কেন?
কেন?
খুব ছোট্ট একটা প্রশ্ন, উত্তরটাও তেমন কঠিন নয়। কিন্তু উত্তরটা অজানা অনেকেরই।
মানুষকে জিজ্ঞেস করে দেখেন, কেন আপনি এ কাজটা করছেন? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জবাব পাবেন না। বেশিরভাগ মানুষের এখন আর চিন্তা করার সময় নেই। তারা যন্ত্রের মতো কাজ করে যাচ্ছে। কেন করছে ভাবছে না।
কিন্তু পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছে যারা বোঝে কেন তারা কাজটা করছে। ছোট্ট একটা উদাহরণ দিই।
আমি চা পান করি না। অভ্যাস নেই। আমার বাবা-মা দুজনেরই অভ্যাস আছে। আমার স্ত্রী শত কাজের মাঝেও চা বানিয়ে দেয় বাবা-মাকে। অথচ নিজের জন্য বানায় খুব কম। বানালেও কাজের চাপে সেটা খেতে পারে না। অথবা ভুলে যায়। তাহলে, কেন সে আমার বাবা-মাকে চা বানিয়ে দেয়? টাকা-পয়সার জন্য? সে তো টি-গার্লের চাকরি করে না। সে কোনো চাকরিই করে না। আমাদের সংসারে তাঁর দেওয়া শ্রমটার কোনো মজুরি আমরা দিই না।
তাহলে কেন?
এই কেনটার উত্তর পেতে হলে আমাদের বুঝতে হবে টাকা-পয়সার প্রেরণা ছাড়াও মানুষ অনেক কাজ করে। যদিও অধুনা সেকুলার শিক্ষা সফলভাবে আমাদের মাথায় ঢোকাতে পেরেছে যে—যে কাজের বিনিময়ে টাকা নেই—সেটা মূল্যহীন।
– সারাদিন অফিস করে আবার বাসায় গিয়ে শশুর-শাশুড়ি-স্বামীর সেবা করতে হবে? উনি কি দেবতা? তুমি কি দাসী?
– তোমার স্ত্রী তো সারাদিন বাসায় শুয়ে বসে থাকে। বাচ্চা বুঝি আর কারো হয় না? তার কাপড়টাও ধুয়ে দিতে হবে তোমাকে? ছি ছি, স্ত্রৈণ বুঝি একেই বলে!
– রফিক সাহেব, সারাজীবন কত মানুষ চরালেন, এখন এই বুড়োবেলা নাতি-পুতিকে স্কুল থেকে আনা-নেওয়া করতে করতে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন? আপনার ছেলে বিনিপয়সায় ভালো দারোয়ান পেয়েছে।
– আপা, আগে ছেলে-মেয়ের গুয়ের ক্যাথা ধুয়েছেন এখন নাতি-নাতনীরটা ধুচ্ছেন। বান্দীগিরির জীবন!
এই কথাগুলো আমাদের বহু শোনা। মা বাচ্চাকে দুধ খাওয়াবে—এই অমূল্য ব্যাপারটা এখন মূল্যহীন হয়ে গেছে।
অথচ, মোবাইল কোম্পানিতে কাজ করা মেয়েটা যখন কাস্টমার কেয়ারে কাজ করে, বিলবোর্ডে হাসিমুখে ছবি ওঠে—‘আপনারই জন্য আমরা; কথা দিলাম’—তখন আমরা প্রীত হই। বিমানবালারা পানি দেয়, চা দেয়, খাবার দেয়—অনেক টাকা বেতন পায়। আমরা তাদের হিংসার চোখে দেখি। ছেলে-মেয়েরা কোচিং করে, প্রশিক্ষণ নেয়—তাদের স্বপ্ন কেবিন ক্রু হবে, এয়ার হোস্টেস হবে।
আমরা শুনি, বউকে বলা হয়, তোমার শশুর-শাশুড়ির কোনো অধিকার নেই তোমার কাছ থেকে সেবা পাবার। কেউ কথাটাতে ইসলামের প্রলেপ দেয়—ইসলাম বাধ্য করেনি স্ত্রীকে স্বামীর বাবা-মায়ের সেবা করতে। কথাটা সত্যি। তবে যারা কথাটা বলছে তারা সত্য প্রচারের জন্য কথাটা বলছে না। কিছু অধিকারের কথা বলা, আর কিছু অধিকারের কথা লুকানো অন্যায়।
পৃথিবীতে ১+১=২ যেখানে একেবারেই চলে না তাকে বলে সংসার। একটা মেয়েকে জীবনে দেখিনি-শুনিনি। দুদিনের দুটো কথার পরে বিয়ে হয়ে গেল। সে আজ কত আপন। সে আমার সন্তানদের মা। আমার ঘরের রাণী। এটা কোন হিসেবে পড়ে?
