মুক্তবাসিনী

জীবন্ত দাফনের আধুনিক রূপ

এক.

আজ থেকে বহুদিন হয়ে গেল ঘটনাটার বয়স। প্রায় তিন যুগ। বিস্মিত ইতিহাসটা স্মরণ করতে হলো এই বইটা লিখতে গিয়ে। বেলকুচি থানার বওড়া গ্রামের যে ঘটনাটি তৎসময়ে বিপুল আলোচিত বিষয় ছিল, মানুষ যে ঘটনাটিকে দেখত নির্মমতার করুণ ইতিহাস হিসেবে, আজ তা আমার সামনে ধরা পড়ছে ভিন্ন এক দৃষ্টিতে।

বেপর্দা, প্রেম আর পরকীয়ার কথাটা কিন্তু খুব বেশি শোনা যেত না এই তিন বা চার দশক আগেও। শুনেছি, আমাদের মায়েরা, চাচিরা বাবার বাড়িতে নাইওর করতে যেতেন রাতে, পর্দাঘেরা পালকিতে বসে। পর্দার বাইরে তো প্রশ্নই আসে না। পর্দা করার পরও দিনের আলোকে তারা পর্দার জন্য অনুকূল মনে করতেন না। তাই তারা রাতকে বেছে নিতেন কোথাও যাওয়ার সময় হিসেবে। পর্দার ব্যাপারে এতো কঠোর ছিলেন বলেই তারা অনেক বেশি নিরাপদ থেকেছেন। নিজেদের সম্ভ্রম রক্ষা করে চলে যেতে পেরেছেন। অবশ্য সে সময়ের কঠোর পর্দার মধ্যেও দুয়েকজন যে এদিক সেদিক করেন নি, তা নয়। কিন্তু আল্লাহর বিধান যেহেতু সর্বকালের সব মানুষের জন্য পালনীয়, তেমনিভাবে তা লঙ্ঘন করার শাস্তিও সবার জন্য প্রযোজ্য। তাই যারা ত্রুটি করেছেন, লাঞ্ছনার সম্মুখীন হয়েছেন। হয়েছেন করুণ পরিণতির শিকার। সে রকম একটা ঘটনা দেখুন :

সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি থানা। এই থানাতেই সংঘটিত হয়েছিল ভয়াবহ সেই নৃশংস ঘটনা। সে আজ থেকে বহু বছর আগে। আমরা তা শুনেছি আমাদের মা-বাবা ও মুরুব্বীগণের কাছে। এক নরপশুর অবৈধ লালসার শিকার হয়ে এক নারীকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল জাহেলিয়াতের গা কাঁটা দিয়ে ওঠা নির্মমতায়। জাহেলী যুগে কন্যা সন্তানকে খারাপ চোখে দেখা হতো। বিয়ের সময় তাকে খরচ করে বিদায় করতে হবে, মানুষ তাকে কন্যার পিতা বলবে, কত লজ্জার কথা! এসব দুষ্টু চিন্তা কন্যার পিতাদেরকে পশুতে পরিণত করত। তাই কন্যাসন্তান হলে তাকে ছয় বছর পর্যন্ত লালনপালন করে একদিন কন্যার মাকে বলা হতো, সাজিয়ে দাও, ওকে চাচার বাড়ি বেড়াতে নিয়ে যাবো।

আরব মায়েদের কাছে এ ছিল এক চরমপত্র। মাতৃত্বের বিরুদ্ধে এক অলঙ্ঘনীয় নিষ্ঠুর নির্দেশনামা। জন্মদাত্রী মা জানতেন তার কলজেছেঁড়া ধনকে আসলে কোন্ চাচার বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু চোখের পানি ছাড়া ওই মায়ের করার বেশি কিছু থাকত না। উচ্ছ্বল বালিকাকে সাজিয়ে দিয়ে করুণাময়ী মা ঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে মেয়ের চিরপ্রস্থানের দিকে অশ্রুপূর্ণ চোখে তাকিয়ে থাকতেন। মাতৃত্বের হৃদয়মুকুরে তখন বইত বেদনার উত্তাল ঝড়।

