স্রষ্টার অবাধ্যতায় সৃষ্টির প্রতি কোনরূপ আনুগত্য নেই। নিশ্চয়ই আনুগত্য হ’ল কেবল ন্যায় কাজে’।[5] ছাহেবে মিরক্বাত বলেন, لكن لا يجوز محاربته ‘কিন্তু খলীফা বা নেতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা সিদ্ধ নয়’।
(وَإِنْ كَانَ عَبْدًا حَبَشِيًّا) ‘যদিও আমীর হাবশী গোলাম হন’ অর্থ فأطيعوه ولا تنظروا إلى نسبه بل اتبعوه على حسبه ‘তার আনুগত্য কর এবং তার বংশের প্রতি দৃষ্টিপাত করো না। বরং তার পদমর্যাদার কারণে তার অনুসরণ কর’। ইমাম নববীর ‘আরবাঈন’ কিতাবে এসেছে, وإن تأمر عليكم عبد صار أميرا عليكم عبد أدنى الخلق فلا تستنكفوا عن طاعته অর্থ ‘তোমাদের উপরে নিম্ন শ্রেণীর কোন লোক যদি আমীর নিযুক্ত হন, তবুও তার আনুগত্য হ’তে বিরত থেকো না’। এর কারণ হ’ল مخافة إثارة الفتن والحروب واصبروا حتى يأتي الله بأمره ‘যাতে যুদ্ধ-বিগ্রহ ও ফিৎনা-ফাসাদ ছড়িয়ে পড়ার ভয় থেকে মুক্ত থাকা যায় এবং তোমরা ধৈর্য ধারণ কর, যতক্ষণ না আল্লাহ্র হুকুম নেমে আসে’। অবশ্য এ হুকুমটি দেওয়া হয়েছে শাসকদের প্রতি আনুগত্যের ব্যাপারে তাকীদ প্রদানের জন্য অথবা উদাহরণ পেশ করার জন্য। ক্রীতদাসকে শাসক নিয়োগে বাধ্যবাধকতার জন্য নয়। কেননা অন্য হাদীছে এসেছে, اَلْأَئِمَّةُ مِنْ قُرَيْشٍ ‘শাসক হবেন কুরায়েশগণের মধ্য হ’তে’। যেমন হাকেম বর্ণিত হাদীছে বলা হয়েছে وَإِنْ أمَّرَتْ عَلَيْكمْ قُرَيْشٌ عَبْداً حَبَشِيًّا مُجَدَّعاً فَاسْمَعُوا لَهُ وأَطِيْعُوْا ‘যদি কুরায়েশ খলীফা তোমাদের উপরে কোন হাবশী নাককাটা ক্রীতদাসকেও শাসক নিয়োগ করেন, তবুও তোমরা তার কথা শোন এবং আনুগত্য কর’।[6]অবশ্য যবরদস্তি চেপে বসা শাসকের আনুগত্য করাও শুদ্ধ। যেমন আজকাল প্রায় সকল দেশেই ঘটছে’। যেমন জনৈক ছাহাবী প্রশ্ন করলেন, يَا نَبِىَّ اللهِ أَرَأَيْتَ إِنْ قَامَتْ عَلَيْنَا أُمَرَاءُ يَسْأَلُونَا حَقَّهُمْ وَيَمْنَعُونَا حَقَّنَا فَمَا تَأْمُرُنَا فَأَعْرَضَ عَنْهُ ثُمَّ سَأَلَهُ فَأَعْرَضَ عَنْهُ ثُمَّ سَأَلَهُ فِى الثَّانِيَةِ أَوْ فِى الثَّالِثَةِ فَجَذَبَهُ الأَشْعَثُ بْنُ قَيْسٍ وَقَالَ : اسْمَعُوا وَأَطِيعُوا فَإِنَّمَا عَلَيْهِمْ مَا حُمِّلُوا وَعَلَيْكُمْ مَا حُمِّلْتُمْ ‘হে আল্লাহ্র নবী! যদি কোন আমীর আমাদের উপর চেপে বসেন ও আমাদের নিকট তাদের হক দাবী করেন, কিন্তু আমাদের হক প্রদান থেকে বিরত থাকেন, সে অবস্থায় আপনি আমাদের কি নির্দেশ দিচ্ছেন? জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তার কথা শোন ও মান্য কর। কেননা তাদের বোঝা তাদের বহন করতে হবে এবং তোমাদের বোঝা তোমাদের বহন করতে হবে’।[7]
