মুক্তবাসিনী

নিন্দিত পথে জায়ার যাত্রা

জায়ারা হলেন সমাজ-সংসারের গুরুত্বপূর্ণ ও ভারসাম্য রক্ষাকারী শক্তি। তাদের বক্রপথে চলায় শান্তি ও স্থিতিশীলিতা নিদারুণভাবে বিঘ্নিত হয়। রক্তস্রোত আর রক্তপাতের নতুন-নতুন ঝর্নাধারা প্রবাহিত হয়। আমাদেরকে আর কত লিখতে হবে রক্তপাত আর রক্তস্রোতের কাহিনী? এসব লিখতে-লিখতে যে হাত অবশ হয়ে এলো! শ্রেষ্ঠজীব মানুষের জীবন সৌন্দর্যের বদলায় রক্ত, রক্তপাত আর জীবনহরণের কাহিনী লেখায় রুচি জোগাড় করা সত্যিকার অর্থেই কঠিন। কিন্তু মুক্তবাসিনী বইটা লিখতে গিয়ে এই কঠিন পথেই পা মাড়াতে হচ্ছে। প্রেম, পরকীয়া আর বেপর্দা জীবনের বিষাক্ত ছোবল সম্পর্কে নারীজাতিকে সচেতন করতে আমাকে বারবার এসব কাহিনী নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে হচ্ছে। দৈনিক পত্রিকাগুলো হাতে নিয়ে কামনা করি যেন আর কোনও খুন, ধর্ষণ বা নারীহত্যার ঘটনা পাঠ করতে না হয়। কিন্তু চোখ আমাকে হতাশ করে। দুচোখের পাতায় ভেসে ওঠে নারী কিংবা পুরুষের রক্তপাতের নোনা কাহিনী। সেসব নোনা কাহিনীই পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে হয় আমাকে, জাতির বিবেক জাগ্রত করার ব্রতে। সেসব কাহিনীরই একটি নিচের কাহিনীটি।

পড়ুন : ৩রা নভেম্বর ২০১০ইং। রোজ বুধবার। এ মাটির চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র আর মানব-দানব প্রত্যক্ষ করল আরেকটি রক্তভেজা কাহিনী।

টাঙ্গাইলের গোপালপুর লাহিড়ী বাড়ির বাসিন্দা হাসান আলী। আট মাস আগে বাড্ডার মোল্লারটেকের বাসিন্দা নীলা মেহরুনকে বিয়ে করে নতুন স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে নতুন সংসার শুরু করেছেন তিনি। সংসারটাকে মধুময় ও দাম্পত্য জীবনকে নিষ্কণ্টক করতে স্ত্রীকে গাজীপুর নিয়ে আসেন হাসান আলী। তিনি গাজীপুরের একটি টেক্সটাইল মিলের কোয়ালিটি কন্ট্রোলার।

নববধূকে নিয়ে ভালোই কাটছিল বিবাহের নতুন দিনকগুলি। সুখের অধরা পায়রাগুলো একে একে লুটোপুটি খাচ্ছিল নবদম্পতির সুখ আঙিনায়। দুহাতে ঠেলেও সেই সুখ-পায়রাগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখা দায়! কিন্তু এমন সব মধুর ভালোবাসা আর সুখের অনুভূতিগুলো দীর্ঘ হলো না। পরকীয়ার একটি ঝড় এসে তাদের সুখপাখিটাকে অনেক দূরে নিয়ে গেল। ভেঙে দিল সুখপাখিটার ওড়ার ডানা।

দুই মাস আগে হাসান জানতে পারেন তার প্রিয়তমা স্ত্রী কেবল তার একার নয়! অন্য এক সুখপাখির ডানায় ভর করে আরেকটু সুখ পাওয়ার আশায় কিংবা ভালোবাসার নতুন নীড় রচনার আশায় নীলা মেহরুন নতুন স্বপ্ন গাঁথছেন। এই স্বপ্ন যে সর্বদাই অলীক স্বপ্ন হয়ে ধরা দেয়, মরীচিকার মতো আশাহত করে পিপাসার্ত পথিককে সে কথা ভুলে যান নীলা। এই স্বপ্নের পরিচিত ও আধুনিক নাম পরকীয়া। বুদ্ধিমান নারী-পুরুষের কাছে যা একটা জীবন্ত আতংকের নাম।

স্ত্রীর ওপর নিরঙ্কুশ অধিকার থাকা একজন স্বামীর প্রত্যাশিত ও বৈধ অধিকার, ঠিক একইভাবে একজন স্বামীতে পূর্ণমাত্রার অধিকার থাকাও একজন নারীর পরম চাওয়া। এই প্রত্যাশা ও চাওয়াচাওয়িতে কোনও অপরাধ বা বাড়াবাড়ি নেই। বরং তা প্রশংসিত ও সর্বজন গৃহীত।