কান্নায় বুক ভাসিয়ে মা যখন শিশুর মতো ফুফিয়ে কাঁদতেন, তখন কন্যার ভাগ্য যুক্ত হতো ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নির্মমতা। আগে থেকেই খোঁড়া গর্তের কাছে মেয়েকে নিয়ে পাষাণ পিতা বলত, আম্মু! দেখতো, এখানে কী আছে? কোমল, উচ্ছ্বল, অবুঝ মেয়েটি যেই নিচের দিকে তাকাতো, তখনই পিতা তাকে ধাক্কা দিয়ে গর্তের মধ্যে ফেলে দিত। তারপর জীবন্ত কন্যাটিকে নিজ হাতে মাটি দিয়ে ঢেকে দিত।

কত শিশু তার বাবার মন গলানোর জন্য কত অনুনয়-বিনয় করেছে? বলেছে, বাবা! আমাকে ছেড়ে দাও, আমি তোমার বোঝা হবো না, দূরে কোথাও চলে যাবো! কোনও বেদুইন পল্লীতে চলে যাবো চিরদিনের জন্য। তোমার মর্যাদায় যেন আঘাত না লাগে, সেজন্য তোমার কন্যা পরিচয় দেব না কখনও! কিন্তু তবু গলত না পিতার নিষ্ঠুর হৃদয়। গর্তসমান মাটি ভরাট করে বিজয়ের হাসি হেসে তবেই ফিরে আসত আপন গৃহে।

সে এক অব্যক্ত ইতিহাস। কোনও কবি, সাহিত্যিক কিংবা ভাষার শিল্পী বা যাদুকর কি সেখানে কখনও উপস্থিত থেকেছেন? পৃথিবীর সব কলমশক্তি দিয়েও কি তিনি পারবেন সে সময়ের একটি অবুঝ শিশুর নিষ্পাপ হৃদয়ে বেদনার যে ঝড় উঠত, তার পরিমাপ করতে ?

দুই.

হ্যাঁ, রহমাতুল আলামীন তা পেরেছিলেন। জনৈক ব্যক্তি এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা শোনালেন। হে আল্লাহর নবী! তিনি বলা শুরু করলেন- আল্লাহ কি আমাকে ক্ষমা করবেন? আমার ছয় বছরের একটি কন্যাশিশু ছিল। আমি একদিন তার মাকে বললাম, মেয়েটিকে সাজিয়ে দাও; একটু বেড়িয়ে নিয়ে আসি। আমার স্ত্রী বোঝে নি আমি কী সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাই মেয়েকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিল সে। অবুঝ মেয়েটির সে কী আনন্দ! বারবার আমার দিকে তাকায়। হইহুল্লোড় করে। আব্বা আব্বা বলে উচ্ছ্বাসের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে।

কিছু দূর যাওয়ার পর রাস্তায় একটা কূপ পড়ল। আমি আর সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলাম না। মেয়েটিকে বললাম, মা! দেখেতো ওতে কী দেখা যায়? মেয়েটি পরম উল্লাসে কূপের দিকে তাকালো। আমি তার ছোট্ট দেহটি দু’হাতে তুলে নিলাম। নরম হাড্ডির তুলতুলে দেহটাকে ছুঁড়ে মারলাম কূপের মধ্যে। মেয়েটি আমার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকালো। কচি শিশুটি বিশ্বাস করতে পারছে না যে, আমি তাকে ইচ্ছাকৃতভাবে কূপে ফেলে দিয়েছি। তাই সে করুণাভরে পিতার কাছে সাহায্য চাইল। আব্বু, আমি ভয় পাই, আমাকে এখন থেকে তুলে নাও তাড়াতাড়ি! আমার তো ভয় করছে! এসব কথা বলল। কিন্তু মেয়ের নিষ্পাপ আকুতি আমি কানে ওঠার সুযোগ দিলাম না। তার আকুতিকে আড়াল করে দিলাম মাটিচাপা দিয়ে। বাবার হাতে অবুঝ মেয়ের মৃত্যু নিশ্চিত করে তবেই বাড়িতে ফিরে এলাম।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি সাল্লাম ঘটনা শুনে খুব করে কাঁদলেন। অন্য সাহাবীরা আফসোস করে বললেন, হায়! তুমি কেন আল্লাহর নবীকে এমন মর্মান্তিক ঘটনা শুনিয়ে কষ্ট দিতে গেলে!

