নাস্তিকতা

হকিং তত্ত্ব ও শাশ্বত সত্য

১৪ই মার্চ ২০১৮, নিত্য দিনের মতো দিনের আলো প্রকাশিত হ’ল ঠিকই, কিন্তু নীরবে নিভে গেল বিজ্ঞান মহাকাশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের জীবন। রবার্ট, লুসি ও টিম হকিং বিবৃতি দিলেন আমরা গভীরভাবে শোকাহত ও মর্মাহত, আমাদের প্রিয় বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। ৭৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করলেন বিখ্যাত ব্রিটিশ জ্যোতিঃপদার্থবিদ অধ্যাপক উইলিয়াম স্টিফেন হকিং। অদম্য মেধাবী ও নিশ্চল নিরলস পরিব্রাজক স্টিফেন হকিং জীবন সংগ্রামে এক সাহসী যোদ্ধার নাম। অনেকে বলেন, তাকে শুধু বিজ্ঞানী বললে অতিশয় বেমানান মনে হয়, বরং তারকা বিজ্ঞানী বললে যথার্থ হয়। কেননা স্বল্প শিক্ষিত লোক মাত্রই যারা দিন দুনিয়ার খবর রাখেন, বিজ্ঞান বোঝেন বা না বোঝেন, তাদের কাছেও বেশ পরিচিত নাম স্টিফেন হকিং।

হুইল চেয়ার, সামনে বসানো কম্পিউটার, মাথাটি কাত হয়ে পড়ে আছে, এঁকে বেঁকে বসা নিথর শরীরটি যেন নিরেট গোশতের মূর্তি। হাত আছে কিন্তু কাজ করে না, পা আছে চলে না, মেরুদন্ড আছে দাঁড়ায় না, মুখ আছে খায় না, জিহবা আছে কথা বলে না। সারা শরীরে জীবিত বলতে আছে দু’টি চোখ। উজ্জ্বল নীল ঐ দু’টি চোখের তীব্র চাহনি পৃথিবীর বলয় পেরিয়ে মহাবিশ্বের মহাকাশে তারায় তারায় ঘুরে বেড়ায়। আহরণ করে জ্ঞান। সণায়ুবিক বৈকল্যে নিথর দেহের এই মানুষটি সর্বদা খুঁজেছেন কিছু মৌলিক প্রশ্নের উত্তর। পৃথিবী কী? এটি যেমন আছে, তেমন আছে কেন? এটি কিভাবে তৈরি হ’ল? এর শেষ পরিণতিই বা কি? উত্তর খুঁজতে গিয়ে দিয়েছেন নানা তত্ত্ব। হয়ে উঠেছেন যুগশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী। ১৪ই মার্চ ২০১৮ তার মৃত্যুতে আবার নতুনভাবে উঠে এসেছে তার নামটি।

স্টিফেন হকিং-এর গবেষণা ও বিবৃতির নানা দিক

১. মহাবিশ্বের শুরু আছে কি?

মহা বিশ্বের আদৌ কোন শুরু আছে, না-কি এটি অনন্তকাল ধরে চলছে? এ প্রশ্নের মধ্যে বিজ্ঞান ঘুরপাক খাচ্ছে হাযার হাযার বছর ধরে। গ্রীক দার্শনিক এ্যারিস্টটল বলেন, মহাবিশ্ব চিরকাল ধরেই আছে, এর কোন শুরু বা শেষ নেই। যদিও এটি তার দর্শনগত তথ্য। এতে বিজ্ঞানের কোন ছোঁয়া নেই। তবুও মানুষ এটি বিশ্বাস করেছে হাযার হাযার বছর ধরে। মূলতঃ অবিশ্বাসীদের এটি কৌশলগত উত্তর। কেননা যদি বলা হয়, মহাবিশ্বের শুরু আছে তখন স্বভাবতই প্রশ্ন আসে এটি কখন কে শুরু করেছেন? অর্থাৎ মহাবিশ্বের সৃষ্টিতে স্রষ্টার একটা হস্তক্ষেপ চলে আসে। আধুনিক বিজ্ঞান বলছে, মহাবিশ্বের শুরু আছে। বিজ্ঞানী হকিং ব্যাখ্যা করেছেন, প্রায় ১৩.৫ বিলিয়ন বছর আগে বিগব্যাঙ বা মহাবিস্ফোরণের আগে কিছুই ছিল না (Nothing) এবং বিস্ফোরণের পর মূলতঃ সবকিছু (Something) হয়েছে। এই বর্ণনার সাথে দারুণভাবে মিলে যায় বিজ্ঞানময় কুরআনের। আল্লাহ বলেন, ‘যিনি মহাকাশ ও পৃথিবীকে অনস্তিত্ব (Nothing) থেকে অস্তিত্বে (Something) আনলেন এবং যখন  তিনি  কিছু  করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তখন শুধু বলেন,

হও আর তা হয়ে গেল (বাক্বারাহ ২/১১৭)। অর্থাৎ মহাবিশ্বের শুরু আছে কি? এ প্রশ্নের উত্তরে হকিংও কুরআনের ন্যায়ই বলছেন। তবে গোলযোগ বেঁধেছে অনুসিদ্ধান্তে। হকিং বলছেন, শূন্য থেকে এমনি এমনি শুরু হয়েছে, আর মহাবিশ্ব যিনি শুরু করে দিলেন সেই সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ বলছেন, না এমনি হয়নি, এটা আমার সিদ্ধান্ত। আমি হও বলেছি, তাই হয়েছে। তবে হকিং-এর কথাই যদি ধরে নেওয়া যায়, মহাবিশ্ব শূন্য থেকে ১৩.৫ বিলিয়ন বছর আগে এমনি এমনি তৈরি হয়েছে, তাহ’লে বিরাট প্রশ্ন থেকে যায় যে, শূন্য থেকে ২০ মিলিয়ন বছর আগে কেন মহাবিশ্ব তৈরি হ’ল না?

২. মহাবিশ্ব কিভাবে শুরু হ’ল?