এই প্রত্যাশার বাইরে কেউ কোনও কিছু বরদাশত করে না। তাই সঙ্গত কারণেই হাসান আলী যখন জানতে পারলেন যে, স্ত্রী নীলার সঙ্গে তার সম্পর্ক কেবলই দেহকেন্দ্রিক, মনের আদান-প্রদান হয় বাড্ডার রাজু নামের এক যুবকের সঙ্গে, তখন তার মেজাজ তিন-চার রকমের হয়ে যায়। শুরু হয় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকর চির অবাঞ্ছিত অধ্যায়। ঝগড়া। এক পর্যায়ে গালাগালি এবং পরিণতিতে মারামারি। সেখান থেকে নারীর দুর্বল দেহের ওপর পুরুষের শাসন ও প্রহারের হাত। যা হোক, এই ঝগড়া-ফ্যাসাদের কবলে পড়ে মন বিষিয়ে ওঠে নীলার। রাগে-অভিমানে মায়ের কাছে চলে আসেন তিনি।

২রা নভেম্বর। মঙ্গলবার। অভিমানী স্ত্রীর মোবাইল নাম্বারে কল দেন হাসান আলী। ফোনে স্ত্রীকে দেখা করতে বলেন তিনি। আর যাই হোন না কেন, তার প্রথম পরিচয় হচ্ছে তিনি নারী। আর একজন নারীসত্তার স্বামীর আহ্বানে সাড়া দেয়া চিরবাঞ্ছিত স্বভাব। তাই হাসানের আহ‌বানে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারেন না নীলা। বহুদিন পর স্বামী-স্ত্রীর মিলনে পরিবেশটা মধুর হয়ে ওঠে। দু’জন মিলে সারাদিন ঘুরে বেড়ান তারা। আর বিকেলবেলায় আশ্রয় নেন বনানীর পূর্ণিমা আবাসিক হোটেলের ১০৩ নং কক্ষে। সম্ভবত এই কক্ষের এক টুকরো মাটি কিংবা ধুলোবালির সঙ্গে নীলার দেহের যোগসূত্র ছিল। তাই এখানে এসে সেই লিখিত ভাগ্যের অনুবাদ ঘটল। হোটেল পূর্ণিমার ১০৩নং কক্ষে আসার প্রয়োজন ছিল নীলার পরযাত্রার পথ সুগম করার জন্য।

সারাদিন মাহেন্দ্রক্ষণের মধ্য দিয়ে কাটালেও রাতে পরকীয়ার ব্যাপার নিয়ে আবার ঝগড়া বাঁধে হাসান ও নীলার মধ্যে। থেমে-থেমে চলে এই ঝগড়া। রাতের এই ঝগড়ার জের থাকে সকাল পর্যন্ত। সকালে হয় আরেক দফা। ভোরের সময়কার ঝগড়ায় মনুষ্যত্বের সংজ্ঞা ভুলে যান হাসান। ফলে ক্রোধে, উন্মত্ততায় হোটেল কক্ষের জানালার পাইপ দিয়ে স্ত্রীর মাথায় আঘাত করেন তিনি। আঘাতের প্রচন্ডতায় মাথা ফেটে রক্ত বের হয় নীলার। এ রক্ত পরকীয়ার পাপের আর হাসানের হিংস্র ক্রোধের।

সামান্য রক্তে শান্ত হন না হাসান। আরও রক্ত চাই তার। চাই পুরো প্রাণটাই। তাই উন্মাদনার সর্বোচ্চ শিখরে পা রাখেন তিনি। অসহায়, অবলা, আহত নারীর প্রতি একটুও মায়া জাগে না তার। নীলার অপরাধটাই শুধু বড় হয়ে দেখা দেয় তার কাছে। তাই ক্ষমা কিংবা আহত স্ত্রীর প্রতি সহানুভূতির সংজ্ঞা মুছে যায় তার অভিধান থেকে। নীলার গলা চেপে ধরেন তিনি। শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে তবেই ক্ষান্ত হওয়া। মা-বাবা, ভাই-বোন আর আত্মীয়-স্বজনের দৃষ্টির আড়ালে স্বামীর প্রচণ্ড নির্মমতায় একটি অপরিচিত কক্ষে চিরদিনের জন্য শান্ত হয়ে যান লীনা। নির্মম পরিণতির শিকার নীলার বিদেহী আত্মার প্রতি আমার সালাম ও মাগফিরাত কামনা।

হাসান পরে নিজেই জানিয়েছেন, ভোর পাঁচটার দিকে নীলার লাশ হোটেলকক্ষে রেখে নাস্তা আনার কথা বলে হোটেল থেকে বেরিয়ে যান তিনি। এই নির্মম ঘটনার জন্ম দিয়ে এক পর্যায়ে তার মধ্যেও ভাবান্তর ঘটে। স্ত্রীর সহযাত্রী হওয়ার পদক্ষেপ নেন তিনি। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে গিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান। কিন্তু ব্যর্থ হন। পরে শাহবাগ থানায় গিয়ে ডিউটি অফিসারের হাতে ধরা দেন। পুলিশের কাজ সহজ করে খুনি নিজেই নিজের হাতে শিকল পরেন। [সূত্র : দৈনিক আমার দেশ ৪ঠা নভেম্বর ২০১০ইং বৃহস্পতিবার]

