জীবনের বাঁকে বাঁকে

লাইসেন্স টু কিল

১/

ছেলেটির শীর্ণ হাতখানা আমার হাতখানি আঁকরে ধরে আছে পরম নির্ভরতায়, মোটা চশমাটার আড়ালে বড় বড় চোখ দু’টোতে গভীর বিশ্বাস। কিন্তু ওর এই উদার হৃদয়খানির উৎস যেখানটাতে, সে ছোট্ট বুকটার ভেতর হৃৎপিন্ডটাতে একটা ফুটো যা তাকে এতটা অসুস্থ করে রেখেছে যে স্বাভাবিক কাজগুলো করাও ওর জন্য এক একটা পরীক্ষা। ও যখন ওর মায়ের ভেতরে একটু একটু করে বড় হচ্ছে তখন ডাক্তার তাঁকে অ্যান্টিবায়োটিক দেন সামান্য সর্দিজ্বর ভাল হয়ে যাবার জন্য। সর্দিজ্বর ভাল হয়ে গেল কিন্তু বাচ্চাটার হৃৎপিণ্ডে একটা ফুটো রেখে দিয়ে গেল সেই অ্যান্টিবায়োটিক। সেটা সারাবার জন্য বাবামা ওকে নিয়ে কোথায় ছুটোছুটি করেননি! মাদ্রাজ পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু ওর হার্টের গঠনেই সমস্যা। এভাবেই বাঁচতে হবে তাকে যে ক’বছর বাঁচে। ডাক্তারের একটি ভুল সিদ্ধান্তের কারণে একটি সম্পূর্ন সুস্থ শিশু পৃথিবীতে আসার আগেই অসুস্থ হয়ে পড়ল।

২/

মেয়েটির মা বাড়ী বাড়ী গিয়ে শাড়ি বিক্রি করত। ছোটখাট মহিলাটি রুচিশীলা। গরীব হলেও ফিটফাটভাবে চলে। মেয়েটিও সাথে আসত মাঝেমাঝে। আট বছর বয়সী চঞ্চলা মেয়েটি একদিন রাস্তা পাড় হতে গিয়ে গাড়ীচাপা পড়ল। ডাক্তার বলল ওর আহত পা টি কেটে ফেলতে হবে। মেয়েটির বাবামা নানাভাবে ডাক্তারকে বোঝানোর চেষ্টা করল- আট বছর বয়সের একটি মেয়ে এক পায়ে কিভাবে বাকী জীবনটা পাড় করবে? গরীবের মেয়ে, কে বিয়ে করবে ওকে? বিয়ে না হলে সে নিজেই বা কিভাবে জীবিকা নির্বাহ করবে? কোন কথা শুনলো না ডাক্তার, পা খানি কেটে ফেলে দিল। যেদিন মেয়েটাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেবে সেদিন ডাক্তার ওর বাবামাকে জানালো, ‘বিশ হাজারটা টাকা হলে আমরা ওর পাটা বাঁচাতে পারতাম’। কপাল চাপড়ে কাঁদতে লাগল ওর মা, ‘মাত্র বিশ হাজারটা টাকার জন্য ওরা আমার মেয়েটার পা কেটে তাকে চিরতরে পঙ্গু করে দিলো। আমার স্বামী বাবুর্চি, প্রতিবার রান্না করলে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা পায়। কতদিন লাগত আমাদের বিশ হাজার টাকা জোগাড় করতে? দরকার হলে আমরা ভিক্ষা করে এই টাকা জোগাড় করতাম। বিশ হাজারটা টাকার জন্য ডাক্তার আমার মেয়েটাকে পঙ্গু করে দিল। এখন আমি ডাক্তারকে কত টাকা দিলে সে ওর পা ফিরিয়ে দিতে পারবে?’

