জীবনের বাঁকে বাঁকে

প্রত্যাবর্তন

একটি কনজারভেটিভ ধর্মীয় ফ্যামিলিতে আমার জন্ম। শৈশব কৈশোর কেটেছে পরিবারের নিয়মতান্ত্রিক শৃংঙ্খলে।ছোটবেলায় ধর্মের ধরা-বাধা নিয়মকে কখনো উপেক্ষা করেছি, এমনটি মনে পড়েনা।

আমার এখনো মনে আছে ফজরে কোরাস সহকারে কোরআন তেলাওয়াত হতো।মাসের মধ্যে দু’য়েক বার মিলাদ পড়ানো ছিলো আমার বাবার ‘অবশ্য কর্তব্য’ দায়িত্বগুলোর একটি।

এরপর পড়াশুনার সুবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই।ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল।স্কলারশীপ পেয়ে পাড়ি জমাই অ্যামেরিকা। অ্যামেরিকার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নিউরো সায়েন্স’ নিয়ে পড়াশুনা শুরু করি ।

আস্তে আস্তে পশ্চিমা কালচারের মধ্যে আমি ডুবে যেতে থাকি। অ্যামেরিকায় কাটানো সুদীর্ঘ তেরো বছরের মধ্যে আমি কখনোই ভোরের সূর্যোদয় অবলোকন করতে পারিনি। সেখানে রাত আর দিনের মধ্যে খুব কমই পার্থক্য করতে পারা যায়। যান্ত্রিক একটা জীবনের মধ্য দিয়ে আমাকে যেতে হয়েছিলো। ভোরের কুয়াশা নেই, নেই ঘাসের ওপর শিশির বিন্দুর আস্তরন। কোকিলের ডাক নেই, বেলি ফুলের গন্ধ নেই।

শান বাঁধানো পুকুর ঘাট নেই।পাকা কাঁঠালের মৌ মৌ করা গন্ধ নেই।ভাপ উঠা ভাপা পিঠা নেই। আছে কেবল ছুটোছুটি-দৌড়-ব্যস্ততা।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমি যে ক’জন বন্ধুর সান্নিধ্য পেয়েছিলাম, তাদের সবাই ছিল সেক্যুলার। আব্রাহামিক ধর্মের প্রতি তাদের কোন আস্থা ছিলোনা,অথচ তাদের সবাই খ্রিষ্ঠান পরিবারের সন্তান।ধর্মকে তারা মনে করে ‘মিথ’।

‘মৃত্যু পরবর্তী জীবন’- এই কনসেপ্টে তাদের কোন বিশ্বাস ছিলোনা বলে তারা জীবনটাকে ‘খাও-দাও-ফূর্তি করো’ থিওরির মধ্যে ফেলে দিলো।

বলা বাহুল্য, তাদের সাথে মিশতে মিশতে আমিও একসময় ধর্মীয় ধ্যান-ধারনা গুলো থেকে সরে আসি।স্রোতের সাথে তাল মিলাতে গিয়ে ভুলে যাই আমার নিজ ধর্মের আচার-আচরন।

ক্লাশ-ক্যাম্পাস-ক্যাণ্টিন-ক্লাব এসবে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়লাম। একসময় এমন হলো যে, আমি পুরোপুরিভাবে কোরান পড়া কিংবা নামাজের নিয়মই ভুলে গেলাম।

°

এরমধ্যে হঠাৎ আমার বাবা খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে আমাকে দেশে ফিরে আসতে হয়।

যেদিন দেশে ফিরি, তার দু’দিন পর বাবা আমাকে তার রুমে একা ডাকলেন। তিনি আমার সাথে কিছুক্ষন একান্তে কথা বলতে চান।

আমি গেলাম। বাবা আমাকে তার পাশে বসালেন। বললেন, ‘তুমি কি আবার অ্যামেরিকা চলে যাবে?’

আমি বললাম,- ‘হ্যাঁ।’

আমার উত্তর শুনে বাবাকে খুব একটা খুশি মনে হয়নি।

বাবা বললেন- ‘চলে যাওয়াটা কি খুব জরুরি?’

আমি বললাম,- ‘বাবা, অ্যামেরিকায় আমার পড়াশোনা-ক্যারিয়ার এভ্রিথিং । It’s Quite impossible to stay here right now..’

