দেবর : ছদ্মবেশী মৃত্যুদূত
‘উকবা ইবন আমের (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ আলাইহিসসালাম ইরশাদ করেন, সাবধান! তোমরা পরনারীর কাছে ঘেঁষা থেকে বিরত থাকবে। তখন জনৈক আনসারী বললেন, দেবর সম্পর্কে বিধান কী? তিনি বললে, দেবর হচ্ছে মৃত্যু।’ [বুখারী : ৫২৩২]
হাদীসে দেবরকে মৃত্যুর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। আসলে কি তাই? সত্যিই কি দেবর মৃত্যুতুল্য? নাকি হাদীসের অন্তর্নিহিত কোনও অর্থ উদ্দেশ্য? মূল আলোচনায় প্রবেশের আগে আসুন এ ব্যাপারে ইসলামী মনীষীদের বক্তব্য জেনে নিই। পাঠক! ততক্ষণ পর্যন্ত ধৈর্য না হারানোর অনুরোধ করছি।
এর ব্যাখ্যায় আবূ উবায়দ (রহ.) বলেন, ভাবীর মৃত্যু হলেও সে যেন দেবরদের দেখা না দেয়। ইমাম খাত্তাবী (রহ.) বলেন, এর অর্থ হচ্ছে, মানুষ মৃত্যুকে যেভাবে ভয় করে, দেবরকেও সেভাবে ভয় করা উচিত। [আ‘লামুল হাদীস : ৩/২০২৫]
আল্লামা উব্বী রহ. বলেন, ‘নারীরা যেন পরপুরুষ ও দেবরদের সঙ্গে নিভৃতে না মেশে। কেননা, এতে শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে এমন পাপ হয়ে যেতে পারে, যা মৃত্যুর চেয়েও ভয়ানক।’
ইমাম কুরতুবী (রহ.) বলেন, দেবরের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত, মৃত্যুর সঙ্গে সাক্ষাত হওয়ার মতোই ভয়ানক ও ক্ষতিকর। [ফাতহুল বারী : ৯/২৪৩]
মনীষীগণের এসব বক্তব্যে ফুটে উঠেছে দেবরের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতের মানসিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষতির কথা। কিন্তু জনৈক কবি আরও কঠিন সত্য একটা কথা বলেছেন, যা আজকের ঘটনার সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। তিনি বলেন :
لاَ يَامَنَنَّ عَلَى النِّسَاءِ اَخٌ اَخًا
مَا فِى الرِّجَالِ عَلَى النِّسَاءِ اَمِيْنٌ
‘স্ত্রীর বেলায় কোনও ভাই তার ভাইয়ের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হতে পারে না। কেননা, কোনও নারীই কোনও পুরুষের ব্যাপারে নিরাপদ নয়।’ [আদিল্লাতুল হিজাব, পৃ: ৫৩]
তো মনীষীগণের এসব বক্তব্য কি আপনার কাছে কাঠখোট্টা টাইপের নিরস মন্তব্য বলে মনে হয়? মনে হয় রূপ-রসের মাহাত্ম্য বুঝেন না- এমন সব লোকের মন্তব্য? আল্লাহ না করুন, যদি তা-ই হয়, তাহলে এসব মন্তব্য-বক্তব্যের বাস্তবতা অনুমান করার জন্য আমাদের সমাজে ঘটে যাওয়া দুয়েকটি ঘটনা জেনে নিন। ‘ছোটবোনের দেবর, তাই বাসায় আসা-যাওয়া করলেও বাধা দেয়া হয়নি’।
প্রথম কথাটি মুক্তির দূত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের। আর দ্বিতীয় এই কথাটি হাসিনা রব্বানী নামের কন্যাহারা এক মায়ের।