৩/

মেয়েটির আনন্দের সীমা নেই। সে প্রথমবারের মত মা হতে চলেছে। ডাক্তার বলেছে বাচ্চার সবকিছু ঠিক আছে, ডেলিভারীতেও কোন কমপ্লিকেশন হবার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছেনা। তাই সময় হলে সে ভর্তি হোল বাড়ীর পাশে ক্লিনিকে। ইন্টার্নী ডাক্তাররা ভাবল সহজ ডেলিভারী কেস, বড় ডাক্তারকে কল দিয়ে লাভ কি? বরং নিজেরা ডেলিভারী করে ফেলতে পারলে পুরো টাকাটা বেঁচে গেল। মাঝপথে সব কেমন যেন গোলমাল হয়ে যেতে লাগল। কিন্তু ততক্ষণে বড় ডাক্তারকে ডাকার সময় নেই, ওরা নিজেরাই যেমন বোঝে তেমন করে কার্যোদ্ধার করল। বাচ্চা ডেলিভারী হোল বটে কিন্তু মেয়েটা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ল। ব্যাগের পর ব্যাগ রক্ত দিয়েও তাকে বাঁচানো গেলনা। বাচ্চাটাও বেঁচে থাকার আপ্রান চেষ্টা করে ক’দিন পর মারা গেল। ভেঙ্গে গেল একটি সুখস্বপ্ন, চলে গেল দু’টি প্রান।

আমার বান্ধবী ডাক্তারী পাস করে আমার সাথে দেখা করতে এলো। সেখানে উপস্থিত ছিলেন আমাদের স্কুলের প্রিন্সিপাল লেঃ কঃ জিয়াউদ্দীন বীরোত্তম। তিনি বললেন, ‘So, you have got your licence to kill? আমি জীবনে অনেক মানুষ মেরেছি কিন্তু তাদের কষ্ট দেইনি। তুমি তো কষ্ট দেবে আবার সেজন্য পয়সাও নেবে!’ বান্ধবী খুব লজ্জা পেল।

কথাটা অবশ্য সবার ক্ষেত্রে সত্য নয়। আমার বান্ধবী নাহিদ আপা একজন আদর্শ ডাক্তার। তিনি একজন শিশু ক্যান্সার স্পেশালিস্ট। তাঁর আয়ের অধিকাংশ ব্যায় হয় রোগীদের ওষুধ পথ্য ইত্যাদির পেছনে। এমনকি যখন তিনি মাত্র ক্যারিয়ার শুরু করেছেন তখনো তিনি নিজের চেয়ে রোগীদের কথা ভাবতেন বেশি। আমার প্রথম সন্তান হবার সময় আমি ডাক্তারের কাছে যেতে চাইতাম না, ফাঁকি দিতাম। তিনি তখন আমাকে ক্লাসের ভেতর থেকে পাকড়াও করে চেকাপ করতেন (আমি তখন শিক্ষকতা করতাম এবং তিনি ছিলেন সেই স্কুলের ডাক্তার, সপ্তাহে একদিন স্কুলের সমস্ত বাচ্চাদের চেকাপ করতে আসতেন)। দিন নেই রাত নেই ফোন করে যেকোন সমস্যার ব্যাপারে পরামর্শ নিতে পারতাম। যেদিন রাদিয়া পৃথিবীতে আগমন করল সেদিন তিনি সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত আমার পাশে আমার হাত ধরে ছিলেন। হাফিজ সাহেবকে বলে রেখেছিলেন, ‘দেখুন, যারা রেহনুমাকে দেখতে আসবেন তাঁরা সবাই আমার স্যার ম্যাডাম। তাঁরা টাকার জন্য সিজারিয়ান করতে চাইবেন। আমিও তাদের সাথে সাথে বলব, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ হাফিজ ভাই, সিজার করা ছাড়া কোন উপায় নেই’। কিন্তু আপনি কিছুতেই রাজী হবেন না। যদি সত্যিই প্রয়োজন হয় তাহলে আমি আপনাকে বলব’। রাদিয়ার জন্মের পর বাচ্চাকে কিভাবে যত্ন নিতে হয়, নিজের কিভাবে যত্ন নিতে হয় সব শিখিয়ে দিয়ে তিনি গেলেন একটি বিয়ের দাওয়াত খেয়ে নিজের বিবাহবার্ষিকী পালন করতে। আবার সন্ধ্যার পর বাচ্চার জন্য জামাকাপড় কাঁথা নিয়ে ফিরে এলেন। আমি বাসায় ফিরে যাবার পর আমাকে আর হাসপাতালে যেতে হয়নি কারণ তিনি বাসায় এসে চেকাপ করে যেতেন। ভাবছেন, বান্ধবী বলে তিনি এই কাজ শুধু আমার জন্য করতেন? না, তিনি প্রতিটা রোগীকে এভাবেই খেয়াল করতেন, রোগীদের নবাগত সন্তানদের জন্য গ্রামের এক দর্জীকে দিয়ে নরম ধুতি কাপড়ের কাঁথা আর পাতলা সুতি জামা বানিয়ে বাসায় জমা করে রাখতেন। বাংলাদেশে এমন ডাক্তারও আছে।

