মুক্তবাসিনী

প্রেমশূন্য প্রেম

প্রেম মানে ভালোবাসা, স্নেহ, প্রীতি- এই সব। যার মধ্যে প্রেম থাকবে, তার মধ্যে ভালোবাসা, স্নেহ, প্রীতি সবই থাকবে এটাই বাস্তব সত্য। কিন্তু কৃত্রিমতার আঁধারে ঢেকে গেছে মানুষের স্বভাবজাত সব আলো। প্রতিটি মানুষের অন্তর যেন আজ প্রেম-প্রীতিহীন এক শুষ্ক মরুভূমি। আছে কেবলই লৌকিকতা, কৃত্রিমতা। এই লৌকিকতা আর কৃত্রিমতা ছাপিয়ে উছলে ওঠে প্রেম ও পরকীয়ার জোয়ার। এই দুটি বস্তু মনুষ্যত্বটাকে বিপুলভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে একথা অস্বীকার করার জো নেই। প্রেম ও পরকীয়া- যা বেপর্দা ও উচ্ছৃঙ্খল জীবনের প্রতিফল- আজ আমাদেরকে এমন অভিজ্ঞতার আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে, যাতে নিজেদের চেহারাকে আমরা মানুষ বলে মনে করতেও ভয় পাই! পড়ুন নিচের ঘটনাটি :

রাজধানীর মোহাম্মাদপুরে শিশু সামিউল হত্যার মতো এবার সাড়ে তিন বছরের শিশু তানহা মায়ের পরকীয়ার বলি হয়েছে। মা তমা ও তার প্রেমিকা রাজু তাকে হত্যা করে ফ্লাটের কার্নিশে ফেলে দেয়। তানহার কচি শরীর পঁচে দুর্গন্ধ ছড়ালে ফ্লাটবাসী তার লাশ খুঁজে পায়। ঘাতক মা পালানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। তানহার বাবা ফারুক গাজী বাদী হয়ে মামলা করেছেন।

জেনিফার ইসলাম তানহার বাবা মুদি ব্যবসায়ী ফারুক গাজী জানিয়েছেন, রেজাউল করিম রেজার সঙ্গে তার স্ত্রী হালিমা ইয়াসমিন তমার (২৭) অনৈতিক সম্পর্কের কথা। মিরপুরে তার বাসার সামনেই থাকত রাজু। সান্নিধ্যের সুবাধে দুজনের মধ্যে বোঝাপরা। এনিয়ে তিনি স্ত্রীর সঙ্গে বকাঝকা করতেন। গত ২৭ই জুলাই স্ত্রী তমা তার সাড়ে তিন বছরের সন্তান তানহাকে নিয়ে উধাও হয়ে যান। স্বামী ফারুক স্ত্রী ও কন্যাকে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাদের সন্ধান করতে পারেন নি।

এদিকে তমা স্বামীর পবিত্র বন্ধন ছিন্ন করে পঙ্কিলতার সাগরে গা ভাসিয়ে দেয়। অবৈধ বিছানায় শয্যাসঙ্গী হয় প্রেমিক রাজুর। সে খিলগাঁওয়ের সিপাহীবাগে রাজুর ভাড়া করা ফ্লাটে আশ্রয় নেয়। রাজু অবৈধ সম্পর্ক বাঁচাতে অবৈধ পরিচয়ের আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। তমাকে বোন পরিচয় দিয়ে ফ্লাটটি ভাড়া নেয় সে। এই পরিচয়েই রাজু-তমা সেখানে বসবাস করছিল।

ফ্লাটবাসীসহ অন্যরা জানতেন, তমার স্বামী মতিঝিলে চাকুরী করে, রাজু তার ভাই। কিন্তু মূল ঘটনার সূত্রপাত হয় ২রা আগস্ট সোমবারে। বাসার কেয়ারটেকার বসির মিস্ত্রিকে নিয়ে ফ্লাটে কাজ করতে গেলে উৎকট দুর্গন্ধ আসে। দুর্গন্ধের কারণ জানতে চাইলে মা তমা চরম মাতৃত্ব অবমাননার আশ্রয় নেন। নিজের কলজে ছেঁড়াধন, গর্ভের রত্ন, সাড়ে তিন বছরের নিষ্পাপ কন্যা তানহাকে তিনি ইঁদুরের পরিচয় দেন। ইঁদুর মরে গন্ধ ছড়াচ্ছে বলে তিনি কেয়ারটেকারকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন!

কিন্তু মাতৃমনের এই নির্দয় ভাষ্য মেনে নিতে কষ্ট হয় কেয়ারটেকারের। আড়চোখে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে সে তাকায় তমার দিকে। তার এই সন্দেহের চাহনী ধরতে কষ্ট হয় না তমার। তাই রাতে ব্যাগ ও সামানপত্র নিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু ফ্লাটের লোকদের কৌশলের কাছে হেরে গিয়ে তিনি পালাতে ব্যর্থ হন। ফ্লাটের অন্যান্য লোকজন কলাপসিবল গেটে তালা ঝুলিয়ে তাকে আটকে দেয়।