তিনি বললেন,- ‘ঠিক আছে,আমি তোমাকে বাঁধা দেবোনা।তবে আমি চাই তুমি বিয়েটা সেরে যাও।’

বাবার কথা শুনে আমি চমকে গেলাম। সত্যি চমকে যাবার মত ব্যপার। অ্যামেরিকায় বিলাসবহুল জীবনযাপন করতে করতে আমার অবস্থা এমন হলো যে, বিয়ের কথা শুনেই আমাকে ধাক্কার মতো খেতে হলো। আসলে তখন আমি ‘লিভ টুগেদার’ এ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি।

তখন আমার বেশকিছু বান্ধবি ছিল অ্যামেরিকায় যাদের সাথে আমি ক্লাবে প্রতি উইকেন্ডে অন্ত:রঙ্গ মূহুর্ত পার করি। ব্যাপারটা শুনতে যতোই বিদঘুটে মনে হোক, পশ্চিমা কালচারে সেটা একদম মানানসই । বরং, ‘বিয়ে’ বা ‘চুক্তি’ করে শারীরিক সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়াটাকেই সেখানে অনেকসময় বাঁকা চোখে দেখা হয়।

বাবাকে সেই মূহুর্তে ‘না’ বলে দেবো, তখনও ততটা বিগড়ে আমি যাইনি। যতোই পশ্চিমা সংস্কৃতি আর পাশ্চাত্যের হাওয়া আমাকে গ্রাস করুক,বাবাকে আমি তখনও সেই আগের মতোই রেসপেক্ট করি।

তবু বললাম,- ‘বাবা, এই মূহুর্তে বিয়ে…… আমার পড়াশুনা?

বাবা জবাব দিলেন,- ‘এটি তোমার পিতার ইচ্ছা।বলতে পারো তোমার কাছে তার প্রথম এবং শেষ ইচ্ছা। বাবার ইচ্ছার মূল্যায়ন করবে কি করবেনা সেটা তোমার ব্যাপার।’

বাবার এরকম উত্তরে যে আমি প্রতিউত্তর করে কিছু বলবো সেরকম কিছুই পাচ্ছিলাম না।অগত্যা সেদিন রাজি হতে হলো বিয়েতে।

দেশে আমি যেহেতু দীর্ঘদিন ছিলাম না,তাই আমার পছন্দের কেউই এখানে ছিলোনা।

কিন্তু দেখা গেলো- আমার বিয়ের জন্য পাত্রী আগে থেকেই বাবা-মা পছন্দ করে রেখেছে।

মেয়েটির নাম- ফাতিমা। ফাতিমা বিনতে আনিস।

আমাদের পরিবারের মতোই রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে।আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়া। সে মাদরাসায় পড়তো।কোরআনে হাফেজা।

বিয়ের ঠিক দু’দিন পূর্বে মেয়েটির সাথে আমার একবার কথা বলার সুযোগ হয়।

ও যখন আমার সামনে আসলো, তখন তার গায়ে কালো রঙের একটি বোরকা,মুখে নেকাব ছিলো।

পা থেকে মুখ অবধি পুরো ঢাকা।এই অবস্থায় পড়ে আমি খুব বিব্রত বোধ করছিলাম। ইচ্ছে করছিলো পালিয়ে যাই।

°

ফাতিমার সাথে আমার বিয়ে হয়। মুসলিম পরিবারে বিয়ের যেসব আনুষ্ঠানিকতা পালন করে বিয়ে হয়,তার সবকিছুই হলো।

দেন-মোহর থেকে শুরু করে কাজি সাহেবের কবুল বলানো- সবকিছু।

বিয়ের ঠিক একুশ দিনের মাথায় আমি অ্যামেরিকা চলে আসি।ঘরে রেখে আসি সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী। অথচ, আমার কোন ফিলিংস কাজ করছিলনা। ফাতিমার চোখজোড়া লাল হয়ে ছিল। যখন বিদায় মূহুর্ত এলো, তখন ঝরঝর করে বাচ্চাদের মতো কান্না শুরু করে দিলো সে। আমি রোমাণ্টিক হলিউড মুভি দেখার মতো মজা পেলাম।

আসলে, আমাকে তখন অ্যামেরিকা ডাকছে আর ডাকছে- Come……Come……..Come……….