মহাবিশ্ব শুরু হয়েছে একথা যখন প্রমাণিত হ’ল, তখন প্রশ্ন আসল এটি কিভাবে শুরু হ’ল? জর্জ গ্যামো ও জর্জ লেমেত্রি মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে মহাবিশ্বের জন্মের তত্ত্ব দিয়েছেন। পরবর্তীতে বিখ্যাত পদার্থবিদ আইনস্টাইন এর সাধারণ আপেক্ষিকতার আলোকে বিজ্ঞানী হকিং ও তার সহকর্মী রজার পেনরোজ তাত্ত্বিকভাবে উপস্থাপন করেছেন যে, কিভাবে একটি পরম বিন্দু থেকে বিগব্যাঙ বা মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে মহাবিশ্ব তৈরি হ’ল। আর এ পরমবিন্দুতে ব্যর্থ হয় পদার্থবিদ্যার সকল সূত্র। প্রাথমিক অবস্থায় মহাবিশ্ব ছিল একটি পিন্ড যেখানে বিস্ফোরণের মাধ্যমে সৃষ্টি হ’ল মহাবিশ্ব। মহাবিশ্বের উৎপত্তি সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘অবিশ্বাসীরা কি দেখে না যে, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল একত্রিত ছিল। অতঃপর আমরা উভয়কে পৃথক করে দিলাম এবং আমরা পানি দ্বারা সকল প্রাণবান বস্ত্তকে সৃষ্টি করলাম। এরপরও কি তারা বিশ্বাস স্থাপন করবে না?’ (আম্বিয়া ২১/৩০)। বিজ্ঞান আরো বলছে মহাবিস্ফোরণের পর ছড়িয়ে পড়ে মহাজাগতিক মেঘ বা গ্যাস। আর এই গ্যাস থেকে ক্রমাগত পরিবর্তনের মাধ্যমে তৈরি হয় মহাবিশ্বের সকল বস্ত্ত। পবিত্র কুরআনে গ্যাসের পরিবর্তে ধোঁয়া শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, যা গ্যাসের নামান্তর এবং অধিক মানানসই। আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মনোনিবেশ করেন যা ছিল ধূম্রকুঞ্জ। অতঃপর তিনি তাকে ও পৃথিবীকে বললেন, তোমরা উভয়ে এসো ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। তারা বলল, আমরা এলাম স্বেচ্ছায় অনুগত হয়ে’ (ফুছছিলাত/হামীম সাজদাহ ৪১/১১)

৩. মহাবিশ্ব কি সম্প্রসারিত হচ্ছে?

মহাবিশ্ব কি সম্প্রসারিত হচ্ছে নাকি সৃষ্টির শুরুতে যত বড় ছিল তত বড়ই আছে? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে বিজ্ঞানীদের বেশ গলদঘর্ম হ’তে হয়েছে। অবশেষে ১৯২৫ সালে বিজ্ঞানী এডউইন হাবল তার দূরবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার করে পর্যবেক্ষণ করে দেখেন যে, ছায়াপথগুলো পরস্পর হ’তে দূরে সরে যাচ্ছে। তিনি মত প্রকাশ করলেন যে, যে, মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে। তবে সমসাময়িক একজন বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রেড হয়েল ও তার দল ভাবতেন মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ সব জায়গায় ঘটে না। বরং গড় পড়তায় মহাবিশ্বের কোন পরিবর্তন নেই। মূলতঃ বিজ্ঞানী হয়েল মহাবিশ্ব সম্প্রসারণকারী এ মডেলটিকে ব্যঙ্গ করে বিগব্যাঙ বলেছিলেন। সর্বশেষ হকিং তত্ত্ব উপস্থাপন করে দেখালেন কিভাবে মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হয়। এখানে মুমিনদের জন্য তৃপ্তির বিষয় হ’ল প্রায় দেড় হাযার বছর আগে যখন দূরবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার হয়নি বা প্রযুক্তির কোন অগ্রগতি হয়নি তখন মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মুখে আবৃত হয়েছে মহাবিশ্ব সম্প্রসারণকারীর বাণী। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি আকাশ নির্মাণ করেছি আমার ক্ষমতা বলে এবং আমি অবশ্যই মহাসম্প্রসারণকারী’ (যারিয়াত ৫১/৪৭)

৪. মহাবিশ্বের শেষ পরিণতি কি?

স্টিফেন হকিং-এর মতে মহাবিশ্ব যেমন একটি বিন্দু থেকে মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে শুরু হয়েছে, তেমনি এর শেষ পরিণতি হ’ল বৃহৎ সংকোচনের মাধ্যমে আরেকটি বিন্দু, যা পরম বিন্দু নামে পরিচিত। তবে সমগ্র বিশ্ব একই সাথে বৃহৎ সংকোচনের মাধ্যমে চুপসে নাও যেতে পারে। সেক্ষেত্রে কোন স্থানিক অঞ্চলে অনন্যতা দেখা দিবে যেটা চুপসে গিয়ে কৃষ্ণগহবরের সৃষ্টি করবে। বিজ্ঞানের ইতিহাসে স্বল্প সংখ্যক কিছু ক্ষেত্র আছে, যা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সত্যতা প্রমাণ হবার আগেই গাণিতিক সমীকরণ দ্বারা তত্ত্ব বিকাশ লাভ করেছে। কৃষ্ণগহবর তাদের মধ্যে একটি। মূলতঃ কৃষ্ণগহবর মহাবিশ্বের এমন একটি বস্ত্ত, যার আয়তন অত্যন্ত ক্ষুদ্র। কিন্তু ভর এত বেশী যে, এর মহাকর্ষীয় শক্তি মহাবিশ্বের সকল শক্তিকে অতিক্রম করে। ফলে এর আকর্ষণ বলয়ের সবকিছু এর মধ্যে প্রবেশ করতে বাধ্য হয় এবং এ থেকে কোন কিছু বের হয়ে আসতে পারে না। সাধারণত তারাগুলো বৃদ্ধ হ’লে বা তাদের জ্বালানি শেষ হ’লে কৃষ্ণগহবরে পরিণত হয়। বিজ্ঞানী হকিং মূলতঃ একেই সৃষ্টির শেষ অবস্থা বলেছেন। পৃথিবী কিভাবে তার শেষ অবস্থায় উপনীত হবে তা কুরআনে স্পষ্ট। আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর যেদিন শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে একটি মাত্র ফুঁক এবং পৃথিবী ও পর্বতমালা উত্তোলিত হবে। অতঃপর একই ধাক্কায় চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে। সেদিন ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে’ (হা-ক্কাহ ৬৯/১৩-১৬)

