মোহাম্মদ (সা.) সত্য রাসুল এবং মৃত্যুর পর প্রত্যেককে সৃষ্টিকর্তার কাছে সকল কর্মের জবাবদিহি করতে হবে- এতে কোন সন্দেহ নেই।
নিশ্চয়ই এই মহাবিশ্বের মহাবিস্ময় ‘আমি’। ‘আমি বেঁচে আছি’- এর চেয়ে আশ্চর্য এই মহাবিশ্বে আর কি-ই বা হতে পারে? আমার কাছে আমি গুপ্ত আবার প্রকাশ্য। নীজের ‘আমি’-কে যখনই বোঝতে এবং জানতে আত্মনিয়োগ করা হয়, জটিলতার পর্দা ততই মজবুত হয়ে চিন্তাশক্তি ও অনুভূতির কাছে এসে উপস্থিত হয়। এই জ্ঞান অর্জন করার সুনির্দিষ্ট পন্থা কি? কোথা থেকে শুরু এবং কিভাবে শুরু? আমি কে? আমি কি? আমি কেন? আমি কিসের তৈরি? আমি কিভাবে তৈরি? শুক্রানু এবং ডিম্বানুর মিশ্রনেই কি আমি? প্রকৃতি কি আমায় তৈরি করিয়াছে নাকি আমি নিজেই নিজেকে সৃজিত করিয়াছি? আমার জীবনের লক্ষ্য কি?…… উত্তরগুলোর জানার উপায় কি? আছে কোন গুরু বা শিক্ষক যিনি এর উত্তর দিতে পারেন?
এই বিষয়ে কেউ যদি নিজ সাধনায় ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ কিছু জেনে থাকেন, সে অন্য কাউকে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না কারন এই দুনিয়ায় এই জ্ঞান দেওয়ার বা প্রকাশ করার কোন মাধ্যম নেই। শুধুমাত্র কিছু মনীষী আংশিক পথটি বলে দিতে পারেন কিন্তু কাউকে বোঝানো বা কারো মস্তিষ্কে এবং অন্তরে স্থাপন করে দিতে পারেন না। ইহা আত্মনিয়োগের মাধ্যমে ভিতরের সত্তা জাগ্রত করার মাধ্যমে অর্জন করতে হয়। জন্ম/মায়ের গর্ভ থেকেই দেহ নামক বস্তুর ভিতরে ‘আমি’-কে গুপ্ত করে ফেলা হয়। তারপর প্রকৃতির স্বাভাবিকতার পর্দার দ্বারা মজবুত করে গুপ্ত ‘আমি’-কে মুড়িয়ে ফেলা হয়। আর এই প্রকৃতির স্বাভাবিক পর্দা আমাদের চিন্তা ও অনুভুতির সীমাবদ্ধতার দেওয়াল সৃষ্টি করে দেয়। আত্মনিয়োগ ও আধ্যাত্মিকতার মাধ্যেমে এই সীমাবদ্ধতার দেওয়ালের বাহিরে গিয়ে আমি-কে আংশিক জানা যায়। আবার সেই আংশিক টুকুও পর্দার প্রাচীর দিয়ে মোড়ানো যার বাহিরে যাওয়া কোন মনীষীর পক্ষে সম্ভব নয়; আত্মনিয়োগও- সে তার সীমানা অতিক্রম করার ক্ষমতা রাখে না।
পরম সত্তা-ই “আমি”-র উৎস। আধ্যাত্মিকতার মাধ্যমে পরম সত্তাকে অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ জানা গেলেও পরম সত্তার রহস্য এবং এঁর উৎস জানা কারো পক্ষে কখনই সম্ভব নয়। মৃত্যুর স্তর এবং তার পরের স্তর সম্পর্কে কেউ কিছু জানার ক্ষমতা রাখে না। পরম সত্তা থেকে নির্গত একটি নুরের শক্তি- “জী-সত্তা” নামে জ্ঞাত যা আমাদের মস্তিষ্ককে পরিচালিত করে। আবার এই জী-সত্তা একাকী নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে না, তার কার্য পরিচালনা করার জন্য ভিত্তির প্রয়োজন হয়। আর সেই ভিত্তি হল অন্তর। অন্তরের