মুক্তবাসিনী

ছাত্রীদের করুণ বিলাপ

পর্দাবিহীন মুক্তবাসের জীবন আমাদেরকে পরিণতির কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে, সে বিষয়ে কিঞ্চিত ধারণা দেয়ার জন্য আপনাদেরকে আমি নিয়ে যাচ্ছি বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তরে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনাক্ষেত্রে।

ঘটনা-১ : কুমিল্লার চান্দিনা এলাকার ঘটনা এটি। সংঘটিত হয়েছে ৭ এপ্রিল ২০১০ইং সালে। ছাত্রীর পিতার লিখিত অভিযোগে জানা যায়, চান্দিনা রেদোয়ান আহমদ কলেজের এক ছাত্রী কলেজে যাওয়া-আসার সময় মাহারৎ গ্রামের শাহ আলমের পুত্র সায়মন (২৫) প্রায়ই তাকে প্রেম প্রস্তাব দিত। কিন্তু ওই ছাত্রী তার আহ্বানে সাড়া দেয় নি। পরিবারের লোকজন তা জানতে পেরে শঙ্কিত হয়ে ওঠেন এবং তার লেখাপড়া বন্ধ করে দেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সন্ত্রাসীরা মোবাইলে তার ছবি তুলে পরে তা কম্পিউটারে নগ্নভাবে প্রকাশ করে বাজারজাত করে।

এটা হলো অভিযোগকারীর নিজস্ব অভিযোগ। কিন্তু গ্রেফতার হওয়ার পর পাওয়া যায় ভিন্ন তথ্য। সায়মন জানায়, প্রথমে তাকে উপেক্ষা করলেও পরে ওই ছাত্রী তার প্রেম প্রস্তাবে রাজি হয়। রাজি হওয়া থেকে ঘনিষ্ঠতা এবং ঘনিষ্ঠতার সুযোগে একজন নারীর সম্ভ্রম ক্ষয়। শুধু তাই নয়,  মোবাইলে সেই কুৎসিত দৃশ্য ভিডিও করে তা বাজারজাত করা। সায়মন জানায়, এ পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল। কিন্তু পরে তাকে বাদ দিয়ে অন্যজনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে গেলে সে ক্ষোভ, অভিমানে মোবাইল ও ভিডিও দোকানে সেসব দৃশ্য সরবরাহ করে। তবে ক্ষোভ থেকেই হোক আর যে কোনও কারণেই হোক এভাবে কিন্তু ওই ছাত্রীর জীবন ঠিকই বিষিয়ে উঠেছে। বস্তুত প্রেম ও বেপর্দা একজন নারীর জীবনকে এভাবে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।

ঘটনা-২ : এ ঘটনাটি ফরিদপুরের চরভাদ্রসনের আলমনগর এলাকার। ১৪ বছরের এক স্কুল ছাত্রীকে ধর্ষণ করে ধর্ষণের চিত্র ভিডিও করে তা বাজারে ছেড়েছে এক ধর্ষক। অবুঝ মেয়েটি ধর্ষণের বিভীষিকার মধ্য দিয়েই ঘটনা শেষ হবে মনে করেছিল। মনের দুখ মনে চাপা দিয়ে রেখে চৌদ্দ বছরের এই মেয়েটি নতুন করে জীবন শুরু করতে চেয়েছিল। কিন্তু এ সমাজের বাস্তবচিত্র সম্পর্কে তার ধারণা ছিল অসম্পূর্ণ। সে জানে না যে, ধর্ষকরা এখন অল্পতে তুষ্ট থাকার পাত্র নয়। ধর্ষণ করে সেই দৃশ্য অন্যকে না দেখালে এখন আর তাদের তৃপ্তি হয় না। তাই ধর্ষণ করে পরে সেই চিত্র তারা বাজারজাত করে মানসিক প্রশান্তি লাভ করে। এখানেও ঘটল তা-ই। মেয়েটি জানতেই পারেনি যে কী সর্বনাশ অপেক্ষা করছে তার জন্য। একদিন দর্জির দোকানে গিয়ে সে জানতে পারে, এখানকার একটি মেয়ের ধর্ষণের চিত্র বাজারের বেশ খানিকটা জায়গা দখল করে রেখেছে। এ ব্যাপারে সকলের আগ্রহ এখন তুঙ্গে!

