মুক্তবাসিনী

এলোমেলো পরিচয়

مَنْ وَقَعَ عَلَى ذَاتِ مَحْرَمٍ فَاقْتُلُوْهُ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- যে ব্যক্তি তার মাহরামের সঙ্গে পাপে (ব্যভিচারে) লিপ্ত হয় তাকে হত্যা করো। [মুস্তাদরাক হাকেম : ৮০৫৪][1]

عَنِ الْبَرَاءِ قَالَ : اِنَّ خَالَهُ بَعَثَهُ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اِلَى رَجُلٍ عَرَّسَ بِاِمْرَأَةِ اَبِيْهِ اَنْ يَقْتُلَهُ وَيُخَمِّسَ مَالَهُ –

‘বারা ইবন ইবন আযেব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার চাচাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে হত্যা ও তার সম্পদ জব্দ করার নির্দেশ দেন এ কারণে যে, সে তার সৎ মা (মাহরাম নারী) এর সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়েছিল।’ [আবূ দাউদ : ৪৪৫৬]

اِلاَّ اِذَا كَانَ يُخَافُ عَلَيْهَا اَوْعَلَى نَفْسِهِ الشَّهْوَةَ فَلاَ يَنْظُرُ وَلاَ يَمْسُ … وَحُرْمَةُ الزِّنَا بِذَوَاتِ الْمُحَارِمِ اَغْلَظُ فَيَجْتَنِبُ –

‘তবে যদি পাপে পতিত হওয়ার আশঙ্কা করে, তাহলে নিজ মাহরাম তথা মা, বোন, ভাই প্রমুখের দিকে দৃষ্টিপাত করবে না এবং তাদের স্পর্শও করবে না। কেননা, পরনারীর সঙ্গে ব্যভিচার করার চেয়ে মাহরাম নারীর সঙ্গে ব্যভিচার করার অপরাধ অনেক বড়।’ [হেদায়া : ৪/৪৬২]

হাদীস ও ফিকহের ভাষাগুলো কেমন কঠিন মনে হয়! তাই না? ভাই বোনকে দেখতে পারবে না! চাচা ভাতিজীকে দেখতে পারবে না! নানা নাতনীকে দেখতে পারবে না! এ কেমন কথা? তথাকথিক নারী স্বাধীনতাবাদীদের কথা না হয় বাদই দিলাম। যারা রক্ষণশীল মুসলিম, তারাও সম্ভবত প্রথম চোটে হোঁচট খাবেন ইসলামী বিধানের এই কঠোরতা দেখে। ভড়কে যাবেন, চমকে উঠবেন। মুখ ফস্কে না বললেও হয়ত মনে উদয় হবে, ইসলামের বিধান এত কঠিন? এত শক্ত? নাহ্ আরা পারা গেল  না…।

কিন্তু কোনও শিশুর হাতে অস্ত্র দেখে তা তার কাছ থেকে কেড়ে নেয়াকে কেউ কি অভিভাবকের নিষ্ঠুরতা বলবেন? অভিভাবকের এই কঠোরতায় কার লাভ কার ক্ষতি? সামাজিক জীবনের এই সহজ অনুভূতিগুলো মাঝে-মধ্যে কাজ করে না বলে আমরা বিভ্রান্ত হই। অবিবেচকের মতো কথা বলি।

শরীয়তের বিধান হলো, নারী-পুরুষ মিলে একটি পরিচ্ছন্ন জীবন গঠন করবে। এতে থাকবে না ক্লেদ, অপবিত্রতা ও নোংরামী। সামাজিক এই ভারসাম্যতার জন্য যতটুকু কঠোরতা প্রয়োজন, ইসলাম তাতে কোনোরূপ ছাড় দেয় নি। তাই কখনও-কখনও আমাদের কাছে এধরনের কঠোরতা বাড়াবাড়ি পর্যায়ের মনে হয়। কিন্তু এর পেছনে যে যৌক্তিকতা আছে, নিরাপত্তা আছে, সে বিষয়টি আমাদের চিন্তায় আসে কম। একথা ঠিক যে, একজন মাহরাম তার মাহরামকে দেখতে পারবে না- এই বিধানটি বেশ কঠিনই। কিন্তু কখন এই বিধান? এই বিধান কিন্তু তখনই, যখন ওই মাহরামের মধ্যকর নিরাপত্তার দেয়ালটা ধসে যায়। পবিত্রতার বন্ধন ছিন্ন হয়ে মোড় নেয় কলঙ্কের দিকে। যে আশঙ্কার কারণে এধরনের কঠিন বিধান আরোপ করা হয়েছে, সেই আশঙ্কাটাই যথার্থ কিনা- তা নিয়েও প্রশ্ন করেন অনেকে। এই প্রশ্ন যারা করবেন তাদের জন্য তুলে দেয়া হলো নিচের ঘটনাটি :

