আত্মোপলব্ধি
ব্যথার কথা
সূরা আলে ইমরানে আল্লাহ বলেন,
“তারা তাদের মুখ দিয়ে সেসব কথা বলে যা তাদের হৃদয়ে নেই।” (সূরা আলে ইমরান: ১৬৭)
আমাদের পুণ্যবান সালাফগণ বলতেন, “মুখের কথা কান পর্যন্তই পৌঁছে, কিন্তু অন্তরের কথা, অন্তরে গিয়ে কড়া নাড়ে।”
আজকাল অনলবর্ষী ভাষণ ও ভাষার অলংকারে অলংকৃত বক্তৃতার অভাব নেই, অথচ সেগুলো শ্রোতার মনে বিন্দুমাত্র দাগ কাটতে পারে না। কতই না বই ও প্রবন্ধ লেখা, যেগুলো কুরআনের আয়াত, উক্তি আর সাক্ষ্যপ্রমাণে ভরপুর, কিন্তু তবুও সেগুলো ব্যর্থ হয় পাঠকদের একটু নাড়া দিতে! কত কবিতার স্তবক লিখা হয় তবুও সেগুলো লোকেদের অন্তরে কোনো প্রভাব রাখতে ব্যর্থ হয়। যেন সেগুলো শক্ত বরফচাঁইয়ের উপর পতিত হয়ে টপটপ করে গড়িয়ে পড়া ঠান্ডা পানির ফোঁটা। কত সালাহ আদায় করা হয় কুরআনের শ্রুতিমধুর সুললিত তিলাওয়াতে, তবু সেটা মানুষের জমে যাওয়া অন্তরকে ঈমানের দীপশিখায় এতটুকু গলাতে পারে না, পারে না চোখের কোণে এতটুকু অশ্রু এনে দিতে।
অথচ ‘উমার বিন খাত্তাব যখন সালাতে দাঁড়িয়ে কুরআন তিলাওয়াত করতেন, তিনি ও তার মুসল্লীরা এত বেশি করে কাঁদতেন যে পেছনের কাতার থেকে ফোঁপানোর আওয়াজ শোনা যেত, কেন? তার কাছে যে কুরআন ছিল তা কি আমাদের কুরআন থেকে আলাদা কিছু?
নবী-তনয়া ফাতিমা আয-যাহরা (রাঃ) যতবার আল্লাহর কথা বলতেন ততবার কেন তার নারী শ্রোতাদের চোখে পানি চলে আসত? তিনি যে আল্লাহর কথা বলতেন, সেই আল্লাহর কথা তো আমরাও বলি, তবু আমাদের কেন এমন হয় না?
কেন ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারাকের লেখা কবিতার আলোচিত সেই পঙক্তি – হে দুই হারামের প্রার্থনাকারীরা – শুনে ‘আলিম ফুদাইল বিন ইয়াদের হৃদয় এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে চোখ যেত ভিজে? অথচ এমন হাজারো পংক্তি আজ শুধু বইয়ের পাতায় নিষ্প্রাণ চেয়ে থাকে।
আর কেনই বা ইবন তাইমিয়া, ইবন আল ক্বাইয়িম, ইবন আন-নুহাস, সায়্যিদ ক্বুতুব, আব্দুল্লাহ আযযাম প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের বই বিশ্বের কোটি মানুষকে উজ্জীবিত ও প্রেরণা দান করতে থাকে, অথচ তাদের থেকেও জ্ঞানী লেখকদের লেখা এমন প্রচুর বই আছে যেগুলো বইয়ের দোকানের তাকেই পড়ে থাকে, কদাচিৎ মানুষ সেগুলো পড়ে?
এর কারণ হল, এই মানুষগুলো যখন কিছু বলেন, লেখেন বা আবৃত্তি করেন, তাদের হৃদয়ের বেদনা, ত্যাগ আর কষ্টের কথা সেই লেখনী, কথন আর আবৃত্তিতে ভেসে ওঠে। যে ব্যক্তি তার হৃদয়ে, তার শিরায়, তার রক্তে ব্যথা অনুভব করেন, তিনিই পারেন তার কথার দ্বারা তার আবেগকে শ্রোতার হৃদয়ে ঢেলে দিতে। যে লেখক, যে গল্পকার তার জীবনে কোনো পরীক্ষা বা কষ্টের সম্মুখীন হননি, তিনি কেবল কথার পর কথাই বলে যান। না থাকে সেই কথার কোনো মূল্য, না থাকে সেই কথায় কোনো প্রাণ। কেননা, তাদের এই কথার জন্ম তো হয়েছে আরাম-আয়েশের মাঝে বেড়ে ওঠা নিষ্প্রাণ এক হৃদয়ে। তাদের কথাগুলো তাদের মুখের কথা, কলমের কথা, জিহবার কথা। কিন্তু মনের কথা নয়, আবেগের কথা নয়। যদি তারা প্রাঞ্জলতম আর অলংকারপূর্ণ সব শব্দ দিয়েও তাদের কথা সাজায়, তবুও, বাস্তবতা হল তাদের শরীর ও মন সে কথাগুলোর উপর ‘আমল করেনি। তাদের কথাগুলো বরফের টুকরোর মতো। শীতল ও কঠিন এই শব্দগুলো কোমলতম হৃদয়েও বিন্দুমাত্র আলোড়ন সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়।
আর অন্যদিকে আছে একদল সত্যিকারের মু’মিন, যেমন সাহাবাগণ (রাঃ) এবং সেসব ব্যক্তি যারা ন্যায়ের পথে সাহাবীদের অনুসরণ করেছেন, করছেন এবং ক্বিয়ামত দিবস পর্যন্ত যারা সাহাবীদের অনুসরণ করে যাবেন। তারা ও তাদের আপন লোকেরা অনুভব করেছেন ক্ষুধা, তৃষ্ণা ও দারিদ্রের কষ্ট, তারা হয়েছেন প্রত্যাখাত, গৃহ ও দেশ থেকে হয়েছেন নির্বাসিত। তারা প্রিয়জন থেকে দূরে থাকার বিরহ ভোগ করেছেন, বঞ্চিত হয়েছেন পার্থিব সব ভোগ্যবস্তু থেকে, বরণ করে নিয়েছেন বন্দীত্ব, নির্যাতন, শারীরিক ও মানসিক কষ্ট এবং মৃত্যুর জ্বালা। এজন্যই তারা জান্নাতের পথে জ্বলন্ত মশাল।
“এরা হচ্ছেন তারা যাদের আল্লাহ পথ প্রদর্শন করেছেন। অতএব, তাদের উদাহরণ হতে শিক্ষা নাও” (সূরা আন’আম:৯০)
এই চরম কষ্ট, অনুভূতি আর আবেগের তীব্রতা আমরা উপলব্ধি করতে পারি সাইদ কুতুবের (রহিমাহুল্লাহ) কথায়, যিনি তার কথার উপর ‘আমল করে জীবন দিয়েছেন। তার সেই বিখ্যাত উক্তি:
“নিশ্চয়ই আমাদের কথাগুলো থেকে যাবে প্রাণহীন, নিস্ফলা, আর ভাবাবেগহীন, যতদিন না আমরা সেই কথাগুলোর উপর ‘আমল করে মৃত্যুবরণ করি, আর তখনই আমাদের কথাগুলো জীবন্ত হবে, আর মৃত অন্তরে প্রাণের সঞ্চার করবে, তাদেরকে করে তুলবে সজীব ও প্রাণবন্ত…”
অনলাইনে প্রথম প্রকাশ : ( http:/bit.ly/2Cy2P48 )