নাস্তিকতা

নাস্তিক্যবাদের মূলসূত্র ও আল্লাহর অস্তিত্ব

নিউটনের তৃতীয় গতিসূত্রে বলা হয়েছে ‘প্রত্যেক ক্রিয়ার সমান এবং বিপরীতধর্মী প্রতিক্রিয়া রয়েছে’। নিউটনের গতিসূত্রগুলো আজ সর্বজন স্বীকৃত এবং সেগুলোর উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞান আজ বহুদূর এগিয়েছে। দুনিয়াতে একজন ব্যক্তি অন্য কাউকে হত্যা করলে তার সমান ও বিপরীতধর্মী প্রতিক্রিয়া হ’ল- ঐ হত্যাকারীকেও হত্যা করা। নিউটনের উপরোক্ত সূত্রমতে কোন ব্যক্তি যদি দশজনকে হত্যা করে তাহ’লে তার এ ক্রিয়ার সমান ও বিপরীতধর্মী প্রতিক্রিয়া হবে তাকেও (হত্যাকারীকে) দশবার হত্যা করা। কিন্তু এটা দুনিয়াতে সম্ভব নয়। এজন্য অনেক সুপন্ডিত বিজ্ঞানী শেষবিচার দিবসের ব্যাপারে সুনিশ্চিত মতামত ব্যক্ত করেছেন, যেদিন এক মহাশক্তিধর সত্ত্বা তাঁর নিজস্ব আদালতে ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে সব মানুষের দুনিয়াতে সংগঠিত সকল ক্রিয়ার সমান ও বিপরীতধর্মী প্রতিক্রিয়া স্বরূপ শাস্তি ও পুরস্কার প্রদান করবেন। সেই মহাশক্তিধর সত্ত্বাই হ’লেন আল্লাহ তা‘আলা, যিনি হ’লেন এই বিশ্ব জাহানের সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা। পাশ্চাত্যে এমনকি প্রাচ্যেও অনেক ব্যক্তি আছেন যারা আল্লাহর অস্তিত্বের ব্যাপারে সন্দিহান। এজন্য বিষয়টি যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা এবং আলোচনার দাবীদার। আল্লাহর অস্তিত্বের প্রশ্নের সাথে জড়িত নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর উপর আলোচনা করা যরূরী :

১. নাস্তিক্যবাদের মূল সূত্র।

২. আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ আমাদের আদৌ প্রয়োজন কিনা?

৩. এ ব্যাপারে কোন ধরণের প্রমাণ প্রয়োজন?

৪. আল্লাহর অস্তিত্বের ব্যাপারে যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা।

৫. কুরআনের যুক্তিমালা।

এই পাঁচটা বিষয়ের উপর বিস্তারিত ব্যাখ্যার সুযোগ এখানে না থাকায় সংক্ষেপে এগুলোর উপর আলোচনা বিধৃত হ’ল-

১. নাস্তিক্যবাদের মূল সুত্র :

যারা নাস্তিক তাদের এমন কোন সর্বজনগ্রাহ্য যুক্তি-প্রমাণ নেই, যার ভিত্তিতে তারা কোন স্রষ্টার অস্তিত্বকে অস্বীকার করে। ইউরোপে নাস্তিক্যবাদের উন্মেষ ঘটে খ্রীষ্টান ধর্মের প্রতি বিতৃষ্ণার ফলশ্রুতি হিসাবে। খ্রীষ্টান ধর্ম এবং চার্চের প্রতি বিতৃষ্ণা এবং বিরুদ্ধতা সৃষ্টির পিছনে প্রধান দু’টি কারণ নিহিত ছিল-

(ক) বিজ্ঞানের নব নব আবিস্কারকে চার্চ বরাবরই বিরোধিতা করে এসেছে। খ্রীষ্টান ধর্ম তার আসল অবয়ব থেকে দূরে সরে বিকৃত অবস্থাকে অাঁকড়ে ধরেছিল, যার চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটে মধ্যযুগে। এজন্য মধ্যযুগ অন্ধকার যুগ হিসাবে চিত্রিত। চার্চ বা পোপের কড়া শাসনে জনগণ ছিল অতিষ্ঠ। এটা কালক্রমে তাদের মনে এক ধরণের বিপ্লবী মানসিকতার জন্ম দেয়। খ্রীষ্টান ধর্মের গোঁড়ামীর জিঞ্জির ভেঙ্গে মার্টিন লুথার এবং জন ক্যালভিনের নেতৃত্বে বেরিয়ে আসে নতুন ধর্মীয় উপদল- প্রটেষ্ট্যান্ট। একই সাথে সূত্রপাত হয় রেনেসাঁর। নিজের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বিলুপ্ত হওয়ার ভয়ে চার্চ বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারকে স্বাগত জানায়নি, বরঞ্চ অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিরোধিতা করেছে। বিজ্ঞান যদি বলেছে পৃথিবী গোলাকার, চার্চ বলেছে- না, পৃথিবী সমতল। চার্চের এই ভূমিকা জনগণকে, বিশেষ করে বুদ্ধিজীবী মহলকে ক্ষেপিয়ে তোলে দারুণভাবে। শুরু হয় চরম বিরোধিতা। চার্চ যেহেতু আস্তিকতায় বিশ্বাসী, সেহেতু বুদ্ধিজীবী মহল পাল্টা জবাব স্বরূপ নাস্তিকতার ধোঁয়া তোলে। তারা ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা এবং বিশ্বাসকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে শুধুমাত্র বস্ত্তনির্ভর জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্মেষ ঘটায়, যেখানে নাস্তিকতা এক বিশেষ কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। ডারউইনের বিবর্তনবাদ (Evolutionism) ফ্রয়েডের যৌনবাদ, বেনথাম ও মিলের প্রেয়োবাদ (Hedonism), কার্ল মার্কসের সাম্যবাদ (Communism), ওগ্যস্ত কঁৎ এর প্রত্যক্ষবাদ (Positivism), কান্টের নৈতিক তত্ত্ব (Moral Theory), এবং Categorical Imprerative প্রভৃতি ঐ একই ধারা থেকে উৎসারিত।

(খ) খ্রীষ্টান ধর্মের প্রতি বিতৃষ্ণা এবং বিরুদ্ধতা সৃষ্টির দ্বিতীয় কারণ হ’ল খ্রীষ্টান ধর্মযাজকদের নৈতিক অবক্ষয়। এরা একদিকে খ্রীষ্টান ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করত, অন্যদিকে যৌন কেলেঙ্কারী, দুষ্টু প্রকৃতির রাজাকে সমর্থন দান, ধনী-গরীবের অসমতা বিধানসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত ছিল। যা মানুষের মনে ধর্ম সম্পর্কে এক ধরণের ঘৃণার জন্ম দেয়। সাধারণ জনগণের একটা সহজাত প্রবণতা হ’ল কোন আদর্শের দিকে না তাকিয়ে বরঞ্চ ঐ আদর্শের অনুসারী এবং প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তিবর্গের দিকে দৃষ্টিপাত করা। খ্রীষ্টান ধর্মের ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটেছিল। পোপের নানান নেতিবাচক আচার-আচরণের কারণে মানুষের মনে খ্রীষ্টান ধর্ম-বিশ্বাসের প্রতি বিতৃষ্ণা দানা বেঁধে ওঠে, যেটা পরবর্তীতে নাস্তিকতাবাদের দ্বার উন্মোচন করে।

ইহুদী ও খ্রীষ্টানদের বিভিন্ন অপকর্মের প্রতি অংগুলি নির্দেশপূর্বক পবিত্র কুরআনে বিশদ বিবরণ এসেছে। যেমন-

আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই বহু (ইহূদী-নাছারা) পন্ডিত ও দরবেশ মানুষের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করে এবং লোকদের আল্লাহর পথ থেকে বিরত রাখে’ (তওবা ৯/৩৪)

নাস্তিকতার বিকাশের পিছনে উপরোক্ত কারণদ্বয় ছাড়াও আর একটা মনস্তাত্ত্বিক কারণ বিদ্যমান রয়েছে। পাশ্চাত্য সমাজে একজন সৃষ্টিকর্তা ও পরকাল অস্বীকার করে নতুন এক মতবাদ গড়ে তোলা হয়েছে। সেটা হ’ল এই যে, যেহেতু সৃষ্টি জগতের কোন স্রষ্টাও নেই, পরকাল বলতেও কিছু নেই। অতএব জীবন থাকতে এ দুনিয়াকে প্রাণভরে উপভোগ করতে হবে। কারণ মৃত্যুর পরতো সবই শেষ হয়ে যাবে। অতএব, খাও, দাও আর জীবনকে উপভোগ কর (Eat, Drink and Be Merry)। আরো বলা হয় যে, এ দুনিয়ার জীবনটা একমাত্র বেঁচে থাকার সংগ্রাম (A struggle for existence)।

যারা ধূর্ত ও বুদ্ধিমান একমাত্র তাদেরই বেঁচে থাকার অধিকার আছে (Survival for the fittest)। আর যে দুর্বল, হোক সে সৎ ও ন্যায়পরায়ণ, তার বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই।

স্রষ্টা ও পরকাল স্বীকার করলেই প্রবৃত্তির মুখে লাগাম লাগাতে হবে। সেচ্ছাচারিতা এবং উচ্ছৃঙ্খলতা বন্ধ করতে হবে, এবং অন্যায় ও অসাদুপায়ে জীবনটাকে উপভোগ করা যাবে না। উপরন্তু জীবনকে করতে হবে সুনিয়ন্ত্রিত ও সুশৃঙ্খল। আর তা করলে জীবনটাকে কানায় কানায় ভোগ করা যাবে না।

অতএব, আল্লাহ ও পরকালের অস্বিত্বকে অস্বীকার করার পিছনে এটাই ছিল মনস্তাত্ত্বিক কারণ।

২. আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ আমাদের আদৌ প্রয়োজন কিনা?

আল্লাহ মানুষকে বিবেক বুদ্ধি দিয়েছেন, যাতে করে স্রষ্টার অস্তিতেবর বিষয়টি চিন্তা ভাবনা করতে পারে। অহী পাঠিয়েছেন নবীদের মাধ্যমে, যাতে করে মহাসত্যকে উদ্ঘাটন করতে পারে। আবার ইচ্ছা শক্তি দিয়েছেন চাইলেই সে সঠিক পথে চলতে পারে, অথবা বাঁকা বা ভ্রান্ত পথকে বেঁছে নিতে পারে।

আল্লাহ বলেন, ‘আমরা তাকে সুপথ প্রদর্শন করেছি। এক্ষণে সে চাইলে কৃতজ্ঞ হবে কিংবা অকৃতজ্ঞ হবে’ (দাহর ৭৮/৩)

কাজেই আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণের প্রয়োজন রয়েছে। এই প্রয়োজনীয়তার কয়েকটা কারণ-

(ক) আল্লাহ আছেন এটা ধ্রুব সত্য। কিন্তু আল্লাহর অস্তিত্বের বিষয়টি দুনিয়াতে অনেকের কাছেই কুয়াশাবৃত্ত, যেহেতু এটা অনেক চিন্তা ও গবেষণার বিষয়। কাজেই এই ধ্রুব সত্যকে কুয়াশা ভেদ করে নতুন ভাবে উন্মোচন (Recover) করার জন্য আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণের প্রয়োজন রয়েছে।

(খ) আল্লাহপাক বিশ্বজাহান সৃষ্টি করেছেন, আর মানুষকে বানিয়েছেন সেরা জীব (আশরাফুল মাকলুকাত) হিসাবে। এসবের পিছনে নিহিত রয়েছে আল্লাহপাকের বিরাট এক উদ্দেশ্য। মানুষ হ’ল আল্লাহর গোলাম, আল্লাহ হ’লেন মানুষের প্রভূ; মানুষ হ’ল সৃষ্টি, আল্লাহ হলেন স্রষ্টা। শেষে সব মানুষকে তাদের স্রষ্টার কাছেই ফিরে যেতে হবে। এখন বান্দা হয়ে মানুষ যদি তার স্রষ্টা বা প্রভুকেই চিনতে না পারে, তাহ’লে তার জীবনের ষোল আনাই ব্যর্থ।

(গ) মনের মাঝে বদ্ধমূল সন্দেহ নির্মূল করার জন্য আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণের প্রয়োজন রয়েছে। অনেকে আল্লাহর অস্তিত্বকে কোনরকম স্বীকার করলেও মনে মনে সংশয় লালন করে থাকে। আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ যদি তারা পেয়ে যায় তাহলে সকল সন্দেহ-সংশয় বিদূরিত হয়ে তথায় দৃঢ় বিশ্বাস পয়দা হয়।

(ঘ) আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস বা ঈমানকে সুদৃঢ় করার জন্য আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণের প্রয়োজন। যারা আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাসী, তাদের কাছে যদি আরো যুক্তি এবং প্রমাণ এসে হাযির হয়, তাহলে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস আরো মযবুত হয়ে ওঠে। আল্লাহ যে মৃতকে জীবিত করতে পারেন- এ দৃঢ় বিশ্বাস ও প্রত্যয় হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর ছিল। তবুও মৃতকে জীবিত করার ক্রিয়া তিনি স্বচক্ষে দেখতে চান। পূর্ণ বিশ্বাসে পরিণত করে মানসিক প্রশান্তি লাভ করতে চান তিনি। তাই তিনি আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করলেন। আল্লাহ চারটি মৃত পাখিকে হযরত ইবরাহীমের (আঃ) চোখের সামনে পুনর্জীবিত করে দেখিয়ে দিলেন (বাকারাহ ২/২৬০)। ঈমান বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে-

‘নিশ্চয়ই মুমিন তারাই, যখন তাদের নিকট আল্লাহকে স্মরণ করা হয়, তখন তাদের অন্তর সমূহ ভয়ে কেঁপে ওঠে। আর যখন তাদের উপর তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয়, তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং তারা তাদের প্রতিপালকের উপর ভরসা করে (আনফাল ৮/২)

তুমি বলে দাও (হে অবিশ্বাসীগণ!), তোমরা কুরআনে বিশ্বাস আনো বা না আনো (এটি নিশ্চিতভাবে সত্য)। যাদেরকে ইতিপূর্বে জ্ঞান দান করা হয়েছে (আহলে কিতাবের সৎ আলেমগণ), যখন তাদের উপর এটি পাঠ করা হয়, তখনই তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়ে। আর তারা বলে, মহাপবিত্র আমাদের পালনকর্তা! আমাদের প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি অবশ্যই কার্যকরী হয়। আর তারা কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে এবং তাদের বিনয়চিত্ততা আরও বৃদ্ধি পায় (বনী ইসরাইল১৭/১০৭-১০৯)

৩. আল্লাহর অস্তিত্বের ব্যাপারে কোন ধরণের প্রমাণ প্রয়োজন?