উপর দাঁড়িয়ে জী-সত্তা মস্তিষ্ককে ব্যবহার করে তার আপন কার্য পরিচালনা করে। জী-সত্তার অন্যতম শক্তিশালী গুণ হল বুদ্ধি আর অন্য গুণগুলো হল চিন্তা, খেয়াল, কল্পনা, স্মরণ এবং ধ্যান। সততা, মানবিকতা ও লজ্জ্বাশীলতার সাথে চিন্তাশক্তির সমন্বয়ে তৈরি হয় ‘বিবেক’। আর অন্তরই ইহ-জীবনের সব কিছুর আধার। গুণ একাকী বিরাজ করতে পারে না, গুণ থাকে গুণাধার বস্তুতে। ভালবাসা, দয়া, মায়া, ক্রোধ, লোভ, কাম, ঘৃণা, অহংকার, ঈর্ষা, বিদ্বেষ ইত্যাদি গুণগুলো থাকে গুণাধারে, আর সেই গুণাধার হল অন্তর। আধ্যাত্মিকতার স্তরে পরম সত্তাকে যখন কেহ অবলোকন করে, তখন আশ্চর্য হয়ে দেখে, ‘আমি’-কে বোঝে এবং বোঝার চেষ্টা করে, স্বর্গীয় পরম শান্তি অনুভব করে আর যখন কোন শ্রোতাকে ইহার বর্ননা করে, শ্রোতা অবাক হয়ে শুনে কিন্তু কিছুই বুঝিতে পারে না।
অন্তর একটি অত্যন্ত জটিল, দুর্বোধ্য এবং গুপ্ত। এর দরজা সর্বদা বন্ধ থাকে বিধায় এর সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। ধৈর্য এবং অভাবের চরমতা অন্তরের ভিতরে ঢুকে একটি স্তরে বিচরন করতে সক্ষম। আর এই ধৈর্য্য এবং অভাবের মাধ্যমে অন্তরের সুপ্রবৃত্তি এবং কুপ্রবৃত্তির ঘোড়া এবং বন্য কুকুরগুলোর(যেমনঃ খায়েশ, খেয়ালখুশী) লাগাম টেনে নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে অন্তরের বহিরাবরনের রূপ অনুধাবন করা যায়। জন্মের সময় শিশুর অন্তর থাকে চারাগাছ। জন্মের পর জী-সত্তা মস্তিষ্কের মাধ্যমে পঞ্চইন্দ্রিয়কে আয়ত্ব করার আগেই অন্তরে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘আকর্ষন’ আর তার আগে স্থাপিত হয় ক্ষুধার অনুভুতি। আকর্ষনের মাধ্যমে জী-সত্তা কর্মকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখা শুরু করে। দেহের বৃদ্ধির সাথে সাথে অন্তর নামক চারা গাছটি সকল প্রবৃত্তিকে ডালপালা বানিয়ে বেড়ে উঠতে থাকে। অন্তর অত্যন্ত শক্তিশালী। সে তার আপন গতিতে চলতে পছন্দ করে আর তার ধর্মই হল মজা লাগানো এবং আরামে থাকা। মজা লাগানোর পাত্র থেকে ক্ষনিকের জন্যেও সে বের হতে চায় না। যখনই বিবেক বা বুদ্ধি বা বাহিরের পরিস্থিতির কারনে অন্তরকে মজা লাগানোর পাত্র থেকে সরানো হয়, তখনই এই সত্তা বিদ্রোহী হয়ে উঠে, শুরু করে যুদ্ধ। অন্তরের এই মজা লাগানোর পাত্রের ধরন এবং যুদ্ধের ফলাফলের উপর নির্ভর করে তৈরি হয় প্রত্যেকের ‘স্বভাব’ বা ‘চরিত্র’। অন্তর যখন মজা লাগানোর পাত্রে দৃঢ় ভাবে অবস্থান করে মস্তিষ্ক(জী-সত্তা)-কে গোলাম বানিয়ে ফেলে, তখনই আবির্ভাব হয় ‘মন’ নামক সত্তার। অন্তরের ‘মজা লাগানো’-র পাত্রেই শুরু হয় মনের জগত এবং তার বৈচিত্র। মনের বৈচিত্রের জগত বৃহত্তর, ব্যপক এবং