সাধারণ আলোচনা করলে দেখা যায়, হকিং মহাবিশ্বের সমাপ্তি টেনেছেন কৃষ্ণগহবর দিয়ে। আর সৃষ্টিকর্তা সমাপ্তি টেনেছেন মহাপ্রলয় দিয়ে। দু’টি ঘটনার সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য আছে।-

ক) কৃষ্ণগহবরের বাইরের ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা গেলেও ভেতরের ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। তেমনিভাবে মৃত্যুর বা ক্বিয়ামতের আগের ঘটনা আমাদের দৃষ্টিগোচর হ’লেও পরের ঘটনা আমাদের ইন্দ্রিয় বহির্ভূত।

খ) কৃষ্ণগহবরের মধ্য থেকে বের হওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। তেমনি মৃত্যু বা ক্বিয়ামতের পরে ইহজীবনে ফিরে আসাও কোনভাবে সম্ভব নয়।

গ) কৃষ্ণগহবর এমন যে, তা থেকে কোন আলো বের হ’তে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘যেদিন সূর্যকে আলোহীন করা হবে’ (তাকভীর ৮১/১)

ঘ) কৃষ্ণগহবরের পরে সময় স্থির। যেমনভাবে মৃত্যু বা ক্বিয়ামতের পরে সময় স্থিরের নানা প্রমাণ কুরআন দিয়েছে। তবে কৃষ্ণগহবরের শেষ পরিণতি কি তার উত্তর হকিং দিয়েছেন। ১৯৭৪ সালে তিনি বলেন, কৃষ্ণগহবর সবকিছু টেনে নেয় পাশাপাশি এটি থেকে বিকিরণও হয়। যা হকিং বিকিরণ নামে পরিচিত। এ আবিষ্কার তাকে জগৎজোড়া খ্যাতি এনে দেয়। ১৯৮১ সালে তিনি বলেন, বিকিরণ করতে করতে কৃষ্ণগহবর উবে যায় তখন এর ভেতরের তথ্যগুলো হারিয়ে যায়। কিন্তু সমস্যা হ’ল তথ্য কখনও হারায় না। তাই পদার্থ বিদ্যায় এ নিয়ে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলছিল। তবে পরবর্তীতে রবার্ট পেনরাজে দেখিয়েছেন, কাগজ পোড়ালে যেমন ছাই হয় তেমনভাবে তথ্য এক রূপ থেকে অন্য রূপে যায়, হারিয়ে যায় না। হকিং এটিকে সমর্থন করেছেন।

৫. পৃথিবী সৃষ্টি, পরিচালনায় ও সমাপ্তিতে সৃষ্টিকর্তার ভূমিকা আছে কি?

বিজ্ঞানীরা গবেষণা করবেন, জ্ঞান অর্জন করবেন, এটা দারুণ ব্যাপার। ইসলাম একে প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত করে। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, ‘বল, তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ কর। অতঃপর দেখ কিভাবে তিনি সৃষ্টিকর্ম শুরু করেছেন। অতঃপর আল্লাহ পরবর্তী সৃষ্টি করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল বস্ত্তর উপরে ক্ষমতাশালী’ (আনকাবূত ২৯/২০)

হকিং সৃষ্টি তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেছেন। তথ্য দিয়েছেন জগদ্বাসীকে। কোন তথ্য সঠিক হ’তে পারে, কোনটি হ’তে পারে ভুল। তবে ধর্মের সাথে সরাসরি বৈপরিত্য এসেছে এই প্রশ্নে যে, পৃথিবী সৃষ্টি, পরিচালনায় ও সমাপ্তিতে সৃষ্টিকর্তার ভূমিকা আছে কি-না? এ প্রশ্নে তিনি উত্তর দিয়েছেন নানাভাবে, যার মূলভাব হচ্ছে-

উত্তর ১ : হকিং বিশ্বাস করতেন, দুনিয়া বিজ্ঞানের নিয়ম মেনেই চলে। এমন হ’তে পারে নিয়মগুলো ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু নিয়মের ব্যাঘাত ঘটানোর জন্য হস্তক্ষেপ করেন না।

একজন মুসলিমও বিশ্বাস করে দুনিয়া যৌক্তিকভাবে একটি সুশৃংখল নিয়ম মেনেই চলে এবং নিয়মগুলো সৃষ্টিকর্তারই সিদ্ধান্ত। যাকে বিজ্ঞান নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘(মনে রাখা আবশ্যক যে,) আকাশ ও পৃথিবী এবং এতদুভয়ের মধ্যে যা কিছু আছে, আমরা তা খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করিনি’ (আম্বিয়া ২১/১৬)। তিনি তাঁর নিয়মের ব্যাঘাত ঘটান না। কারণ তিনি তার সৃষ্টিকে বিভ্রান্ত করতে চান না। বরং সুশৃংখল নিয়মের আওতায় তার সন্ধান দিতে চান। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, আল্লাহ তিনি, যিনি ঊর্ধ্বদেশে স্তম্ভ ছাড়াই আকাশ মন্ডলীকে স্থাপন করেছেন, যা তোমরা দেখছ। অতঃপর তিনি আরশে সমুন্নীত হন এবং সূর্য ও চন্দ্রকে অনুগামী করেন। প্রতিটি নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত সন্তরণ করবে। তিনি সকল বিষয় নিয়ন্ত্রণ করেন… তিনি দিবসকে রাত্রি দ্বারা আবৃত করেন। এ সবের মধ্যে নিদর্শন সমূহ রয়েছে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য’ (রা‘দ ১৩/২-৩)

সীমাহীন সৃষ্টিলোকের প্রত্যেকটি তারকা-নক্ষত্র, গ্রহ-উপগ্রহ ও ধূমকেতু তার জন্য নির্দিষ্ট নিরক্ষবৃত্তের মধ্যে থেকেই সাঁতার কাটছে। সেখান থেকে না ফিরে আসতে পারছে, না পালিয়ে কোথাও সরে যেতে পারছে। সবগুলোই পারস্পরিক মধ্যাকর্ষের এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে বন্দী থেকেই মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তার একত্বের প্রমাণ বহন করছে (সৃষ্টি ও সৃষ্টিতত্ত্ব, পৃঃ ১৭৭)