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আবার শোনাও দেখি তোমার ঘটনা! তিনি আবার শোনালেন। এবার করুণার নবীর দয়ার সমুদ্রে তুফান উঠল। শিশুর মতো কেঁদে বুক ভাসালেন। কাঁদলেন উপস্থিত সবাই। কাঁদলেন শিশুটির বাবাও।

ইসলাম এসব করুণ কাহিনীর উপাখ্যান চিরতরে মিটিয়ে দিয়েছে। আর কোনও দিন যেন কোনও কারণে এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনার অবতারণা না হয়, তার সুষ্ঠ ব্যবস্থা করেছে। বিখ্যাত কবি ফারাযদাকের দাদা মুছআসাহ ইবন নাজিয়া মুজাশিফী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! জাহেলী যুগে আমরা যে ভালো কাজ করেছি, তার কোনও বিনিময় কি পাবো না? যেমন, আমি জাহেলী যুগে ৩৬০টি শিশুকন্যাকে জীবন্ত দাফনের হাত থেকে বাঁচিয়েছি। প্রতিটি শিশুকে ছাড়াতে আমাকে দিতে হয়েছে দুটি করে দামি উট। মোট ৭২০টি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি ইসলামের ছায়া পেয়েছো এই নেক আমল ও সুসভ্যতার কারণেই!

তো ইসলাম যেমন সভ্যতা রক্ষার ফসল, তেমনি ইসলাম রক্ষাই করে সভ্যতা। আর একারণেই হয়ত কোনও বিধান এমন, যা বাহ্যিক দৃষ্টিতে কঠিন বলে মনে হয়। কিন্তু প্রকৃত অর্থে তা মানবতার মুক্তির রক্ষাকবচ। সেই বিধান পালন না করলে, ইসলামের আদর্শ লঙ্ঘন করলে, কিভাবে ফিরে ফিরে আসে জাহেলিয়াতের অসভ্যতা, বর্বরতা তা নিচের ঘটনাটি পড়ে অনুমান করার চেষ্টা করুন :

তিন.

বহু দিন পর ফিরে এলো সেই মর্মান্তিক ইতিহাস। যে ইতিহাসটি রচিত হয়েছিল একটিমাত্র পাপের কারণে। শরীয়তের একটি বিধান লঙ্ঘন ও বেপর্দার নাফরমানীর কারণে।

বর্তমানে দৌলতপুর ইউনিয়নের এক ওয়ার্ডের মেম্বার ময়নু (ছদ্মনাম)। দাপট বেজায়। সন্ত্রাস, লুণ্ঠন, লুটপাট, স্কুল-মসজিদে দেয়া দানের টাকা মেরে দেয়া, রাস্তা, পুল নির্মাণের টাকা আত্মসাৎ করাসহ সব ধরনের অপরাধ জগতে তার নির্বিঘ্ন বিচরণ। পৌঢ় বয়সে যার এত কীর্তি (?) যৌবনে সে বসে থাকার লোক ছিল না। তাই সে তার যৌবনকালে একটি মেয়ের চূড়ান্ত সর্বনাশ ঘটিয়েছিল। আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন করে করেছিল ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।

কামালুদ্দিনের (ছদ্মনাম) সহজ-সরল মেয়ের সরলতার সুযোগ নিল ময়নু। তামিমা (ছদ্মনাম) নামের মেয়েটি প্রয়োজনের তুলনায় বেশিই সরল। অবশ্য সে সময়ের মেয়েরা এমনই ছিলেন। যুগের কালো ধোঁয়া তাদের সরলতার শুভ্রতায় দাগ ফেলত কম। কিন্তু এই সরলতার সঙ্গে যতটুকু দ্বীনি সচেতনতা প্রয়োজন, তাতে ঘাটতি ছিল যথেষ্ট, তা বলতেই হবে। তাই কৌশলে ময়নু তার ওপর যৌবনের লাম্পট্য চর্চা করল। মেয়েটিকে ফুসলিয়ে নিয়ে এলো অন্ধকার জগতে। বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে তার সম্ভ্রম কেড়ে নিল। মৌমাছি ফুল থেকে মধুটুকু চুষে নিয়ে যেভাবে আপন পথে কেটে পড়ে, তেমনি সেও তা-ই করল।

কিন্তু পাপের উপসংহার সহজে হয়? তাই চলে গেলেও সে তামিমার গর্ভে রেখে গেল অশুভ নাপাক ঔরস, যার গ্লানি বইতে হবে এখন সরল তামিমাকে, তার গরীব অসহায় মা বাবাকে!