°

অ্যামেরিকায় ফিরে আমি আগের জীবনে প্রবেশ করলাম।আগের মতোই সবকিছু চলছিলো।

ক্লাশ-ক্যাম্পাস-ক্যাণ্টিন-ক্লাব।

বাসায় ফোন দেইনা। দিলেও কয়েক মিনিটের বেশি কথাই বলতাম না। ফাতিমার কথা একদম ভুলে গেলাম।

একবছর কাটলো এভাবে।

একদিন খবর পেলাম, ফাতিমা কনসিভ করেছে। আমি ধর্মপ্রাণ ধার্মিক মুসলিম হলে এই খবর শুনে বলতাম- আলহামদুলিল্লাহ্‌।

যেহেতু আমি সেরকম কিছুই ছিলাম না, তাই খবরটি আমার মাঝে তেমন কোন ভাবান্তর ঘটাতে পারেনি।আমি শুধু বললাম,- ‘ও’।

ফাতিমার সাথে একটু ফোনে কথা বলবো,খবরাখবর নেবো- সেরকম কোন ইচ্ছেও আমার মধ্যে তখন ছিলোনা।

এরমধ্যে একদিন ষ্ট্রোক করে হুট করে বাবা মারা গেলেন।

মৃত্যু সংবাদ আমাকে শোনানো হলো দু’দিন পরে। অ্যামেরিকায় আসার পর দ্বিতীয়বারের মতো আমি বিষণ্ণ একটি দিন পার করেছিলাম সেদিন।প্রথমদিন ছিলো, যেদিন অ্যামেরিকায় প্রথম আসি।

বাবার মৃত্যু সংবাদ যেদিন পেলাম, সেদিন কোত্থাও বের হইনি।পুরোদিন বাসায় কাটিয়েছি আর বিয়ার খেয়েছি।

বাবা মারা যাওয়ার কিছুদিন পর মা’ও মারা গেলো। তাও আমাকে জানানো হলো পরে।

অ্যামেরিকায় থেকেও হঠাৎ নিজেকে একা একা লাগছিলো তখন। এক সপ্তাহ আমি বাইরে বের হইনি। দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে ছিলাম।

এরপর সবকিছু আবার আগের মতোই স্বাভাবিক হয়ে গেলো। ধীরে ধীরে আমি সব বিষন্নতা কাটিয়ে উঠি।

এরইমধ্যে ফাতিমার কোলে আমাদের সন্তান সাঈদ পৃথিবীতে এলো। আমাকে যখন জানানো হলো- তখনও আমি ফিলিংলেস ছিলাম, যেন এটা আমার কাছে কোন ব্যাপারই না। প্রতিদিন শুনছি এরকম কিছু।

বাবা-মা দু’জনের কেউই নেই। আমার অন্য কোন ভাই-বোনও ছিলনা। অথচ আমি একটিবারের জন্যও জানতে চাইতাম না, ফাতিমা এখন কোথায় আছে,কিভাবে আছে।

°

এক বিকেলে ক্যাম্পাসে কথাচ্ছলে আড্ডায় আমি আমার বিয়ের কথা বললাম। বললাম- ‘I got married last year & her name is Fatima..’

আমার কথা শুনে বন্ধুরা হোঁ হোঁ করে হেসে উঠলো। ভাবলো,আমি মজা করছি।

আমি বললাম,- ‘Hey guys, I’m serious! I’m not joking…’

জ্যাকব নামের আমার এক বন্ধু তখন হেসে বলে উঠলো- Yeah! bring her here. We can also enjoy her…

জ্যাকবের কথা শুনে আমার রক্ত মাথায় চড়ে বসলো। তখন আমার ঠিক কি হলো আমি জানিনা। আমি তার কলার ধরে তাকে মাটিতে ফেলে দিলাম। তাকে মাটিতে চেপে ধরে বললাম,- ‘Bustard! You know who is she? She is my Wife! If u say a single bad word again about her, I’ll kill u….’