তিনি আরো বলেন, ‘আর (অন্যতম নিদর্শন হ’ল) সূর্য, যা তার গন্তব্যের দিকে চলমান থাকে। এটা হ’ল মহাপরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়ের নির্ধারণ’ (ইয়াসীন ৩৬/৩৮)

তিনি আরো বলেন, ‘তিনি যথার্থভাবে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছেন। তিনি রাত্রিকে আচ্ছাদিত করেন দিবস দ্বারা এবং দিবসকে আচ্ছাদিত করেন রাত্রি দ্বারা। আর তিনি অনুগত করেছেন সূর্য ও চন্দ্রকে। প্রত্যেকেই পরিভ্রমণ করবে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত। জেনে রেখ, তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল’ (যুমার ৩৯/০৫)। এ ব্যাপারে তিনি আরো বলেন, ‘সূর্য ও চন্দ্র পরিমাণ মত সন্তরণে রত’ (আর-রহমান ৫৫/০৫)

তবে প্রয়োজনে তিনি নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানোর জন্য হস্তক্ষেপের পূর্ণ ক্ষমতা রাখেন। বিজ্ঞানী হকিং ২১ বছরে রোগাক্রান্ত হন। ডাক্তার বলেছিলেন বড়জোর দু’বছর বাঁচবেন। কেউ বললেন, হকিংকে ২৫ বছর বয়সে আমরা পাব না। কিন্তু বিজ্ঞানের সমস্ত বিধিকে অসার প্রমাণ করে বেঁচে রইলেন ৭৬ বছর বয়স পর্যন্ত। এটি কি সৃষ্টিকর্তার হস্তক্ষেপের বড় প্রমাণ নয়?

উত্তর ২ : হকিং-এর ‘The Grand Design’ বইটি প্রকাশের পর CNN-এর এক সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করেন, আপনি কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন? হকিং বলেছিলেন, ঈশ্বর থাকলেও থাকতে পারে তবে মহাবিশ্ব তৈরীতে তার প্রয়োজন নেই।

এ উত্তরে তিনি নাস্তিক্যবাদের দিকে আরও এক ধাপ এগিয়েছেন। তিনি বলেছেন, শূন্যস্থান থেকে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন-এর মাধ্যমে বস্ত্তকণা তৈরি হয়েছে, যা মহাকর্ষীয় বলের দ্বারা নিউট্রালাইজড হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হ’ল ঐ শূন্যস্থানে যখন সময় আর স্থান তৈরি হয়নি তখন কোথা থেকে কিভাবে মহাকর্ষ বল এলো এর ব্যাখ্যা হকিং দেননি।

তাছাড়া শূন্যস্থান বলতে তিনি কোনকিছুই নেই (Nothing) নাকি বস্ত্তর অনুপস্থিতি (Quantum Vaccum) বুঝিয়েছেন। তা মোটেও পরিষ্কার নয়।

তিনি তার বইতে বলেছেন, কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন-এর জন্য সময় দরকার ছিল না, স্থান প্রয়োজন ছিল। তাই তখন সময় ছিল না। কিন্তু কখন এ স্থান আবার আজকের মতো সময় হ’ল তার ব্যাখ্যা তিনি দেননি। কাজেই সৃষ্টিতে সৃষ্টিকর্তার প্রয়োজন নেই এটি তার ব্যক্তিগত আবেগ, যা কোন বৈজ্ঞানিক তথ্য নয়।

উত্তর ৩ : ২০১৪ সালে সেপ্টেম্বর মাসে স্প্যানিশ ভাষার একটি পত্রিকা EL Mundo-এর সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, বিজ্ঞান বুঝার আগে আমরা বিশ্বাস করতাম ঈশ্বরই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন।  কিন্তু  বিজ্ঞান এখন সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিয়েছে। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ‘আমরা ঈশ্বরের মন বুঝতে চেষ্টা করছি, আমি বুঝাতে চাচ্ছি, যদি কোন ঈশ্বর থেকে থাকে যা আসলে নেই, তাহ’লে সে ঈশ্বরের যা যা জানার কথা, আমরা তা জানব। আমি নাস্তিক।

মৃত্যুর কিছুকাল আগে তার এ উক্তি তাকে চূড়ান্তভাবে অবিশ্বাসীদের তালিকাভুক্ত করেছে। তিনি সৃষ্টিকর্তার সমান জ্ঞানে জ্ঞানী হ’তে চেয়েছেন যা শুধুই অবাস্তব নয় বরং  হেয়ালিপনা এবং ধৃষ্টতাও বটে। কারণ মানুষকে এমন জ্ঞান দান করা হয়নি যা দ্বারা সে সৃষ্টিকর্তা পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। আল্লাহ বলেন, ‘আর এ বিষয়ে তোমাদের প্রতি সামান্যই জ্ঞান দেওয়া হয়েছে’ (ইসরা ১৭/৮৫)।[1]

৬. মৃত্যু ও পরকাল মূলত কি?

গার্ডিয়ান পত্রিকার এক সাক্ষাৎকারে হকিং বলেন, মানুষের মৃত্যু মূলত তার মস্তিষ্কের মৃত্যু। মস্তিষ্ক একটি কম্পিউটারের মত। যখনই এর উপকরণ কাজ করতে ব্যর্থ হয়, তখনই এটি থেমে যায়। পরকাল সম্বন্ধে তিনি বলেন, আমি মস্তিষ্ককে কম্পিউটার হিসাবে বিবেচনা করি। এর উপাদানগুলো ব্যর্থ হ’লে এটা কাজ করা থামিয়ে দেবে। এই কম্পিউটার ভেঙে গেলে আর স্বর্গ বা পরকাল বলে কিছুই থাকে না। যারা অন্ধকারে (পরকাল) ভীত, তাদের কাছে এটি একটি রূপকথার গল্প ছাড়া কিছুই নয় (that is a fairy story for people afraid of the dark)।

২০১১ সালে ডিসকভারী চ্যানেলে একটি টিভি সিরিজ কিউরিসিটিতে তিনি বলেন, আমরা চিন্তার ক্ষেত্রে স্বাধীন। কোন স্রষ্টা নেই, কেউ মহাবিশ্ব তৈরি করেনি এবং কেউ আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ করে না। সম্ভবতঃ কোন জান্নাত নেই, নেই কোন পরকাল। তাই আমাদের মহাবিশ্বের মহান নকশার কদর করতে হবে। আমি এই জীবন পেয়ে কৃতজ্ঞ’।

৭. পৃথিবীর ভবিষ্যৎ কি?