সংসার ছাড় দেওয়ার জায়গা। কেউ বেশি দেবে, কেউ কম। একের অভাব অন্য পরিপূর্ণ করে দেবে। অধিকার ফলিয়ে সংসার টিকে থাকে না। টিকে থাকে ছাড় দেওয়ার উপরে। ত্রুটিগুলো দেখেও না দেখার ভান করাতে। অন্যের ভুলকে ভুলে যাওয়াতে। প্রত্যাশা কমানোতে। যা পাই—তাতেই খুশি। কিছু না পাই যদি, তাও খুশি। আলহামদুলিল্লাহ। কেন? আল্লাহকে খুশি করার জন্য।
আপনি সারাজীবন সেবা করেও স্বামীর সন্তুষ্টি না পেতে পারেন। আপনি সারাজীবন মাসের পুরো বেতন স্ত্রীর হাতে তুলে দিয়েও তার মন না পেতে পারেন। আপনি অনেক পড়াশোনা করলেন, তাও আপনার বাবা-মা আপনার ওপর খুশি নাও হতে পারেন।
আপনার সারাজীবনের সঞ্চয় দিয়ে আপনি একটা বাড়ি বানালেন; তারপরেও কোনো নিশ্চয়তা নেই যে বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের কাছে শুনবেন না, ‘একটা ফ্ল্যাট ছাড়া আর দিয়েছটা কী?’ কিন্তু আপনি যদি আল্লাহকে খুশি করার জন্য কাজ করে থাকেন তাহলে প্রত্যেকটি দিনের প্রতিটি কাজের বিনিময় আপনি আল্লাহর কাছে পাবেন।
আপনার বাচ্চা যে কামড়টা দিত দুধ খাওয়ার সময়—সেটার বিনিময় আপনি আল্লাহর কাছে পাবেন। ওই ব্যাথার বিনিময়ে আপনার গুনাহ মাফ হবে। আর কারো কাছে সেটা নিয়ে অভিযোগ না করে ধৈর্য ধরার সাওয়াব পাবেন আল্লাহর কাছে অগুণতি। বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানো কুরআনের নির্দেশ। এই নির্দেশ যখন আপনি আল্লাহকে খুশি করার জন্য পালন করছেন—তখন এর বিনিময়ে আপনি আল্লাহর কাছে প্রতিদান পাবেন।
যাদের আল্লাহ নেই, তাদের কাছে বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানো অর্থহীন মনে হতেই পারে। অ্যামেরিকার ২৫ ভাগ মা জন্মের পরে বাচ্চাদের বুকের দুধ খাওয়ান না। কেন? উন্নত বক্ষের সৌন্দর্য ধরে রাখতে? আল্লাহ জানেন। ডাক্তাররা বলেন, জন্মের পরের ছয়মাস বাচ্চাদের শুধু বুকের দুধ খাওয়ানো উচিত, অন্য কিচ্ছু না। অ্যামেরিকাতে প্রতি একশটা বাচ্চার মধ্যে মাত্র ১২ জন জন্মের পরের ছয়মাস মায়ের দুধ খাওয়ার সৌভাগ্য পায়। বাকিরা পায় না। কেন? মাকে চাকরিতে ফিরে যেতে হয়। বুকের দুধের দাম মেটানো হয় বেবি ফরমুলায়। কৃত্রিম দুধে কি বাচ্চার অভাব পূরণ হয়? না। বছরে প্রায় ৯০০টা বাচ্চা মারা যায় এমন সব অসুখে যাদের বুকের দুধ খাওয়ালে ওসব অসুখে তাদের পড়তে হতো না। যারা মারা যায় না তাদের চিকিৎসায় খরচ হয় ১৩ বিলিয়ন ডলার![1]
কিন্তু ওই যে, সমাজ আমাদের বুঝিয়েছে মায়ের দুধ ফাও। টাকা তো আর কামাই হচ্ছে না। কাজে যাও, টাকা কামাও তবেই না তোমার দাম আছে। আমরা আল্লাহর কাছে দামী হতে চাই না, মানুষের কাছে দাম পেতে চাই। আমরা যখন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করব তখন আমাদের জীবনের অর্থ খুঁজে পাব।
