অসময়ের করুণ প্রস্থান
‘যারা আমার চিঠি পড়বেন, তাদের কাছে আমার একটাই অনুরোধ, আমার মতো আর কারও জীবন যেন নষ্ট না হয়। এই সব বখাটে ছেলেদের কবলে যেন আমার মতো আর কারো শিকার হতে না হয়।’
হৃদয়বিদারক এই চিঠিতে এভাইে ফুটে উঠেছে আমাদের করুণ সমাজের রুগ্নদশা। আমরা দিন-দিন বর্বরতার কোন্ গহীন অরণ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, তা নির্দেশ করে ছোট্র এই চিঠিটি। যেসব ‘চিরকুটে’ প্রাণ হারানো, সম্ভ্রম হারানো, লাঞ্চিত হওয়ার দলিল রয়েছে, হাজারও নারী, কন্যা, জায়া জননীর সেসব চিরকুটের একটি হলো চৈতির এই চিঠিটি।
এটি এই সমাজের রুগ্নদশার ছোট্ট একটা উপমা। চিঠির অল্প কয়েকটি বাক্যই বিষ মাখানো ছুরির ফলা হয়ে বিদ্ধ হয় চিন্তাশীল মানুষের বুকে। কেন এই চিঠি লিখেছিলেন চৈতি? কী পরিণাম হয়েছিল তার? বিবরণ পাঠ করুন :
মাদারীপুর জেলার কালকিনি উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক শাহাদাত হোসেনের মেয়ে চৈতি আক্তার (১৭) কালকিনি উপজেলার সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজের মানবিক প্রথম বর্ষের ছাত্রী। মেধাবী ও বেশ দর্শনধারী। কিন্তু মাত্র সতের বছর বয়সে দুনিয়ার রূপ-রস আর সৌন্দর্য দেখার আগেই দুনিয়া তাকে সালাম বলেছে। হয়েছেন তিনি সামাজিক পাপ আর ইলাহী বিধান লঙ্ঘনের নির্মম শিকার।
তিনি তার শেষ ডায়েরিতে লিখেছেন- ‘আমার জীবনের মায়া ত্যাগ করলাম শুধু একটি ছেলের কারণে। তার নাম সাগর। একটি মেয়ের জীবনে যা অমূল্য ধন হিসেবে তোলা থাকে, তা আমার কাছ থেকে ওই ছেলেটি ছলেবলে কৌশলে আদায় করে নিয়েছে। এমনকি আমার বোনকে নষ্ট করার হুমকি দিয়েছে। তাই আমি ভাবলাম, আমার জীবন নষ্ট হয়েছে; কিন্তু আমার বোনের জীবন নষ্ট হতে দেব না। আমার এত কষ্ট, আমার এই কথাগুলো কাউকে বলে যেতে পারতাম না। পরে শেষে আমার বোন চাঁদনীর কাছে বলেছিলাম। আমার বাবা খুব রাগী, তাকে খুব সম্মান করি। তাই তার কাছে বলার সাহস করি নি। পরে চাঁদনী ছোট মামীর কাছে ব্যাপারটা জানায়। কিছুদিন আগে সাগর অতিরিক্ত ভয় দেখিয়ে উত্যক্ত করায় আমি না বলে পারি নি। একটা মেয়ে কখন তার জীবনের মায়া ত্যাগ করে? কিন্তু আমি যে বাঁচব, তার কোনও কূল ছিল না। আমি জানি, আত্মহত্যা মহাপাপ। তার পরেও আমাকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছে।’
পাঠক! এতক্ষণ পর্যন্ত তো আমিই ঘটনা বিশ্লেষণ করলাম। এবার এই দায়িত্বটা আপনি নিন। চিন্তা করুন আমাদের সামাজিক অবস্থার কথা। আজ পর্দা ভেদ করে সমাজ শুধু পাপের সাগরেই ডুবে যায় নি, নাযুকতার এমন এক পরিস্থিতির সামনে দাঁড়িয়েছে, যেখানে পাপিষ্ঠকে প্রতিরোধ করা যায় না। গোটা দুনিয়াটা যেন বাঘ-ভল্লুকদের অভয়ারণ্য। যারা নিরপরাধ থাকতে চায় তারা নিরস্ত্র শিকার। তাদের যে যেভাবে ইচ্ছা আক্রমণ করবে, ভোগ করবে এবং এক সময় বাসি হয়ে গেলে তাকে ত্যাগ করে আরেকজনের সর্বনাশ করবে। ওই বনের অলিখিত সংবিধান, কেউ বাধা দিতে পারবে না। বাধা দেয়ার পরিণাম ভালো হবে না।
কোথায় গেল সেই নববী আদর্শ, যেখানে প্রতিটি মুসলিম ছিল তার মুসলিম বোনের সম্ভ্রম রক্ষার অতন্দ্র প্রহরী? কোথায় তাদের উত্তরসূরী, যারা বিশ্বের কোথাও কোনও বিধর্মী শাসক কর্তৃক কোনও মুসলিম নারীর সম্ভ্রমে সামান্যতম আঁচড় কাটলে ঝাঁপিয়ে পড়ত সেই পাপীর ওপর? আমরা কি পারি না সেই সোনালী ধারা ফেরত আনতে? না পারলেও অন্তত তাদের অনুসরণ করতে? পারি না আমরা প্রত্যেকেই মুসলিম নারীর সম্ভ্রম রক্ষার জামিন হতে? আর মুসলিম বোনেরা কি পারি না নিজের সম্ভ্রমটাকে পর্দার দুর্গে নিরাপদ রাখতে? এ আমাদের পারতেই হবে। আমরা আর কত দেখব মা-বোনদের এমন নির্মম পরিণতি, করুণ আখ্যান? আমরা আর তা দেখতে চাই না। এ অতীত ভুলে ফিরে যেতে চাই আগের অতীতে।
– আবু বকর সিরাজী