জীবনের বাঁকে বাঁকে

নও মুসলিম … তারপর?

আমরা যখন মসজিদে দেখি, পেপারে পড়ি, টিভিতে দেখি বা ইন্টারভিউ শুনি কেউ ইসলাম গ্রহন করেছে তখন আমাদের হৃদয়েও ঈমানের জোশ নতুন করে দোলা দিয়ে যায়। আমরা জানতে চাই সে কেন ইসলাম গ্রহন করেছে, কিসে তাকে উদ্বুদ্ধ করল, তার কাহিনী শুনে চমৎকৃত হই, তার প্রশংসা করি, সুযোগ পেলে তাকে আলিঙ্গন করি, কিছু সুন্দর কথা বলি … কিন্তু তারপর? তারপর এই মানুষগুলোর কি হয়, ওরা কোথায় যায়, কি করে, কোন ধরনের প্রতিকুলতার সম্মুখীন হয় তা কি আমরা খবর রাখি? হ্যাঁ, এই খবর নিয়েই আমার আজকের লেখা।

একজন মানুষ যখন সত্যকে খুঁজে পায় তখন তার মনের অবস্থাটা কেমন হয় সেটা আমরা যারা জন্মগতভাবে সত্যটাকে পেয়েছি তারা অধিকাংশই বুঝতে পারিনা, কারণ এই সত্য ওদের কাছে সম্পদ আর আমাদের কাছে সম্পত্তি। আমরা ইসলামকে পৈত্রিকসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি মনে করি বলেই এর প্রতি আমাদের অনুভূতি দায়সারা গোছের, দায়িত্ব তার চেয়েও কম এবং সম্মান তার চেয়েও কম। কিন্তু যারা সারাজীবন ভুলে ডুবে থেকে হঠাৎ সত্যটাকে খুঁজে পায়- ভুল থেকে বেরিয়ে আসার, নিজেকে পবিত্র করার, সত্যকে গ্রহন করার প্রতি তাদের যে অপ্রতিরোধ্য স্পৃহা কাজ করে- আমাদের অনেকেরই ঈমান এক জীবনেও সেই স্তরে পৌঁছয়না। আমরা আগপাছ ভাবি, ভূত ভবিষ্যত চিন্তা করি, লাভ লোকসান হিসেব করি- এর মধ্যে কর্তব্য অনেক সময় সঠিক পথ থেকে বিচ্যূত হয়ে যায়। কিন্তু একবার ভাবুন তো, আল্লাহকে কতটুকু ভালবাসলে একজন মানুষ আগপাছ, ভূত ভবিষ্যত, লাভ লোকসান কোনকিছুই চিন্তা না করে সর্বসমক্ষে সত্যটাকে ঘোষনা করতে পারে!

অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমাদের অভিজ্ঞতা ঐ অংশ পর্যন্ত। তারপর একজন নও মুসলিম নিজের সাথে অনেকগুলো ফ্রন্টে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। প্রথমত, তার হৃদয় তার প্রভুর প্রতি ভালবাসায় পরিপূর্ণ, সে চায় সর্বস্ব দিয়ে তাঁর স্তুতি করতে, কিন্তু সে জানেনা কিভাবে তাঁর বন্দনা করতে হয়। তাকে তার প্রভুর প্রশংসা এবং শুকরিয়া করার জন্য নামাজ শিখতে হয়, তাঁর নির্দেশ জানার জন্য একটি ভিনদেশী ভাষা শিখতে হয়, সত্যপথের ওপর টিকে থাকার জন্য অনেক নতুন ক্রিয়াকর্ম এবং তাঁর মহিমা সার্বক্ষনিকভাবে প্রত্যক্ষ করে তাঁর স্তুতি প্রকাশ করার জন্য প্রাত্যহিক জীবনে ব্যাবহার্য অনেকগুলো শব্দ এবং বাক্য শিখতে হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যাক্তি এমন প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করতে পারে বা মুসলিমদের সাথে তার ওঠাবসা না থাকতে পারে যার ফলে এই জিনিসগুলো শেখার জন্য তাকে অনেক অদ্ভুত পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়। যেমন এক যুবকের ইন্টারভিউ দেখলাম যে ইন্টারনেট ঘেটে এবং ইউটিউব দেখে নামাজ শিখেছে। এক ভদ্রলোক জানালেন তিনি আরবী শেখার জন্য মরক্কোর এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে চলে যান যেখানে কেউ আরবী ছাড়া আর কোন ভাষা জানেনা যেন তিনি আরবী পড়তে, লিখতে, বলতে এবং বুঝতে বাধ্য হন। এক অ্যামেরিকান মহিলা তাঁর গ্রামে এক মুসলিম মহিলাকে শপিং করতে দেখে তাঁকে অনুসরন করতে থাকেন এবং আধঘণ্টা অনুসরন করার পর সাহস করে গিয়ে তাঁকে জানান যে তিনি মুসলিম, মহিলা তাঁকে হিজাব পরতে শিখিয়ে দিতে পারবেন কিনা; মহিলা আরবী ছাড়া আর কোন ভাষা জানতেন না, পরে মহিলার স্বামী তাঁকে বাসায় আসতে বলেন যেন ভদ্রমহিলা তাঁকে হাতে কলমে শিখিয়ে দিতে পারেন। এরপর শুরু হয় অভ্যস্ত জীবন থেকে বেরিয়ে আসার যুদ্ধ। অনেক খাবারই তাদের বাদ দিতে হয় যা তারা সারাজীবন খেয়ে এসেছে। বাদ দিতে হয় মদ্যপান যেটা খাবার বাদ দেয়ার চেয়েও অনেকের জন্য কঠিন, বিশেষ করে যারা এতে নেশাগ্রস্ত। যারা মাদকে অভ্যস্ত ছিল তাদের মাদক বাদ দিতে হয় কোন ডাক্তারের সাহায্য ছাড়াই, তবু তারা সক্ষম হয় কারণ আল্লাহর সন্তুষ্টি যে আরো বড় মাদক! অনেকে আবিস্কার করে যা তাদের জীবিকা ছিল তা ইসলামের দৃষ্টিতে গ্রহনযোগ্য নয় এবং অনেককে মাঝবয়সে পেশা পরিবর্তন করে নতুনভাবে জীবন শুরু করতে হয়।

পরবর্তী যুদ্ধ পরিবার এবং বন্ধুবান্ধবের সামনে সত্য প্রকাশের যুদ্ধ। অনেকে ভীত বোধ করে যে সত্য প্রকাশ করলে তারা সর্বস্ব হারাবে। অনেক সময় ব্যায় করে, সাহস সঞ্চয় করে, যুক্তি দাঁড় করিয়ে তারা পরিবারের সম্মুখীন হয় তাদের মনের কথা জানাবার জন্য। অনেকের পরিবার মেনে নিতে পারেনা, সম্পর্ক ছিন্ন হয় সাময়িক কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে চিরতরে। অনেকের পরিবার মেনে নেয়, কিন্তু এর পর তাদের পক্ষে আর এই সন্তানকে সাহায্য করা সম্ভব হয়না কারণ তাঁরা জানেনা কিভাবে তাকে সাহায্য করা যায়। তারপর আসে বন্ধুবান্ধবদের ব্যাপার। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়না শুধুমাত্র এই কারণে যে ওরা যেসব জিনিসে আনন্দ পায় তা আর এখন তাকে আকর্ষন করেনা। তাছাড়া অনেকসময় তার পক্ষে বন্ধুদের সাথে খাওয়াদাওয়া করা সম্ভব হয়না যেহেতু সে হালাল হারামের ব্যাপারে সচেতন, তাদের সাথে আনন্দ করা সম্ভব হয়না যেহেতু সে নাচগান থেকে দূরে সরে গিয়েছে, তাদের সাথে ফূর্তি করা সম্ভব হয়না যেহেতু সে নারীপুরুষের মিশ্র পরিবেশ থেকে দূরে সরে এসেছে। তার যদি গার্লফ্রেন্ড বা বয়ফ্রেন্ড থেকে থাকে তাহলে তাকে বাদ দিতে হয়। স্ত্রী বা স্বামী যদি ইসলাম কবুল না করে তাহলে পরিস্থিতি দাঁড়ায় আরো জটিল। অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের পক্ষ থেকে সন্তানকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। অনেকসময় সে হয়ে যায় একেবারেই একা।