সারাদিন সিয়াম থেকে জরুরি ফোন কলে রক্ত দিতে কেন যাবেন? আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। রাত বারোটায় কেউ মারা গেছে। আমার মাকে দেখতাম, রাত একটায় বেরিয়ে গেছেন। বাবা বসে থাকতেন রাত চারটা অবধি। মা আসবেন, দরজা খুলে দেবেন। কেন? কোন লাভে? আল্লাহকে খুশি করার জন্য।
বন্যায় ত্রাণ দিতে গিয়ে মানুষের কালোমুখ দেখতে হয়। তাদের ধারণা ত্রাণের টাকা আমরা মেরে দিয়েছি। কথাটা নেহায়েত মিথ্যা নয়। এক কুড়িগ্রামেই ৬৫ লাখ টাকার সরকারী ত্রাণের বরাদ্দ চাল লোপাট হয়ে গিয়েছে। [2] এখন আমরা যে নিজেদের পকেটের টাকা থেকে চাল কিনে এনেছি সেটা তো আর সাধারণ মানুষ জানে না। তারা ভাবে আমরাও চোর। সে কথা তারা শুনিয়েও দেয়। এরপরও কেন আমরা ত্রাণ নিয়ে যাই? আমরা বিশ্বাস করি, মানুষের দুঃখ লাঘব করলে কিয়ামাতের দিন আল্লাহ আমাদের দুর্দশা কমিয়ে দেবেন।
বিদেশে বসে সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠানে, ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা’ গান না গেয়ে দেশে ফিরে আসা কেন? পুলিশি হয়রানি, দুর্নীতি আর করের বোঝা মাথায় নিয়ে সামাজিক ব্যবসা করি কেন? একুশে পুরষ্কার পাবো না জানি। ইউনুস সাহেবের দুর্গতিও চোখে দেখা। আমরা সরকারকে খুশি করার জন্য কাজ করিও না। আমরা বিশ্বাস করি মানুষকে ভালো কিছু দিলে, মানুষের জীবন সহজ করলে, কিছু মানুষের হালাল রিযিকের ব্যবস্থা করলে আল্লাহ খুশি হবেন।
এক ভাই সারাদিন কাজ করে এসে বাসায় ঢুকে আগে মায়ের ঘরে ঢোকেন। তার পা টিপে দেন। কেন? আল্লাহকে খুশি করার জন্য। মা যদি দু’আ করেন—সেটা বোনাস। যদি না-ও করেন—তার কোনো অভিযোগ নেই। কারণ তিনি জানেন তিনি কেন মায়ের সেবা করেন।
অনেকে বলতে পারেন, মায়ের সেবা করা তো প্রাকৃতিক ব্যাপার। এই মানবিক কাজটা কেন তাহলে মানুষরা করছে না। যে মা ছাড়া ছোটোবেলায় একটা মুহুর্ত চলত না, সেই মা আজ এত জঞ্জাল হয় গেল কেন? কেন ভারতের কেরালাতে গত চার বছরে ওল্ড হোমে মানুষদের সংখ্যা ৬৯% বেড়েছে?[3] এমন তো না, এদের ছেলে-পুলেরা গরীব, বাবা-মাকে পালার সামর্থ্য রাখে না। বরং উলটো। বাসার আধুনিক সব হোম অ্যাপ্লায়েন্সের বিপরীতে বুড়ো বাবা-মা বড্ড বেমানান।
মানুষের স্বভাব হচ্ছে সে প্রতিদান চায়। অফিসে কাজ করে মাস শেষে বেতন পাবে বলে। ছোট বাচ্চাকে প্রতিপালন করে, কারণ স্বপ্ন থাকে সন্তান বড় হয়ে মা-বাবাকে দেখবে। কিন্তু আধুনিক সন্তানেরা দেখছে না। কারণ, এদের জীবনে আল্লাহ নেই। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা, যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন, যিনি আমাদের রব্ব—তার প্রতি মানুষ যখন অকৃতজ্ঞ হয়, বাবা-মায়ের প্রতি অকৃতজ্ঞতা তো স্বাভাবিক।
যখন বাবা-মায়ের জীবনে আল্লাহ থাকবে না, তখন আস্তে আস্তে সন্তানের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। কে এত কষ্ট করে বাচ্চা নেবে? রাতের ঘুম হারাম করে বাচ্চা পালবে? কেন? বাচ্চা দেখতে আদর লাগে বলে? তাহলে কুকুরের বাচ্চা পাললেই হয়।