কিন্তু প্রথমে যেসব উদাহরণ দিলাম তেমন ডাক্তারেরও অভাব নেই, এটাই দুঃখের কথা।

ছোটবেলায় রিডার্স ডাইজেস্ট আদ্যোপান্ত গিলে খেতাম। তখনকার পড়া কয়েকটি ঘটনা আজও স্মৃতিপটে উজ্জ্বল হয়ে আছে।

১/

দক্ষিণ আমেরিকার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে এক ডাক্তার জনসেবামূলকভাবে স্থানীয় রোগীদের চিকিৎসা করতে গিয়েছেন। এক কিশোরীকে দেখে তিনি বুঝতে পারলেন, মেয়েটি পোকার কামড়ে উদ্ভটভাবে ফুলে যাওয়া ঠোঁটের চিকিৎসা করতে এলেও ওর মস্তিষ্কের ভেতর একটি প্রমান সাইজের টিউমার টাইম বোমার মত টিক টিক করছে, যেকোন মূহূর্তে ফেটে গিয়ে অঘটন ঘটতে পারে। এই অস্থায়ী হাসপাতালে টিউমারের অপারেশন করার মত ব্যাবস্থা নেই। ঠোঁটের অপারেশনটুকুই কেবল করতে পারেন তারা। মেয়েটিকে অপারেশন টেবিলে শোয়ানো হোল। কিন্তু অপারেশন শুরু করার আগেই মৃত্যু হোল মেয়েটির। যেখানে মৃত্যু একটি প্রাত্যহিক ঘটনা সেখানে কিশোরীটিকে নিয়ে হা হুতাশ করার সময় নেই কারো। মেয়েটির পরিবার দূরে বসে কাঁদছে। এত রোগীর ভিড়ে লাশ হস্তান্তর করার সময় নেই কারো। লাশ পরে দেয়া হবে। কিন্তু পরে লাশ হস্তান্তর করতে গিয়ে অস্থায়ী হাসপাতালের কর্মীরা এবং মেয়েটির পরিবারের সবাই হতবাক হয়ে গেল। তারা দেখতে পেলো মেয়েটির ঠোঁট দু’টো নিখুঁত যেন ওর ঠোঁটে কোনকালে কিছু হয়নি। এত রোগীর ভিড়েও ডাক্তার কোন এক ফাঁকে মৃত কিশোরীর শেষ ইচ্ছাটি পূরণ করে দিয়ে গেছেন।

২/

একুশ বছর বয়সী ছেলেটির একমাস পর বিয়ে হবে, খুশির অন্ত নেই। সহকর্মীর সাথে এই নিয়ে আলাপ করছিল। সহকর্মীটি চলে যাবার সময় সে দেখতে পেলো যে নির্মানস্থলে তারা কাজ করে সেখানে একটি ক্রেন থেকে আচমকা ছুটে যাওয়া একটি লোহার পাত বন্ধুটিকে দ্বিখন্ডিত করে দিতে যাচ্ছে। সে ছুটে গিয়ে বন্ধুটিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। সহকর্মী বেঁচে যান, ছেলেটিও বেঁচে যায়, কিন্তু লোহার পাতের আঘাতে ওর দুটো হাতই কব্জী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব লোকজন দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। একজন সহকর্মী বুদ্ধি করে হাত দু’টো কুড়িয়ে নিয়ে, ধুয়ে, একটি প্লাস্টিক ব্যাগে ভরে, বরফ দিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ডাক্তাররা টানা ৯০ ঘন্টা ধরে চেষ্টা করে ছেলেটির হাতের প্রতিটি রক্তনালী এবং স্নায়ু যথোপযুক্তভাবে জোড়া দিয়ে হাত দু’টোকে আবার সচল করতে সক্ষম হন। তিনমাস পর ছেলেটির বিয়ে হয় এবং সে নিজ হাতে নববধূকে কোলে করে ঘরে তোলে।