বিদেশী নারীদের নগ্ন অভিসারদৃশ্য দেখে এখন দর্শকরাও ক্লান্ত। তারা চায় দেশী মেয়েদের এমন দৃশ্য! তাই বাজারে এ ধরনের কোনও দৃশ্য এলে তা মুহূর্তের মধ্যে বাজার দখল করে। মেয়েটি কিন্তু তখনও বুঝতে পারে নি আসল ঘটনা। পরে যখন জানতে পারে, তখন কী অবস্থা হয়েছিল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। পত্রিকার বিবরণ দেখুন :

১.  মেয়েটির বয়স ১৪ বছরের বেশি নয়।

২. প্রথমে মেয়েটির গলা চেপে ধরা হয়।

৩. ধর্ষণের পুরো সময়টিতে সে ডুঁকরে কেঁদেছে।

৪. অনেকজন তাকে ঘিরে রেখেছে এবং একজন ভিডিও করেছে।

৫. তার কান্নার মধ্যেই ধর্ষকরা তাকে ধর্ষণ করে উৎফুল্লতা প্রকাশ করে নারকীয় উল্লাস প্রকাশ করেছে।

পাঠক! আপনি চিন্তা করতে পারেন মানবতা, সভ্যতা আর নৈতিকতার কী পরিমাণ ধস নামলে এ ধরনের একটি ঘটনা সংঘটিত হতে পারে?

ঘটনা-৩ : টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার এক কিশোরীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। শুধু ধর্ষণ করে তো আর এ যুগের বাঁদররা থামতে নারাজ। তাই এর সঙ্গে ওই কিশোরীর যৎকিঞ্চিত আড়ালে থাকা সম্ভ্রমটুকুও নিলামে তুলেছে। ধর্ষণের ভিডিও ছবি ধারণ করে ধর্ষকরা তা বাজারে ছেড়ে দিয়েছে। সম্ভ্রম হারিয়ে মামলা করলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ওই নষ্ট বাঁদরদেরকে আটক করে নি। উল্টো ধর্ষিতার পরিবার সম্ভ্রম হারানোর পর এবার জীবন হারাতে রাজি নয় বলে সেখান থেকে পালিয়ে গেছে।

ঘটনার বিবরণে জানা যায়, মেয়েটি স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে হাবিবুল্লাহ ইতিহাস ওরফে হাবিব, আরিফ আহমেদ, বাবুল আজাদ তাকে জোরপূর্বক অপহরণ করে মোটর সাইকেলে সখীপুর হাজীপাড়ায় আলমগীর হোসেনের এক ছাত্রাবাসে নিয়ে যায়। পরে হাবিবুল্লাহ ইতিহাস তাকে ধর্ষণ করে। তার সহযোগীরা সেই ধর্ষণের চিত্র ভিডিও করে। তার কামনার আগুন নির্বাপিত হলে আরেক জানোয়ার মেয়েটির দিকে অশুভ হাত এগিয়ে দেয়। কিন্তু এই সুযোগে মেয়েটি কোনও মতে সেখান থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। তারা তাকে ধাওয়া করেও নাগালে পেতে ব্যর্থ হয়।

মেয়েটি সে সময় তাদের হাত থেকে ছাড়া পেলেও চূড়ান্ত অর্থে ছাড়া পায় নি। কেননা, সারা জীবন তাকে বয়ে বেড়াতে হবে কলঙ্কের দাগ। যে দাগের সাক্ষী হবে হাজারো মানুষ। মোবাইল কিংবা ভিডিও দোকানে ছেড়ে দিলে তো কথাই নেই। হয়ত তার মৃত্যুর পরেও বহুকাল পরজগতের বাসিন্দা হয়েও সে আত্মার চোখ দিয়ে দেখতে পাবে সম্ভ্রম হারানোর করুণ দৃশ্য, যে দৃশ্য দেখে লালায়িত দর্শক শয়তানী মুগ্ধতায় মুগ্ধ হবে! কামনা করবে তার বিদেহী দেহের অবৈধ সঙ্গ!