জটিল। খেয়ালখুশি চিন্তা এবং খেয়ালখুশি কর্ম মনের জগতের অন্যতম ভয়ংকর ও বিপদজনক। এই খেয়ালখুশী অর্থসম্পদের আধিক্যের সাথে মিশে অহংকার, লোভ, জিদ, হিংসা ইত্যাদিকে বাহন হিসেবে ব্যবহার করে ভিতরের হিংস্র বন্য কুকুরগুলোকে জাগ্রত করে, অন্তর তার স্বাভাবিকতা এবং সুস্থ্যতা হারিয়ে ফেলে, গুণাধারের ভাল গুণাগুণগুলো নিস্তেজ হয়ে আসে। অন্তর মজা লাগানোর পাত্রে অবস্থান করে স্বভাবকে কঠোর করে এবং ধীরে ধীরে সে তার নিজের অবস্থান নিজেই দৃঢ় করে ফেলে। আর এই শ্রেনীর মানুষগুলো হল প্রকৃত প্রবৃত্তি পুজারী, নির্বোধ ও জ্ঞানহীন এবং এদের অন্তরই পর্দা দ্বারা আবৃত থাকে। এই শ্রেনীর মানুষ সত্য-কে উপলদ্ধি করার ক্ষমতা রাখে না।
উত্তম চরিত্রঃ এর সর্বপ্রধান বৈশিষ্ট ‘সত্যবাদিতা’। জীবনের প্রতিটি কর্ম এবং আচরনে মিথ্যার অস্তিত্ব না থাকা। ধৈর্য- জ্ঞানের জগতকে উন্মোচিত করে, প্রজ্ঞানকে প্রতিষ্ঠিত করে। প্রকৃতির স্বাভাবিক পর্দাকে ভেদ করার শক্তি ধৈর্য-রেই থাকে। অঙ্গীকার রক্ষা করা চরিত্রের অন্যতম গুন। রাগ দমন করা অত্যন্ত সাহসের কাজ। অর্থের লোভ, সম্পদ জমা করার লোভ, ক্ষমতার লোভ, নারী লোভ, খাবারের লোভ- অন্তরে যখন দৃঢ় ভাবে অবস্থান করে, মানবিক ও নৈতিকতার পতন শুরু হতে থাকে। আর অহংকার সকল পাপের ভান্ডার এবং জ্বালানী আর তুলনায় ইহা সৌরজগতের সূর্য। অহংকার, কুপ্রবৃত্তি সমুহকে দানব থেকে মহা-দানবে রুপান্তরিত করে। দয়া, সহানুভূতিশীলতা, মানবিক ও নৈতিকতাকে ধ্বংস করে, সাথে অন্তরকে অসুস্থতা ও কঠোরতার কারাগারে আবদ্ধ করে ফেলে। ক্ষমতা এবং অর্থ-সম্পদের আধিক্য অন্তরে অহংকার সৃষ্টির অন্যতম প্রধান কারন। উত্তম চরিত্রের অনুশীলনকারী সকল প্রাকারের লোভ-কে নিবারন করে আর অহংকারের প্রতি নিজ খেয়ালের মাধ্যমে সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রাখে। লজ্জ্বাশীলতা চরিত্রের অন্যতম শক্তিশালী খুঁটি। এই খুঁটির উপর ভিত্তি করে তৈরি হয় প্রত্যেকের ‘ব্যক্তিত্ব’। আগুন যেমন কাঠকে পুড়িয়ে কয়লা করে দেয়, ঈর্ষা তেমনি অন্তরকে জ্বালিয়ে ছারখার করে ফেলে। একজন চরিত্রবান নিজের যা আছে তাই নিয়ে সন্তুষ্টি থাকে এবং তা দিয়ে ঈর্ষাকে পরাভূত করে। লাঞ্চনা, গঞ্জনা, শারীরিক ও মানসিক আক্রমন, নিজের হক থেকে বঞ্চিত ইত্যাদির কারনে ক্রোধ, প্রতিশোধ পরায়নতা অন্তরে আস্তানা গেঁড়ে নেয় এবং এর প্রভাবে স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হয়। ক্রোধ সর্বদা দাঙ্গা হাঙ্গামা, খুনখারাবী, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার মাধ্যমে চিন্তা ও কর্মকে আচ্ছাদিত করে ফেলে। সকল প্রকার ক্রোধ, প্রতিশোধ পরায়নতা অন্তর থেকে দূর করার ঔষধ হল ক্ষমা। ক্ষমা করার মাধ্যমে অন্তর পবিত্র হয়, এইজন্যই ক্ষমা একটি স্বর্গীয় গুন হিসেবে চিহ্নিত। অন্যের উপকারে আত্মনিয়োগ করা, গীবত-সমালোচনায় মজে না থাকা, অন্যকে কষ্ট দিয়ে কথা ও কর্ম না করা, অপ্রয়োজনীয় কথা না বলা, খেয়ালখুশী কর্ম না করা উত্তম চরিত্রের লক্ষন। সকল প্রকার কামনা, খায়েশ, পছন্দের দ্বারা আত্মতৃপ্তির পাত্র থেকে নিজ অন্তরকে দূরে রাখে। পরিবার-প্রতিবেশীদের কাছে নম্রতা ও মিষ্টভাষীর দ্বারা নিজেকে নিবেদন করে, সংসারের কাজকর্ম নিজেই সমাধা করে এবং সর্বদা সৎ কর্ম করে। দয়া, সহিষ্ণুতা এবং বিনয়ী উত্তম চরিত্রের গুন।
একজন নবী বা রাসুলের চরিত্র হতে হয়, উত্তমের উত্তম। মোহাম্মদ(সা.) নবুয়্যত পাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সকলের কাছ থেকে প্রতিষ্ঠিত ভাবে ‘সত্যবাদী’ উপাধি পেয়েছিলেন। কেউ কখনও তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করেনি, সন্দেহ করেনি। দুনিয়ার যে কোন ব্যক্তির চরিত্রের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এবং গ্রহনযোগ্য সার্টিফিকেট দিতে পারেন নিজ সহধর্মিনী। প্রত্যেক সহধর্মিনী নিজ নিজ স্বামীর স্বভাব সম্পর্কে সবচেয়ে বেশী জ্ঞাত। তারপর পরিবার, বন্ধু, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী এবং যারা লেনদেন করেন। সহধর্মিনী খোদেজা(রা.)-র চেয়ে মোহাম্মদ(সা.)-কে কে বেশী চিনা এবং জানার জ্ঞান রাখেন? একজন স্ত্রীর যদি স্বামীর চরিত্র সম্পর্কে অনু পরিমান সন্দেহ প্রবণ হয়, তাহলে সেই স্ত্রী কখনই তার স্বামীকে রাসুল হিসেবে স্বীকৃতী দিবেন না; তা স্বামীর প্রতি প্রেম-ভালবাসা এবং সম্মান যতই থাকুক। খাদিজা(রা.) সর্বপ্রথম মোহাম্মদ(সা.)-র উপর ঈমান এনে মুসলমান হন। তারপর পরিবারবর্গ, বন্ধুগন মুসলমান হন যারা মোহাম্মদ(সা.)-কে জানেন।
যিনি উত্তমের উত্তম চরিত্রের অনুশীলন করেন, তিনি কখনও মিথ্যা বলতে পারেন না। চাঁদ আর সূর্য এক হতে পারে না, সত্য ও মিথ্যা এক হতে পারে না। একজন উত্তম চরিত্রের অনুশীলনকারী নিজেকে আল্লাহ্র রাসুল বলে পরিচয় দিয়ে মিথ্যার আশ্রয় নিতে পারেন না, কোরানকে আল্লাহ্র কিতাব বলে মানুষের সাথে প্রতারণা করতে পারেন না। একজন রাসুলের পক্ষে হাজার বছরের বেশি সময় ধরে বিশ্বের সকল মানুষের সাথে সবচেয়ে বড় মিথ্যা ও প্রতারণা করা কখনও সম্ভবপর হতে পারে না। মোহাম্মদ(সা.) তাঁর জীবনে জেনেশুনে এবং ইচ্ছাকৃতভাবে একটা মিথ্যা বলেছেন কিংবা অঙ্গিকার ভঙ্গ করেছেন কিংবা আমানতের খিয়ানত করেছেন কিংবা অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করেছেন বা নির্দেশ দিয়েছেন তা প্রমান করা গেলে, এই ইসলাম ধর্ম পৃথিবী