বাবা ছিলেন নেহায়েত নির্দয় মানুষ। তিনি জানতেন না এসব কাহিনী। বিয়ে ঠিক করলেন মেয়ের। বিয়ের দিন খুব কাছে গড়ালে তিনি শুনতে পেলেন সেই পাপের কাহিনী। বিচারের প্রার্থনা করবেন সেই সামর্থ নেই। কারণ, লম্পট লোকটির বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করার মতো শক্ত ভিত নেই তার। যুগে যুগে একশ্রেণীর মানুষ এমন অসহায় ও লম্পটদের লালসার শিকার হয়েই এসেছে। কে তাদের সঙ্গে ইনসাফ করবে? তাদের বিচারের প্রার্থনা কে আমলে নেবে? তাদের একমাত্র সহায় আল্লাহ ও আল্লাহর বিধান। কিন্তু সেই একমাত্র সম্বলটাও যখন কাজে লাগানো হয় না, তখন তাদের দুঃখ অবধারিত হয়ে যায়।

যাহোক, বিয়ের ঠিক আগ মুহূর্তে দুর্ঘটনার কথাটা শুনে মাথায় বাজ পড়ে তামিমার বাবার। কী করবেন এখন- তা ভেবে পান না তিনি। অবৈধ ঔরস ধারণ করা একটা মেয়েকে অন্যের হাতে তুলে দিলে যে শেষে পস্তাতে হবে! তাই অতি আশাবাদী হলেন তিনি। ময়নুর অভিভাবকদের কাছে গেলেন মেয়ের একটা বিহিত করতে। বিহিত আর কী! যার দ্বারা সম্ভ্রম খুইয়েছে, তার ঘাড়েই কন্যার দায় তুলে দেয়া। পৃথিবীতে পিতার তরে দুটি বোঝা সবচে ভারী। এক. পিতার ঘাড়ে সন্তানের লাশ। দুই. কন্যার গর্ভের বৈধতার জন্য লম্পটের দ্বারস্থ হওয়া। কামাল এক্ষেত্রে দ্বিতীয় বোঝাটা উঠাতে গেলেন। প্রস্তাবটা ঠিকমতো তুলতেও পারলেন না তিনি। ময়নুর পরিবারের লোকজন তাকে নিদারুণ অপমান করে ঘর থেকে বের করে দিল। ক্রোধ, ক্ষোভ আর ঘৃণা থেকে সৃষ্ট একটি নির্মম সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি বাড়ি ফিরলেন।

বিয়ের প্রস্তুতি চলছে। কয়েকদিন মাত্র বাকি। সকলের মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনা কাজ করলেও থমকে আছে কামালুদ্দিনের সব আয়োজন। এরই মধ্যে বিয়ের আগের দিন সন্ধ্যায় তিনি মেয়েকে ডেকে বললেন, চল মা, তোকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাই। একজন ডাক্তারের নাম ধরে কথাটা বললেন তিনি।

মেয়ে বাবার কথা শুনে চমকে গেল। এই সময় এতো দূরের ডাক্তারের কাছে যাওয়া! অথচ আগামীকাল বিয়ে! মেয়েটি সরল-সোজা হলেও বাবার কথাও তার বিশ্বাস হতে চাচ্ছিল না। কিন্তু বাবার সঙ্গে ফুফুও আছেন। তিনিও বারবার তাগিদ করছেন প্রস্তুত হয়ে নিতে। অগত্যা ডাক্তার বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগল তামিমা। বিদায় বেলায় মা চৌকাঠে দাঁড়িয়ে মেয়েকে ঠিক সেভাবে বিদায় জানালেন, যেভাবে ছয় বছরের কন্যাকে বিদায় জানাতো জাহেলিয়াতের আরব মায়েরা।