পাঠক! আমার ইঙ্গিত বুঝতে পারবেন নিশ্চয়ই। বুঝতে পারবেন, নবী আর নবীর উম্মতের কথার ব্যবধান কত বেড়ে চলেছে! যার কথায় কোনও সন্দেহ নেই, যিনি কথা বলেন ওপরওয়ালার ইশারায়, তার কথা আর তার উম্মতের কথার মধ্যে ব্যবধান কত বেড়ে চলেছে তা অনুমান করতে সম্ভবত কারো কষ্ট হওয়ার কথা নয়। এই ব্যবধানের ফল কত ভয়াবহ, কত হৃদয়বিদারক তা বুঝানোর জন্যই আজকের ঘটনার অবতারণা। নবী ও তাঁর উম্মতের মধ্যে দূরত্ব যত বাড়ে, উম্মত তত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ধ্বংসের পথে তার যাত্রা বেগবান হয়। দেখুন :
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেবরকে মৃত্যু আখ্যায়িত করে তাকে দূরে রাখতে এবং তার কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার কথা বললেন। কিন্তু উম্মতের কাছে হয়ত তা গুরুত্বহীন বলে মনে হয়েছে, আমল পরিত্যাগযোগ্য বলে মনে হয়েছে। আর এরকম ধারণার ফল যে শুভ নয়, তা-ই প্রমাণিত হলো মেনকার ঘটনা দ্বারা।
ঘটনাটা ২০১০ইং সালের জুলাই মাসের। সম্ভবত ৫ তারিখের হবে। রাজধানীর পাইকপাড়ায় নিজ কক্ষে নিহত হন ইডেন কলেজের মেধাবী ও সুন্দরী ছাত্রী মোহসিনা রব্বানী মেনকা। বয়সে কাঁচা, মাত্র তেইশ বছর। দুনিয়ার রূপ-রস, স্বাদ-গন্ধ পাওয়ার আগেই দুনিয়াকে সালাম জানাতে হলো আল্লাহর শুধু একটি বিধান লঙ্ঘন করার কারণে, যার দায় তার, তার পরিবারের এবং আমাদের এই ঘুণেধরা সমাজের প্রত্যেকের।
মেনকা নিহত হয়েছেন খুব কাছের একজন মানুষের হাতে। যাকে এক সময় তিনি ভালোও বেসেছিলেন। লোকটার নাম তারেকুজ্জামান কবির। খুনি নিজে এবং পুলিশ স্বীকার করেছে, প্রেমঘটিত কারণে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। বিস্তারিত দেখুন :
মেনকার খালা জেসমিনের দেবর এই কবির। আল্লাহর বিধান- পর্দা লঙ্ঘনের সুযোগে সম্পর্কে ভাগিনীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে সে। এই সম্পর্ক গড়ে ওঠার কিছু দিন পরেই সে মালেয়শিয়ায় চলে যায়। ফলে সম্পর্কের জোয়ারে কিছুটা হলেও ভাটা পড়ে।
কিছু দিন মালেয়শিয়ায় কাটিয়ে ২০০৯ই সালের শেষের দিকে দেশে ফিরে আসে কবির। ফিরে এসেই জোরদার করতে চায় আগের সেই প্রেমের সম্পর্ক। ঘষে-মেজে চকচকে করতে চায় হৃদয়ের মরচেপড়া বন্ধন। কিন্তু ততদিনে নদীর স্রোত গড়িয়েছে অনেক দূর। পানির জোয়ার আর আগের জায়গায় বহাল নেই। বহমান ধারায় তা আজ মিশে গেছে অন্য কোনও মোহনায়। মেনকার বেলায়ও তা ঘটতে পারে এবং তা-ই স্বাভাবিক। আর সেই স্বাভাবিকতার কারণেই তিনি কবিরকে অস্বীকার করতে শুরু করেন। যে সম্পর্কে ভাটা পড়েছে, তাতে আবার নতুন করে জোয়ার আনা দরকার কী? এই চিন্তা-ভাবনা মেনকার।