অবাধ যৌনাচারের যুগে ইউরোপে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩ শতাংশ। এখন যত মানুষ আছে—এই সংখ্যাটা ধরে রাখতে হলেও ন্যুনতম জনসংখ্যা থাকতে হবে ২.১ শতাংশ। এই হারে চললে ইটালি, স্পেন, রাশিয়া, ফ্রান্স—এই দেশগুলোর মানচিত্র বদলে যাবে।[4] সংসারের এত দায়িত্ব নেওয়া কেন? এই কেন-র উত্তর না পেয়ে পশ্চিমের দেশে দেশে ডেমোগ্রাফিক উইন্টার নেমে আসছে।
কত পড়া, কত কাজ—এরপরেও ঘরে ফিরে বাচ্চাদের সুযোগ দিই আমার সাথে খেলা করার জন্য। আমার ক্লান্ত শরীরটাতে তারা লাফিয়ে পড়ে; হাত-পা চলে না, তাও ঘোড়া হই। সারাদিন অফিস করে, রাতে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে হাঁটি ঘুম পাড়ানোর জন্য। কেন? আল্লাহকে খুশি করার জন্য। আমার সন্তানেরা যদি কোনোদিন আমার কষ্টের মর্ম না বোঝে—আমার একটুও আফসোস নেই। কেন? কারণ আমি তাদের জন্য যা করেছি সবই করেছি আল্লাহকে খুশি করার জন্য। আল্লাহ একজন মুসলিম হিসেবে যে দায়িত্ব আমাকে দিয়েছিলেন তা পালন করার জন্য।
আমার মা যদি একটা কটু কথা বলেও ফেলেন—আমার স্ত্রী ধৈর্য ধরেন আল্লাহকে খুশি করার জন্য। তিনি বাসায় নতুন কাপড় পড়েন আমাকে দেখানোর জন্য—সেটার পেছনে মূল উদ্দেশ্য আল্লাহ-ই থাকেন। আমি হয়ত খেয়াল করলাম না, কিন্তু আল্লাহ তো তার অন্তরের খবর জানেন। আমার উদাসীনতার কারণে আমার স্ত্রীর প্রচেষ্টা কখনও নিষ্ফল হবে না। কারণ আল্লাহ হচ্ছে মহা হিসাবগ্রহণকারী। তিনি তাঁর জন্য করা তুচ্ছাতিতুচ্ছ কাজগুলোকেও মূল্যায়ন করেন। সামান্য একটা কাজের প্রতিদান বহুগুণে বাড়িয়ে আখিরাতে ফেরত দেন।
যাদের জীবনে এই কেনটা নেই বা কেন-এর সদুত্তর নেই, এদের জীবনের কোনো অর্থ নেই। আছে শুধু নৈরাজ্য, হতাশা। এই হতাশা এরা অন্যদের মাঝে সংক্রমিত করে। এরা নিজের অতি আপনজনদের ভালোবাসতে পারে না। এরা আর্থিক স্বার্থের বাইরে কোনো হিসেব করতে পারে না। তাই স্নেহ-ভালোবাসা, মায়া-মমতা এদের কাছে অর্থহীন, মূল্যহীন। এরা শুধু মাপতে পারে শরীরের সুখ, আরাম। এক মায়ের রাতের ঘুম হারাম করে সন্তানের জন্য জেগে থাকাতে এরা বোকামি ছাড়া অন্য কিছু খুঁজে পায় না।
এইসব সেকুলার মানুষদের জন্য আমরা বুকের ভেতর থেকে করুণা অনুভব করি। এদের কেউ আল্লাহকে ভালোবাসা বুঝিয়ে দেয়নি। আল্লাহর পুরষ্কারের আশা কী জিনিস তা শেখায়নি। এরা ভালোবাসতে শেখেনি। ভালোবাসার মানুষদের সম্মান করতে শেখেনি। ঘৃণাভর্তি একটা ভালোবাসাহীন জীবন নিয়ে এরা চিৎকার করতে থাকে। সারা পৃথিবীকে এদের অসুখের গল্প শোনায়। অথচ আল্লাহর কাছে যদি এরা ফিরে যেতে পারত, আল্লাহকে খুশি করার জন্য প্রতিদিনের প্রতিটা কাজ করতে পারত—একটা অনাবিল সুখ আর শান্তিতে এদের জীবনটা ভরে যেতে পারত!
