জীবনের বাঁকে বাঁকে

ঐক্য

বাসর রাতের যে সময়টা নবদম্পতিরা সচরাচর প্রেমালাপে বিভোর থাকে সে সময় এক বেরসিক মেয়ে তার সদ্য স্বামীর সাথে আলাপ করছিল, ‘শুনুন, আমরা দু’জন দু’টো ভিন্ন পরিবার থেকে, পৃথক পরিবেশ থেকে এসে একত্রিত হয়েছি। সুতরাং, আমাদের চিন্তা চেতনা, ধ্যানধারণা, কাজ করার ধরণ, সিদ্ধান্ত নেবার পদ্ধতি থেকে প্রতিটা বিষয়ে পার্থক্য থাকবে। এটাই স্বাভাবিক। আবার এটাও সত্য একসময় আমরা পরস্পরের সাথে এতটাই সিঙ্ক্রোনাইজড হয়ে যাব যে একজন আরেকজনের চেহারা দেখেই বলে দিতে পারব সে কি ভাবছে বা কেমন অনুভব করছে। কিন্তু সে ব্যাপারটা দু’একদিনে ঘটবেনা। এর জন্য সময় লাগবে কয়েক বছর, সারা জীবনও লেগে যেতে পারে। এর মধ্যে খুঁটিনাটি থেকে বড় বড় ব্যাপারগুলো নিয়ে আমাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হবে, মনোমালিন্য হবে, তর্কাতর্কি হওয়া অস্বাভাবিক নয়, চুলাচুলিও হতে পারে। কিন্তু চলুন একটি ব্যাপারে আমরা সম্মত হই। আমাদের মধ্যে যা হবে তা বন্ধ দরজার এপাশেই রয়ে যাবে। এই দরজা খুলে যখন আমরা পৃথিবীর সামনে বের হব তখন নিজেদের মধ্যে যতই মাথা ফাটাফাটি থাকুক না কেন, জনসমক্ষে আমরা হব পরস্পরের শ্রেষ্ঠ বন্ধু। নইলে তৃতীয় কোন ব্যাক্তি আমাদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করার সুযোগ পাবে। আমরা একত্রিত থাকলেও যে কেউ চেষ্টা করবেনা তা নয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে আমরা পরস্পরের সাথে ব্যাপারগুলো আলাপ করে সত্যতা যাচাই করে নেব, তা যতই বেদনাদায়ক হোক না কেন, যেন একে অপরের কাছে স্বচ্ছ থাকতে পারি এবং আমাদের মাঝে বিভ্রান্তির সৃষ্টি না হয়’।

এই পদ্ধতিটি শুধু যে একটি দম্পতি বা একটি পরিবারের মাঝে সৌহার্দ্য রক্ষা করার ক্ষেত্রে কার্যকর তা কিন্তু নয়, বরং এই প্রক্রিয়া অবলম্বন করে একটি জাতি নিজেদের মধ্যে বিভেদগুলোকে মিনিমাইজ করে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। যেমন মুক্তিযুদ্ধের সময় কেউ ভাবেনি কে বড় কে ছোট, কে মুসলিম কে হিন্দু, সবার মাঝে একটাই চিন্তা কাজ করেছে – যেকোন মূল্যে শত্রুকে প্রতিহত করতে হবে, দেশের বিপন্ন অস্তিত্বকে রক্ষা করতে হবে। কিন্তু যুদ্ধোত্তরকালে আমরা আবার নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যগুলোকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে বিভাজিত হয়ে পড়েছি এবং বিভাজিত হতে রয়েছি। দুঃখজনকভাবে আমাদের চেতনাগুলো আমাদের দেশের স্বার্থে একত্রিত করার পরিবর্তে স্বার্থপর এবং আত্মকেন্দ্রিক করে তুলেছে। আমরা নিজেদের আদর্শকে উদাহরণ এবং বাস্তবায়নের মাধ্যমে সমুজ্জ্বল করার পরিবর্তে তর্ক এবং মারামারির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছি। আমাদের সচেতনতা ক্রমান্বয়ে অচেতনতার রূপ পরিগ্রহ করেছে। এক পর্যায়ে আমরা এমন অবস্থায় এসে পৌঁছেছি যেখানে আমরা নিজের মতাদর্শের বাইরে অবস্থানকারীদের মানুষ ভাবতেও নারাজ, তাদের মানবিক অধিকার দিতে অনিচ্ছুক, তাদের দমন উৎপীড়ন এবং হত্যা করার মাধ্যমে নিজের মতকে প্রতিষ্ঠিত করতে নির্লজ্জভাবে বদ্ধপরিকর এবং নিজেদের মতামতকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে নিজেদের বিভেদকে বঃহিশত্রুর জন্য প্রবেশপথ বানাতেও দ্বিধাহীন।

এখনো কি প্রশ্ন করার সময় আসেনি আমরা আসলে কি চাই, কোন পথে যাত্রা করেছি, কোথায় আমাদের গন্তব্য?