গাজীপুর জেলার টঙ্গী থানার একটি গ্রাম। এখানে বহুপ্রাচীন একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও হাইস্কুল আছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা হয়েছে সেই বৃটিশ আমলে আর হাইস্কুল ১৯৬৭ইং সালে। এই স্কুলেরই অষ্টম শ্রেণীর এক ছাত্রী হয়েছে ভাষায় প্রকাশের অযোগ্য এক কলঙ্কের শিকার। যে বিধানের কথা শুনে আপনি থমকে গেলেন, ভড়কে গেলেন এবং কুরআন-হাদীসের বিধানকে কঠিন বলে মনে করলেন, সেই বিধানে ত্রুটি হওয়ার কারণেই রচিত হয়েছে এই কলঙ্কজনক অধ্যায়। ঘটনার শিকার মেয়েটিকে এ কারণে এমন এক স্মৃতি বয়ে বেড়াতে হবে সারা জীবন, যার ক্ষত কখনও শুকাবে না। মৃত্যুও মনে হয় তাকে এই শোক ভুলিয়ে দিতে পারবে না।

কনা (ছদ্মনাম) মেয়েটির স্বাস্থ্য ইদানিং বেশ বেড়ে গেছে। সবাই দেখে অবাক হয়। সখীরা খুনসুটি করে, কী লো তুই এতো মুটিয়ে যাচ্ছিস কেন? স্বাস্থ্য প্রত্যাশী ক্ষীণদেহী বান্ধবীরা বলে, তুই কোন্ দোকানের চাউলের ভাত খাস লো? আমাদেরকেও সে দোকানের চাউলের ভাত খেতে হবে যে!

সখী-বান্ধবীদের এসব হাসি-কৌতুকে হাসি মিলিয়ে যায় কনার। মুখটা হঠাৎই পানসে হয়ে যায়। প্রসঙ্গ পাল্টাতে মুখ কালো করে বলে- হু, ডাক্তার বলেছে আমার নাকি মেদ হয়েছে! কিন্তু কনা আসলে জানে এটা কিসের মেদ। পেটে কীসের মেদ এবং কীসের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে সে!

এভাবে চলতে চলতে এক সময় স্কুলই বন্ধ হয়ে গেল কনার। সখী-বান্ধবীরা কিছুদিন খোঁজ করার পর তার কথা ভুলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এই বিস্মৃতির মধ্যেই টনক নড়ল সবার। সখী কনার কথা এখন বান্ধবী, এলাকাবাসী এবং মহল্লার প্রতিটি মানুষের মুখে-মুখে। সে এখন কেবল সাধারণ একজন ছাত্রী নয়, আলোড়ন সৃষ্টিকারী এক ঘটনার জননীও বটে!

মাস্টার আব্দুল লতিফ সাহেবের গিন্নি চমকে উঠলেন। তার বাড়ির পাশেই কনাদের বাড়ি। কনার বাবা থাকে বিদেশে। বাড়িতে মা ও নানা। এছাড়া অন্য কোনও মানুষের অস্তিত্ব নেই। এ বাড়ি থেকে শিশু বাচ্চার কান্নার আওয়াজ তো আসার কথা নয়? তাও নতুন অতিথি শিশু! তিনি খেয়াল করলেন বেশ কিছুদিন ধরে কনাদের বাড়ির গেট সবসময় বন্ধ থাকে। ওদের বাড়ির কেউ সচরাচর বাইরে বের হয় না। আগে কনা মেয়েটি আসত, এখন সেও আসে না। অন্য কেউ তাদের বাড়িতে গেলে তারা অস্বস্তি প্রকাশ  করে। সপ্তাহখানেক হয় কে একজন মহিলা যেন ওদের বাড়িতে আস্তানা গেড়েছে! এ ব্যাপারটিও ভাবালো তাকে।