ঘটনা-৪ : গোপালগঞ্জ ইডেন কলেজের রসায়ন বিভাগের ৩য় বর্ষের ছাত্রী সাদিয়া নূর মিতা (২২)। মিয়াপাড়ার বাসিন্দা লিয়াকত হোসেনের কন্যা তিনি। মিতাও গলিত সমাজের এক নিষ্ঠুর পরিণামের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। এক করুণ গল্পের প্রয়াত নায়িকা।

কলেজ বন্ধ হওয়ার পর ‘আজ আমাদের ছুটি ও ভাই আজ আমাদের ছুটি’র আনন্দ নিয়ে বাড়ি এসেছেন। মা-বাবা, ভাই-বোনের সঙ্গে মিলেমিশে রোযা পালন করবেন, ঈদ করবেন এমনসব সুন্দর-সুন্দর ইচ্ছা তার। কিন্তু বখাটে আর সমাজের লম্পটেরা সত্য হতে দিল না তার সুন্দর ইচ্ছাগুলো। কামনার অগ্নিতে ছাই হয়ে গেল তার এই সুন্দর ও পবিত্র ইচ্ছাগুলো।

২৪ আগস্ট নিখোঁজ হলেন তিনি। সাহরী খাওয়ার সময় একজন যুবতী নারীর নিখোঁজ হওয়া কম উৎকণ্ঠার কথা নয়। পরিবারের সকলে মিলে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকলেন তাকে। সম্ভাব্য-অসম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজা হলো তাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল এমন  জায়গায় আর এমন অবস্থায়, যার কল্পনা করতে পারে না কোনও মা, কোনও বাবা, কোনও ভাই, কোনও বোন এমনকি কোনও দুশমনও। স্থানীয়রা মিয়াপাড়ায় হাসানুর রহমানের পুকুরপাড়ে তাকে পড়ে থাকতে দেখা যায় লাশ অবস্থায়, ধর্ষিতা অবস্থায়!

এ যেন মিতার লাশ নয়, গোটা বিশ্বের অধঃপতিত সমাজের মৃত অস্তিত্বের সাক্ষী তিনি।

ঘটনা-৫ : এটাও কলেজ ছাত্রীর সম্ভ্রমহানীর ঘটনা। তাও একেবারে দিনদুপুরের ঘটনা। কলেজের ক্যাম্পাসের মধ্যে!

কলি (ছদ্মনাম) খুব নিশ্চিন্তে হেঁটে যাচ্ছিলেন কলেজ ক্যাম্পাসের সামনে দিয়ে। ঢাকা পলিটিকনিক্যাল কলেজের ছাত্রী তিনি। একজন ছাত্রী কলেজ ক্যাম্পাসে নিরুদ্বিগ্ন থাকবেন, নিশ্চিন্তে বিচরণ করবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যে সমাজ আর সভ্যতার কোলে আমরা বসবাস করছি, সে সমাজ আর সভ্যতার যোগ-বিয়োগের ফলাফল ভিন্ন। এখানে দুইয়ে-দুইয়ে চার হয় না, বাইশ হয়! ফলে অনেক সময় অপ্রত্যাশিত সব হিসেব লিখিত হয় আমাদের হিসেবের খাতায়। কলির বেলায়ও তা-ই হলো। যে ক্যাম্পাসকে তিনি নিরাপদ মনে করে দিনে-দুপুরে নিশ্চিন্তে হেঁটে যাচ্ছিলেন, সেই ক্যাম্পাসই তার সবচেয়ে দুঃসহ স্মৃতির ট্রাজেডিময় স্থান হয়ে থাকল। মোবারক ও অনিত নামের দুই ছাত্র ২৪ এপ্রিল রবিবার কলিকে ক্যাম্পাসের একটি কক্ষে নিয়ে পালাক্রমে লাঞ্ছিত করে। শিক্ষা নিতে এসে শিক্ষা ক্যাম্পাসে লাঞ্ছিত হয়ে এই সমাজ সম্পর্কে কী মন্তব্য করবেন কলি, তা বড় বেশি জানতে ইচ্ছা করে। এই নির্মম পরিণতির শিকার হওয়ার পর ইসলামের আদর্শের মধ্যে শান্তি খুঁজে পাওয়ার, পর্দার নিরাপদ বিধানের প্রতি তার শ্রদ্ধা জাগে কিনা তাও জানতে ইচ্ছা করে। [সূত্র : দৈনিক আমার দেশ, সেপ্টেম্বর ২০১০ ইং]