আমরা প্রত্যক্ষ যা দেখি, তাইতো শুধু অস্তিত্ব নয়, যেটা অনুভব করি সেটাও অস্তিত্ব। আমাদের প্রত্যক্ষ দৃষ্টির সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমাদের দৃষ্টিপাতে একটা সমাপ্তি বিন্দু আছে। সুতরাং দৃষ্টির গোচরে যা আসছে তাই শুধু সত্য নয়, আমাদের দৃষ্টির অধিকারের বাইরেও অস্তিত্বের বিস্তার রয়েছে, যেটাকে আমরা মেনে নিই দৃষ্টিগত যুক্তির সাহায্যে। যেহেতু দৃষ্টি কতগুলো রং এবং রেখার চিহ্নিতকরণ করে, সুতরাং আমরা দৃষ্টির বাইরেও একই প্রকৃতির রং এবং রেখা যে থাকবে তা আমরা মেনে নিই। সবুজে আকীর্ণ বনভূমি শুধু আমার দৃষ্টির সীমায় যে আছে তা নয়, আমার দৃষ্টির বাইরেও তা আছে।

সুতরাং যাকে আমরা প্রত্যক্ষ করি, তার কিছুটা দৃষ্টির গোচরে থাকে, কিছুটা অগোচরে। গোচরীভূত সত্ত্বার যুক্তির সাহায্যে আমরা অগোচরকেও মেনে নেই।

প্রাণীকূলের মাঝে মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিক জীব হ’লেও মানুষের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিশাল আকারের তারকাকে আমরা ছোট জোনাকীর মত মিট মিট করতে দেখি। শুধুমাত্র ইন্দ্রিয় বা নিরীক্ষণ নির্ভর জ্ঞান এজন্য অপূর্ণ। মানুষ যে ইমপারফেক্ট সত্ত্বা, তার প্রমাণ এখানেই। মানুষের জীবনে ক্ষয় আছে, উত্থান-পতন আছে, আছে মৃত্যু। কিন্তু এ বিশ্ব জাহানের যিনি স্রষ্টা, তিনি চিরঞ্জীব-চিরস্থায়ী ও সর্বজ্ঞানী। অতীত বর্তমান ভবিষ্যত সবই তিনি জানেন। কাজেই তিনি সব দিক দিয়েই পারফেক্ট সত্ত্বা (Perfect Being)। একজন ইমপারফেক্ট সত্ত্বা পারফেক্ট সত্ত্বাকে দেখতে পারে না-এটাই স্বাভাবিক। (A perfect Being cannot be seen by an imperfect being)। এখন কেউ যদি বলেন- আল্লাহ্কে না দেখানো পর্যন্ত তাঁর অস্তিত্বে বিশ্বাস করব না, তাহ’লে নিঃসন্দেহে এটা একটা অযৌক্তিক দাবী হবে। কোন কিছু প্রমাণের জন্য যুক্তি দাবী করলে তার দাবীটাও যৌক্তিক হওয়া প্রয়োজন। হযরত মূসা (আঃ)-এর কাছে, এমনকি শেষ নবী (ছাঃ)-এর কাছেও অনেকে এরূপ অযৌক্তিক দাবী পেশ করেছিল। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে-

‘আহলে কিতাবরা তোমার কাছে আবেদন করছে যে, তুমি তাদের প্রতি আকাশ থেকে কোন কিতাব নাযিল করাও। বরং তারা মূসার কাছে এর চেয়েও বড় দাবী পেশ করেছিল। তারা বলেছিল যে, তুমি আল্লাহকে আমাদের সামনে প্রকাশ্যে দেখাও। তখন তাদের এই সীমালংঘনের কারণে প্রচন্ড নিনাদ তাদের পাকড়াও করে। অতঃপর তারা গো-বৎস পূজা শুরু করে তাদের নিকট স্পষ্ট প্রমাণাদি এসে যাওয়ার পরেও। অতঃপর আমরা তাদের মার্জনা করি। আর আমরা মূসাকে স্পষ্ট প্রমাণ দান করি’ (নিসা ৪/১৫৩)। আল্লাহ্ আরো বলেছেন, ‘অতঃপর যখন মূসা আমাদের নির্ধারিত সময়ে পৌঁছে গেল এবং তার প্রভু তার সাথে কথা বললেন (পর্দার অন্তরাল থেকে সরাসরি), তখন সে বলল, হে প্রভু! আমাকে দেখা দাও, আমি তোমাকে দেখব। তিনি বললেন, তুমি কখনোই আমাকে দেখতে পাবে না। বরং তুমি পাহাড়ের দিকে তাকাও। যদি সেটি তার স্থানে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে তুমি আমাকে দেখতে পাবে। অতঃপর যখন তার প্রতিপালক পাহাড়ে তার জ্যোতির বিকীরণ ঘটালেন, তা তাকে বিধ্বস্ত করে দিল। আর মূসা জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল। অতঃপর যখন মূসা জ্ঞান ফিরে পেল তখন বলল, মহাপবিত্র তুমি (হে প্রভু!)। আমি তওবা করছি এবং আমিই বিশ্বাস স্থাপনকারীদের প্রথম’ (রাফ ৭/১৪৩)

কাজেই সরাসরি নিরীক্ষণের মাধ্যমে স্রষ্টাকে দেখা সম্ভব নয়। সৃষ্টির মধ্যে স্রষ্টার অস্তিত্ব খুঁজতে হবে। স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণের নিরিখে অনেকে বিভিন্ন রকম যুক্তি পেশ করেছেন। উক্ত যুক্তিগুলো কারো মনোপুত না হ’লেই স্রষ্টার অস্তিত্বের ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করাটা কখনো সমীচীন নয়।

আইন শাস্ত্রের একটি বিশ্বজনীন সূত্র হ’ল- ‘কোন জিনিস প্রমাণের নিমিত্তে পেশকৃত যুক্তিগুলো গ্রহণযোগ্য না হওয়ার অর্থ এই নয় যে উক্ত জিনিসটা ভুল’। যেমন- বাতাসে গাছের পাতা নড়ে। এটা প্রমাণের জন্য কেউ অনেকগুলো যুক্তি (দলীল) পেশ করল, কিন্তু যুক্তিগুলো গ্রহণযোগ্য হ’ল না। এর অর্থ এই নয় যে, বাতাসে গাছের পাতা নড়ে না।

কিন্তু সুস্পষ্ট যুক্তি-প্রমাণ পেশ করার পরও অনেকে একগুঁয়েমী, অহমিকা এবং ব্যক্তিস্বার্থের কারণে স্রষ্টার অস্তিত্বকে অস্বীকার করে। কেউ যদি কোন সত্যকে গ্রহণ না করার ব্যাপারে প্রথমেই মানসিকভাবে প্রস্ত্তত থাকে, তাহ’লে তাঁর সামনে হাযারো যুক্তি পেশ করলেও সে তা প্রত্যাখান করবে। এদের সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে-

(১) আমরা বহু জিন ও ইনসানকে সৃষ্টি করেছি জাহান্নামের জন্য। যাদের হৃদয় আছে কিন্তু বুঝে না। চোখ আছে কিন্তু দেখে না। কান আছে কিন্তু শোনে না। ওরা হল চতুষ্পদ জন্তুর মত, বরং তার চাইতে পথভ্রষ্ট। ওরা হ’ল উদাসীন’ (রাফ ৭/১৭৯)

(২) ‘ওরা বধির, বোবা, অন্ধ। ওরা ফিরে আসবে না’ (বাক্বারা ২/১৮)