ধস্তাধস্তি করে একদম তাকে কাহিল করে ছাড়লাম। অন্যরা আমার এমন আচরনে হতবাক হয়ে গেলো।

এরপর থেকে তারা ফাতিমাকে নিয়ে আর কোন বাজে কথা বলেনি।

°

এক সকালে ঘুম থেকে উঠে আমি খেয়াল করলাম আমার পিটে ঘামাচি জাতীয় কিছু জিনিস।

প্রচুর চুলকানি। অবস্থা এরকম, আমি কোন শান্তিই পাচ্ছিলাম না চুলকানির জন্য। দেখতে দেখতে ঘামাচির মতো জিনিসগুলো আমার সারা পিট নিয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে গেলো।

আমি দ্রুত ডাক্তারের কাছে গেলাম। তিনি আমাকে কিছু ঔষধ দিলেন আর বললেন, দ্রুত কিছু টেষ্ট করাতে। সামান্য ঘামাচির জন্যে টেষ্ট? আমি অবাক হলাম।ডাক্তার বললেন,- এগুলো ঘামাচি নয়।নতুন একটি ভাইরাসের ছড়ানো রোগ।

ডাক্তারের সিরিয়াসনেস দেখে আমি বিস্মিত হলাম আর কিছুটা ভয় পেতে লাগলাম।

সন্ধ্যা হতে না হতেই এই জিনিসগুলো একদম আমার পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়লো আর আকৃতিতে আরো বড় হতে লাগলো।চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আমার মুখ-পিট-হাত-পা এই জিনিসগুলোতে ভরে গেলো। এবার আমি খুব ভয় পেলাম।টেষ্ট করালাম। ডাক্তাররা আমাকে নিয়ে শঙ্কায় পড়ে গেলেন।

আমাকে একদম আলাদা কেবিনে রাখা হলো।যে নার্স আমার কেবিনে আসছে,তার হাত-পায়ে মাস্ক পরা। আজব তো! আমি কোন ছোঁয়াছে রোগি নাকি?

আমি নিজেকে নিজেই চিনতে পারছিনা। চেহারার কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা ঘামাচি জাতীয় বিচিগুলো ছাড়া। হাতে-পায়ে-পিটে সবখানে।

আমাকে বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হলো।

আমার ট্রিটমেন্ট বাসায় স্তানান্তর করা হলো কেন বুঝলাম না। আমার অবস্থা তখন খুব খারাপ। বিচিগুলো থেকে পূঁজ পড়ছিলো। উৎকট গন্ধ। আশেপাশে মানুষ আসা দূরে থাক,আমি নিজেই নিজের কাছ থেকে পালাতে পারলেই যেন বাঁচি।

আমার বন্ধুরা প্রথমদিন আমাকে দেখতে এসেছিলো। এরপর আস্তে আস্তে তারা আসা বন্ধ করে দিলো। যেসব বান্ধবিরা রোজ রাতে পালা করে আমার সাথে রাত কাটাতো, তাদের আমি আর দেখিনি।

আমার তখন সংকটাপন্ন অবস্থা। জরুরি ভিত্তিতে আমাকে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হলো।

অ্যামেরিকায় আমার চিকিৎসা নেই- আমি ভাবতেই পারছিলাম না।

আমাকে আলাদা বিমানে করে পাঠানো হলো। কেবিন ক্রুদের সবার নাকে-হাতে মাস্ক। আমার নিজের প্রতি নিজের তখন করুণা হচ্ছে।

°

আমার বাবার রুম’টায় আমি শুয়ে আছি। পুরো ঘরে আমার শরীরের পঁচা উৎকট গন্ধ। শরীরের অর্ধেকটা তখন পঁচে গেছে।

ডাক্তারদের মতে- আমি অতি শ্রীঘ্রই মারা যাবো।

আমার চারপাশে কিছু মাছির ভন ভন আওয়াজ শুনতে পায় সারাক্ষন ।

সাঈদের তখন চারমাস বয়স। ফাতিমার বাবা এসেছিলো তাকে নিয়ে যেতে। তাকে অন্যত্র বিয়ে দেবে।

ফাতিমা পাথরের মতো হয়ে গেলো। তার বাবা তাকে সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্য জোরাজুরি করলো। সে গেলোনা।

আমার শরীরের পঁচা গন্ধে যখন আশেপাশের প্রতিবেশিদের জীবন অতিষ্ঠ, তখন একটা মেয়ে আমার সেবা-শুশুষ্রা করে যাচ্ছিলো। তার নাকে কোন কাপড় নেই।