কিন্তু তাতে চলে না কবিরের। তার চাই আগের মতো হৃদয়ের উত্তলতা, ভালোবাসা, উচ্ছ্বলতা। তাই মেনকার মন জয় করতে মরিয়া হয়ে ওঠে সে। কিন্তু কিছুতেই কাজ হচ্ছিল না। অটল পাহাড়ের মতো নিজ সিদ্ধান্তে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন মেনকা। ফলে জীবনের সবচেয়ে নির্মম সিদ্ধান্তটা নেয় কবির। শেষবারের মতো মেনকাকে তার ভালোবাসা নিবেদন করে তার কাছে আসতে চায়। কাজ হলে ভালো, না হলে সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন।
পরিকল্পনামতো ঘটনার আগের দিন বুধবার রাতে মেনকার মোবাইলে ফোন দেয় কবির। সে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বলে, আগামীকাল আমার সিঙ্গাপুরের ফ্লাইট। তোমার সঙ্গে শেষবারের মতো একটু দেখা করতে চাই। সরলতা নারীর মাতৃপ্রদত্ত গুণ। এই গুণের সুবিধা নিয়ে কত মানুষ যে তাদের স্বার্থ সিদ্ধ করেছে, কোনও মানুষের পক্ষে তার হিসেব করা সম্ভব নয়। নারীসুলভ এই সরলতা ধ্বংসের চিরকুট হয়ে আসল মেনকার ঠিকানায়। কিন্তু তিনি তা বুঝতে না পেরে খুব সহজ ভাষায় পাঠ করলেন এই চিরকুটটি। অনুমতি দিলেন কবিরকে দেখা দেবার।
অনুমতি পেয়ে পরের দিন বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে বারোটার দিকে কবির মেনকাদের বাসায় আসে। কন্যার খুনের দূত কবিরকে স্বাগত জানান মা হাসিনা বেগম রব্বানী। চিরসত্য ভুলটি তিনি করে বসেন সেদিনও। একজন বেগানা পুরুষকে বসতে দেন একেবারে মেনকার ঘরে। তার বেডরুমে।
দুপুরে খানাদানাও হলো মেনকার সঙ্গে। খানা খাওয়া শেষ করে আবার মেনকার কক্ষে মেনকা ও তার মা মিলে কবিরের সঙ্গে আলাপচারিতায় লিপ্ত হলেন। কিছুক্ষণ পর মা বললেন, তোমরা কথা বলো, আমি একটু বিশ্রামে যাবো। হিংস্র হায়েনার মুখে কলজেছেঁড়া ধন মেয়েকে অসহায়, একা ফেলে মা চলে গেলেন বিশ্রাম করতে! সম্ভবত এই একটি ভুলের জন্য সারা জীবন ক্রন্দন করতে হবে তাকে, আঁখিজলে সিক্ত করবেন স্নেহের আঁচল।
এবার বাঁধহীন স্বাধীনতা পেয়ে যায় কবির। মেনকাকে ঘরে একা পেয়ে দানব হয়ে যায় সে। ফরিদপুরের গ্রামের বাড়ির পাশের গ্রামের এক কর্মকারের কাছ থেকে আড়াইশ টাকা দিয়ে সে একটা ছোরা বানিয়ে এনেছিল। সেটি মেনকার বিছানার এক পাশে রেখে কবির জানতে চায়, তুমি আমাকে এড়িয়ে চলছো কেন?
কিছুক্ষণ চুপ থেকে মেনকা বলে, বুয়েটের এক ছাত্রকে আমি ভালোবাসি। তার সঙ্গেই আমার বিয়ে হবে। একথা শুনে পরিত্যাজ্য প্রেমিকের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। সে ছুরি দেখিয়ে বলে, এই ছুরি দিয়ে তোমাকে এবং তোমার মাকে হত্যা করব!
কবিরকে মৃত্যুদূত ভাবতে কষ্ট হয় মেনকার। একজন ভালোবাসার মানুষ- যদিও তা সাবেক এবং এখনও সে নাকি মেনকাকে ভালোবাসে- তার দ্বারা রক্তপাতের আশা করা যায়! তাই মেনকাও তা করেন নি। শিশু বাচ্চার মতো হো হো করে হেসে উঠেন তিনি। কারণ, ভালোবাসার মানুষকে হত্যা করার হুমকিকে নিরস কৌতুক ছাড়া আর কী-বা ভাবা যেতে পারে?
