বধূর জন্য লড়াই

বহু বছর আগে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের একটা ঘটনা পড়েছিলাম। পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গলের নির্জনতায় সভ্যতার আলো না পড়লেও এক হিন্দু গৃহস্থ্যের ঘরে সভ্যতা ও বিজ্ঞানের অবিচ্ছেদ্য অংশ ক্যামেরার আলো এবং সাংবাদিকের পা পড়েছিল ঠিকই। শকুন যেমন চারশো ক্রোশ দূর থেকেও মড়া দেখতে পায়, ঠিক তেমনি ওই সাংবাদিক বন-জঙ্গলের নির্জনতার অন্ধকারে খুঁজে বের করেছিলেন অন্ধকার জগতের আরেক গল্প। এই গল্প আমাকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। বিবেককে করেছিল বিকল। হয়ত আমার বাড়াবাড়ি এটা। সামান্য ঘটনাকে বড় করে দেখার বাতিক রোগ। এড়িয়ে যাওয়ার ঘটনাকে বিশ্লেষণ করে ফুলিয়ে-ফাপিয়ে প্রকাশ করার ‘নিরুদ্দেশ’ চেষ্টা। পাঠক! অন্তত এই ঘটনাটিকে আপনি এই দৃষ্টিতে দেখবেন না। বরং ঘটনাবিশ্লেষণে আপনিও শরীক হন আমার সঙ্গে।
মেঘালয় রাজ্য। পাহাড়-পর্বতের নির্জনতায় শিক্ষাহীন, আলোহীন, সভ্যতাহীন এক হিন্দু পরিবার। সংসারে গৃহকর্তা দুইজন আর গৃহকর্ত্রী একজন। গৃহকর্তা দুইজন হলেন সহোদর ভাই! তাদের পরিচয় এখানেই শেষ নয়, তারা আবার ওই গৃহকর্ত্রীর স্বামীও বটে! অর্থাৎ এক নারীর দুই স্বামী, সম্পর্কে যারা পরস্পরে সহোদরা!
পুরুষের ঔরস বিভক্ত হয়ে একাধিক নারীর গর্ভে প্রতিস্থাপন হতে পারে। তাই তারা একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করতে পারে এবং তা যুক্তিযুক্ত। কিন্তু একজন নারী কি পারে তার গর্ভকে বিভক্ত করতে? একেকজনের জন্য আলাদা আলাদা গর্ভ বানাতে? পারে না। তাই সঙ্গত কারণেই তারা পারে না একাধিক স্বামী গ্রহণ করতে। পারে না একাধিক স্বামীর ঔরস নিয়ে নিজের গর্ভকে কলঙ্কিত করতে। এসব কল্পনা আমাদের মনে ঘেন্না সৃষ্টি করে। তা ভাবতে গেলে আমাদের রুচি নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু ওই দুই ভাই, দুই স্বামী এবং দুই স্বামীর এক স্ত্রীর এ নিয়ে কোনও ঘেন্না নেই। ধর্মীয় শিথীলতা আর জ্ঞান ও সভ্যতার আলোস্বল্পতা তাদের মন থেকে হয়ত এই মর্যাদাবোধ উঠিয়ে দিয়েছে। অতএব তাদের নিয়ে লেখালেখির প্রয়োজনয়ীতা বড় স্বল্প!
