বাটখারাটির ওজন কি আলুর সমান?

অন্যান্য দিনের মতোই ব্যাগ হাতে বাজারে আসলেন চৌধুরী সাহেব। আলুওয়ালার টুকরির সামনে ঝুঁকে আলু বাছতে লাগলেন। অন্যান্য দিনের মতোই একটা পলিথিনে ফুঁ দিয়ে চৌধুরী সাহেবের সামনে মেলে ধরলো আলুওয়ালা। পছন্দ মতো আলু নিয়ে পলিথিনে পুরলেন চৌধুরী সাহেব। চোখের আন্দাজে এক কেজির মতো হবে। আলুওয়ালা সেটা নিয়ে রাখলো দাঁড়িপাল্লার এক দিকে। ঠক করে আরেকদিকে বসালো এক কেজির বাটখারা। বেশ খানিকটা ঝুঁকে গেলো বাটখারার পাল্লাটি।
হাত বাড়িয়ে আরো কয়েকটা আলু পুরতে যাবে আলুওয়ালা। এমন সময় ঘটলো বিপত্তি। চৌধুরী সাহেব প্রশ্ন করে বসলেন, “তোমার বাটখারাটা কি এই এক কেজি আলুর সমান ওজনের?”
কিছুক্ষণ বোকার মতো চেয়ে থেকে আলুওয়ালা জিজ্ঞেস করলো, “জ্বে ছার?” চৌধুরী সাহেব আবার শুধালেন, “বলছি তোমার যে এই বাটখারাটা, সেটা কি আমার তোলা এই এক কেজি আলুর সমান ওজনের?”
চৌধুরী সাহেব যে উল্টো বলছেন এ নিয়ে তাঁকে লজ্জায় ফেলতে চাইলো না আলুওয়ালা। বললো, “ছার, আলু এক কেজির একটু কম হইছে। আমি আর কয়েকটা দিয়া সমান কইরা দিতাছি।”
এইবার তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন চৌধুরী সাহেব, “মূর্খ আলুর ব্যাপারী! আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি এক কেজি আলু তুলেছি। তোর বাটখারাতেই সমস্যা।”
এই বলে কোত্থেকে একটা মেটাল কাটিং ব্লেড বের করে আনলেন চৌধুরী সাহেব। ঝাঁআঁআঁআঁ আওয়াজে ঘুরতে লাগলো যন্ত্রটি। বাটখারাকে আজ সাইজে এনে ছাড়বেন তিনি। এই না দেখে আলুওয়ালা তার দাঁড়িপাল্লা, বাটখারা সব গুটিয়ে লুঙ্গিতে কাছা মেরে আলুর ঝাঁকা মাথায় তুলে এক দৌড়ে শহর-গঞ্জ-সেতু-সাঁকো-মাঠ-নদী-ঘাট-হাট পেরিয়ে গ্রামের বাড়িতে।
চৌধুরী সাহেবের ভুলটা নিশ্চই পাঠকদের চোখ এড়ায়নি। যথাযথ কর্তৃপক্ষ একমত হয়ে এক কেজি কতটুকু হবে, সে স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ করেছে। এম.কে.এস. পদ্ধতি অনুসরণ করে যেখানে ওজন (ফিজিক্সের ভাষায় ‘ভর’) মাপা প্রয়োজন, সেখানে এই স্ট্যান্ডার্ড পরিমাণের উপর ভিত্তি করে তৈরি বাটখারা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সেই একই পরিমাণ নকল করে যত বাটখারা তৈরি হচ্ছে, তার ওজন এই এক কেজিই হবে। এর অর্ধেক হলে আধা কেজি, দ্বিগুণ হলে দুই কেজি…ইত্যাদি। চৌধুরী সাহেবের চোখের দেখায় তোলা আলুর ওজনের ভিত্তিতে বাটখারা পরিবর্তিত হবে না। বাটখারার ভিত্তিতেই আলু বাড়বে কমবে।
হয়তো মনে প্রশ্ন জাগছে “হুজুর হয়ে আলু-বাটখারার খোঁজ রাখেন কেন?” তাহলে ক্লিয়ার করা যাক।