(৩) ‘অতঃপর যখন সে (মুহাম্মাদ) স্পষ্ট প্রমাণাদী নিয়ে আগমন করল, তখন তারা বলল, ‘এতো এক প্রকাশ্য যাদু’ (ছফ ৬১/৬)

৪. আল্লাহর অস্তিত্বের ব্যাপারে যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা :

‘আল্লাহ্কে পাওয়ার পথ সৃষ্ট প্রাণীকূলের সমান’- এক শ্রেণীর বিশেষজ্ঞদের মুখে মুখে এই কথাটি প্রচলিত। এক কথায় তার অর্থ হচ্ছে- আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণের দলীল একটি দু’টি নয়, দশ বিশ একশ’ নয়। তা তত, যত সংখ্যার প্রাণী এই দুনিয়াতে আছে। কথাটি যথেষ্ট বিস্ময়োদ্দীপক। বিশেষ করে যারা আল্লাহ সম্পর্কিত জ্ঞানের গভীরতা অর্জন করতে পারেনি, যারা তাওহীদের নিগুঢ় তত্ত্ব আয়ত্ব করতে অক্ষম, তাদের ব্যাপারে উক্ত কথাটি কি করে সত্য হ’তে পারে? এই জগতের প্রতিটি অণুর মধ্যে যে ব্যবস্থা সদা কার্যকর, তাঁর প্রত্যেকটিই আল্লাহর অস্তিত্বের অকাট্য প্রমাণ।

আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণের পক্ষে অগণিত যুক্তি-প্রমাণের মধ্যে কয়েকটি পেশ করা যরূরী। টমাস একুইনাস (১২২৫-১২৭৪) এ ধরণের ৫টি যুক্তি বা দলীল উপস্থাপন করেছেন-

(১) পরিবর্তন/গতিশীতলতার দলীল : দুনিয়ার সব বস্ত্তই পরিবর্তন হচ্ছে। বস্ত্ত নিজেই নিজেকে পরিবর্তন করতে পারেনা। এক বস্ত্ত অপর বস্ত্ত বা সত্ত্বা দ্বারা পরিবর্তিত হয়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ এভাবে বলা যায়- বস্ত্ত অপরিবর্তিত হয় ‘ই’ দ্বারা, আবার ‘ই’ পরিবর্তিত হয় ‘ঈ’ দ্বারা। প্রক্রিয়াটি চলতে চলতে এমন এক পর্যায়ে এসে থেমে যাবে, যেখানে এমন এক সত্ত্বা আছেন বা প্রয়োজন, যিনি পরিবর্তনের সূচনাস্থল, কিন্তু তিনি নিজে পরিবর্তিত নন। এ পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় যদি কোন সূচনাকারী (Who is unmoved by something) না থাকতো তাহ’লে প্রক্রিয়া শুরু হ’ত না। এই সূচনাকারীই হ’লেন বিশ্ব স্রষ্টা আল্লাহ।

এরিষ্টটল ও তাঁর অনুসারী প্রাচীন পদার্থপ্রকৃতি বিজ্ঞানবিদগণও একই ভাবে বস্ত্ত ও গ্রহ-নক্ষত্রাদির গতিশীলতার জন্য একজন গতিদানকারীর অপরিহার্যতার দলীলের ভিত্তিতে আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণ করতেন। তাদের বক্তব্যের সারনির্যাস হচ্ছে, এই গতিশীল চলমান বিশ্বলোক ও আকাশমার্গীয় সত্ত্বাসমূহের জন্য এমন একজন গতিদানকারী অবশ্য প্রয়োজন, যিনি নিজে গতিশীলতা মুক্ত। ফর্মুলা হচ্ছে- ‘প্রত্যেকটি গতিশীল বস্ত্তর জন্য একজন এমন গতিদানকারী প্রয়োজন, যে নিজে গতিশীল নয়’।

(২) কার্য-কারণের দলীল : দুনিয়ার সব ঘটনাই কার্য-কারণ সম্পর্কে সম্পর্কিত। প্রত্যেক কার্যেরই কারণ রয়েছে। এই প্রক্রিয়ারও এক সূচনাকারী আছেন, যিনি নিজে সব কিছুর কারণ, কিন্তু নিজে কার্য নন (He causes everything, but He Himself is uncaused)। আর তিনি নিঃসন্দেহে আল্লাহ্।

(৩) নির্ভরশীলতা/অস্তিত্বের দলীল :কোন বস্ত্ত বা প্রাণীই নিজের অস্তিত্ব নিজে দিতে পারে না। বেঁচে থাকার জন্যও অন্যান্য অস্তিত্বশীল সত্ত্বার প্রয়োজন যিনি সব কিছুর অস্তিত্ব দেন, এবং সবকিছুই তাঁর উপর নির্ভরশীল, কিন্তু তিনি নিজে কারোর উপর নির্ভরশীল নন।

(৪) দুনিয়ার প্রত্যেক জিনিসের নিজস্ব যে গুণাগুণ থাকে তা অবশ্যই কোন অপেক্ষাকৃত বেশী গুণাগুণ সম্পন্ন জিনিস থেকে নিঃসৃত : কোন বস্ত্ত যদি গরম হয় তাহ’লে বুঝতে হবে তার উৎসস্থল হ’ল আগুন বা আগুনের তৈরী কিছু। এমনিভাবে প্রত্যেক সৌন্দর্য ও গুণাগুণের আলাদা উৎস রয়েছে।

দুনিয়াটা সৌন্দর্যের অপরূপ সম্ভারে সমৃদ্ধ। চারিদিকের দিবস-যামীনির পরিক্রমা, নীল আকাশের বুকে চন্দ্র-সূর্য গ্রহ-তারার অপূর্ব মেলা, পাহাড়ের মৌনতা, নদীর কুল কুল ধ্বনি, ফুল-ফলের হরেক রকম সুগন্ধ আর স্বাদে ভরপুর এক সীমাহীন সৌন্দর্যের অপরূপ কারুকার্য দিয়ে গড়া এই মোহনীয় বসুন্ধরা। এই সীমাহীন সৌন্দর্যের নিশ্চয়ই এক উৎস আছে, আর নিঃসন্দেহে তা হ’ল আল্লাহ রববুল আলামীন।

(৫) এই বিশাল সীমাহীন বিশ্বলোক এবং তার অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ব্যবস্থা এক চরম মাত্রার বিস্ময়কর বিষয় এ শৃংখলা নিয়ম বিশ্বলোকের প্রতিটি বস্ত্ত ও অণুকে পর্যন্ত গ্রাস করে আছে। কোন কিছুই তার বাইরে নয়, তা থেকে মুক্ত নয়। সর্বাত্মক ও সর্বব্যাপক নিয়ম শৃংখলা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর, যা বুদ্ধিমান ও চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গকে আল্লাহর সাথে পরিচিত করে দিচ্ছে। কেননা এ ধরণের সর্বব্যাপী ও চিরস্থায়ী নিয়ম শৃংখলা এক মহাপরিচালক বা সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণ শক্তি সম্পন্ন সত্ত্বা ব্যতীত চিন্তা করা যায় না।