হকিং মনে করেন, মানুষ ধীরে ধীরে প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে এবং এক সময় মানুষ আর প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। তিনি বলেন, If human can design computer viruses, then I fear that they might also design artificial intelligence (robots) which can replace themselves (human). ‘যদি মানুষ কম্পিউটার ভাইরাস তৈরী করতে পারে তবে আমি শংকিত যে, তারা হয়ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও (রোবট) তৈরী করবে যা তাদের নিজেদেরই (মানুষ) স্থলাভিষিক্ত হ’তে পারে’।

তিনি আরো বলেন, আগামী ৬শ’ বছরের মধ্যে পৃথিবীর জনসংখ্যা এত পরিমাণ বেড়ে যাবে যে, মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস ও বিদ্যুতের অতিমাত্রায় ব্যবহারের কারণে পৃথিবী অত্যধিক তাপে একটি অগ্নি গোলকে পরিণত হবে (death by fireball)। এছাড়াও পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার, মানুষের আগ্রাসী মনোভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মহাকাশীয় বস্ত্তর সংঘর্ষের কারণে পৃথিবীর মৃত্যু অনিবার্য। তাছাড়া ভিনগ্রহের প্রাণীও আক্রমণ করতে পারে। যাদের প্রতিহত করার মত ক্ষমতা পৃথিবীবাসীর থাকবে না। এ কারণে হকিং বলেন, অতি শীঘ্রই একশ’ বছরের মধ্যেই অন্যত্র Survivable planet বা বসবাসের স্থান খুঁজে না পেলে এবং সেখানে পৌঁছতে ব্যর্থ হ’লে মানব জাতি ধ্বংস হয়ে যাবে।

শেষ গবেষণা :

মৃত্যুর দশদিন পূর্বে ৪ঠা মার্চ ২০১৮তে প্রফেসর থমাস হার্টগ-এর সাথে “A smooth exit from eternal inflaton” নামে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমরা সবাই বর্তমান মহাবিশ্বকেই একমাত্র মহাবিশ্ব মনে করি। কিন্তু ১৯৮০ সালে Alan Guth ও Andrei lendie এর গবেষণায় দেখা যায় যে, এ মহাবিশ্বের বাইরেও অনেক মহাবিশ্ব আছে যা মালটিভার্স নামে পরিচিত। তারা গবেষণা করে দেখান যে, মালটিভার্স সৃষ্টি ও বিস্তৃতি অনন্তকাল ধরে ঘটেই চলবে। অর্থাৎ মালটিভার্স চিরস্থায়ী। এই চিরস্থায়ী বিস্তৃতিকে বলা হয়, eternal inflaton। অতঃপর ১৯৮৩ সালে হকিং তার no boubdary theory-তে মহাবিশ্বের বিস্তৃতির যে হিসাব কষেছিলেন তাতে তিনি এ ধারণাকে সমর্থন করতে বাধ্য হন। তিনি একটি নিবন্ধে লিখেন, মহাবিশ্বের কোন সীমানা নেই। কিন্তু জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দেখান যে eternal inflaton বলে কিছুই নেই। তবে মালটিভার্স থাকলেও থাকতে পারে। তার এই শেষ গবেষণায় তিনি সৃষ্টিতত্ত্বের এক অন্যতম বিষয়কে ভুল প্রমাণ করেন। তার এই গবেষণার হিসাব থেকে পদার্থবিদরা মহাবিশ্বের ধ্বংসের সময়কালের ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারবেন এবং আদৌ মালটিভার্স আছে কি-না তাও দেখাতে পারবেন।

হকিং-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

জন্ম ও শিক্ষা : পুরো নাম স্টিফেন উইলিয়াম হকিং। পরিবারের অনেকে তাকে স্টিভ বলেও ডাকতো। ১৯৪২ সালের ৮ই জানুয়ারী ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ফ্রাঙ্ক (১৯০৫-১৯৮৬) অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিসিনে পড়াশোনা করে চিকিৎসা গবেষক হিসাবে কাজ করতেন। মা ইসাবেল এলিন হকিং (১৯১৫-২০১৩) একই বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে অধ্যয়ন করেছেন। দুই বোন ফিলিপ্পা ও মেরি ছাড়াও পরিবারে ছিল পালিত ভাই এ্যাডওয়ার্ড ফ্রাঙ্ক ডেভিড।