ইসলামকে আমরা গ্রহণ করবো কি করবো না, তা আমরা নির্ণয় করতে চাই আমাদের মাথায় সেট করা কিছু ধ্যান-ধারণার ভিত্তিতে। তাই আমাদের মনে হাজারো প্রশ্ন! “ইসলাম কি শান্তির ধর্ম?” “ইসলাম কি বিজ্ঞানসম্মত ধর্ম?” “ইসলাম কি গণতান্ত্রিক ধর্ম?” “ইসলাম কি নারী স্বাধীনতার ধর্ম?”…ইত্যাদি।
না। ইসলাম এইসব কোনোকিছুর ধর্মই না। ইসলাম ইসলামই। এটিই স্ট্যান্ডার্ড। আর আপনার সংজ্ঞায়িত শান্তি, বিজ্ঞান, গণতন্ত্র, নারী স্বাধীনতা ইত্যাদি হচ্ছে সেই আলু, ইসলামের নিক্তিতে যা বেড়ে-কমে সঠিক পরিমাপে আসবে।
আপনার নিজের স্বার্থ যেখানে ক্ষুণ্ণ হয় না, সেটাই আপনার সংজ্ঞানুযায়ী শান্তি।
একের পর এক আসতে থাকা হাইপোথিসিস, থিওরি আর ফ্যাক্ট, যার অনেকগুলো আবার এক শতাব্দী পর পর ভুল প্রমাণিত হয়, এ সবের সমষ্টিই হলো আপনার সংজ্ঞায়িত বিজ্ঞান।
অধিকাংশ সুবিধাবাদীর যেটা পছন্দ, সেটাকেই চাপিয়ে দেওয়া হলো আপনার সংজ্ঞা মতে গণতন্ত্র।
আর নারী স্বাধীনতার পলিটিক্সের তো এক বাক্যে সংজ্ঞা দেওয়াটাই অসম্ভব।
ইসলাম আপনার আবিষ্কৃত অত-শত আলুর পরিমাণ মেনে চলে নাযিল হয়নি। ইসলাম এগুলো মানতে বাধ্যও নয়। আপনিও এগুলো দ্বারা ইসলামকে বিচার করে কোনো স্থির সিদ্ধান্তে আসতে ঝামেলায় পড়বেন।
১৩ বছর যাবত মক্কায় কেবল তাওহীদ-রিসালাত-আখিরাতের মতো বুনিয়াদি বিষয়গুলো নিয়ে আয়াত নাযিল হয়েছে। আল্লাহ যে আছেন এবং একজনই আছেন, নবী রাসূল যে আসেন এবং আসার প্রয়োজনীয়তা আছে, আখিরাত যে বাস্তব এবং যৌক্তিক, এসব কথা বিভিন্নভাবে বোঝানো হয়েছে। বলা হয়েছে “আফালা তা’ক্বিলুন?” তোমরা কি চিন্তাভাবনা করো না?
মাদানী যুগে নাযিল হওয়া শুরু করেছে হালাল-হারাম ফরয-মুস্তাহাব সংক্রান্ত হুকুম আহকাম। বলা হয়েছে ভাই পাবে বোনের দ্বিগুণ, স্ত্রী থাকবে একই সময়ে অনুর্ধ্ব চারজন। আল্লাহ ভালো করেই জানতেন তৎকালীন সমাজে এগুলো নারীর অতিরিক্ত ক্ষমতায়ন বলে গণ্য হবে। আবার অদূর ভবিষ্যতেই কোনো একটা সময় এগুলোকেই মানুষ নারীর প্রতি বর্বরতা বলবে। কিন্তু লম্বা-চওড়া ব্যাখ্যার পেছনে দীর্ঘ সময় ব্যয় করা হয়নি। কুরআন মুমিনের বৈশিষ্ট্য বলে দিচ্ছে “সামি’না ওয়া আত্বা’না!” আমরা শুনলাম এবং মানলাম।
ইসলামের প্রতিটা বিধানই যৌক্তিক এবং সর্বোচ্চ কল্যাণময়। মনের প্রশান্তি ও অমুসলিমদের দা’ওয়াহ করার জন্য সেগুলো গবেষণা করা দোষের নয়। কিন্তু আপনার সীমিত ও পক্ষপাতদুষ্ট ইন্টেলেক্টের সামনে এসব কখনো স্পষ্ট হবে, কখনো হবে না। বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন সমাজে বিভিন্নরকম আচার-প্রথা দিয়ে প্রভাবিত মানুষেরা ইসলামকে বিভিন্নভাবে দেখবে। কিন্তু ইসলাম চায় আপনি তাকে সেভাবেই বুঝুন যেভাবে সাহাবাগণ বুঝেছেন।
তাই চৌধুরী সাহেবদের মতো হবেন না। বরং চৌধুরী সাহেবদেরকে সামনে পেলে বলে দিন, “চৌধুরী সাহেব!!! আলু দিয়ে বাটাখারা মাপবেন না।”
#হুজুর হয়ে