উইলিয়াম পেলি (১৭৮৩-১৮০৫) কতৃক প্রদত্ত আল্লাহর অস্তিত্ব সংক্রান্ত তত্বটাও খুব বিখ্যাত। তাঁর তত্ত্বের নাম ‘ঘড়ি ও ঘড়ি নির্মাতা’ (The watch and watch-maker)। তাঁর বর্ণনা হ’ল- কোন খালি জায়গায় যদি আমরা একটি পাথর দেখি এবং নিজেকে প্রশ্ন করি- পাথরটা কিভাবে এখানে এল। জবাবে হয়ত বলব, প্রাকৃতিক কারণে এমনিতেই পাথরটি এখানে এসেছে। কিন্তু একটা ঘড়ি দেখে যদি একই মন্তব্য করি যে- কোন প্রাকৃতিক কারণে অনেকগুলো যন্ত্রপাতি একত্রিত হয়ে হঠাৎ একটি ঘড়ির রূপ ধারণ করেছে, তাহ’লে সেটা গ্রহণযোগ্য হবে না। ধরুন! ঘড়ির তিনটি কাঁটা (হাত) আছে, চেইন আছে, যেটা স্টীলের তৈরী, কাঁটাগুলো পরিমাপ এবং অবস্থানের নির্দিষ্ট মাত্রা ও স্থান রয়েছে ভিতরের সব যন্ত্রপাতি সুন্দরভাবে সাজানো।

কাটাগুলো রক্ষার জন্য ঘড়ির উপরিভাগে পাত দেয়া, সেটা আবার কাঁচের তৈরী যাতে কাটাগুলো দেখা যায়। কোন কাঁটা কি গতিতে ঘুরবে তারও সুনির্দিষ্ট মাত্রা রয়েছে। এসব কিছু দেখে সকলে এক বাক্যে স্বীকার করতে বাধ্য যে নিশ্চয়ই ঘড়ির একজন নির্মাতা আছেন। এক মিলিয়ন মানুষের মধ্যে একজনও এটা বলবে না যে, ঘড়িটা নির্মাতা ছাড়াই আপনা আপনি প্রাকৃতিক কারণে যন্ত্রপাতিগুলো দৈবক্রমে একত্রিত হয়ে সময় দেওয়ার জন্য হঠাৎ তৈরী হয়ে গেছে।

এবার আমরা মানুষ বা প্রাণীকূলের কোন একটির কথা চিন্তা করি। এগুলোতো ঘড়ির চেয়েও লক্ষ কোটি গুণ জটিল যন্ত্র। এগুলোরও যে নির্মাতা বা সৃষ্টিকর্তা আছেন- তার কোন সন্দেহ নেই। সর্বোপরি পৃথিবীর কথা আমরা চিন্তা করি। পৃথিবী গোলকের পুরুত্ব, সূর্য থেকে তার অবস্থান দূরত্ব, জীবন দায়িনী সূর্যতাপ ও আলো বিচ্ছুরণের মাত্রা, ভূপৃষ্ঠের ঘণত্ব (Thickness), পানীয় পরিমিতি, কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ, নাইট্রোজেনের ঘণত্ব- সবই সুনির্দিষ্ট পরিমাপ এবং পরিমান অনুসারে রয়েছে। পৃথিবীর এই সুন্দর ব্যবস্থাপনা নিঃসন্দেহে একজন নির্মাতার সুপরিকল্পিত সৃষ্টির ফলশ্রুতি।

৫. কুরআনের কিছু যুক্তিমালা :

কুরআন আল্লাহর অস্তিত্ব এবং তাঁর একত্ববাদের (তাওহীদ) ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। কোন রকম যুক্তি প্রমাণ ব্যতিরেকেই কুরআন মানুষকে আল্লাহর অস্তিত্ব স্বীকার করতে বাধ্য করেনি। আল্লাহর অস্তিত্বের ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে ভুরি ভুরি যুক্তি এবং প্রমাণ। এজন্য পবিত্র কুরআনকে আমরা প্রমাণের বই (The book of proof) বলতে পারি। আল্লাহর অস্তিত্বের ব্যাপারে কুরআনের অসংখ্য যুক্তিমালার মধ্যে কয়েকটা নিম্নে বর্ণিত হ’ল-

(১) ‘তারা কি  কোন কিছুই ছাড়াই সৃষ্টি হয়েছে, নাকি তারা নিজেরাই নিজেদের সৃষ্টিকারী’ (তূর ৫২/৩৫)

মানব সৃষ্টির ব্যাপারে কতকগুলো বিকল্প প্রশ্ন আল্লাহ্পাক এখানে উপস্থাপন করেছেন- (এক) তারা সৃষ্টিকর্তা ছাড়াই আপনা আপনি সৃষ্টি হয়েছে। অথবা (দুই) তারা নিজেরা নিজেদেরকে সৃষ্টি করেছে। অথবা (তিন) আল্লাহ এদেরকে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু আপনা আপনি মানুষ সৃষ্টি হ’তে পারে না; কোন জিনিসের পক্ষে নিজেকে সৃষ্টি করা সম্ভব নয়; অতএব, আল্লাহ্ই তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন।

আল্লাহ্পাক আরো বলেন ‘নাকি তারা নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছে? বরং তারা দৃঢ় বিশ্বাসী নয়’ (তূর ৫২/৩৬)। নাকি আল্লাহ্ ব্যতীত তাদের কোন উপাস্য আছে? অথচ তারা যাদের শরীক করে, আল্লাহ্ সেসব থেকে পবিত্র’ (তূর ৫২/৪৩)

(২) ‘আমরা সবকিছু সৃষ্টি করেছি পরিমাপ মোতাবেক’ (ক্বামার ৫৪/৪৯)

‘তিনি স্তরে স্তরে সাত আসমান সৃষ্টি করেছেন। দয়াময়ের সৃষ্টিতে কোন ত্রুটি দেখতে পাও কি? আবার দৃষ্টি ফিরাও। কোন ফাটল দেখতে পাও কি?’ ‘অতঃপর তুমি বারবার দৃষ্টি ফিরাও। তোমার দৃষ্টি ব্যর্থ ও ক্লান্ত হয়ে তোমার দিকে ফিরে আসবে’। ‘আমরা নিকটবর্তী (দুনিয়ার) আকাশকে প্রদীপমালা দ্বারা সুসজ্জিত করেছি এবং ওগুলির স্ফূলিঙ্গসমূহ শয়তানদের প্রতি নিক্ষেপ করি। আর শয়তানদের জন্য আমরা প্রস্ত্তত করে রেখেছি চূড়ান্ত দাহিকাশক্তিসম্পন্ন আগুনের শাস্তি’ (মুলক /৩-৫)

এই নিখিল জাহানের সুনিয়ন্ত্রিত শৃঙ্খলা বিন্যাস দেখলেই বুঝা যায় এটা আপনা-আপনি সৃষ্টি ও পরিচালিত হওয়া সম্ভব নয়। দুনিয়ার সব কিছুই পরিমিত রূপে সৃষ্টি করা হয়েছে। পৃথিবীর নিজ কেন্দ্র থেকে প্রতি ২৪ ঘন্টায় একবার আবর্তিত হয়। এই আবর্তনে তার গতি হচ্ছে ঘন্টায় এক হাজার মাইল। এই গতিমাত্রা যদি কমে গিয়ে ঘন্টায় এক মাইল হয়ে যেতো বা যায়, তাহ’লে রাত ও দিনের দৈর্ঘ্য বর্তমান অপেক্ষা বৃদ্ধি পেত। আর তাহ’লে গ্রীষ্মকালীন সূর্যতাপ দিনে দৈর্ঘ্যকালে সমস্ত উদ্ভিদ জ্বালিয়ে ভস্ম করে দিত। আর রাত্রীর দৈর্ঘ্যকালে শৈত্য ছোট ছোট গাছপালা ও গুল্মলতাকে বরফাচ্ছাদিত করে মেরে ফেলত।