প্রিয় পাঠক, আপনার জীবনটাকে আপনি কোনদিকে নেবেন এটা একান্তই আপনার সিদ্ধান্ত। আপনি লাখ টাকা বেতন পেয়ে রাতে দুটুকরো শসা আর একটা স্যান্ডুইচ চিবিয়ে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে পারেন। আবার মাত্র ২০ হাজার টাকা কামাই করে ডাল-ভাত মেখে খেয়ে বউ-বাচ্চাসহ এক বিছানায় শান্তিতে ঘুম দিতে পারেন। ঘুমের আগে দু’আ পড়ে ঘুমালে পুরো ঘুমটা ইবাদাত হবে। খাওয়ার আগে বিসমিল্লাহ বললে খাওয়াটা ইবাদাত হবে। স্ত্রী-সন্তানকে খাওয়াবেন বলে কাজ করলে সারাটা দিন ইবাদাতে কাটবে। আল্লাহকে খুশি করতে চান বলে ঘুমানোর আগে আপনি এই তৃপ্তি নিয়ে ঘুমাতে পারবেন যে আজকের দিনের সব কষ্টের প্রতিদান আল্লাহ আখিরাতে দেবেন।
প্রিয় পাঠিকা, আপনি চুলার আগুনের সামনে যে কটা ঘামের বিন্দু ফেললেন—তার প্রতিটার বদলে আল্লাহ আপনাকে একটা করে মুক্তোর মালা দেবেন। একটা করে বাড়ি দেবেন। একটা করে দুনিয়া দেবেন। আপনি যা চাবেন আল্লাহ তাই দেবেন। জান্নাত ব্যাপারটাই এমন। মানুষ সেখানে যা চাবে তাই পাবে। আপনি আল্লাহর জন্য কাজ করেই দেখুন। আপনার শাশুড়ি নাইবা আপনার প্রশংসা করল। আপনার স্বামী আপনাকে ঘরের কাজ নাইবা সাহায্য করল। সংসারের মানুষ আপনার মূল্যায়ন নাইবা করল। আল্লাহ তো করবেন। তিনি ওয়াদা দিয়েছেন তিনি অণু পরিমাণ ভালো কাজের পুরষ্কার মানুষকে দেবেন।
আপনার বান্ধবী মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে অনেক টাকা—কামায়, আপনি তাকে দেখে কষ্ট পাবেন না যেন। আপনার বান্ধবীর জীবনে অন্ধকার আছে, আপনি জানেন না। আপনি জানেন অ্যামেরিকাতে ২৯,০০০ ধর্ষণ হয় কর্মক্ষেত্রে?[5]
আপনি জানেন না একটা মেয়ের দেহ তার অগোচরে কত মানুষ চোখ দিয়ে চেটে খায়। একটা মেয়ে অনেক ভালো কাজ করল—তার বস খুশি হতে পারে, নাও হতে পারে। নতুন আরো সুন্দরী, আরো খোলামেলা কোনো মেয়ে আসলে আপনার বান্ধবীর চাকরিটি চলে যেতেও পারে। বিশ্বাস করেন না, আপনার আপন ১০ জন কর্মজীবি নারীকে জিজ্ঞেস করে দেখুন কর্মক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা। ক’জন ভালো বলে আর ক’জন খারাপ বলে সেটা শুনে আপনি নিজেই একটা পরিসংখ্যান বানিয়ে নিন।