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেবরকে- চাই সে খালার দেবর হোক-না কেন- মৃত্যুর সঙ্গে তুলনা করেছেন। কিন্তু সে খবর মেনকার থাকলে তো! তাই এই হুমকি পাওয়ার পরেও বাঁচার কোনও চেষ্টা করলেন না তিনি।
আল্লাহর বিধান লঙ্ঘনে পটু কবিরদের কোন কিছুতে বাঁধে না। তাই সত্যি সত্যিই ছুরি ব্যবহারের কার্যকারিতা দেখায় সে। প্রথমে সে মেনকার পেটে আঘাত করে। এরপর চলে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত। অসহায় নিরস্ত্র মেয়েটি বাঁচার জন্য তার শেষ অস্ত্র ব্যবহার করেন। চিৎকার দিয়ে ওঠেন সর্বশক্তি ব্যয় করে। চিৎকার করে ডাকেন মাকে। প্লাবিত রক্ত আর কন্যার আর্তচিৎকারের পর কোনও মা কি পারেন আরাম করতে? শুনেছি, অনেক দূরে থাকলেও নাকি মায়েরা সন্তানের বিপদের কথা আঁচ করতে পারেন। মেনকার ‘মা’ ডাক আর আর্তচিৎকার তাই আঘাত করে মেনকার মায়ের কলিজায়। তিনি ঘুম থেকে উঠে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলতে বলেন। তিনি বাইরে থেকে শুনতে পান বুকের ধন মেয়ের আত্মচিৎকার, মা মা আর বাবা শব্দের হৃদয়বিদারক ডাক। শুনতে পান মেয়ের দেহ থেকে ফিনকি দিয়ে গড়িয়ে পড়া রক্তের কলকল ধ্বনি। তাই তিনি মাতৃকূলের সব মমতা আর উদ্বিগ্নতা নিয়ে কবিরের তরে দরজা খোলার আকুতি জানান। কিন্তু কবির তাতে কর্ণপাত করে নি। কেন সে করবে? সে যে আজ চেনা সেই কবির নয়- মৃত্যুদূত!
মায়ের সাধ্য হলো না অন্তিমপথের যাত্রী কন্যার মুখে এক ফোঁটা পানি তুলে দিতে। কারণ, তিনি একজন নারী। আর একজন নারীদেহে ঘরের শক্ত দরজা ভাঙার মতো শক্তি থাকার কথা নয়! এভাবে কেটে যায় কিছুক্ষণ। মহাকালের পথের পথিকের খাতায় নাম রেজিষ্ট্রেশন করার কাজ শেষ হয় মেনকার। মৃত্যু নিশ্চিত করে দরজা খুলে পাহলোয়ানের মতো গর্বভরে কবির বলে, আমি আপনার মেয়েকে খুন করেছি। পুলিশে খবর দেন!
এভাবে রচিত হয় একটি বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড। মেধাবী মেনকার রক্তে ভেসে যায় নিজেরই কক্ষ। মা-বাবার একমাত্র কন্যা মেনকা ভালো মেয়ে ছিলেন। তার নামে কোনও খারাপ রিপোর্ট ছিল না। গর্ভধারিণী মাও তাকে ভালো মেয়ে বলে আখ্যায়িত করেছেন। মহল্লার লোকেরাও তা-ই বলেছে। ইডেনে পড়াশোনার পাশাপাশি এফ এম ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এন্ড কলেজে শিক্ষকতা করতেন তিনি। সেই স্কুলের সহকর্মীরাও তাকে ভাল মেয়ে বলে রায় দিয়েছেন। শিক্ষক রাশেদুল এবং কারী মোঃ রাশেদুল ইসলাম বলেন, ‘এক বছর মেনকা তাদের সঙ্গে শিক্ষকতা করেছেন। তার মতো ভালো, ভদ্র ও মার্জিত শিক্ষক কমই চোখে পড়েছে।’
তো সকলেই তাকে ‘ভালো মেয়ে’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। কিন্তু তারপরেও তাকে কেন এই অশুভ পরিণতির শিকার হতে হলো? কী এক শূন্যতা, অপূর্ণতা ভর করেছিল তার জীবনে? পাঠক! আমার সঙ্গে একমত হবেন কী যে, সেই শূন্যতাটা ছিল পর্দা? অভিশপ্ত মুক্তবাসই কী কবিরকে তার রক্তপিয়াসী করে তুলেছিল না? যদি পর্দার বিধান পালিত হতো, নিজেকে যদি তিনি কবিরের বিষাক্ত দৃষ্টি থেকে দূরে রাখতেন, সে তার প্রতি আকৃষ্ট হতো না, দেবর হিসেবে যতটুকু সম্মান ইসলাম তাকে দিয়েছে, ততটুকুর মধ্যেই তার পরিবার সংক্ষেপিত থাকতেন, তাহলে কী এমন একটি করুণ মৃত্যু আমাদেরসহ সকলের চোখের পানি ঝরাতো? পর্দার বিরুদ্ধে জেহাদে নামা এই সমাজের কে দেবে এমন একটি নির্মম প্রশ্নের সঠিক জবাব?
– আবু বকর সিরাজী