পৃথিবীতে বর্তমানে যে সূর্যতাপ পৌঁছায়, তা যদি বর্তমানের অপেক্ষা অর্ধেক কমে যেত, তাহ’লে শীতের তীব্রতায় পৃথিবীর সব জীব জন্তু ধ্বংস হয়ে যেত। পক্ষান্তরে তার পরিমাণ যদি কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেত, তাহ’লে সমস্ত উদ্ভিদ মরে যেত, জীবনের শুক্রকীট ধ্বংস হয়ে যেত। ফলে কোন জীবের উন্মেষ বা জন্মলাভ সম্ভব হ’ত না।

পৃথিবী ও চাঁদের দুরত্ব যদি ৫০ হাযার মাইল কম হয়ে যেত, তাহ’লে দুনিয়ার নদী-সমুদ্রের জোয়ার-ভাটা এত প্রবলভাবে ছুটতো যে পানির নিকটবর্তী পৃথিবীর এলাকাসমূহ প্রতিদিনে দুবার করে প্রবল জলস্রোতে ডুবে যেত। তার স্রোত ও গতিবেগ এত সাংঘাতিক হ’ত যে পাহাড়গুলিকেও উপচিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যেত।

মহাজাগতিক আলোকোচ্ছটার যাতায়াতের জন্য যরূরী পরিমাণ বায়ুস্তর পৃথিবীকে গ্রাস করে রয়েছে। তাতে এমন সব রাসায়নিক উপাদান-উপকরণ রয়েছে তা কৃষিকার্যের জন্য একান্তই যরূরী। তা জীবাণু ধ্বংস করে এবং ভিটামিন উৎপাদন করে; কিন্তু তাতে মানুষের কোন ক্ষতি হয়না। পৃথিবী থেকে যুগ যুগ ধরে যে গ্যাস উদ্গীরণ ঘটে তার বিরাট অংশই বিষাক্ত। কিন্তু বায়ু তাঁর সাথে সংমিশ্রিত হয়ে দোষমুক্ত হয়না। মানুষের অস্তিত্বের জন্য যে ভারসম্যপূর্ণ অনুপাত প্রয়োজন তাতেও কোনরূপ ব্যতিক্রম ঘটে না।

আমরা যে বাতাস শ্বাসের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে টেনে নিই, তা বিভিন্ন গ্যাসে ভরপুর থাকে। তাতে নাইট্রোজেন থাকে ৭৮ ভাগ, আর অক্সিজেন থাকে ১২ ভাগ, বাকী অন্যান্য গ্যাস। এখানে অক্সিজেন যদি ৫% হয়ে যায় তাহ’লে জগতে জ্বলনযোগ্য সমস্ত উপকরণ এমন মাত্রায় জ্বলে উঠবে যে, বিদ্যুতের প্রথম স্ফুলিঙ্গ একটি গাছে লাগলে গোটা বন জ্বলে উঠবে।

কেউ যদি গভীর মনোযোগ সহকারে এবং স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সমুদ্র সম্পর্কে চিন্তা গবেষণা করে, তাহ’লে তার মন সাক্ষ্য দিবে যে, পৃথিবীর উপর আন্ত-বারিরাশির সমাবেশ এমন সৃষ্টিনৈপূণ্য যা কখনো হঠাৎ কোন দূর্ঘটনার ফল নয়। অতঃপর এত অসংখ্য হিকমত তার সাথে সংশ্লিষ্ট যে, এত সুষ্ঠু সুন্দর বিজ্ঞতাপূর্ণ ও সামঞ্জস্য ব্যবস্থাপনা কোন সৃষ্টিকর্তার নিয়ন্ত্রণ ব্যতীত হঠাৎ আপনা-আপনি হওয়া কিছুতেই সম্ভবপর নয়। সমুদ্র গর্ভে অসংখ্য অগণিত প্রাণী সৃষ্টি করা হয়েছে। তাদের আকৃতি ও গঠনপ্রণালী বিভিন্ন প্রকারের। যেরূপ গভীরতায় যার বাসস্থান নির্ণয় করা হয়েছে, তাঁর ঠিক উপযোগী করেই তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। সমুদ্রের পানি করা হয়েছে লবণাক্ত। তার কারণে প্রতিদিন তার গর্ভে অসংখ্য জীবের মৃত্যু ঘটলেও তাদের মৃতদেহ পঁচে-গলে সমুদ্রের পানি দূষিত হয়না। বারিরাশির বৃদ্ধি ও হ্রাস এমনভাবে সীমাবদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত করে রাখা হয়েছে যে, তা কখনো সমুদ্রের তলদেশে ভূগর্ভে প্রবেশ করে নিঃশেষ হয়ে যায় না। অথবা, প্রবল আকারে উচ্ছসিত হয়ে সমগ্র স্থলভাগ প্লাবিত করেনা। কোটি কোটি বছর যাবৎ নির্ধারিত সীমার মধ্যেই তাঁর হ্রাস বৃদ্ধি সীমিত রয়েছে। এ হ্রাস বৃদ্ধি সৃষ্টিকর্তারই নির্দেশে হয়ে থাকে।

সূর্যের উত্তাপে সমুদ্রের বারিরাশি থেকে বাষ্প সৃষ্টি হয়ে উর্ধ্বে উত্থিত হয়। তা থেকে মেঘের সৃষ্টি হয়। মেঘমালা বায়ু চালিত হয়ে স্থলভাগের বিভিন্ন অঞ্চল বারিশিক্ত করে। বারি বর্ষণের ফলে শুধু মানুষ কেন, স্থলচর জীবের জীবন ধারণের যাবতীয় প্রয়োজনীয় সামগ্রী উৎপন্ন হয়। লবণাক্ততা জীবকুলের জন্য ক্ষতিকর, এজন্য মহান স্রষ্টা সমুদ্রের লবণাক্ত বারিরাশী থেকে বাষ্প সৃষ্টির সময় লবণ উঠান না। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ আকাশ থেকে বারি বর্ষণ করেন। অতঃপর তার মাধ্যমে যমীনকে তার মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত করেন। নিশ্চয়ই এর মধ্যে নিদর্শন রয়েছে ঐ লোকদের জন্য যারা মন দিয়ে কথা শোনে’ (নাহল ১৬/৬৫)

সমুদ্রগর্ভ থেকেও মানুষ তার প্রচুর খাদ্য সামগ্রী আহরণ করে। সংগ্রহ করে অমূল্য মনি মুক্তা, প্রবাল, হীরা-জহরত। তার বুক চিরে দেশ থেকে দেশান্তরে জাহাজ চলাচল করে। অবাধ ব্যবসা-বাণিজ্য চলে। স্থান থেকে স্থানান্তরে মানুষের গমনাগমন হয়। এই গভীর নিবিড় মঙ্গলময় সম্পর্ক এক সুনিপুণ হস্তের সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই একমাত্র সম্ভব। হঠাৎ ঘটনাচক্র দ্বারা পরিচালিত কোন ব্যবস্থাপনা এটা কিছুতেই নয়।

আল্লাহ তা‘আলা তাঁর অত্যাশ্চর্য সৃষ্টি নৈপূণ্যের নিদর্শন- সুউচ্চ আকাশের কথা উল্লেখ করেছেন। বিজ্ঞানের চরম উন্নতির যুগেও বিজ্ঞানীরা আকাশ সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম হননি। আকাশের বিস্তৃতি কত বিরাট ও বিশাল এবং তাঁর আরম্ভ ও শেষ কোথায়, এখনো তা তাদের জ্ঞান বহির্ভূত।