স্বামী স্ত্রী যতই ঝগড়া করুক না কেন শেষতক তাদের একই ঘরে অবস্থান করতে হয়। তাই নিজেদের প্রশান্তির জন্য, সংসার এবং সন্তানদের খাতিরে, তাদের একটি শান্তপূর্ন সহাবস্থানের উপায় খুঁজে নিতে হয় – এই কাজটি করতে হয় কখনো ছাড় দিয়ে, কখনো সম্পর্কের দাবী প্রতিষ্ঠা করে, কখনো হাত বাড়িয়ে, কখনো অভিমান দিয়ে। একটি দেশের অধিবাসীরা একটি বৃহত্তর পরিবারের অংশ। একটি পরিবারে যেমন কেউ আত্মভোলা হয়, কেউ পরোপকারী হয়, কেউ স্বার্থপর হয়, কেউ বুদ্ধিমান হয়, কেউ বোকা হয়, কেউ ঝগড়াটে হয়, কেউ অভিমানী হয়, কেউ অবুঝ হয়, কেউ সমঝদার হয়, কিন্তু এই পার্থক্যের জন্য কেউ কাউকে ছেড়ে যায়না আবার কেউ কাউকে আলমারীতে পুরে তালাবদ্ধও করে রাখেনা – তেমনি একটি দেশের নাগরিকদেরও প্রয়োজন নিজেদের পার্থক্যগুলোকে জাতীয় ঐক্যের ওপরে স্থান না দেয়া, তা সে যার জন্যই হোক না কেন; উচিত নিজেদের মধ্যকার পার্থক্যগুলোকে সংলাপ এবং যুক্তির মাধ্যমে সমাধান করা; উচিত তর্কের খাতিরে সহিংসতায় না গিয়ে শান্তির খাতিরে সহাবস্থানের উপায় খুঁজে নেয়া। নইলে দেশের মানচিত্রই যে কেবল হুমকির সম্মুখীন হয় তা নয় বরং ঘরের ভেতর আগুন জ্বলে উঠে সেই ধোঁয়া লুটেরাদের দৃষ্টি আকর্ষন করতে পারে।

হেনরিক ইবসেনের ‘দ্য ডলস হাউজ’ নাটকটির প্রধান চরিত্র ছিল নোরা। ওর স্বামী ওকে খুব আদর করত কিন্তু মূল্যায়ন করতনা। ফলে সে নিজের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি স্বামীর অনাসক্তিতে হতাশ হয়ে একদিন সাজানো সংসার ফেলে বেরিয়ে যায়। একটি সংসারে যেমন স্বামী স্ত্রী এবং পর্যায়ক্রমে সন্তানদের অধিকার সমভাবে নিশ্চিত করতে হয়, তেমনি একটি দেশের নাগরিকদের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হয়। কারো কথা বলার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য যদি অপর পক্ষের কথা বলার অধিকার ছিনিয়ে নেয়া হয় তবে তা এক সময় অভিমান থেকে ক্ষোভ, ক্ষোভ থেকে রাগ, রাগ থেকে সহিংসতার রূপ ধারণ করবে যা কারো জন্য কোনভাবেই কল্যাণকর নয়। সেক্ষেত্রে দোষটা যে রাগ করল তার চেয়েও যে পক্ষপাতিত্ব করে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করল তার ওপর বর্তায়। প্রেশার কুকারের ছিদ্র কুকারের ভেতরের প্রেশারটা ব্যালেন্স করতে সহযোগিতা করে, কিন্তু প্রেশার কুকারের ছিদ্র বন্ধ করে তাকে চুলার ওপর এড়িয়ে দিলে বিস্ফোরণ ঘটবেই। সেটা প্রেশার কুকারের দোষ নয়, দোষ সেই আহাম্মকের যে ছিদ্র বন্ধ করে তাকে চুলায় চড়িয়েছে। অথচ প্রেশারটাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে অনেক কম সময়ে অনেক বেশি রান্না করা যায়!