কিন্তু পার্থক্য হলো তামিমার মা কোনোরকম অশ্রু বিয়োগ করলেন না। হাসিমুখেই বিদায় জানালেন মেয়েকে। মায়ের এই অশ্রুহীন আঁখি তামিমাকে আশ্বস্ত করল। চিকিৎসা শেষে ফের আপন জায়গায় ফিরে আসার প্রত্যাশা নিয়ে বাবা ও ফুফুর সঙ্গে পথে নামল সে।

এখন থেকে প্রায় তিন যুগ আগের ঘটনা। সে সময়ের পল্লীগুলোকে নিভৃত পল্লীই বলতে হয়। বহু দূরে দূরে একটি করে বাড়ি। যেখানে সন্ধ্যাতেই রাত নামে। সূর্যাস্তের কিছুক্ষণের মধ্যে পল্লী গাঁয়ের খেটে খাওয়া মানুষেরা ক্লান্তিতে আশ্রয় নেয় ঘুমের কোলে।

পল্লী গায়ের এমনি নিস্তব্ধতা ভেদ করে এগিয়ে চলছে তিনটি মানুষ। প্রকৃতির নিস্তব্ধতা, পিতার নীরবতা আর ফুফুর ফিসফিসানি তামিমাকে এক অজানা আতংকে ফেলে দিল। বাবা তাকে একটা কথাও বলছেন না। কিছু জিজ্ঞেস করলেও হ্যাঁ না-র মধ্যে উত্তর সীমাবদ্ধ। ফুফু কিছুক্ষণ পর-পর বাবার সঙ্গে কী যেন ফিসফিস করে বলেন। বোঝা যায় না কিছু, কিন্তু অস্বাভাবিক কিছু যে হতে যাচ্ছে, তা বুঝতে তামিমার সরলতাটা প্রতিবন্ধক নয়।

তার শংকা আতংকে পরিণত হলো যখন ডাক্তার বাড়ির পথ ছেড়ে তারা অন্য পথ ধরলেন তার বাবা। ফুফুকে জিজ্ঞেস করে কোনও সদুত্তর পাওয়া গেল না। বাবাকে জিজ্ঞেস করে খেল বকা। অসহায় নিরুপায় হয়ে তাই বাবা ও ফুফুর অনুসরণ করতে হলো তাকে।

বহুদূর চলার পর থামলেন তামিমার বাবা ও ফুফু। হুড়োসাগর নদীর পাড়ে। নদীটা বেশ পরিচিত। এক সময়ে প্রমত্তা নদী ছিল। কালের অনেক কিছুরই সাক্ষী এই নদীটা। কিন্তু বিস্মৃত অতীতের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া এসব ঘটনায় তার মনোযোগ নেই। সে এখন সাক্ষী হতে যাচ্ছে দেড় হাজার বছর আগের জাহেলিয়াতের একটি ঘটনা অবতারণার।

নদীর ধারে কাশবন। জোসনার আলো দু’ টুকরো হয়ে অর্ধেক নদীর পানিতে এবং অর্ধেক কাশবনের সাদা ফুলের ওপর পড়েছে। নদীর কুলকুল করে বয়ে যাওয়া পানি আর বাতাসের ধাক্কায় কাশবনের দোল খাওয়ার দৃশ্য অন্য সময় হলে সরল তামিমার মনেও হয়ত প্রকৃতির প্রতি একটা শ্রদ্ধা জাগিয়ে দিত। কিন্তু আজ এ অবস্থায় তার এসবে কোনও মনোযোগ নেই। তাকে গ্রাস করে রেখেছে এক অজানা আতংক। একপর্যায়ে তাকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে রেখে বাবা ও ফুফু যেন কী কথা সেরে নিলেন। এরপর বাড়ি থেকে নিয়ে আসা ব্যাগটা থেকে বাবা যে জিনিসটা বের করলেন, তাতে জোসনার কড়া আলো পড়ে একটা হালকা ঝিলিক দিয়ে গেল। সরল তামিমার মনটা তখন শংকায় কাঁপতে শুরু করেছে।