মাথার উপরে যে অনন্ত শূন্য মার্গ দেখা যায়, যার মধ্যে কোটি কোটি মাইল ব্যবধানে অবস্থিত চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্ররাজি বিচরণ করছে, সেই অনন্ত শুন্য মার্গই কি আকাশ, না তার শেষ সীমায় আকাশের শুরু, তা সঠিকভাবে বলা শক্ত। যে আলোর গতি প্রতি সেকেন্ডে একলক্ষ ছিয়াশি হাযার মাইল, সেই গতিতে চলা শুরু করে এখনো অনেক তারকার আলো পৃথিবীর বুকে এসে পৌঁছায়নি। এ তারকাগুলো যেখানে অবস্থিত পৃথিবী হ’তে তার দূরত্ব এখনো পরিমাপ করা সম্ভব হয়নি।

বিজ্ঞানীদের কাছে আকাশ এক মহাবিষ্ময় সন্দেহ নেই। তাদের মতে, সমগ্র আকাশের একাংশ যাকে Galaxy (ছায়াপথ) বলে, তারই একাংশে আমাদের এ সৌরজগৎ। এই একটি Galaxy এর মধ্যেই চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্রাদি বিদ্যমান। বিজ্ঞানীদের সর্বশেষ পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অন্তত দশলক্ষ Galaxy -এর অস্তিত্ব ধরা পড়েছে। এসব অগণিত ছায়াপথের (Galaxy) মধ্যে যেটি আমাদের অতি নিকটবর্তী, তার আলো পৃথিবীতে পৌঁছতে দশ লক্ষ বছর সময় লাগে। অথচ, আলোর গতি প্রতি সেকেন্ডে একলক্ষ ছিয়াশি হাযার মাইল।

সমগ্র উর্ধ্বজগতের যে সামান্যতম অংশের জ্ঞান এ যাবৎ বিজ্ঞান আমাদেরকে দিয়েছে, তারই আয়তন এত বিরাট ও বিশাল। এসবের যিনি সৃষ্টিকর্তা, তাঁর কুদরত ও জ্ঞানশক্তি কত বিরাট, তা আমাদের কল্পনার অতীত। এসব নিয়ে চিন্তা করলে ঠিকই আমাদের দৃষ্টি ব্যর্থ ও পরিশ্রান্ত হয়ে আমাদের দিকেই ফিরে আসবে।

আল্লাহপাক বলেন, ‘নিশ্চয়ই (১) নভোমন্ড ও ভূমন্ডলের সৃষ্টিতে, (২) রাত্রি ও দিবসের আগমন-নির্গমনে এবং (৩) নৌযানসমূহে  যা সাগরে চলাচল করে, যদ্বারা মানুষ উপকৃত হয় এবং (৪) বৃষ্টির মধ্যে, যা আল্লাহ আকাশ থেকে বর্ষণ করেন। অতঃপর তার মাধ্যমে মৃত যমীনকে পুনর্জীবিত করেন ও সেখানে সকল প্রকার জীবজন্তুর বিস্তার ঘটান এবং (৫) বায়ু প্রবাহের উত্থান-পতনে এবং (৬) আকাশ ও পৃথিবীর মাঝে অনুগত মেঘমালার মধ্যে জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য আল্লাহর নিদর্শনসমূহ মওজূদ রয়েছে (বাক্বারা ২/১৬৪)

(৩) ‘ক্বিয়ামতের দিন এটাই হবে তাদের আপ্যায়ন’। ‘আমরাই তোমাদের সৃষ্টি করেছি। অথচ কেন তা তোমরা সত্য বলে বিশ্বাস করছ না’? ‘তোমরা কি ভেবে দেখেছ তোমাদের বীর্যপাত সম্পর্কে’? ওটা কি তোমরা সৃষ্টি কর না আমরা সৃষ্টি করি? (ওয়াক্বিআহ৫৬/৫৬-৫৯)

আল্লাহ আরো বলেছেন, তোমরা যে শস্যবীজ বপন কর, সে বিষয়ে ভেবে দেখেছ কি? তোমরা কি ওটাকে উৎপন্ন কর, না আমরা উৎপন্ন করে থাকি? (, ৬৩-৬৫)।

তিনি আরো বলেছেন, তোমরা কি পানি পান কর, সে বিষয়ে চিন্তা করেছ কি? তোমরা কি ওটা মেঘ হতে বর্ষণ কর, না আমার বর্ষণ করি? যদি আমরা চাইতাম, তাহ’লে ওটাকে তীব্র লবণাক্ত বানাতে পারতাম। অতঃপর তোমরা কেন কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর না? তোমরা যে আগুন জ্বালাও সে বিষয়ে ভেবে দেখেছ কি? তোমরা কি এর বৃক্ষ সৃষ্টি করেছ, না আমরা সৃষ্টি করেছি? (, ৬৮-৭২)

উপরোক্ত আয়াত সমূহের তিনটি পর্যায় উপস্থিত করা হয়েছে- ১. মানবীয় কোষ সংযোজন, সংগঠন এবং তার বিস্ময়কর সৃষ্টি। ২. উদ্ভিদকুলের ক্রমবৃদ্ধি (Growth) এবং বিপদ-আপদ থেকে তাকে রক্ষা করা। ৩.বৃষ্টিবর্ষণ এবং তাকে নোংরা ময়লাযুক্ত হওয়া, দুর্গন্ধময় হওয়া ও লবণাক্ত হওয়া থেকে রক্ষা করা। এ সবই আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণের জলন্ত স্বাক্ষী। এসব প্রাকৃতিক প্রপঞ্চ রূপায়ণে মানুষের অংশগ্রহণ অপরিহার্য। যেমন সন্তান উৎপাদনে পুরুষ-নারীর যৌন সঙ্গম দ্বারা বীজ বপন পর্যায়ের কাজ মানুষই করে। কিন্তু এই অংশগ্রহণ আংশিক ও বাহ্যিক। শুধু এই আংশিক অংশগ্রহণ দ্বারাই উদ্দেশ্য সম্পন্ন হয়না। এর প্রতিটি ক্ষেত্রে মহাশক্তিমান সত্ত্বার নিরংকুশ সৃষ্টি ক্ষমতার প্রত্যক্ষ ব্যবস্থাপনা ও কর্মসাধন কার্যকর না হ’লে না মানুষের অস্তিত্ব সম্ভব, না বৃক্ষাদি ও পানির অস্তিত্ব।

অধিকতর বিশ্লেষণ পর্যায়ে বলা যায়- ‘তোমরা কি চিন্তা ভাবনা করেছ, তোমরা যে শুক্রকীট নিক্ষেপ কর, তা থেকে তোমরা সন্তান সৃষ্টি কর, না তার সৃষ্টিকর্তা আমরা’? এ আয়াতে মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে, এর সূচনা হয় শুক্রকীট থেকে। এই শুক্রকীট মানুষ নিজে তৈরী করে না। মানব দেহে আল্লাহর বিশেষ ব্যবস্থাপনায় স্বতস্ফূর্তভাবেই তৈরী হয়। অতঃপর মানুষের কাজ হচ্ছে যথাস্থানে নিক্ষেপণ। এটা তো শুধু স্থানান্তর করণ পর্যায়ের কাজ। অতঃপর সন্তান উৎপাদনের ব্যাপারে মানুষের কিছুই করার থাকে না। পরবর্তী সব কাজই একমাত্র আল্লাহর। সৃষ্টিকর্তা ছাড়া সন্তান উৎপাদন- তথা মানুষ সৃষ্টি অকল্পনীয়। সৃষ্টিকর্তাই মানব দেহে শুক্রকীট সৃষ্টি করেন, তাকে মায়ের গর্ভাধারে নিক্ষেপণের ব্যবস্থা করেন, ও তথায় স্থিত করেন, সংরক্ষণ ও লালন করেন। এভাবেই নির্দিষ্ট মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর সন্তান লাভ সম্ভব হয়ে থাকে।