পাঠক, আসুন আমরা এই ঘটনার পোস্টমর্টেম করি। দেখুন, কে এমন নীরস প্রাণ যে, স্ত্রীকে ভালোবাসে না? নারীর মধ্যে আল্লাহ এমন এক আকর্ষণ গচ্ছিত রেখেছেন, যার টানে পুরুষরা কাবু হবেই। এমন এক শক্তির অধিকারী নারীকে যখন কোনও পুরুষ বধূর মর্যাদা দিয়ে ঘরে নিয়ে আসে, তখন স্বামী ওই নারীর প্রতি নিবেদন করে সারা জীবনের গচ্ছিত প্রেম, রক্ষিত ভালোবাসা। তাকে নিয়ে শুরু করে নতুন জীবন, পবিত্র বন্ধন। স্ত্রীর সুখচিন্তায় স্বামী সর্বস্ব বিলিয়ে দেয়। হাড়ভাঙা খাটুনি করে। স্ত্রীর প্রতি এই ভালোবাসার কারণেই তো জগতের মাতৃকূলেরা বউদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, বৌটাই তার কাছ থেকে তার সন্তানটাকে কেড়ে নিয়ে গেল! একথা কিন্তু সত্য যে, বউদের আকর্ষণেই ছেলেরা মা-বাবাকে ত্যাগ করে, যদিও এটা ক্ষমার অযোগ্য অমানবিক ও অনৈতিক কাজ।

তো যে নারীর কারণে একজন সন্তান তার জন্মদাতা মা-বাবা থেকে আলাদা হয়ে যায়, মায়ের অসীম ত্যাগ, কুরবানী ও স্নেহের কথা ভুলে যায়, সেই নারীর প্রতি কেন সে খড়গহস্ত হবে- এই প্রশ্ন কখনও করি আমরা? এই প্রশ্নের সমাধান করা প্রতিটি বিবেকবান মানুষের একান্ত দায়িত্ব এবং এর উত্তর খুঁজে বের করতে পারলেই কেবল এসব সমস্যার সমাধান বের হয়ে আসবে।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীর প্রতি পুরুষের এই দানবতার মূল কারণ প্রেম, পরকীয়া এবং উচ্ছৃঙ্খল জীবন। আগে-পরের নানা ঘটনা আমাদেরকে এই তিক্ত বাস্তবতা স্বীকার করতে বাধ্য করে।

আলোচ্য ঘটনার প্রতিই নজর দিন। মাত্র আট-মাস বয়স বিয়ের। এই অল্প দিনে কী হলো যে, নিজ স্ত্রীর রক্ত প্রবাহিত করতে হবে হাসানের? হ্যাঁ, এখানে যে ঘটনা ঘটেছে তাতে হাসানের দানবীয় হয়ে ওঠার বাস্তবতা অস্বীকার করা যায় না। কেননা, বিয়ের মাত্র কয়েক দিনের মাথায় হাসান জানতে পারেন যে, স্ত্রী নীলা ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাজুর সঙ্গে প্রেমালাপ করে। স্বামীর তরে যে ভালোবাসা নিবেদন করার কথা, সেই ভালোবাসা, সেই আবেগ, সেই উচ্ছ্বাস নিবেদন করে অন্য পুরুষের সঙ্গে!

হাসানকে যুগপৎ সাধুবাদ ও নিন্দা জানাতে হয়। কারণ, প্রথমে তিনি স্ত্রীর এই পরকীয়া এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। দেখেও না দেখার ভান করেন স্ত্রীর পরকীয়া অভিসার। তাকে সাধুবাদ স্ত্রীর প্রতি প্রথমেই খড়গহস্ত না হওয়ার জন্য আর নিন্দাবাদ ভাঙনের মুখে যথাসময়ে বাঁধ না দেয়ার কারণে।

তবে একথা সত্য যে, একজন পুরুষ ভাস্কর্য নয় যে, স্ত্রীর অনৈতিকতা দেখেও ভাস্কর্যসত্তা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে বহুকাল। সেই দর্শনেই হাসানের পুরুষসত্তা জেগে ওঠে সৃষ্টিগত ক্রোধমহিমায়। স্ত্রীর অনৈতিকতার জলোচ্ছ্বাসে তার ভালোবাসার মিনার ভেঙে পড়ে। ভালোবাসার সেই ধ্বংসস্তূপে নির্মিত হয় দানবতা আর রক্তপিপাসার নিষ্ঠুর প্রাসাদ। তাই স্ত্রীকে বেড়ানোর কথা বলে নিয়ে যান মৃত্যুকূপে। নিষ্ঠুর, নির্দয়ভাবে হত্যা করেন তাকে। এরপর ভালোবাসার হতাশা আর পরকীয়ার বিরক্তি নিয়ে পুলিশের হাতে নিজেকে ধরা দেন। এভাবেই স্ত্রী ও নিজের জীবনকে মূল্যহীন করে দেয় পরকীয়ার বিষাক্ত জীবন।

– আবু বকর সিরাজী

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

মন্তব্য করুন

Back to top button