তবে সবচেয়ে অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া আসে মুসলিমদের পক্ষ থেকে। একজন উপজাতীয় ইসলাম কবুল করার পর কোনক্রমে প্রান নিয়ে পালিয়ে এসে একটি মসজিদে আশ্রয় নেয়। সম্পূর্ন কপর্দকশূন্য লোকটি মসজিদে আগত মুসল্লীদের কাছ থেকে সাহায্য চাইতে গেলে একজন মুসল্লী তাকে বলেন, ‘ব্যাটা ইসলামের সাইনবোর্ড দেখিয়ে ভিক্ষা করার জন্য মুসলিম হয়েছিস নাকি? যা ভাগ!’ একজন অ্যামেরিকান মহিলা একটি মসজিদে ইসলাম শিক্ষার ব্যাপারে সাহায্য চাইতে গেলে তারা তাকে সাহায্য করেনি এই কারণে যে সে যে বইটি পড়ে ইসলামে প্রবেশ করেছে তা শিয়াপন্থীদের লেখা, অথচ সে জানেনা সুন্নী কি বা শিয়া কি! একজন নও মুসলিম ইসলাম গ্রহনের সাতদিন পর ইমাম সাহেবের কাছে সাহায্য চাইতে যান কিভাবে ফজরের নামাজের জন্য ওঠা যায়, একজীবনের অভ্যাস কি এত সহজে পরিবর্তন করা সম্ভব? ইমাম সাহেব কিছুমাত্র চিন্তা না করে তাকে বলে দেয়, ‘তুমি গুনাহগার, তাই তুমি ফজরের নামাজের জন্য উঠতে পারোনা’। সে ভাবে, আল্লাহ বলেছেন ইসলাম গ্রহনের পর ব্যাক্তি সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুর মত পবিত্র হয়ে যায়, আর ইনি বলছেন আমি গুনাহগার বলে আল্লাহ আমাকে তার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন, এখন আমি কি করব? আমাদের শহরেই এক নও মুসলিম ইসলাম গ্রহন করে মসজিদ থেকে বেরিয়েই এক মুসলিমের আক্রমনের শিকার হন যে গাড়ী উল্টোপাল্টা পার্কিং করার কারণে তার গায়ে থুথু ছিটিয়ে দেয়; সে চিন্তা করে এই যদি হয় মুসলিমদের আচরন তবে আমি মুসলিম হতে চাইনা; ঐ লোক তাৎক্ষণিক ইসলাম ত্যাগ করার সংকল্প করে ফেলে।

তারপর আসে নতুনভাবে নিজের জীবনকে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা। পরিবার পরিজন, বন্ধুবান্ধব, ব্যাবসা সব হারিয়ে একজন নও মুসলিম আবার নিজের জীবনকে গড়ে তোলার প্রয়াসে রত হয়। তখন অনেকেই সহানুভূতি জানায়, ‘তুমি আমার মুসলিম ভাই। বল, আমি তোমাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি’। সে যখন বলে, ‘আমি একটি পরিবার গড়ে তুলতে চাই, তোমার মেয়েকে আমার কাছে বিয়ে দাও’, সাথে সাথে নানারকম সমস্যা কোকাকোলার বুদবুদের মত উৎপত্তি হতে থাকে, ‘তুমি তো অমুক অঞ্চলের নও, তোমার পরিবার তো মুসলিম নয়, তুমি তো কালো কিংবা সাদা চামড়া ইত্যাদি ইত্যাদি’। এরা তাঁদেরই আদর্শের বাহক যারা মুহাজিরদের আপন করে নেয়ার জন্য নিজের স্ত্রীকে তালাক দিয়ে মুসলিম ভাইকে সংসার গড়ার সুযোগ দিতে কার্পন্য করেননি; এরা সেই আদর্শের অনুসারী যা সাদাকালোতে, আঞ্চলিকতায়, ভাষায় বিভেদের অবসান ঘটাতে এসেছে; কেবলমাত্র আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা যাদের মানদন্ড হবার কথা। এরা যখন সহযোগিতা করেন না তখন বেচারারা গিয়ে এমন সব মুসলিমদের হাতে পড়ে যাদের নাম ছাড়া ইসলামের আর কোন বৈশিষ্ট্য নেই। অনেকেই প্রচন্ড তিক্ত অভিজ্ঞতার শিকার হোন, অনেকেই হারান আরো অনেক বেশি কিছু।

সবচেয়ে হৃদয় ছুঁয়ে গেল এক মহিলার কথা যে বলল, ‘তোমরা সবাই ঈদের সময় বাড়ী যাও,আপনজনদের সাথে একত্রিত হও, একে অন্যকে উপহার দাও, মজার মজার খাবার খাও, আনন্দ উপভোগ কর- আমরা তখন কার কাছে যাই, কি করি বল তো!’