(৫) ‘আল্লাহ তিনি, যিনি ঊর্ধ্বদেশে স্তম্ভ ছাড়াই আকাশ মন্ডলীকে স্থাপন করেছেন যা তোমরা দেখছ। অতঃপর তিনি আরশে সমুন্নীত হন এবং সূর্য ও চন্দ্রকে অনুগামী করেন। প্রতিটি নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত সন্তরণ করবে। তিনি সকল বিষয় নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি নিদর্শন সমূহ ব্যাখ্যা করেন যাতে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাতের ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাসী হ’তে পার’ (রাদ ১৩/২)

(৬) ‘তিনিই পৃথিবীকে বিস্তৃত করেছেন এবং তাতে পাহাড়-পর্বত ও নদী-নালা স্থাপন করেছেন। তিনি প্রত্যেক ফলকে ছোট-বড় (টক-মিষ্টি ইত্যাদি) দু’প্রকারের সৃষ্টি করেছেন। তিনি দিবসকে রাত্রি দ্বারা আবৃত করেন। এ সবের মধ্যে নিদর্শন সমূহ রয়েছে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য’ (রাদ ১৩/৩)

(৭)  আর পৃথিবীতে রয়েছে পরস্পরে সংলগ্ন ভূখন্ডসমূহ এবং রয়েছে আঙ্গুরের বাগিচা সমূহ, রয়েছে শস্যক্ষেত ও খেজুর বাগান। যার কিছু পরস্পরে যুক্ত মূল বিশিষ্ট এবং কিছু পৃথক একক মূল বিশিষ্ট, যা একই পানিতে সিঞ্চিত হয়। আর সেগুলিকে আমরা স্বাদে একটি অপরটির উপর উৎকৃষ্ট করেছি। নিশ্চয়ই জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য এসবের মধ্যে নিদর্শন সমূহ রয়েছে (রাদ ১৩/৪)

(৮) আর তোমার প্রতিপালক মৌমাছিকে প্রত্যাদেশ করলেন যে, তুমি তোমার গৃহ নির্মাণ কর পাহাড়ে, গাছে ও যেখানে মানুষ বসবাস করে সেখানে। অতঃপর তুমি সর্বপ্রকার ফল-মূল হতে ভক্ষণ কর? অতঃপর তোমার প্রভুর পথ সমূহে (অর্থাৎ গাছে, পাহাড়ে প্রভৃতিতে) প্রবেশ কর বিনীত ভাবে। তার পেট থেকে নির্গত হয় নানা রংয়ের পানীয়। যার মধ্যে মানুষের জন্য আরোগ্য নিহিত রয়েছে। নিশ্চয়ই এর মধ্যে নিদর্শন রয়েছে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য (নাহল ১৬/৬৮-৬৯)

(৯) ‘তিনিই সমুদ্রকে মিলিতভাবে প্রবাহিত করেছেন। একটি মিষ্ট সুপেয়, অপরটি লবণাক্ত বিস্বাদ এবং দু’টির মাঝখানে রেখেছেন পর্দা দুর্ভেদ্য অন্তরায়’। ‘তিনিই মানুষকে পানি হ’তে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি তার বংশগত ও বিবাহগত সম্পর্ক নির্ধারণ করেছেন। আর তোমার প্রতিপালক সর্বশক্তিমান’ (ফুরক্বান২৫/৫৩-৫৪)

এভাবে পবিত্র কুরআনে আল্লাহর অস্তিত্ব, একত্ববাদ এবং ক্ষমতা সম্পর্কে ভুরি ভুরি অকাট্য যুক্তি পেশ করা হয়েছে। একজন সুস্থ জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষে নাস্তিক হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। হযরত আলী (রাঃ)-এর একটি বিশ্লেষণের নির্যাস এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। মহান আল্লাহর বিরাট শক্তি এবং তাঁর বিপুল নে‘মত সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলেই নির্ভুল পথের সন্ধান পাওয়া যাবে, জাহান্নামের ভয় মনে জাগ্রত হবে। আল্লাহর ক্ষুদ্রতম সৃষ্টিগুলোকেও যদি লক্ষ্য করা যায়, দেখা যাবে তিনি তাকে কত দৃঢ়তা দিয়েছেন, তাঁর গঠনটাকে কত নিপুণ করেছেন, তাকে শ্রবণ শক্তিও দৃষ্টিশক্তি দিয়েছেন, তাঁর অস্থি ও চামড়া কত ভারসাম্য করেছেন। তোমরা ক্ষুদ্র পিঁপড়াই দেখনা কেন! তার অবয়ব কত ক্ষুদ্র। আকার আকৃতিতে কি মসৃণতা ও সুক্ষ্মতা। চোখের পলকেও তা ধরতে পারা যায়না। তা কিভাবে যমীনের উপর চলে এবং খাদ্যের সন্ধান ও সংগ্রহ করে তা চিন্তা করেও কূল পাওয়া যায় না।

খাদ্যকণা টেনে নিয়ে গিয়ে তার গর্তের মধ্যে জমা করে, গ্রীষ্মকালে শীতকালের জন্য সঞ্চয় করে রাখে। তাদের এই সঞ্চিত পরিমান খাদ্য সারা শীত মওসুমের জন্য যথেষ্ট হয়। এভাবে মহান দয়াময় তাদের রিযিকের ব্যবস্থা করেন, যখন যেখানেই ওরা অবস্থান করুক না কেন। পিঁপড়ার খাদ্য তাঁর পেটের গর্তের কোণায় কি করে স্থান গ্রহণ করে, তার মাথায় চোখ ও কান কি করে স্থান পেয়েছে, তা যদি চিন্তা করা যায় তাহ’লে বলতেই হবে, এ এক বিস্ময়কর সৃষ্টি! তার দেহ সংগঠন চিন্তা করেও কোন সীমায় পৌঁছা যাবে না। এরূপ একটি প্রাণীকে যে মহান স্রষ্টা তাঁর অতুলনীয় কৌশলে সৃষ্টি করেছেন, তাঁর প্রশংসায় এবং তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি-বিনয়ে মস্তক আপনা আপনিই নত হয়ে আসে।

– ড. মুহাম্মাদ সাঈদুল ইসলাম


ঋণ স্বীকার :

  1. Sayed Abdul Hai, Muslim Philosophy (Islamic Foundation, Dhaka, Bangladesh, 1982)
  2. Louis Pojaman (ed.), Introduction to Philosophy: Classical and Contemporary Readings (Belmont, 1991)

৩. আববাস আলী খান, মৃত্যু যবানিকার ওপারে (কেন্দ্রীয় প্রকাশনা বিভাগ, জা.ই.বা, ঢাকা, ১৯৯৭)

৪. মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুর রহীম, আল কুরআনের আলোকে শিরক ও তাওহীদ (খায়রুন প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯৭)

৫. সৈয়দ আলী আহসান, আল্লাহর অস্তিত্ব (বাড পাবলিকেশন্স, ঢাকা, ১৯৯৭)

৬. পবিত্র কুরআন- বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর (খাদেমুল হারামাইন শরীফাইন বাদশাহ ফাহদ কুরআন মুদ্রণ প্রকল্প, মদীনা, ১৯৪৩ হিজরী)

৭. Abdur Rashid Moten, Political Science in Islamic Perspective (ST. Martins Press, Inc, London, 1996)।

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

আরও দেখুন
Close
Back to top button