১৯৪৮ সালে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন শুরু হয়। স্কুল জীবনে তিনি আইনস্টাইন বলে পরিচিত হন। বন্ধুদের এই অভিধা ঠিক প্রমাণ করে তিনি হয়েছিলেন কালের নায়ক। যদিও স্কুলের শুরুটা তার আশানুরূপ ছিল না। তিনি শিক্ষা ব্যবস্থাকে দোষারোপ করে স্কুল ত্যাগ করেন। স্কুল জীবনে তিনি বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতেন, বোর্ড গেম খেলতেন, আতশবাজী প্রস্ত্তত করতেন, উড়োজাহাজ ও নৌকার মডেল তৈরি করতেন। পাশাপাশি খ্রিষ্টান ধর্ম ও ইন্দ্রীয় বহির্ভূত অনুভূতিকর বিষয়ে আলোচনা করতেন। স্কুল শিক্ষক ডিকরান তাহরার অনুপ্রেরণা পরবর্তীতে হকিং শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন। ১৯৫৮ সালে তাহরার সহযোগিতায় ঘড়ির অংশবিশেষ, পুরনো টেলিফোনের সুইচবোর্ড ও অন্যান্য রিসাইক্লিং উপাদান দিয়ে কম্পিউটার তৈরি করেন। বিজ্ঞানে হকিং-এর সহজাত আগ্রহ ছিল। তিনি চেয়েছিলেন গণিতে পড়াশোনা করতে। কিন্তু গণিতে সণাতকদের তখন বেশী চাকরির ব্যবস্থা ছিল না বিধায় তার পিতা আপত্তি করেন। তাছাড়া অক্সফোর্ডে গণিত বিষয়ে পড়ানো হ’ত না। অবশেষে পদার্থ ও রসায়ন বিষয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। তার আগ্রহের বিষয় ছিল মূলত তাপগতি বিদ্যা, আপেক্ষিকতা এবং কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। ১৯৫৯ সালে ১৭ বছর বয়সে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ভর্তি হন। প্রথম দিকে তিনি বেশ বিরক্ত হন ও একাকীত্ব বোধ করেন। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা তার কাছে ‘হাস্যকর রকমের সহজ’ মনে হ’ত। পদার্থ বিদ্যার শিক্ষক রবার্ট বারম্যান বলেন, ‘তার শুধু জানা দরকার ছিল, এটা করা যায়। তবে কিভাবে করা যায় বা অন্যরা কিভাবে করেছেন, তা না দেখে নিজেই করতে পারতেন’। পরবর্তীতে তিনি কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত গণিত ও তত্ত্বীয় পদার্থ বিজ্ঞানে সণাতকোত্তরে ভর্তি হন। এসময় তিনি মোটর নিউরোন ডিজিজে আক্রান্ত হন। তার সকল মাংসপেশী ধীরে ধীরে অবশ হয়ে আসে। দু’বছর পর রোগের প্রকোপ কমলে তিনি পুনরায় পি.এইচডি অভিসন্দর্ভের কাজ এগিয়ে নেন। ২৩ বছর বয়সে ১৯৬৬ সালে তিনি ‘প্রসারণশীল মহাবিশ্বের বৈশিষ্ট্যসমূহ’ বিষয়ের উপরে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন।

পারিবারিক জীবন : ১৯৬২ সালে তিনি যখন কেম্ব্রিজে স্নাতক শ্রেণীর শিক্ষার্থী, তখন তার বোনের বান্ধবী জেম ওয়াইল্ড-এর সাথে পরিচয় হয়। ১৯৬৩ সালে তিনি মোটর নিউরোন রোগে আক্রান্ত হ’লেও ১৯৬৪ সালে জেনের সাথে বাগদান সম্পন্ন হয়। এই বাগদান তাকে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা যোগায়। ১৯৬৫ সালে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পত্তির দু’টি পুত্র রবার্ট ও টিমোথি এবং একটি কন্যা লুসি। ১৯৯৫ সালে জেনের সাথে তার বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে এবং একই বছর হকিং তার সেবিকা এলিয়েন মেসনকে বিয়ে করেন। পরবর্তী ২০০৬ সালে মেসনের সাথে পুনরায় বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে এবং জেনের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ট হয়।

রোগাক্রান্ত হকিং : অক্সফোর্ডে গ্রাজুয়েট স্টিফেন হকিং ১৯৬২ সালে পা রাখলেন কেম্ব্রিজের সুরম্য আঙ্গিনায়। ঠিক সেই সময় দুরারোগ্য স্নায়বিক রোগ এ্যামায়াট্রেফিক ল্যাটারাল স্লেরোসিস বা এএলএস রোগে আক্রান্ত হন। ডাক্তাররা তার জীবনের মেয়াদ বেঁধে দিলেন ২ বছর। এটি মূলতঃ একটি মোটর নিউরোন রোগ, যা লাউ গেহরিক নামেও পরিচিত।

প্রাণীর ত্বক অনুভূতি গ্রহণ করে। এ অনুভূতি সেন্সরি নিউরোনের মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌঁছায়। মস্তিষ্ক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ সিদ্ধান্ত মোটর নিউরোনের মাধ্যমে ক্রিয়াস্থলে পৌঁছায়। এভাবে আমাদের ইচ্ছাধীন পেশীগুলো নড়াচড়া করে ও কার্য সম্পাদন করে। অর্থাৎ মোটর নিউরোন মস্তিষ্ক ও ঐচ্ছিক পেশীর মধ্যে সংযোগ রক্ষা করে। ঐচ্ছিক পেশীর কাজ যেমন আমরা ইচ্ছামতো কথা বলি, চিবাই, নড়াচড়া ও হাঁটাচলা করি ইত্যাদি। এএলএস রোগে মোটর নিউরোন নষ্ট হয়ে যায় বা মারা যায়। ফলে মস্তিষ্ক তার বার্তা পেশীতে পৌঁছাতে পারে না। এতে ঐচ্ছিক পেশী বেঁচে থাকে কিন্তু কাজ করে না। সকল পেশী অবশ হয়ে যায়। ফলে কথা বলতে পারে না বা কথা জড়িয়ে যায়। খাবার গলধঃকরণ করতে পারে না এমনকি শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। National Institute of Nurological Disorder And Strok মতে এ রোগটি যেকোন বয়সে হঠাৎ হ’তে পারে। এতে বংশগত কোন প্রভাব নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগী ৩-৫ বছরের মধ্যে মারা যায়।

স্টিফেন হকিং ৩০ বছর বয়স থেকে কেবল মাথা ও হাতের কিছু সীমাবদ্ধ নড়াচড়া ছাড়া পুরো শরীরের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হারিয়ে হুইল চেয়ারে বন্দি হন। ১৯৮৫ সালে তীব্র নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু মুখে পতিত হ’তে চলেছিলেন। শ্বাস নিতে পারছিলেন না। বিধায় শ্বাসনালী কেটে সেখানে টিউব বসানো হয়। এতে তিনি সুস্থ হন কিন্তু বাকশক্তি সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেন। ভয়েস সিন্থেসাইজারের মাধ্যমে তিনি মিনিটে পনেরটির মতো শব্দ বলতে পারতেন। ২০০৮ সালে আঙ্গুলও অসার হয়ে পড়ে। তখন চোখের পেশী নাড়িয়ে যোগাযোগ করার ব্যবস্থা করা হয়।