এর কিছুক্ষণ পরই সব শংকা আর আতংক জোসনার আলোর মতোই সত্য হয়ে ধরা পড়ল তামিমার দৃষ্টিতে। বাবা তাকে চুলের মুঠি ধরে কাশবনের মধ্যে টেনে নিতে শুরু করলেন। পেছন থেকে ধাক্কালেন ফুফু। নারীমনের সকল দুর্বলতা আর আতংক গ্রাস করে নিল তামিমাকে। বাঁচাও বাঁচাও বলে সে ভয়ার্তকণ্ঠে চিৎকার করতে লাগল। কিন্তু তার চিৎকার ধ্বনি নদীর পাড়ে লেগে একটা প্রতিধ্বনি হয়ে তারই কাছে ফিরে এলো। একজন পিতা যখন কোনও সন্তানকে হত্যা করতে উদ্যত হয়, তখন ওই সন্তানের বাঁচার আর্তনাদ আর কার কানেই বা পড়বে! তাছাড়া নিষ্ঠুর পিতা কন্যাহত্যার জন্য এমন এক স্থান বেছে নিয়েছিলেন, যা ছিল রাতের প্রকৃতিতে মানুষের দৃষ্টিসীমার অনেক বাইরে।

কোনও মনুষ্যসন্তান যখন তামিমাকে বাঁচাতে এগিয়ে এলো না, তখন বাঁচার তাগিদে সে পিতার স্নেহদৃষ্টি আকর্ষণ করল। প্রথমে বাবার কাছে আরজি জানিয়ে বলল, বাবা! আমাকে এবারের মতো ছেড়ে দাও। এই এখান থেকেই চিরদিনের জন্য অজানার পথে নেমে পড়বো। কোনোদিন আর তোমার দুয়ারে হাজির হবো না। তোমাকে আর বাবা বলে বিরক্ত করব না। মেরেই ফেলতে চাচ্ছো যখন, তখন জীবনটা না হয় ভিক্ষাই দাও, বাবা! এই দেখো, তোমার পা ছুঁয়ে শপথ করছি, সত্যি কোনোদিন আর বাড়িতে ফিরে আসব না…।

ইনিয়ে-বিনিয়ে বহু কথা বলল তামিমা। বাবার মন নরম করে জীবন বাঁচানোর জন্য সম্ভাব্য সব কৌশল অবলম্বন করল। কিন্তু নিষ্ঠুর বাবার মন গলানো গেল না। তখন সে প্রতিবাদী হয়ে উঠল। ধস্তাধস্তি হলো বাবা ও ফুফুর সঙ্গ। যুবতী বয়সী একজন নারীর শক্তিতো একেবারে ফেলবার নয়, কিন্তু হত্যাপ্রচেষ্টায় উদ্যত দানব পিতা আর তার সহযোগী ফুফুর শক্তিকে কুলিয়ে উঠতে পারল না সে। তারা দুইজন তাকে ধস্তাধস্তি করে কাশবনের একেবারে ভেতরে নিয়ে গেলেন।

এবার শুরু হলো আরেক লড়াই। তাকে মাটিতে ফেলে জবাই করা হবে। এখানেও অনেকক্ষণ লড়ল তামিমা। অনেক স্থান জুড়ে ভেঙে গেল কাশবন। তবে শেষ পর্যন্ত এখানেও পরাজিত হলো সে। পিতার হাতের উদ্যত ধারালো ছুরি তার গলা স্পর্শ করল। মৃত্যু নিশ্চিত বুঝতে বাকি থাকল না তামিমার। বাবা আর ফুফুর সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে গলা শুকিয়ে গিয়েছিল আগেই। তাছাড়া মৃত্যুর সময়টাতে মানুষ এমনিতেই পিপাসার্ত হয়। তাই শেষবারের মতো পানি চাইল তামিমা।

তামিমা ভুলে গিয়েছিল, যে লোক দুটোর কাছে সে পানি চাচ্ছে, তারা এখন তার বাবা আর ফুফু নয়। তারা জল্লাদ! আর জল্লাদের কাজ তো মৃত্যুপথ যাত্রীকে পানি দেয়া নয়, দ্রুত জীবনলীলা সাঙ্গ করা। তাই তামিমার শেষ ইচ্ছা পূরণ হলো না। নীরব নিস্তব্ধ প্রকৃতির সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেল তার পানি চাওয়ার আহবান। পানি দাও পানি!