ছাহেবে মিরক্বাত বলেন, সেযুগে হাবশী ক্রীতদাসের আধিক্য থাকায় উদাহরণ স্বরূপ এদের নাম নেওয়া হয়েছে। নইলে যানজীরা এদের চাইতে আরও নিকৃষ্ট শ্রেণীর লোক ছিল’। কেউ বলেন, হাবশী বলতে সকল কৃষ্ণকায় ব্যক্তিকে বুঝানো হয়েছে। তখন ব্যাপক অর্থে তা হাবশী, যানজী, হিন্দুস্তানী, তুর্কী সবাইকে শামিল করবে’।
উম্মুল হুছায়েন (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, إِنْ أُمِّرَ عَلَيْكُمْ عَبْدٌ مُجَدَّعٌ أَسْوَدُ يَقُودُكُمْ بِكِتَابِ اللهِ تَعَالَى فَاسْمَعُوا لَهُ وَأَطِيعُوا ‘যদি তোমাদের উপর নাককাটা কৃষ্ণকায় গোলামও আমীর নিযুক্ত হন, যিনি তোমাদেরকে আল্লাহ্র কিতাব অনুযায়ী পরিচালিত করেন, তোমরা তার কথা শোন ও মান্য কর’।[8]
(فَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِى) ‘আমার পরে তোমাদের মধ্যে যারা বেঁচে থাকবে’। অর্থাৎ ألزموا ما قلت لكم فانه من يعش منكم بعد وفاتى لا مخلص له الا نصيحتى ‘আমি যা বলছি তা অপরিহার্যরূপে গ্রহণ কর। কেননা আমার মৃত্যুর পরে তোমাদের মধ্যে যারা বেঁচে থাকবে, আমার এই উপদেশ মেনে চলা ব্যতীত তাদের বাঁচার কোন পথ থাকবে না’। (فَسَيَرَى اخْتِلاَفًا كَثِيرًا) ‘তখন সত্বর তারা বহু মতভেদ দেখতে পাবে’। এখানে فَسَيَرَى একবচন আসলেও এর মর্ম বহু বচনের। যেমন আল্লাহ বলেন, وَقُلِ اعْمَلُواْ فَسَيَرَى اللهُ عَمَلَكُمْ وَرَسُولُهُ وَالْمُؤْمِنُونَ ‘আপনি বলে দিন যে, তোমরা আমল কর। কেননা সত্বর তোমাদের আমল দেখবেন আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং মুমিনগণ… (তওবাহ ৯/১০৫)।
এই মতভেদের ধরন বিভিন্ন প্রকারের হবে। যেমন প্রত্যেকেই নিজ নিজ আক্বীদা ও আমলকে সঠিক মনে করবে এবং অন্যকে বেঠিক বলবে। যেমন বিদ‘আতীরা হাদীছপন্থীদের বলে থাকে। অথবা নিকৃষ্টতর লোকেরা শাসকের চেয়ার দখল করবে। যেমন ৬৫৬ হিজরীতে কুরায়শী খেলাফত খতম করার পরে বাগদাদে ও মিসরে মামলূক অর্থাৎ দাসবংশের শাসন চেপে বসে।
(فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِى) ‘তখন তোমরা আমার সুন্নাতকে অাঁকড়ে ধরবে’ অর্থ الزموا بطريقتي الثابتة عني واجبًا أو مندوبًا ‘তখন তোমরা আমার প্রতিষ্ঠিত নীতি ও পদ্ধতি কঠোরভাবে অবলম্বন করবে, চাই তা ওয়াজিব বিষয়ে হৌক বা মানদূব বিষয়ে হৌক’। ‘মানদূব’ হ’ল এমন বিষয়, যা করলে নেকী আছে, কিন্তু না করলে গোনাহ নেই।
(وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ) ‘এবং আমার সুপথপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে অাঁকড়ে ধরবে’। কেননা তাঁরা আমার সুন্নাত ব্যতীত আমল করেন না। এখানে রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত বলার পরে ‘এবং’ অব্যয় দ্বারা বিপরীতার্থ বুঝানো হয়নি। বরং খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতের অনুকূলে একই অর্থবোধক সুন্নাত বুঝানো হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন, قُلْ أَطِيعُوا اللهَ وَالرَّسُولَ ‘আপনি বলুন যে, তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য কর’ (আলে ইমরান ৩/৩২)। অর্থাৎ দুই আনুগত্য মূলতঃ একই। একটি অপরটির বিপরীত নয়।
এখানে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত আমল করার তাকীদ দিয়েছেন- তার কারণ হ’তে পারে দু’টি। এক- এমন অনেক সুন্নাত ছিল, যা রাসূল (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় প্রসিদ্ধি লাভ করেনি। সেটা খুলাফায়ে রাশেদীনের আমলে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। যেমন তারাবীহ্র ছালাত তিনদিন জামা‘আতের সাথে আদায় করার পর ফরয হওয়ার ভয়ে আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ) আর পড়েননি।[9] ফলে তা জনগণের মধ্যে প্রসিদ্ধি লাভ করেনি। পরে ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে তিনি এটা পুনরায় জামা‘আত সহকারে চালু করেন।[10] এবং তা সমস্ত ইসলামী জগতে প্রসিদ্ধি লাভ করে। দুই- রাসূল (ছাঃ)-এর কোন সুন্নাতের উপরে গবেষণা করে তার অনুকূলে কোন হুকুম বের করা। যেমন রাসূল (ছাঃ)-এর তত্ত্বাবধানে লিখিত ও তারতীবকৃত কুরআনের যে মূল কপিটি খেজুর পাতার চাটাইয়ে ও পাতলা সাদা পাথরে লিখিত অবস্থায় উম্মুল মুমিনীন হযরত হাফছা (রাঃ)-এর নিকটে ছিল, সেটাকে আবুবকর (রাঃ)-এর সময়ে পুনরায় কপি করা।[11] অতঃপর ওছমান (রাঃ)-এর সময়ে অন্যান্য ছয়টি উপভাষায় কুরআন প্রচার নিষিদ্ধ করে এবং সব কপি জ্বালিয়ে দিয়ে কেবলমাত্র হাফছাহ (রাঃ)-এর নিকটে রক্ষিত মূল কুরায়শী ক্বিরাআতের কপিটি অনেকগুলি কপি করে সর্বত্র প্রচার করা।[12] মোটকথা খুলাফায়ে রাশেদীন সর্বদা রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতের অনুকূলে আদেশ-নিষেধ জারি করবেন শত্রুর মোকাবিলার জন্য এবং দ্বীনের শক্তি বৃদ্ধির জন্য। রাসূল (ছাঃ)-এর নীতি ও পদ্ধতির বিপরীত কিছু করার অবকাশ তাঁদের নেই।
(الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّيْنَ) ‘সঠিক ও সুপথপ্রাপ্ত’ পরপর দু’টি বিশেষণ আনার উদ্দেশ্য হ’ল উক্ত খলীফাগণ যে হকপন্থী এবং তাঁরা যে সত্যের উপরে দৃঢ় হবেন, সে বিষয়ে তাকীদ সহকারে বলে দেওয়া। এক্ষণে খুলাফায়ে রাশেদীন কারা, সে বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রসিদ্ধ হাদীছ রয়েছে, যা তাঁর অন্যতম মু‘জেযা হিসাবে অভিহিত। তিনি বলেন, الْخِلاَفَةُ بَعْدِي ثَلاَثُونَ سَنَةً ثُمَّ تَصِيرُ مُلْكًا ‘আমার পরে খেলাফত ত্রিশ বছর থাকবে। তারপর আসবে রাজাদের যুগ’।[13]
উক্ত ত্রিশ বছর সময় আবুবকর, ওমর, ওছমান ও আলী (রাঃ)-এর খেলাফতের মাধ্যমে শেষ হয়েছে। তাওরীশী বলেন, … এর দ্বারা অন্যান্য খলীফায়ে রাশেদ-এর সুন্নাত গ্রহণকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। কেননা তাতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অপর একটি হাদীছের বিরোধিতা হবে। তিনি বলেছেন, لاَ يَزَالُ هَذَا الدِّينُ قَائِمًا حَتَّى يَكُونَ عَلَيْكُمُ اثْنَا عَشَرَ خَلِيفَةً ‘তোমাদের উপর ১২ জন খলীফা থাকা পর্যন্ত আমার এ দ্বীন সূদৃঢ ভিত্তির উপর কায়েম থাকবে’।[14] উমাইয়া খলীফা ওমর বিন আব্দুল আযীয (রাঃ) নিঃসন্দেহে তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন (খেলাফত কাল : ৯৯-১০১ হিঃ)। তবে প্রথম চার খলীফার মর্যাদা সবার উপরে এবং তাঁরা সর্বযুগের সকল হকপন্থীদের অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁদের গৃহীত সিদ্ধান্ত ও নীতি-পদ্ধতি সর্বাধিক বিশুদ্ধ এবং সুন্নাতে রাসূলের প্রতিচ্ছবি। যার অনুসরণ করা সকল যুগের শাসকদের জন্য অপরিহার্য।
(تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ) ‘তাকে কঠিনভাবে ধরবে এবং মাড়ির দাঁত সমূহ দিয়ে কামড়ে ধরে থাকবে’। النَوَاجِذُ -এর একবচন نَاجِذَةٌ অর্থ মাড়ির গোড়ার প্রথম দাঁত। এর দ্বারা বিপদে-আনন্দে কোন অবস্থায় সুন্নাতকে না ছাড়ার ব্যাপারে কঠোরভাবে তাকীদ করা হয়েছে। ব্যাথাতুর ব্যক্তি যেমন শত কষ্ট হ’লেও অপারেশনের যন্ত্রণা সহ্য করে, অনুরূপভাবে দুনিয়াতে শতকষ্ট হ’লেও জান্নাত পাওয়ার স্বার্থে মুমিনকে সর্বদা রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতকে অাঁকড়ে ধরে থাকতে হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّ مِنْ وَرَائِكُمْ زَمَانَ صَبْرٍ لِلْمُتَمَسِّكِ فِيْهِ أَجْرُ خَمْسِيْنَ شَهِيْدًا مِّنْكُمْ- ‘তোমাদের পরে এমন একটা কঠিন সময় আসছে, যখন সুন্নাতকে দৃঢ়ভাবে ধারণকারী ব্যক্তি তোমাদের মধ্যকার পঞ্চাশ জন শহীদের সমান নেকী পাবে’।[15] কবির ভাষায়,
مسلك سنت په اے سالك چلے جا بے دہڑك
جنت الفردوس تك سيد ہى چلى گئى يه سڑك
সুন্নাতের রাস্তা ধরে নির্ভয়ে চল হে পথিক!