আপনি ঘরে আছেন বলে নিজেকে ছোট ভাবছেন? অথচ আপনি আল্লাহকে খুশি করার জন্য যা-ই করছেন, আল্লাহ তাই লিখে রাখছেন। এর বিনিময়ে তিনি আপনাকে দুনিয়াতে সম্মান দিয়েছেন, আর আখিরাতে যে কী দেবেন—তিনিই জানেন। সেকুলাররা যখন আপনাকে ঘরে বন্দী বলে উপহাস করে তখন জেনে রাখুন—সেই বাইরে বন্দী। তার ঘর নেই বলে সে আপনাকেও ঘর ছাড়া করতে চায়। আপনার স্বাধীনতা দেখে সে আসলে কষ্ট পায়। আকাশে সেই ঘুড়িটাই ওড়ে যার সুতো লাটাইয়ে বাঁধা। যার সুতো ছিড়ে গেছে কারেন্টের তারে জড়িয়ে যায়, ছাদে গোত্তা খেয়ে পথ হারায়। পশ্চিমা স্বাধীনতার চক্করে পড়ে আসল স্বাধীনতা হারাবেন না। আখিরাত হারাবেন না।
শুরুর কেন-তে ফিরে যাই। আপনার জীবনটাকে অর্থবহ করার জন্য এই কেন ভীষণ উপকারী ভূমিকা রাখতে পারে। যেসব কেন-এর উত্তরে আসবে—আল্লাহর সন্তুষ্টি—সেগুলো হলো আসল। বাকি সবকিছু ফালতু। এখন আপনি নিজের হিসেব নিজে করে নিন।
বোন, এই যে আপনি ফেসবুকিং করছেন, অনর্থক কেনা-কাটা করছেন, অন্য মানুষের কাছে স্বামী-শশুরবাড়ির নিন্দা করছেন। কেন? এতে কি আসলেই আপনার জীবনে শান্তি এসেছে? আল্লাহ এতে খুশি হচ্ছেন কি?
ভাই, আপনি স্ত্রীর দোষ নিয়ে সবার সাথে আলাপ করছেন, ফেসবুকে নতুন খাবারের দোকানে চেক-ইন দিচ্ছেন, চায়ের দোকানে বসে বিড়ি খেতে খেতে রাজা-উজির মারছেন। কেন? এগুলো করে কী লাভ হচ্ছে? এর চেয়ে ভালো প্রডাকটিভ কাজ করতে কি আপনি পারেন না? আপনার এসব কথা-কাজে কি আল্লাহ সন্তুষ্ট হচ্ছেন?
আপনার হিসেব আপনি নিজে করে নিন। আমি এই লেখাটা লিখলাম কেন জানেন? আপনাকে একটা বার্তা দেওয়ার জন্য।
সেটাও বা কেন?
আল্লাহকে খুশি করার জন্য।
আল্লাহ যেন আমাদের প্রতিটি গোপন এবং প্রকাশ্য—প্রতিটি ইচ্ছা, কথা এবং কাজ শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করার তাওফিক দেন। আল্লাহ যেন আমাদের তাঁর জন্য মরা এবং তাঁর জন্যই বাঁচার তাওফিক দেন। আমীন।
– শরীফ আবু হায়াত অপু
[1] The Burden of Suboptimal Breastfeeding in the United States: A Pediatric Cost Analysis; Melissa Bartick, Arnold Reinhold; Pediatrics March 2010
[2] কুড়িগ্রামে ২০৫ টন ত্রাণের চাল লোপাট, আহসান হাবীব নীলু, দৈনিক যুগান্তর, ২ অগাস্ট ২০১৬
[3] http:/m.thehindu.com/news/cities/Thiruvananthapuram/oldage-homes-reflect-sorry-statistics/article7670066.ece
[4] http:/www.heritage.org/events/2008/02/demographic-winter-the-decline-of-the-human-family
[5] Crime Characteristics: Summary Findings. 2001. U.S. Dept. of Justice, Bureau of Justice Statistics. Washington, DC. Retrieved January 9, 2004.