মুক্তবাসিনী

পর্দাঘেরা প্রতিবেশী : নিরাপদ জীবন

সৎ প্রতিবেশী হওয়া, প্রতিবেশীর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করার কথা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছে ইসলাম। আর একজন প্রতিবেশীর সবচেয়ে গুরুদায়িত্ব হচ্ছে অপর প্রতিবেশীর সম্ভ্রম রক্ষা করা। তাই প্রতিবেশী কোনও নারীর সম্ভ্রমহানী করাকে ইসলাম ক্ষমার অযোগ্য মারাত্মক অপরাধ সাব্যস্ত করেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলো :

اَىُّ الذَّنْبِ اَعْظَمُ ؟ فَذَكَرَ فِيْهِ الزِّنَا بِحَلِيْلَةِ الْجَارِ –

‘কোন গুনাহ সবচেয়ে জঘন্য? তিনি উত্তর করলেন, প্রতিবেশির নারীর সঙ্গে ব্যভিচার করা।’ [বুখারী : ৪৪৭৭]

অন্য আরেক হাদীসে ইরশাদ হয়েছে : মেকদাদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

لَأَنْ يَزْنِيَ الرَّجُلُ بِعَشْرَةِ نِسْوَةٍ أَيْسَرُ عَلَيْهِ مِنْ أَنْ يَزْنِيَ بِامْرَأَةِ جَارِهِ –

‘একজন সাধারণ নারীর সঙ্গে ব্যভিচার করার চেয়ে প্রতিবেশী নারীর সঙ্গে ব্যভিচার করা দশগুণ বড় অপরাধ।’ [মুসনাদ আহমাদ : ২৩৮৫৪]

কিন্তু একটি সমাজ থেকে যখন ইসলামের আলো সরে যায়, বেপর্দা ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে আত্মপ্রকাশ করে, তখন সেই সমাজে এধরনের অপরাধ অস্বাভাবিক কোনও ব্যাপার থাকে না। বেগম রোকেয়া যে সময় ‘অবরোধবাসিনী’ বইটি লিখেছিলেন, তখন হয়ত সমাজে পর্দা পালনের কড়াকড়ির একটি চিত্রই দেখেছিলেন। সমাজের অপর পিঠ তিনি দেখার চেষ্টা করেন নি। পর্দার অপর পিঠ তথা বেপর্দা, উচ্ছৃঙ্খল জীবনাচারের ক্ষতবিক্ষত যে পিঠটা আছে, তা তিনি দেখেন নি বা দেখার গরজ বোধ করেন নি। বেপর্দা নারীর সম্ভ্রম কোথায় নিয়ে যায়, আজকের ঘটনাবালীর দুয়েকটি যদি তিনি সচক্ষে প্রত্যক্ষ করতেন, তাহলে হয়ত তার ভুল ভাঙত। কলমের নিব তিনি উল্টো পথে ধরতে বাধ্য হতেন। যাহোক, নিচের ঘটনাটি পড়ুন :

‘আমার বিটির ইজ্জত লিয়ে ললি চিপি ধরি মুখে বিষ ঢালি দি মারচে। পুলিশেক আমরা কইচি। কিন্তু পুলিশেরা আমারে কতাই লেয় না। আরো ধমক দেয়। পুলিশ কইচে ওগুলি বিষের দাগ। এখন আনোয়ার হুমকি দিচ্চে। কাইচে, একজন গেছে আবার আরেকজনকে খুন করব।’

কথাগুলো একজন সন্তানহারা মায়ের, যিনি বেপর্দা জীবনের এক করুণ পরিণতির স্বীকার হওয়া মেয়ের মা। কাঁদতে-কাঁদতে এভাবেই আর্তি জানালেন নাটোরের লালপুর ভবানীপুর গ্রামের নিহত গৃহবধূ রিতার মা হিরা বেগম। গত ২রা সেপ্টেম্বর একই  গ্রামের প্রভাবশালী আনোয়ার হোসেন ও তার সঙ্গীরা রিতাকে বাড়ি থেকে অপহরণ করে পাশের আখ ক্ষেতে নিয়ে ধর্ষণ করে শেষে গলা টিপে ধরে। এরপর জোর করে বিষ পান করিয়ে হত্যা করে।

ভবানীপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায় ছনের বেড়া আর টিনের  ছাপড়ার বাড়িতে মা আবিলা বেগম ও বাবা মহির উদ্দিনের সঙ্গে একই বাড়িতে বাস করতেন ছেলে কাবিল উদ্দিন ও ছেলের বউ রিতা বেগম। আবিলা বেগম বলেন, সংসার সুখের হবে এই আশায় একই গ্রামের হিরা বেগমের মেয়ে রিতা বেগমের সঙ্গে কাবিলের বিয়ে হয়। কিন্তু গরীবের ঘরের সুন্দরী বউয়ের ওপর লালসাভরা চোখ পড়ে প্রতিবেশী ধনাঢ্য কৃষক আকবর আলী মিস্ত্রির ছেলে আনোয়ারের। সে প্রায় সময় গৃহবধূ রিতাকে কুপ্রস্তাব দিত। গত ২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার পর আনোয়ারের মামা সাজদার হোসেন কাবিলকে পাশের হাজীরহাট বাজারে নিয়ে যায়। রাত ৯টার দিকে বাড়ির সবাই শুয়ে পড়েন। বাড়ির লোকজন ঘুমের সমুদ্রে ঢলে পড়ার পর সুযোগ কাজে লাগাতে দেরি করে না আনোয়ার।

আনোয়ার কিভাবে কী করে সর্বনাশা পদক্ষেপ নিয়েছিল তা জানা যায় নি। তবে হঠাৎ রিতার একটি ‘মা’ ডাক সবাইকে স্তম্ভিত করে দেয়। কল্যাণকামী মা একটিমাত্র ডাকে বিছানা ছেড়ে ধড়ফড় করে উঠে পড়েন। দৌড়ে যান রিতার ঘরের দিকে। কিন্তু ঘরের দরজা বাইরে থেকে শিকল দেয়া। মা হিরা বেগম তখন রিতাকে ডাকতে থাকেন। কিন্তু কোনও জবাব না পেয়ে কেঁদে ওঠে মা-সত্তা। তিনি চিৎকার করে ওঠেন। পরে বাড়ির একশ গজ দূরে আখক্ষেতের মধ্যে রিতাকে পড়ে থাকতে দেখা যায়। মৃত্যুপথযাত্রী রিতা কয়েকটিমাত্র কথা বলার সুযোগ পান। তিনি মাকে জানান, ‘আনোয়ারসহ কয়েকজন লোক ধর্ষণ করে আমাকে জোর করে বিষ খাইয়ে দেয়। মা আমাকে বাঁচাও।’ কথাগুলো বলার পর থেমে যায় রিতার কণ্ঠ। উদ্বিগ্ন মা রিতাকে বনপাড়া হাসপাতালে নিয়ে যান। কিছুক্ষণ পর রিতা সেখানেই মারা যান।

রিতা জীবনের পাঠ চুকিয়ে এই সমাজের নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা আর অধঃপতনের চরম অবস্থার অস্তিত্বের প্রতি ইঙ্গিত করে গেলেন। একজন মানুষ কত পাষাণ হলে, পর্দা ও নৈতিকতার পরিবেশ কতটা খারাপ হলে একজন সতী নারীর পিছু নিয়ে এভাবে অসহায় অবস্থায় পেয়ে তার সম্ভ্রম লুট করে শেষে জীবনটা পর্যন্ত কেড়ে নিতে পারে? আমরা তো সমাজ-সংসারের স্বার্থে বিভিন্ন রকমের হিসাব করে থাকি। দিনের হিসাব, সপ্তাহের হিসাব, মাসের হিসাব এবং বছরের হিসাব। বছর শেষে ব্যবসায়ীরা করে হালখাতা। কিন্তু আমরা কি কখনও আমাদের পরকালীন জীবন ও নৈতিকতার পরিসংখ্যান জানতে হিসাব কষেছি? একটি সমাজের চিত্র পাল্টে দেয়ার জন্য যথাযথ কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি? যদি তা না করি এবং আমরা যদি এভাবে অনুভূতিহীন হয়ে যাই, তাহলে আমাদের পতন যে খুবই সন্নিকটে, তাতে সন্দেহ নেই। [সূত্র : দৈনিক কালেরকণ্ঠ ৫/১২/২০১০ ইং]

– আবু বকর সিরাজী

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button