থেকে বিলুপ্তি এবং ধ্বংস হওয়ার জন্য যথেষ্ট এবং এতে কোন সন্দেহ নেই। ইহা সহজ, সরল এবং সত্য। একজন মানুষ সারাজীবন সত্যের সহিত জীবন অতিবাহিত করলে- তাঁর আচরণ, কথা, জীবন নির্বাহ কেমন হবে তা বোঝা ও উপলদ্ধির জন্য প্রত্যেকের নিজ চিন্তাশক্তি এবং অনুভূতিই যথেষ্ট। তারপরও এই সত্য-কে সন্দেহমুক্ত করতে যারা অপারগ, তাদের কাছে নিশ্চিতই স্পষ্ট হবে- যারা উত্তম চরিত্রের অনুশীলন করেন। আর স্পষ্ট হবে না তাদের কাছে, যারা সংসারত্যাগী কিংবা অসুস্থ এবং কঠোর অন্তর ধারনকারী।
স্বাভাবিক অবস্থায় অন্তর সত্তা-টি অস্থিরতাকে ধারন করে না, করতে চায় না এবং পারেও না। ইহা সকলের জন্য চিরন্তন সত্য। সহজ ভাবে, দুনিয়ার সকল মানুষ অবশ্যই “মিথ্যা বলা”-কে অপছন্দ করে। কোন প্রতারক, মিথ্যাবাদী, দুশ্চরিত্রার সংস্পর্শে অন্তর যতটুকু অস্থির হয়ে উঠে, তার চেয়ে অনেক বেশী তিক্ততার সহিত অস্থির হয় কর্কশ, রুঢ় আচরণকারী এবং মূর্খদের সংস্পর্শে। আবার এই অন্তর-ই অহংকার, কামনা, হিংসা ইত্যাদির বশবর্তী হয়ে অন্তরকে মজা লাগানোর পাত্রে ঢুবিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে নিকৃষ্ট স্বভাবের মানুষদের সংস্পর্শে আসে এবং সে নিজেও এই নিকৃষ্ট গুণাবলীর অধিকারী হয়। অস্থিরতার ভিতরে অন্তর ধরে রাখা কেবল সম্ভবপর হয় তখনই, যখন কেহ তার অন্তরকে স্বাভাবিকতার অবরণ থেকে কঠোরতার আবরনে প্রবেশ করিয়ে স্বভাবকে কঠিন ও রুক্ষ করে। মোহাম্মদ(সা.) তাঁর সময় ছিল অন্ধকার ও মূর্খের যুগ। হত্যা, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, যুদ্ধ, ব্যভিচার, শিশু হত্যা, প্রতারণা, দস্যুতা, বিচারবিহীন সমাজ যা ছিল নিকৃষ্টতর এবং এক জঘন্য মানবিকতার অধঃপতন ও অনৈতিকতার সমাজচিত্র। যে কেহ তার স্বভাব বিরুদ্ধ কাজ করে না এবং স্বেচ্ছায় আশপাশের নির্বোধদের সংস্পর্শে যায় না। আর মোহাম্মদ(সা.) শুধু আরবের মূর্খ ও নির্বোধ জাতি নয়, কিয়ামত পর্যন্ত দুনিয়ার সকল মানুষের দায়িত্ব ও পথপদর্শক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। চরিত্রের সর্বনিম্ন স্তর থেকে বিশাল জনসমুদ্রকে চরিত্রের উন্নত স্তরে আরোহণ করার দায়িত্ব নিয়েছেন। এই মহান দায়িত্ব শুধুমাত্র রাসুলের পক্ষেই সম্ভব। ইহা সত্য, মহা-সত্য। মানুষ খুব কমই ইহা অনুধাবন করে।