ঘটনা-৬ : ‘আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা ফুল তুলিতে যাই, ফুলের মালা গলায় দিয়ে মামার বাড়ি যাই’ কবিতার এই চরণগুলো হয়ত চিরদিনের জন্য ভুলে যেতে চাইবে তুলি (ছদ্মনাম)। কারণ, সে মামার বাড়ি বেড়াতে গিয়ে হারিয়ে এসেছে তার সবচেয়ে দামি সম্পদটুকু। মাত্র ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী সে। বাড়ি পিরোজপুরে। কোনও এক ছুটিতে হল্লা করে বেড়াতে গিয়েছিল নানার বাড়ি চরভদ্রাসনে। কিন্তু মেজবানরা তার মেহমানদারী করেছে তার সম্ভ্রম কেড়ে নিয়ে। প্রত্যন্ত গ্রামের এক পাটক্ষেতে তার সম্ভ্রমহানী করা হয়। ধর্ষক আহসান কবির মামুন, তুষার, কালামসহ মোট চার যুবক এই পাপক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। তারা শুধু ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয় নি। পাটক্ষেতে সংঘটিত ক্ষমার অযোগ্য এই অপরাধচিত্র নিয়ে আসে জনসম্মুখে। লক্ষ মানুষের দৃষ্টিতে। সহযোগীদের দিয়ে ধর্ষণের সেই ভিডিও দৃশ্য ধারণ করে বাজারজাত করে তারা। পাপের আঁধারচারীরা দেখে তৃপ্ত হয় একটা অসহায় কিশোরী কিভাবে সম্ভ্রম হারাচ্ছে! লম্পটরা তার থেকে কী ঘৃণ্যভাবে ফায়দা তুলে নিচ্ছে।

ঘটনা-৭ : আরও নারকীয় ঘটনা এটি। ২৭ ও ২৮ বছরের দুইজন পাক্কা যুবকের একজন তৃতীয় শ্রেণীর কাঁচা দেহের ওপর হামলে পড়া! ঘটনাটি কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার থানার নারায়ণপুর গ্রামের। মেয়েটির নাম ফারজানা। আবূ বকর সিদ্দিকের মেয়ে তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী এই ফারজানা। বুধবার ওয়াহেদপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে আবদুর রশিদ (২৭) এবং বশির (২৮) তাকে পাটক্ষেতে নিয়ে ধর্ষণ করে। কিন্তু পরিচয় ফাঁস হওয়ার ভয়ে শুধু ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয় না তারা, মুখের ভেতর কাঁদা ঢুকিয়ে মুখ বন্ধ করে হত্যা করে তারা। ওই দিন মেয়েটিকে খোঁজাখুঁজি করে উদ্ধার করার পর ভূতের আছরে মারা গেছে বলে প্রচার করে দাফন করা হয়। কিন্তু পরে পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করলে আসল ঘটনা বেরিয়ে আসে। আসল ঘটনায় জানা যায়, সেই ভূতটা ছিল  রশিদ ও বশির নামের দুই পিশাচ। তারাই ফারজানার সামনে ভূতের ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে তাকে ধর্ষণ ও হত্যা করেছে!

ঘটনা-৮ : যশোর জেলার অভয়নগর থানার আলমডাঙ্গা গ্রাম।  গ্রামের রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণীর ছাত্রী রেশমা বেগম। বয়স মাত্র সাত বছর। এ বয়সে যেখানে সবার আদর আর সোহাগ পাওয়ার কথা, সে বয়সে সে পেয়েছে লাঞ্ছনা আর নির্মমতা। সমাজের আয়না আজ এত বিচ্ছিরি হয়েছে যে, এর দিকে তাকাতেও ঘৃণা ধরে যায়। স্কুল শেষে বাড়ি ফেরার পথে একই গ্রামের হান্নান মোল্লার ছেলে জাকির হোসেন (১৮) তাকে পেঁপে খাওয়ানোর লোভ দেখিয়ে পাশের কুলক্ষেতে নিয়ে ধর্ষণ করে। ধর্ষণের পর ঘটনা ফাঁস হওয়ার ভয়ে তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে সে। দীর্ঘক্ষণ মেয়েকে না পেয়ে মা এদিক-ওদিক  খোঁজাখুজি করেন। দুপুর ২টার সময় পাশের সাদেক আলীর স্ত্রী আছিয়া বেগম কুলক্ষেতে রেশমাকে বিবস্ত্র অবস্থায় দেখতে পেয়ে চিৎকার করে ওঠে। তার মুখে সে সময় কাদা ঢুকানো ছিল। এই কাদা আসলে আমাদের বিবর্ণ সমাজের নোংরা পঙ্কিলতা মাত্র!

– আবু বকর সিরাজী

মন্তব্য করুন

Back to top button