এই কাহিনী শুধু নও মুসলিমদের নয়, মডারেট মুসলিমদের সন্তানদেরও যারা হয়ত পড়াশোনা করে ইসলামকে জানার পর উপলব্ধি করতে পেরেছে তাদের বাবামা ইসলামের নামে যা পালন করে আসছে তা পরিপূর্ণ ইসলাম নয়। প্রথমেই ওরা বাবামা, আত্মীয়স্বজনের পক্ষ থেকে যেটার মুখোমুখি হয় তা হোল, ‘আজকালকার ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করে বিগড়ে যাচ্ছে, আমরা কি ওদের চেয়ে কম জানি? বেয়াদব কোথাকার!’ তারপরের পর্যায় হোল, ‘নামাজ নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করার কি আছে? আমরা কি নামাজ পড়িনা নাকি? কাজা পড়ে নিলেই তো হয়!’ তারপরের পর্যায় হোল, ‘আজকের যুগে এভাবে চললে কি জীবনধারণ করতে পারবে নাকি? বোরকা তো পতিতাদের ড্রেস, শালীনভাবে কাপড় পরলেই হোল। আমরা কি কুর’আন পড়িনি নাকি? মাথায় কাপড় দিতে হবে এমন কোথাও লেখা নেই, যত্তসব বাড়াবাড়ি’। এই মডারেট মুসলিমদের মধ্যে এমন লোক আছেন যারা মেয়েদের গা থেকে ওড়না টেনে খুলে ফেলেছেন, মেয়েদের বোরকা নিয়ে পুড়িয়ে ফেলেছেন, মেয়েদের ঘরবন্দী করে রেখেছেন এরা সভ্য সমাজে চলার উপযোগী নয় বলে। অনেক ছেলেরাই বেয়াদব হয় শুধু বাবা, চাচা কিংবা দাদার আগে দাড়ি রেখে। বিয়ের সময় এদের জন্য এদের পছন্দমত ছেলে বা মেয়ে খুঁজে বের করা মুশকিল হয়ে যায় কারণ মেয়ে পরিবারের পছন্দ হলে ছেলের পছন্দ হয়না, ছেলের পছন্দ হলে পরিবারের পছন্দ হয়না। অন্যদিকে আছে ইসলামপন্থীদের সোনার পাথরবাটির সন্ধান। ছেলে সুন্দর এবং স্মার্ট হতে হবে কিন্তু দাঁড়ি থাকার কারণে মেয়ে না করে দেবে; ছেলে শিক্ষিত এবং পয়সাওয়ালা হতে হবে কিন্তু অবৈধ ইনকাম করতে পারবেনা; শুধু ছেলে নয় ছেলের পরিবারকেও ইসলাম বিশেষজ্ঞ হতে হবে, চর্চা থাকুক বা না থাকুক। আর মেয়ে হলে তো কথাই নেই। মেয়ে পর্দা করবে কিন্তু তাকে দেখতে নায়িকার মত হতে হবে; মেয়ের বাপ ভাই থাকতে হবে এবং তাদের পয়সাওয়ালা হতে হবে; মেয়ে ছেলের পরিবার এবং তাকে উভয়কেই চমৎকৃত করতে হবে।

আমরা কবে ইসলামের আসল স্পিরিটটা বুঝব, কবে আমরা নিজের চেয়ে আল্লাহর পছন্দকে অগ্রাধিকার দিতে শিখব, কবে আমরা শুধু নিজের কথা না ভেবে আমাদের ভাইবোনদের কথা ভাবব, কবে আমরা দেখানোর চেয়ে মেনে চলাকে প্রাধান্য দেব, কবে আমরা কথায় বড় না হয়ে কাজে বড় হব, কবে আমরা সত্যিকার অর্থে মুসলিম হব…

 

– রেহনুমা বিনতে আনিস

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button