সৃষ্টিকর্তা মানুষকে এক অনন্যরুপে সৃষ্টি করেছেন; অত্যান্ত নিখুতভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ‘আমি’ নামক সত্তা এই টাইম এবং স্পেস ডাইমেনশন মহাবিশ্বের বাসিন্দা নয় এবং এই সত্তা সকল যুক্তি ও কারনের উর্ধ্বে। এই সত্তাকে দেহ নামক বস্তুতে ভরে কিছু সময়ের জন্য এই দুনিয়ায় ভ্রমনে পাঠানো হয়েছে। জগতের এমন কিছু নেই যার দ্বারা অন্তর সন্তুষ্ট হবে বা হতে পারে। এই সত্তা তার নিজ আপন জাত নুরের জগতে না যাওয়া পর্যন্ত সন্তুষ্ট হবে না। ভাল এবং খারাপ গুনের সমন্বয়ে গুনাধার অন্তর-কে রুহের মাধ্যমে দুনিয়ায় পাঠানো হয়েছে পরীক্ষার জন্য। অবশ্যই ইহা রহস্যময় পরীক্ষা, কারন আমার কাছে ‘আমি’ গুপ্ত। একে দেওয়া হয়েছে চিন্তাশক্তি, বিবেক ও বুদ্ধি। তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে নিজ স্বাধীন ইচ্চাশক্তির ভিতর। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত চলতে থাকে প্রত্যেকের কর্ম। আর সেই কর্ম লিপিবদ্ধ হচ্ছে। প্রত্যেকে কি উপার্জন করছে নিজ কর্ম থেকে? সবাইকে সবার কর্মের হিসাব দিতে হবে সৃষ্টিকর্তার কাছে। ইহাই পরীক্ষা; এই পরীক্ষার জন্যই সৃষ্টিকর্তা মানুষ সৃষ্টি করেছেন, কর্মে কে শ্রেষ্ঠ? আল্লাহ্ এই জন্যই রাসুল পাঠিয়েছেন সবাইকে এই সতর্ক করার জন্য, কোরানের মাধ্যমে নির্দেশ দিয়েছেন কিভাবে জীবন নির্বাহ করতে হবে। যারা অহংকার, খেয়ালখুশী, অজ্ঞতা, আত্মতৃপ্তি, মায়া এবং মায়ার বাঁধনে আবদ্ধ হয়ে নিজের বাপ-দাদা থেকে প্রাপ্ত ধর্ম/নাস্তিকতা, পক্ষপাতিত্ব ইত্যাদি এবং অন্য যে সকল কারনের কারনে সত্যকে অস্বীকার করে, মোহাম্মদ(সা.)-কে রাসুল মেনে নিতে প্রত্যাখ্যান করে- তারা জেনে রাখুক যার উপর দাঁড়িয়ে আজ সে নিজ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে, এর কোনটিই তার নিজের নয়। ইহা ফাঁদ; মহা ফাঁদ। ‘সত্য’ এবং ‘জ্ঞ্যান’ প্রত্যেকের ভিতরে দৃঢ়তার সহিত স্থাপন করা হয়েছে। সকল সৃষ্টির বৃদ্ধির গোল্ডেন রেশিও, ডি এন এ, প্রোটিন অনুসহ মহাবিশ্বের যত সব ঘটনা ঘটছে, সবই সৃষ্টিকর্তার আদেশ এবং নির্দেশ। যারা প্রকৃতিকে নিজে নিজে কার্য সম্পাদানের উপায় দাবী করে- ইহা অতীব মন্দ ও অযৌক্তিক চিন্তা। সৃষ্টিকর্তার ক্ষমতা সম্পর্কে তাদের কোন ধারনাই নাই। তাদের বোঝশক্তি বড়ই দূর্বল; আর দূর্বল এই কারনেই যে তাদের অন্তর কঠোর। বক্ষস্থিত পর্দাই সৃষ্টিকর্তার অগনিত নিদর্শনকে প্রত্যাখ্যান করে। মৃত্যুর স্বাদ সবাই গ্রহন করিবে এবং খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে সে সত্য-কে চাক্ষুস দেখিতে পাবে যে বিষয়ে সন্দেহ করিত। আশ্চর্য রকম বুদ হইয়া দেখিবে নিজের ‘আমি’-কে। পরিস্কার হবে সকল নবী-রাসূলগনের উদ্দেশ্য; আরো পরিস্কার হবে নিজেদের খেয়ালখুশী, ঠাট্টা, তামাশা। সৃষ্টিকর্তার পাকরাও অতীব সূক্ষ্ম, অত্যন্ত কঠিন এবং মজবুত। সকলই জীবনের নির্ধারিত কালের শেষ সীমার দিকে ধাবিত হচ্ছে দ্রুতই; আর কখন সময় হবে নিজ অন্তরের পর্দাগুলো খুলে দেওয়ার? আর কখন সময় হবে আত্মজ্ঞানের মাধ্যমে সাবধান হওয়ার?