জান্নাতুল ফেরদৌসে সিধা চলে গেছে এ সড়ক।
(وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُورِ) ‘সাবধান! দ্বীনের মধ্যে নতুন সৃষ্টিসমূহ হ’তে দূরে থাকবে’। বাক্যটি পূর্বোক্ত فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِى বাক্যের উপরে عطف হয়েছে। প্রথমোক্ত বাক্যে কঠিনভাবে সুন্নাতকে অাঁকড়ে ধরতে বলা হয়েছে এবং আলোচ্য বাক্যে কঠোরভাবে বিদ‘আত হ’তে দূরে থাকতে বলা হয়েছে। সুন্নাত ও বিদ‘আত দু’টি সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী বস্ত্ত। তাই দু’টি বাক্যের বক্তব্য বিপরীতমুখী। প্রথমটিতে কঠোর নির্দেশ এবং শেষেরটিতে কঠোর নিষেধাজ্ঞা। বাক্যের অর্থ দাঁড়াচ্ছে, احذروا عن الأمور التي أحدثت على خلاف أصل من أصول الدين واتقوا إحداثها ‘তোমরা সাবধান থাকো ঐসব কাজকর্ম হ’তে, যা দ্বীনের কোন মূলনীতির বিপরীতে সৃষ্টি হয়েছে এবং তোমরা দ্বীনের মধ্যে নতুন সৃষ্টি করা হ’তে বেঁচে থাক’।
(فََإِنَّ كُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ) ‘কেননা প্রত্যেক বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা’। অর্থ كل بدعة فى الشريعة ضلالة ‘শরী‘আতে সৃষ্ট প্রত্যেক বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা’। আভিধানিক অর্থে বিদ‘আত ভ্রষ্টতা নয়। যেমন ওমর (রাঃ) মসজিদে নববীতে তারাবীহ্র জামা‘আতের পুনঃ প্রবর্তন করার পর বলেছিলেন نِعْمَتِ الْبِدْعَةُ هَذِهِ ‘কতই না সুন্দর বিদ‘আত এটি’।[16] এটি তিনি আভিধানিক অর্থে বলেছিলেন। এই জামা‘আত কোন শারঈ বিদ‘আত ছিল না। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজেই নিজ ইমামতিতে তিন দিন মসজিদে নববীতে তারাবীহর জামা‘আতের সূচনা করেছিলেন। যা প্রায় দু’বছরের অধিককাল পরে একই স্থানে পুনরায় চালু করেন খলীফা ওমর (রাঃ)। দুনিয়াবী স্বার্থে সৃষ্ট নিত্য নতুন আবিষ্কার যেমন বিমান, মোটরযান, রেডিও-টিভি, কম্পিউটার, মাইক্রোফোন, মোবাইল ইত্যাদি কোন শারঈ বিদ‘আত নয়, বরং আভিধানিক অর্থে বিদ‘আত বা নতুন সৃষ্টি, যা কখনোই নিষিদ্ধ নয়। কেননা এগুলি ধর্মের নামে ও আখেরাতে ছওয়াবের উদ্দেশ্যে নতুন সৃষ্ট নয়, বরং মানুষের দুনিয়াবী প্রয়োজনে সৃষ্ট। এগুলি জায়েয হওয়ার অজুহাতে যারা ধর্মের নামে সৃষ্ট তাক্বলীদ, মীলাদ-ক্বিয়াম, কুলখানি-চেহলাম, শবে-মে‘রাজ, শবেবরাত, ওরস-ঈছালে ছওয়াব, দলবদ্ধভাবে আখেরী মুনাজাত এবং সর্বোপরি কুরআন ও ছহীহ হাদীছের উপরে মানুষের রায়কে অগ্রাধিকার দেওয়া ইত্যাকার নানাবিধ অনুষ্ঠানকে ‘বিদ‘আতে হাসানাহ’ বা সুন্দর বিদ‘আত বলে সমাজে চালু করেছেন এবং চালু রাখতে সহায়তা করে যাচ্ছেন, তারা নিঃসন্দেহে বিদ‘আতের সংজ্ঞা জানেন না অথবা জেনেও আত্মপ্রবঞ্চনায় ভুগছেন এবং লাখ লাখ সরল-সিধা মুসলমান নর-নারীকে ধর্মের নামে বিপথে নিয়ে যাচ্ছেন।