এর পরের দিন মঙ্গলবার কেয়ারটেকার বসিরসহ অন্যরা ফ্লাটে তল্লাশী চালায়। একপর্যায়ে রান্নাঘরের পাশের জানালার কার্নিশে কিছু একটা পড়ে থাকতে দেখে তারা। এতো অন্য কিছু নয়, পরকীয়ার বিষাক্ত ছোবলে জর্জরিত একটি নিষ্পাপ শিশুর পঁচা-গলা লাশ! কিন্তু এখানেও নিষ্ঠুর অভিনয় করেন মা তমা। তিনি মিথ্যা গল্প ফাঁদেন এবং বলেন, হাঁস এনেছিল, ওই হাঁস মরে যাওয়ায় জানালা দিয়ে তা ফেলে দেয়া হয়েছে।

কিন্তু একটি নিষ্পাপ শিশুরও তো অভিশাপ আছে। এই অভিশাপ থেকে বাঁচার সাধ্য কার? তাই মায়ের মিথ্যাচারিতা ও প্রতারণা ধরিয়ে দেয় অন্য জগতের বাসিন্দা শিশু তানহা। কেন যেন নিজের মৃত্যৃ উপস্থিতিটা তানহা জানিয়ে দেয় নিজের দেহের দুর্গন্ধ দিয়ে। যার মা তাকে ইুঁদুর বানিয়েছে, মরা পঁচা-হাঁস বানিয়েছে সে তো এতটুকু প্রতিবাদ করবেই। তাই তার ‘অব্যক্ত প্রতিবাদে’ ফেঁসে যান মা তমা। লোকজন কার্নিশে তানহার ঝুলন্ত লাশ দেখে তমাকে আটক করে।

যে প্রেমিকের সাধ পূরণের জন্য তমার এই নিষ্ঠুর অভিসারযাত্রা, বিপদের সময় সেই প্রেমিক পলাতক। তমাকে বিপদে পড়তে দেখে রাজু গা ঢাকা দিয়েছে। হবে তো তা-ই। যে সম্পর্কের ভিত্তি এই পঙ্কিল-কাদা, সে সম্পর্কের অস্তিত্ব তো এমন দুর্বল হবেই!

বাবার কাছে যথা সময়ে পৌঁছে কন্যার এই করুণ পরিণতির সংবাদ। তিনি ছুটে আসেন কন্যার গলিত লাশের ‘সমাধিপাড়ে’। কান্নায় হাউমাউ করে ওঠেন তিনি, কন্যাবিয়োগে পিতৃস্নেহে ভেঙে খান-খান হয়ে যায় তার কোমল হৃদয়। সন্তানহারা বাবা নিজেই স্ত্রীর পরকীয়া ও নানা অপকর্মের কথা প্রকাশ করেন পুলিশের সামনে। তিনি জানান-

পাঁচ বছর আগে তমাকে বিয়ে করেন ফারুক। সম্ভবত বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই আল্লাহপ্রদত্ত হালাল উপভোগ্যতার পরিবর্তে হারাম আস্বাদনের প্রতি ঝুঁকে পড়েন তমা। এপথে তার যোগ্য সহযোগী প্রেমিক রাজু। এসব পরকীয়া প্রেমিক  সমাজের বোঝা, জাতির কলঙ্ক। এরাই সমাজটাকে গলিত করে তুলছে। স্ত্রীদেরকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে স্বামীর পবিত্র বন্ধন থেকে। কখনও করছে বাবাকে সন্তানহারা। কখনওবা মাকে কাঁদাচ্ছে সন্তানহারার যন্ত্রণায়। এদের ফাঁদে পা দিয়ে বহু নারী এবং বহু পুরুষ নিজ স্ত্রী বা নিজ স্বামীর বন্ধন ছিন্ন করে পাপের পথে নামছে। যে পথের যাত্রা বন্ধুর, অসংলগ্ন এবং পরিণাম অশুভ।

পাঠক! এই ঘটনা আপনার মনে কতটুকু দাগ কাটলো, তা জানি না। কিন্তু ঘটনার নির্মমতা এখানেই শেষ নয়। আরও আছে। তমাও তার প্রেমিক রাজু মিলে তানহাকে হত্যা করার পর লাশের বিহিত করতে তৎপর হয়ে ওঠে। প্রেমসাগরের ভ্রান্ত নাবিকেরা যথাযথ হাল ধরতে ব্যর্থ হয়। তারা জানালা দিয়ে লাশ ফেলে দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু গ্রিলমিস্ত্রি কী আর জানতো যে, কোনোকালে জানালার এই সংক্ষিপ্ত ফোঁকর দিয়ে কোনও মা তার আপন সন্তানকে হত্যা করে লাশ ফেলে দেবে! যদি জানত, তাহলে হয়তবা ফোঁকরটা পরিমাণে বড় রাখত। বেকায়দায় পড়তে হত না তমা ও রাজুকে। কিন্তু গ্রিলমিস্ত্রির সেই অদূরদর্শিতা (!) কাল হলো মা তমা ও তার প্রেমিক রাজুর। কারণ, জানালা সেই ফাঁক দিয়ে লাশ বাইরে ফেলা গেল না। তবে দমলেন না তারা। গ্রিলমিস্ত্রি লোহার ওপর যে চর্চা করেনি, তমা-রাজু সেই চর্চা করল শিশু তানহার কচি দেহের ওপর। তানহার লাশের মাথার যতটুকু অংশ জানালার ফোঁকরে আটকে গেল ততটুকু অংশ বটি দিয়ে কেটে ফেললেন তারা! এরপর তাকে জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলেন! এই হলো আমাদের সমাজ, দেশ, নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অবস্থা! [সূত্র : দৈনিক আমার দেশ, ৫ আগস্ট ২০১০ ইং বৃহস্পতিবার]

– আবু বকর সিরাজী

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button