জর্জ অরওয়েল তাঁর ‘শুটিং অ্যান এলেফ্যান্ট’ গল্পে বার্মায় অবস্থানকালে তাঁর মানসিক অস্থিরতার বর্ণনা দিয়েছেন। একদিকে স্থানীয় জনগণের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের দমনপন্থী আচরন; অপরদিকে স্থানীয়দের প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ যা একজন পুলিশ অফিসার হিসেবে তাকে প্রতিদিনই মুকাবিলা করতে হচ্ছে। তাঁর ফ্রাস্ট্রেশনের বঃহিপ্রকাশ ঘটেছে এভাবে, ‘I was young and ill-educated and I had to think out my problems in the utter silence that is imposed on every Englishman in the East. I did not know that the British Empire is dying, still less did I know that it is a great deal better than the younger empires that are going to supplant it. All I knew was that I was stuck between my hatred of the empire I served and the rage against the evil–spirited little beasts who tried to make my job impossible. With one part of my mind I thought of the British Raj as an unbreakable tyranny, as something clamped won on prostrate peoples; with another part I though the greatest joy in the world would be drive a bayonet into a Buddhist priest’s guts. Feelings like these are a normal by-product of imperialism; ask any Anglo-Indian official, if you can catch him off duty’. (আমার বয়স ছিল অল্প, লেখাপড়াও ছিল যৎসামান্য এবং আমাকে আমার সমস্যা নিয়ে ভাবতে হত নীরবে যে নীরবতা ছিল পূর্বে কর্মরত প্রতিটি ইংরেজের সঙ্গী। আমি জানতাম না ব্রিটিশ সাম্রাজ্য তখন মৃত্যুপথযাত্রী, আমার ধারণাও ছিলোনা যে এই সাম্রাজ্য সেসব নব নব সাম্রাজ্যের চেয়ে অনেক ভাল ছিল যেগুলো পরে তাকে প্রতিস্থাপন করবে। আমি কেবল এটাই জানতাম যে আমি এক শাঁখের করাতে আটকে পড়েছিলাম যার একদিকে ছিল সেই সাম্রাজ্যের প্রতি ঘৃণা যার জন্য আমি কাজ করতাম এবং অপরদিকে সেই বজ্জাত নাছোড়বান্দারা যারা আমার কাজ করা অসম্ভব করে তুলছিল। আমার মনের একাংশ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে দেখছিল এক অলঙ্ঘ্যনীয় স্বৈরাচার হিসেবে যা নতজানু জনমানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে; অন্য অংশ ভাবছিল পৃথিবীর সবচেয়ে আনন্দের কাজ হত বৌদ্ধ ভিক্ষুদের পেটের ভেতর বেয়োনেট ঢুকিয়ে দেয়া। এ’ধরনের অনুভূতিগুলো সাম্রাজ্যবাদের স্বাভাবিক ফলাফল, যেকোন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান অফিসারকেই জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন যদি তাকে ডিউটির বাইরে ধরতে পারেন।) কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি বুঝতে পারলেন হাতি মরলে সাম্রাজ্যবাদী বা জনগণ কেউ লাভবান হয়না, তার টুকরোগুলো শকুনে খেয়ে নিঃশেষ করে।

আমাদের দুর্ভাগ্য এই জাতির শত শত বছরের ইতিহাসে আমরা এমন শাসক পাইনি যারা এই দেশকে ভালবেসেছে, দেশের মানুষকে একত্রিত করেছে, দেশের উন্নতিকে জীবনের লক্ষ্য স্থির করে নিয়েছে, ব্যাক্তিস্বার্থকে পেছনে ফেলে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে জনতাকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করতে সমর্থ হয়েছে। আমরা যুগে যুগে স্বৈরাচারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে এতটাই যুদ্ধংদেহী হয়ে গিয়েছি যে বঃহিশত্রু না পেলে আমরা নিজেরাই মারামারি করে মরি। মাঝখানে অন্য কেউ এসে আমাদের খাবার চেটেপুটে লুটে যায় তা আমাদের নজরেই পড়েনা। কি অদ্ভুত এক জাতি আমরা! আত্মকেন্দ্রিকতারও তো একটা সীমা থাকে। আত্মকেন্দ্রিকতার ফলাফল যদি নিজের জন্যই ধ্বংস বয়ে আনে তবে তাকে বর্জন করাই শ্রেয় নয় কি? আনুগত্য ভাল জিনিস, কিন্তু কার আনুগত্য করা হচ্ছে বা কি উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে, সেটা কি যাচাই বাছাইয়ের দাবী রাখেনা?