কিন্তু আঁধারের অসভ্যতার যদি পুনরাবৃত্তি ঘটে, অন্ধকারের ঘটনার পুনর্জনম হয়, সভ্যতাকে কলঙ্কিত করা এধরনের কোনও ঘটনা ঘটে চোখের সামনে, তাহলে কি আর নিশ্চুপ থাকা যায়? তাই মেঘালয় রাজ্য ছেড়ে এবার আমাদের আলোর সভ্যতার মুসলিমদের বিবর্ণ সমাজের ঘটনা শুনুন : ‘বউ ফিরে পেতে দুই প্রবাসীর লড়াই’ শিরোনামে একটি সংবাদ ছেপেছে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা। ঘটনার বিবরণ নিম্নরূপ :
হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ থানার আউশকান্দি ইউনিয়নের দরবেশ গ্রামের লুৎফা বেগম। মনভরে ভালোবাসেন পাশের মিনহাজপুর গ্রামের নজরুল ইসলাম ওরফে ইয়াফিসকে। লুৎফার ভালোবাসায় কোনও কমতি নেই। কিন্তু ইয়াফিসের ভালোবাসায় আছে প্রতারণা। তিনি তার বিবাহিত পরিচয় লুকিয়ে রেখে গভীর প্রেম চালিয়ে যান লুৎফার সঙ্গে। সরল লুৎফা প্রেমদরিয়ায় হাবুডুবু খাওয়ায় ভালোবাসার মানুষের আসল পরিচয়ের কিনারা খুঁজে পান নি। পরে অবশ্য ঘটনা ফাঁস হয়ে যায়, ইয়াফিসের আসল পরিচয় বেরিয়ে আসে। কিন্তু লুৎফা অনড়। যে করেই হোক ইয়াফিসকেই তাকে চাই। পরিবারের বাধা-আপত্তি কোন ছাই! তার জেদ আর ভালোবাসার জয় হলো।
২০০৯ইং সালের ২৪ই মার্চ ভালোবাসার গলায় বিজয়ের মালা পরিয়ে সতীনের ঘর করতে গেলেন তিনি। পরিবারের সম্মতি অস্বীকার করে প্রেমিকযুগল পালিয়ে গেলেন বাড়ি থেকে। হবিগঞ্জ সদর উপজেলার লস্করপুর ইউনিয়নের কটিয়াদি বাজারের কাজি অফিসে তাদের বিয়ে হয়। মোহরানা নির্ধারণ করা হয় দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা। আইনি ঝামেলা এড়াতে তারা একই তারিখে হবিগঞ্জ নোটারী পাবলিকে এফিডেভিট করেন। ইয়াফিসের পরিবার বিয়েটি মেনে নিলেও লুৎফার পরিবার তা মেনে নেয় নি। তাই তার পরিবারের লোকদের মধ্যে পুঞ্জীভূত হয় ক্ষোভের ছাইচাপা আগুন। মা-বাবার দু‘আ-আশির্বাদহীন এই বিয়ের পরও বেশ সুখেই কাটছিল তাদের সংসার। তবে এর কিছুদিন পর ইয়াফিস আমেরিকায় চলে যান।
এবার পরিবারের লোকদের ক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে। তারা লুৎফাকে বিয়ে বিচ্ছেদের জন্য চাপ দিতে থাকে। একই সঙ্গে তারা ভুয়া নিবন্ধন কার্ড সংগ্রহ করে জোর করে ২ নভেম্বর ২০১০ইং লুৎফাকে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কদমহাটা গ্রামের মৃত মকসুদ আলীর ছেলে যুক্তরাজ্য প্রবাসী সৈয়দ আফজাল হোসেনের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেয়। অত্যন্ত গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে এই অবৈধ বিয়ের কাজ সম্পন্ন করা হয়। এই বিয়ে এজন্য অবৈধ যে, একজন প্রাপ্ত বয়স্ক নারী-পুরুষ তাদের নিজের পছন্দে বিয়ে করলে সামাজিক দৃষ্টিতে তা যত বড়ই অপরাধ এবং শরীয়তের নৈতিক দৃষ্টিতে দূষণীয় হোক না কেন- সেই বিয়ে সিদ্ধ ধরা হয়। এই বিয়ের মধ্যে অন্য কোনও বিয়ে বাঁধালে তা হবে অবৈধ ও নাজায়েয। এই বিয়ের মিলন হবে ব্যভিচার-যেনা। তো এই ব্যভিচারী বিয়ের কথাটা লুকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয় লুৎফার পরিবার। এলাকায় জানাজানি হয়ে যায় তা। শুরু হয় আসল স্বামী এবং নতুন অবৈধ স্বামীর মধ্যে বউ পাওয়ার লড়াই। আইনী লড়াইয়ের মাঠে নামতে চাচ্ছেন নজরুল ইসলাম ওরফে ইয়াফিস। কম যাচ্ছেন না নতুন স্বামী আফজাল হোসেনও। এই অপ্রিয় লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত যারই জয় হোক না কেন, আমাদের সামাজিকতা আর নৈতিকতার পরাজয় কিন্তু অবধারিত। আর জয় ইসলাম ও ইসলামের আদর্শের। ইসলামী আদর্শ ও নৈতিকার আশ্রয়ে থাকলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, লুৎফা, নজরুল ও আফজাল কাউকেই এমন নোংরা প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে হতো না।
আমাদেরও স্মরণ হতো না মেঘালয় রাজ্যের সেই অপ্রিয় কড়চা কথা।
– আবু বকর সিরাজী
khub bhalo aro islamic bisoy guli sen koren