৩/

তিনি ছিলেন দক্ষিন আমেরিকার একজন বিখ্যাত সার্জন। শহরটিকে যখন ভূমিকম্প নাড়া দিয়ে যায় তখন তিনি পঞ্চম তলায় রোগীর অপারেশনে ব্যাস্ত। ভূমিকম্পে ছয়তলা হাসপাতালটি সম্পূর্ন মাটিতে শুয়ে পড়ে। তাঁর বাবা ভাই মিলে ছয়জনে এসে বুঝার চেষ্টা করে পঞ্চম তলার ধ্বংসাবশেষ কোথায় থাকতে পারে এবং সেই বরাবর তারা খুঁড়তে থাকেন। একে একে চারদিন পার হয়ে যায়। অধিকাংশ লোকজন ততদিনে ধ্বংসাবশেষে আত্মীয় বন্ধুদের খোঁজা বন্ধ করে দিয়েছে। তাদের অনেকেই পাগল ভেবে এই বাপ ভাইদের কান্ড দেখছে যারা চারদিন যাবত দিনেরাতে ধ্বংসাবশেষের মাঝে খুঁড়ে চলেছে। পঞ্চমদিন তারা তাঁকে উদ্ধার করতে সক্ষম হোল। আশ্চর্যজনকভাবে তাঁর শরীরের কোথাও কোন ক্ষতি হয়নি, সম্ভবত হাসপাতালের একটি বিছানার নীচে তিনি লুকিয়েছিলেন যা কংক্রিটের ভার সামলেছিল। কিন্তু তাঁর হাত দু’টি দিনের পর দিন কংক্রিটের নীচে চাপা পড়ে থাকায় রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গ্যাংগ্রিন হয়ে গিয়েছিল। অনেক চিকিৎসার পর হাতের তালু দু’টি বাঁচানো গেলেও আঙ্গুল সব কেটে ফেলতে হোল। তাঁর বাবা ভাইরা মিলে তাঁকে বুঝালেন তিনি বেঁচে আছেন সেটাই তাদের জন্য সবচেয়ে বড় কথা। কিন্তু তিনি মনে শান্তি পেলেন না। তিনি ভাবলেন এতগুলো মানুষের মাঝে গড তাকে বাঁচিয়ে রাখলেন, সবার আত্মীয় স্বজন যখন হাল ছেড়ে দিলো তখনো তাঁর বাবা ভাইরা দিনরাত পরিশ্রম করে তাঁকে খুঁজে বের করলেন – এর পেছনে সৃষ্টিকর্তার নিশ্চয়ই কোন উদ্দেশ্য আছে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি আবার ডাক্তারী শুরু করবেন- রোগী দেখা ডাক্তারী নয়, তিনি আবার সার্জন হিসেবেই কাজ করবেন। কিন্তু একটিও আঙ্গুল ছাড়া তিনি এই কাজ কিভাবে করবেন? এক বন্ধু সার্জনের সাথে কথা বলে তিনি নিজের ওপর অপারেশনের ব্যাবস্থা করলেন। তাঁর পায়ের সমস্ত আঙ্গুল কেটে নিয়ে তাঁর হাতের আঙ্গুলগুলোর জায়গায় বসিয়ে দেয়া হোল। কয়েক মাসের ভেতর তিনি প্র্যাক্টিস করতে করতে এই আঙ্গুল দিয়ে স্ক্যাল্পেলের মত সুক্ষ্ম জিনিস ধরতে এবং তা দিয়ে কাজ করতে সক্ষম হলেন। ফিরে এলেন জনসেবায়। সৃষ্টিকর্তা যে জীবন তাকে দিয়েছেন তা স্রষ্টার সৃষ্টির সেবার নিয়োজিত করলেন।

এমন লোকজনেরই ডাক্তার পড়া উচিত যারা ডাক্তারীকে জনসেবার একটি মাধ্যমে হিসেবে নেন। তাহলে হয়ত তারা যখন একজন রোগীর দিকে দৃষ্টিপাত করবে তখন চোখে একজন বৃদ্ধ বাবা, একজন ছোট বোন, একজন কর্মঠ ভাইকে দেখবে – ডাইনিং টেবিলে মুরগীর রান, নতুন ফার্নিচার কিংবা দেয়ালজোড়া টিভি নয়। তাহলেই হয়ত এই মহৎ পেশাটি প্রথম প্রকার ডাক্তারদের মত লোকজনের দ্বারা সৃষ্ট দুর্নাম হতে রক্ষা পাবে, রক্ষা পাবে অনেক জীবন, বৃদ্ধি পাবে সমাজের মানুষগুলোর সুস্থতা এবং একজন ডাক্তারের লাইসেন্স টু কিল হয়ে যাবে তাঁর লাইসেন্স টু সার্ভ।

 

– রেহনুমা বিনতে আনিস

মন্তব্য করুন

Back to top button