সে আমার খসে পড়া চামড়াগুলো ঠিক জায়গায় বসিয়ে দিচ্ছে, ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিচ্ছে, ঘাঁ হয়ে যাওয়া ক্ষতে মলম লাগাচ্ছে। আমার কাপড় পাল্টিয়ে দিচ্ছে। নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছে।

তার কাজে এতটুকু অবহেলা নেই। এতটুকু বিরতি নেই। আমার জন্যে তার ক্ষতি হতে পারে- সে ভয় নেই।

আমার মাথার কাছে বসে টপ টপ করে চোখের জল ফেলছে।

যেদিন তাকে রেখে আমি অ্যামেরিকায় চলে যাচ্ছিলাম,সেদিনও সে আজকের মতো খুব কাঁদছিলো। সেদিন তার কান্নাকে আমি হলিউডের রোমাণ্টিক মুভির কোন দৃশ্য মনে করে মজা পেয়েছি।

কিন্তু আজ ইচ্ছে করছে আমার হাত দিয়ে তার চোখের অশ্রুটুকু মুছে দিতে। কিন্তু সে শক্তি যে আমার নেই। আমার হাত পঁচে গেছে। নাড়লেই পূঁজ ঝরে। ক’দিন পর হয়তো পোকারা কিলবিল করবে আমার পঁচা মাংসে।

ফাতিমা তার মতো করে আমার সেবা করছে। সুস্থ অবস্থায় আমাকে সে কাছে পেয়েছে মাত্র একুশ দিন।

আমার ইচ্ছে করছে, ইশ! আমি যদি তার সাথে একুশ হাজার বছর সংসার করতে পারতাম!

রাতে আমি শুনতাম, ফাতিমা অন্ধকারে হুঁহুঁ করে কাঁদতো। ডাকলে তখন সাড়া দিতোনা। বুঝতে পারতাম, সে নামাজে কাঁদছে।

আমারও তখন খুব নামাজ পড়তে ইচ্ছে করতো। কতো আগে নামাজ পড়েছিলাম। মাঝখানে কতোগুলো বছর আমি নামাজ পড়িনি। কিভাবে পড়তে হয়- তাই ভুলে গেছি।

এভাবেই দিন কাটছে। সকাল গড়িয়ে দুপুর। দুপুর গড়িয়ে বিকেল।এরপর সন্ধ্যা-রাত।

সময় পালাচ্ছিলো দ্রুত। আমিও মৃত্যুর প্রহর গুণছিলাম।

এক শুক্রবার!

ঘুম থেকে জেগে আমি অনেকটাই সুস্থ বোধ করছিলাম। নিজেকে হালকা মনে হতে লাগলো।

কেন যেন মনে হচ্ছিলো- আমি সুস্থ হয়ে যাবো। জগতে কতো রকম মিরাকলই তো হয়।

সময় গড়াচ্ছিলো, আমি আর ফাতিমা অবাক হচ্ছিলাম।

আমার হাতের পঁচন ধরা ক্ষতগুলো দ্রুতই শুকাতে শুরু করলো। আস্তে আস্তে সবখানে সজীবতা ফিরে আসছে। মরে যাওয়া চামড়ার ওপর নতুন চামড়া উঠেছে। আমরা অবাক হচ্ছিলাম।

ঠিক যত দ্রুত এই রোগ আমার শরীরে এসেছিলো, তত দ্রুতই সেটা চলে গেলো।

সপ্তাহ খানেকের মধ্যে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলাম। ফাতিমা আমাকে ওজু করিয়ে আনলো।

বুঝিয়ে দিলো কি করে নামাজ পড়তে হবে।

আমি দু’রাকাত নামাজ পড়লাম। এরপর আমার ছেলে সাঈদকে কোলে নিয়ে অনেকক্ষন আদর করলাম। ফাতিমা কোরআন তিলাওয়াত করতে লাগলো, আমি শুনছি।আহা! কতোদিন পর শুনছি সেই সুর! সেই ঝঙ্কার!

‘আলিফ-লাম-মীম! যা-লিকাল কিতাবু লা-রাইবা ফিহি হুদাল্লিল মুত্তাকিন।’

 

– আরিফ আজাদ

৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button