কর্মজীবন : তাত্ত্বিক কসমালোজি তথা মহাবিশ্ব সৃষ্টি তত্ত্ব ও কোয়ান্টাম মাধ্যাকর্ষণ ছিল হকিং-এর প্রধান গবেষণা ক্ষেত্র। তিনি কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মজীবন শুরু করেন এবং পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের লুকাসিয়াম অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত থেকে ১লা অক্টোবর ২০০৯ সালে অবসর নেন। এসময় তিনি নানা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ফেলো হিসাবে কাজ করেছেন। প্রায় ২ শতাধিক গবেষণা নিবন্ধ লিখেছেন। তাকে নিয়ে বেশ কিছু চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। তার কর্মের জন্য এক ডজনেরও বেশী সম্মাননা ডিগ্রী ও নানা পুরস্কার পেয়েছেন। বিভিন্ন গবেষণাগারের নামকরণ করা হয়েছে তার নামে। তার চিন্তাধারায় উজ্জীবিত হাযারো তরুণ এখন কাজ করছে সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে। সমসাময়িক অনেক বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীরাই কাজ করেছেন জ্যোতিঃপদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে। তবে স্টিফেন হকিং মূলতঃ তিনটি কারণে তারকা বিজ্ঞানী হয়েছেন :

১. সৃষ্টি তত্ত্বের উপর মৌলিক গবেষণা : দুর্ঘটনায় সংজ্ঞাহীন কোন ব্যক্তি হাসপাতালের বিছানায় জ্ঞান ফিরে পেয়ে যেমন জিজ্ঞেস করে, আমি এখানে কেন? আমার কোথায় কি হয়েছিল? এখানে কিভাবে আসলাম? ঠিক তেমনিভাবে সাধারণ মানুষ, জ্ঞানী বা বিজ্ঞানী সবার মন সাধারণ কিছু প্রশ্নের উত্তর পাবার জন্য ব্যাকুল হয়। আর তা হ’ল আমরা এখানে কেন? কোথা থেকে এসেছি? পৃথিবী যেমনভাবে আছে, তেমনভাবে কেন আছে? এর শুরু ও শেষইবা কি? হকিং গবেষণা করে উত্তর দিয়েছেন, তাই মানুষ ছুটে গিয়েছে তার কাছে।

২. ফলাফল সহজভাবে উপস্থাপন : হকিং ছিলেন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ। যার গবেষণা মূলতঃ গণিতের জটিল সমীকরণের। যা সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, অধিকাংশ বিজ্ঞানীদের কাছেও দুর্বোধ্য। তবে তিনি তার চিন্তাধারাকে মানুষের জন্য সহজভাবে উপস্থাপন করেছেন। এমনকি তার বিখ্যাত বই A Brief History of Time-এ E=mc2 ছাড়া অন্য কোন সমীকরণ ব্যবহার করেননি। এ কারণেই বইটি সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের তালিকায় উঠে এসেছে। অল্প মূল্যের স্বল্প ভাষায় গভীর জ্ঞানের সহজ গল্প তাকে সহজে পরিচিতি দেয়। তার বন্ধুবর রজার পেনরাজে বলেন, পক্ষাঘাতগ্রস্ততার কারণে হকিং-এর কথা বলতে কষ্ট হ’ত। অনেক সময় নিয়ে একটা শব্দ উচ্চারণ করতে হ’ত তাকে। এ কারণে কথা বলার সময় তিনি ছোট ছোট বাক্যে ভাব প্রকাশের অভ্যাস গড়ে নিতে বাধ্য হন। লেখার ক্ষেত্রেও সেই প্রভাবটা পড়েছিল। ফলে তার ভাষা ছিল চমৎকার ও সহজবোধ্য।

৩. শারীরিক প্রতিবন্ধকতা : শারীরিক প্রতিবন্ধকতা, মানসিক শক্তির কাছে কিভাবে পরাজয় বরণ করে তা যথার্থভাবে দেখিয়েছেন হকিং। এ প্রতিবন্ধকতা তার জীবনে বড় আশীর্বাদ হয়ে আসে। এ প্রতিবন্ধকতা তাকে দিয়েছিল নিরবচ্ছিন্ন সময় যা তিনি ব্যয় করেছেন গবেষণার কাজে। এ প্রতিবন্ধকতা তাকে দিয়েছিল পরিচিতি। হুইল চেয়ারের বিজ্ঞানী, প্যারালাইসড বিজ্ঞানী বা প্রতিবন্ধী বিজ্ঞানী বললেই সবার চোখে ভেসে আসে একটি নাম স্টিফেন হকিং। তিনি যতটা মানুষের কাছে পৌঁছেছেন, তার চেয়ে মানুষ বেশী পৌঁছেছে তার কাছে। হকিং সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কৌতুহল, তাকে তার বৈজ্ঞানিক কর্মকান্ড থেকেও অনেক উচ্চতায় নিয়ে গেছে।

উপসংহার : হকিংয়ের মতে ধর্ম হচ্ছে কর্তৃত্ব করা আর বিজ্ঞানের ভিত্তি হ’ল পর্যবেক্ষণ ও যুক্তি। তবে জয় হবে বিজ্ঞানেরই, কারণ এটা কার্যকর। যদিও তার নিজের কোন তথ্যই পর্যবেক্ষিত ও প্রমাণিত নয় এবং ভবিষ্যতে প্রমাণের কোন সম্ভাবনাও বিজ্ঞানীরা দেখছেন না। আর এটিকেই তার নোবেল পুরস্কার অপ্রাপ্তির কারণ হিসাবে দেখানো হয়েছে। তবে ধর্ম যে কর্তৃত্ব করে এ ধারণা তার এসেছে খৃষ্টান ধর্মের ধর্মগুরুদের অযৌক্তিক আচরণের কারণে। কারণ ক্যাথলিক ধর্মগুরুরা বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের নিয়ে বাইবেলকে বিজ্ঞান সম্মত প্রমাণ করতে বারে বারে সংস্করণ আনতেন। বাইবেলের পুরাতন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের বিপরীতে কোন বিজ্ঞানী নতুন তথ্য উপস্থাপন করলে তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে পর্যন্ত তার প্রতিরোধ করতেন।

বিজ্ঞানী গ্যালিলিওর উপর অমানুষিক আচরণ তার জ্বলন্ত প্রমাণ। বিজ্ঞান গবেষণার স্বাধীন ক্ষেত্রে পোপদের এরূপ রূঢ় আচরণ হকিং-কে বিষিয়ে তুলেছিল। তবে তার গবেষণার বড় ব্যর্থতা এই যে তিনি অবশেষে সৃষ্টিকর্তার সন্ধান পেলেন না। পরকাল বলেও কিছু জানতে পারলেন না।