যাহোক, তিনি চমকে গেলেন। কৌতূহলী হলেন। কচি শিশুর কান্না তাকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলল। তিনি ঘর থেকে বের হয়ে কনাদের গেটের কাছে গেলেন। ইতিমধ্যে আরও অনেকেই এখানে সমবেত হয়েছে। সকলে মিলে কনাদের বাড়িতে প্রবেশ করলেন। ভেতরে গিয়ে যা দেখলেন, তাতে তাদের বেহুঁশ হওয়ার দশা। নবজাতক একটি শিশুকে বড় এক ড্রামের মধ্যে ফেলে রেখে ড্রামের মুখ বন্ধ করে রাখা হয়েছে! ভবের সদ্য আলো-বাতাস দেখা শিশুটি নিঃশ্বাস ফেলতে না পেরে করুণ কান্না করছে। প্রথমে তারা শিশুটিকে উদ্ধার করলেন। তারপর মনোনিবেশ করলেন ঘটনার রহস্য উন্মোচনের প্রতি। ঘটনা শুনে উপস্থিত নারীরা আকাশ থেকে পড়লেন। বাচ্চাটির মা ওই কনা, যে পেটে মেদ হয়েছে বলে বান্ধবীদের চোখে ধূলা দিয়েছিল!

এক পর্ব শেষ করে দ্বিতীয় পর্ব হিসেবে সন্তানের উৎস অনুসন্ধানের পালা। উৎস সম্পর্কে যা বলা হলো, তাতে বিশ্বাসের কান পাততে যে কোনও মানুষের ধাক্কা লাগা স্বাভাবিক। তবু বিশ্বাস করতে হলো। কেননা, কখনও-কখনও এমন সব ঘটনাও ঘটে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা না হলেও তা বিশ্বাস করতে হয়।

নানার ঔরস নিয়ে প্রেগন্যান্ট হয়েছিল কনা! একথা কারই বা বিশ্বাস হয় এবং কারই বা শুনতে ভালো লাগে? ভর্ৎসনা, ঘৃণা আর ধিক্কারের থুতু নিক্ষেপ করা শুরু করলেন উপস্থিত সবাই। এ নিয়ে কথা আর আগে বাড়াতে চাই না। তবে একটি কথা হলো; এই পরিবারের সবার পরিচয় এখন সম্পূর্ণ এলোমেলো। নাতনী হয়েছে সন্তানের মা। নানা হয়েছে সন্তানের বাবা। মেয়ে হয়েছে শাশুড়ী! কী জঘন্য চিত্র!

কনার মা বারবার বিলাপ করে বলছিলেন- হায়, আমার এ কী হলো! কনা আমাকে আগেই ইশারা-ইঙ্গিতে বুঝাতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি তা বুঝি নি। সে বলত- আম্মু, নানা আমার সঙ্গে কেমন কেমন যেন করে। আমি বলতাম, নানা তো নাতনীর সঙ্গে ইয়ার্কি-দুষ্টামি করবেই। নানার সঙ্গে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা বলা হলে কিংবা বাড়িতে যাওয়ার কথা বলা হলে কনা যেতে চাইত না এবং বলত, নানা আমার সঙ্গে দুষ্টামি করে। কিন্তু মায়ের মনে তখন দুষ্টামির বাইরে ভিন্ন কিছু ভাবার সুযোগ হয় নি। এ কারণে মেয়ের কথায় পাত্তা দিতেন না কনার মা। এর পরিণাম আজ সবার সামনে। আজ সংসার সমুদ্রে পালভাঙা, মাস্তুলহারা এক নৌকার নাবিক কনা এবং তার মা।

পাঠক! এবার বুঝে এসেছে তো, কেন মাহরাম পুরুষ, ভাই-বোনে, নানা-নাতনীতে সময় সময় পর্দা করতে হয়? বুঝে আসছে তো ‘মাহরামের সঙ্গে ব্যভিচারের অপরাধ অন্য নারীর সঙ্গে ব্যভিচারের অপরাধের চেয়ে জঘন্য’ কথাটার তাৎপর্য? বুঝে আসছে তো অন্য নারীর সঙ্গে ব্যভিচারের গ্লানি আর মাহরামের সঙ্গে ব্যভিচারের ধিক্কারের পার্থক্য? দেখলেন তো, মাহরামের সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হলে পরিচয়টা কতদিক থেকে এলোমেলো হয়ে যায়?

এবার আল্লাহর বিধানের সামনে নিঃশর্ত আনুগত্য প্রদর্শন করে বলুন- ইসলামের সব বিধান মনেপ্রাণে মেনে নাও তবে শান্তি।’

– আবু বকর সিরাজী


[1]. হাকেম এটিকে সহীহ বলেছেন। তবে অন্য অনেক মুহাদ্দিস হাদীসটির সনদ পর্যালোচনা করে এটিকে যঈফ বলেছেন। তবে দ্বিতীয় হাদীস থেকে আমরা এ হাদীসের বক্তব্যের সমর্থন পাই।

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button