মোটকথা শারঈ বিদ‘আত সম্পূর্ণটাই ভ্রষ্টতা। তাতে ভাল ও মন্দ বলে কোন ভাগাভাগি নেই। এ বিষয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর স্পষ্ট ঘোষণা হ’ল كُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ وَكُلَّ ضَلاَلَةٍ فِى النَّارِ ‘প্রত্যেক বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা এবং প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণাম জাহান্নাম’।[17] আর এই বিদ‘আত হ’ল শারঈ বিদ‘আত, আভিধানিক বিদ‘আত নয়।
চারটি উপদেশ :
এক্ষণে উপরোক্ত হাদীছে বর্ণিত চারটি বিদায়ী উপদেশ হ’ল :
(১) সর্বাবস্থায় আল্লাহভীতি বজায় রাখা (২) আমীরের আদেশ শ্রবণ করা ও মান্য করা (৩) রাসূল (ছাঃ) ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত হাতে-দাঁতে কামড়ে ধরা এবং (৪) ধর্মের নামে সৃষ্ট সকল প্রকার বিদ‘আত হ’তে বিরত থাকা। আল্লাহ আমাদেরকে উক্ত হাদীছের উপর যথাযথভাবে আমল করার তাওফীক দান করুন- আমীন!
মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
[1]. আহমাদ হা/১৭১৮৫, আবুদাঊদ হা/৪৬০৭, দারেমী হা/৯৫, তিরমিযী হা/২৬৭৬, ইবনু মাজাহ হা/৪২; মিশকাত হা/১৬৫ ‘কিতাব ও সুন্নাহ্কে অাঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ; সনদ ছহীহ।
[2]. মায়েদাহ ৫/৮৩, তওবাহ ৯/৯২।
[3]. বুখারী হা/৫১৪৬, মুসলিম হা/৮৬৯; মিশকাত হা/৪৭৮৩ ‘শিষ্টাচার সমূহ’ অধ্যায়।
[4]. আহমাদ হ/১১৭৯১, ছহীহাহ হা/৫৫৫।
[5]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৩৬৬৫।
[6]. হাকেম; ছহীহুল জামে‘ হা/২৭৫৭, সনদ ছহীহ।
[7]. মুসলিম, মিশকাত হা/৩৬৭৩ ‘নেতৃত্ব ও বিচার’ অধ্যায়।
[8]. মুসলিম, মিশকাত হা/৩৬৬২ ‘নেতৃত্ব ও বিচার’ অধ্যায়।
[9]. আবুদাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/১২৯৮; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১২৯৫ ‘রামাযান মাসে রাত্রি জাগরণ’ অনুচ্ছেদ।
[10]. বুখারী হা/২০১০ ‘তারাবীহ’ অনুচ্ছেদ; মিশকাত হা/১৩০১ ‘রামাযান মাসে রাত্রি জাগরণ’ অনুচ্ছেদ।
[11]. বুখারী হা/৪৯৮৬; মিশকাত হা/২২২০ ‘কুরআনের ফযীলত সমূহ’ অধ্যায় ২ অনুচ্ছেদ।
[12]. বুখারী হা/৪৯৮৭; মিশকাত হা/২২২১।
[13]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/৪৯৪৩, সনদ হাসান; মিশকাত হা/৫৩৯৫ ‘ফিৎনা সমূহ’ অধ্যায়।
[14]. বুখারী, মুসলিম, আবুদাঊদ হা/৪২৭৯; মিশকাত হা/৫৯৭৪ ‘মানাক্বিব’ অধ্যায়।
[15]. ত্বাবারাণী কাবীর হা/১০২৪০; ছহীহুল জামে‘ হা/২২৩৪, ছহীহাহ হা/৪৯৪।
[16]. বুখারী হা/২০১০ ‘তারাবীহ’ অনুচ্ছেদ; মিশকাত হা/১৩০১ ‘রামাযান মাসে রাত্রি জাগরণ’ অনুচ্ছেদ।
[17]. নাসাঈ হা/১৫৭৯।