মানুষের চর্ম চক্ষুর দর্শন ক্ষমতা অতীব সামান্য। ৩৯০-৭০০ nm তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো মানুষ দেখতে পায়। দৃষ্টিসীমাও সীমিত। অনুবীক্ষণ বা দূরবীক্ষণ যন্ত্র দৃষ্টির এ সীমাবদ্ধতা অতি সামান্য দূর করেছে। মানুষের কর্ণকুহর ২০-২০০০০ Hz-এর মধ্যেই কেবল শুনতে পায়। একইভাবে নাক, জিহবা ও ত্বকের রয়েছে সীমাবদ্ধ ক্ষমতা। সীমার কম বা বেশী হ’লে আমাদের কাছে তা নেই বলে বিবেচিত হয়। মানুষের জ্ঞান সীমিত। তাই মানব সৃষ্ট বিজ্ঞান চূড়ান্ত সত্যের মানদন্ড নয়। বিজ্ঞান প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। আজ যা ঠিক, কাল তা ভুল। কিছুকাল আগেও নিউটন ও আইনস্টাইন এর চরম বৈপরীত্য বেশ উপভোগ্য ছিল। মানুষের এই জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা তখন দূরীভূত হয় এবং প্রকৃত সত্যের আবির্ভাব ঘটে যখন সৃষ্টিকর্তার অহি-র জ্ঞানের সাথে তার সংযোগ ঘটে। আল্লাহ বলেন, ‘সত্য আসে তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে’ (কাহফ ১৮/২৯)। ঈমানদারগণ নিজেরা বিজ্ঞান চর্চা করেন ও বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারকে স্বাগত জানান, প্রীত হন, যখন কোন আবিষ্কার অহি-র তথ্যের সাথে মিলে যায়। তবে অসংলগ্নতা দেখা দিলে বিন্দুমাত্র বিচলিত হন না। কারণ ঈমানদারগণ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, অহি-র বাণী আল-কুরআন শাশ্বত সত্য। এটি বিজ্ঞানের গ্রন্থ না হ’লেও এটি বিজ্ঞানময়, বিজ্ঞান গবেষণার উৎস এবং বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সত্যায়নকারী।

পরিশেষে আমরা সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, আমরা যেন আমাদের মস্তিষ্ক প্রসূত কল্পনার কালিমায় ও জল্পনার জটে জড়িয়ে না পড়ি। সঠিক পথে গবেষণা করে সৃষ্টিকর্তার সন্ধান জনসমাজে উপস্থাপন করতে পারি। অচল দেহের সচল মস্তিষ্কের আলোচিত মানুষটি, সচল দেহের উদাস মস্তিষ্কের চৈতন্য ফিরাবে কি?


[1]. নিঃসন্দেহে মানুষকে অতি অল্পই জ্ঞান দেয়া হয়েছে। সেকারণ তারা আজও নিজ দেহে বাস করা নিজ আত্মার সন্ধান পায়নি। তাকে দেখতে পায়নি, ছুঁতে পারেনি বা ধরতে পারেনি। অথচ এই অদৃশ্য বস্ত্তটিকে বিশ্বাস না করে তার উপায় নেই। মানুষ নিজের আত্মাকে না দেখে বিশ্বাস করে। অথচ নিজের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে না দেখে বিশ্বাস করে না। জন্মের আগে মানুষের কোন অস্তিত্বই ছিল না। যে মহান সত্তা তাকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে আনলেন, তিনিই আল্লাহ। তিনিই সৃষ্টিকর্তা, রূযীদাতা, জীবন ও মরণদাতা, তিনিই আমার জীবনের পরিচালক ও কর্মবিধায়ক। এ বিশ্বাসটুকু আনার মত স্বল্প জ্ঞানও অনেকের নেই, সে তার আত্মার খবর কি করে জানবে? এমনকি যে বিজ্ঞান নিয়ে আমরা অহংকার করি, সেই বিজ্ঞানের সত্যকে কোন বিজ্ঞানীই অভ্রান্ত বলেননি। বরং তারা সকলেই বলেছেন, Science gives us but a partial knowledge of reality বিজ্ঞান আমাদেরকে কেবল আংশিক সত্যের সন্ধান দেয়। তারা বলেন, ‘আমরা কতিপয় বাহ্য প্রকাশকে দেখি মাত্র, মূল বস্ত্তকে দেখি না। নিঃসন্দেহে সেই মূল সত্তাই হ’লেন আল্লাহ। যিনি অদৃশ্যে থেকে সকল সৃষ্টিকে পরিচালনা করেন। তিনি সকল বস্ত্তর উপরে ক্ষমতাশালী (হূদ ১১/৮; বাক্বারাহ ২/২০ প্রভৃতি)।

শানে নুযুল : হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, একবার কুরায়েশ নেতারা ইহুদী পন্ডিতদের বলল, তোমরা আমাদের এমন কিছু শিখিয়ে দাও, যেটা আমরা এই ব্যক্তিকে প্রশ্ন করব (এবং সে জবাব দিতে পারবে না)। তখন তারা বলল, তোমরা তাকে রূহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস কর। সেমতে তারা জিজ্ঞেস করল। তখন অত্র আয়াত নাযিল হয় (আহমাদ হা/২৩০৯ সনদ ছহীহ)।

– মুহাম্মাদ আব্দুল মান্নান,
সহকারী শিক্ষক, রাজশাহী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ, রাজশাহী।

৩টি মন্তব্য

  1. ‘অবিশ্বাসীরা কি দেখে না যে, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল একত্রিত ছিল। অতঃপর আমরা উভয়কে পৃথক করে দিলাম এবং আমরা পানি দ্বারা সকল প্রাণবান বস্ত্তকে সৃষ্টি করলাম।

    আল্লাহ কি এক জন, নাকি অনেক জন? আপনি যদি এক আল্লায় বিশ্বাস করেন তাহলে উপরে বাক্যে আমরা হবে নাকি আমি হবে। এরকম অসংখ্য ভূল আছে আপনার বিভিন্ন লেখায় যা শিরক এর মত! দয়া করে নিজে পড়ে সংসোধন করে পোষ্ট করবেন।

মন্তব্য করুন

আরও দেখুন
Close
Back to top button