ছোটবেলায় আবুধাবীতে ছিলাম। স্কুলে ইউ. এ. ই. সোশ্যাল স্টাডিজ নামে একটা বিষয় বাধ্যতামূলক ছিল। পড়ে হতবাক হয়ে গেছিলাম যে তাদের জনসংখ্যার মাত্র ৪% ছিল স্থানীয় জনগণ, বাকী সব অভিবাসী। কিন্তু সবার জন্যই গ্যাস, ইলেক্ট্রিসিটি, পানি ছিল ফ্রি যেহেতু এরা সবাই মিলেই ১৯৭১ এ স্বাধীন হওয়া দেশটিকে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। একজন মাহাথির মুহাম্মদ মালয় এবং চৈনিক জাতিগত দাঙ্গায় বিধ্বস্ত একটি দেশকে তুলে নিয়ে পারেন উন্নতির চরম শিখরে। কিন্তু হায়, বাঙ্গালী একাই একশ, কিন্তু একশ বাঙ্গালী কখনো এক হতে পারেনা! দেশের স্বার্থেও না। পলাশীর প্রান্তরে মীরজাফর যা করেছিল আমরা আজও তার পুণরাবৃত্তি করে চলেছি। আজও আমরা নিজের স্বার্থে দেশকে দ্বিধাবিভক্ত করে ফেলছি, পৃথিবীর সামনে নিজেদের লজ্জা ঢাকার পরিবর্তে নাঙ্গা করে দিচ্ছি, একে অপরের ঘরে আগুন দিচ্ছি, একে অপরকে গুঁতিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করছি, একে অপরকে পিটিয়ে মেরে ফেলছি, ভুলে যাচ্ছি হায়েনারা বসে আছে আমাদের লাশ সাবাড় করার জন্য।

শত শত বছরের বঞ্চনার ইতিহাস আমাদের মাঝে এক আত্মপ্রবঞ্চক, লোভী, স্বার্থান্বেষী চরিত্রের জন্ম দিয়েছে যে নিজের জন্য সব কিছু করতে পারে কিন্তু ভাবেনা অন্যদের ছাড়া নিজের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে। নিজের অস্তিত্বের জন্য আমরা যেকোন অন্যায়, যেকোন অনাচার, যেকোন অবিচার করতে এবং মেনে নিতে প্রস্তুত থাকি। কিন্তু আমাদের মাথায় থাকেনা, every action has an equal and opposite reaction. (প্রতিটি ক্রিয়ারই একটি সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে।) যখন আমি একজন মানুষের মৃতুর খবর শুনে আগে ‘আহা’ করে উঠব এবং পরে বাকী তথ্য জানতে চাইব তখন বুঝব আমি মানুষ, কিন্তু যখন আমি একটি মৃত্যুসংবাদ শুনে আগে অনুসন্ধান করব সে কোন দলের বা মতাদর্শের ছিল এবং তারপর ভাবব আমি আদৌ রি-অ্যাক্ট করব কিনা তখন আমার মানবতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে বৈকি। তখন অপর এক ব্যাক্তি যদি আমাকে মারতে আসেন তাকে দোষারোপ করা যাবেনা, কেননা আমি নিজেই অপরের জীবনের কোন মূল্য দেইনি! সুতরাং, এই বিভক্তির শেষফল সমূলে ধ্বংস যা থেকে আমি, তুমি, আপনি, তুই কেউ রেহাই পাবেনা।

এখনো সময় আছে। আমরা কি এভাবেই আমাদের ‘সোনার বাংলা’কে নিঃশেষ হয়ে যেতে দেব, ভবিষ্যত প্রজন্মের সামনে একটি অসহনীয় অসহায় বিরান জীবন রেখে যাব, নাকি সবাই মিলে একটি সত্যিকার ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তুলব? সিদ্ধান্ত আমার, তোমার, আপনার, তোর। এরপর যে ফল দাঁড়াবে তা কিন্তু সবাইকে মিলেই খেতে হবে। সুতরাং, ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন।

 

– রেহনুমা বিনতে আনিস

মন্তব্য করুন

Back to top button