এলাকার মানুষের ভাষ্য, বহুদিন পর্যন্ত নদীর এই পাড়টায় মানুষ একাকী হলেই এই আওয়াজটা শুনতে পেতো। পানি দাও পানি! কী জানি, হয়ত তামিমার বিদেহী আত্মার সমবেদনা জানাতেই সেদিনের প্রকৃতি তামিমা হয়ে গিয়েছিল। তাই বহুদিন পর্যন্ত সমবেদনা ফিরে ফিরে এসেছে প্রকৃতির মুখে মুখে- পানি দাও, পানি!

কয়েকদিন আগে আমার আব্বা এসেছিলেন ঢাকায়। তার কাছে পুনরায় ঘটনাটার আদ্যোপান্ত জেনে নিলাম। আমার জিজ্ঞাসায় তিনি প্রথমে হকচকিয়ে গেলেন। এতদিন আগের নির্মম একটা ঘটনা স্মৃতির সরলরেখায় ফিরে আসায় একটা দীর্ঘশ্বাস নিলেন। করুণকণ্ঠে শোনালেন সেই ঘটনাটা। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, তামিমাকে কি কবর দেয়া হয় নি? তিনি বললেন, কয়েকদিন পর্যন্ত শেয়াল-কুকুরের আহার ছিল সে। এরপর স্থানীয় লোকজন সদয় হয়ে তার দেহের অবশিষ্টাংশ মাটি চাপা দিয়ে রাখে।

কথাটা শুনে মনটা আরও বিষন্ন হলো। তাহলে তামিমার কপালে কি জাহেলী যুগের শিশুকন্যাদের মর্যাদাটুকুও জোটেনি? কবরস্থ হওয়ার মর্যাদা? তামিমার জন্য আমার নিদারুণ কষ্ট হয়, তার জন্য সমবেদনা জ্ঞাপন করি। কিন্তু বারবার এই প্রশ্ন মনে দোলা খায়, এই যে নির্মম হত্যাকাণ্ড, পিতাকর্তৃক কন্যা নিহত হওয়ার মতো নির্মম ঘটনা; কেন ঘটে এসব? শুধু জাগতিক দৃষ্টিতে বিচার করলে কি এসব সমস্যার সমাধান হবে? নাকি আমাদেরকে বের করতে হবে সমস্যার মূল কারণটা?

পাঠক! আমি হলফ করে বলতে পারি, সরল তামিমা যদি পর্দায় নিজেকে আবৃত করত, বিবাহবহির্ভূত অবৈধ সম্পর্ককে প্রশ্রয় না দিতো, তাহলে তাকে এই নিদারুণ পরিণতির শিকার হতে হতো না। আল্লাহর বিধান রক্ষা করার মর্যাদা তাকে রক্ষা করতো যিল্লতী ও জীবননাশ থেকে।

– আবু বকর সিরাজী

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

৪টি মন্তব্য

  1. “পাঠক! আমি হলফ করে বলতে পারি, সরল তামিমা যদি পর্দায় নিজেকে আবৃত করত, বিবাহবহির্ভূত অবৈধ সম্পর্ককে প্রশ্রয় না দিতো, তাহলে তাকে এই নিদারুণ পরিণতির শিকার হতে হতো না। আল্লাহর বিধান রক্ষা করার মর্যাদা তাকে রক্ষা করতো যিল্লতী ও জীবননাশ থেকে।”

    লিখাটি পড়ার পর আপনাদে ধন্যবাদ জানাই।
    তবে শেষ দুইটি লাইন আমি ভাল করে পড়লাম।
    আপনি তো শেষ পর্জন্ত সেই অসভ্য লোকটির দোষ এড়িয়ে গেলেন, বরং দোষ চাপালেন সেই অবলা নারীর উপরেই।

মন্তব্য করুন

Back to top button