জীবনের বাঁকে বাঁকে

ইমার্জেন্সির দিন-রাত্রি

বাচ্চাটার বয়স দুই বছর। জরুরী বিভাগের টেবিলে শুয়ে চিৎকার করছিলো ব্যথায়। খেলার সময় চোখে ঢিল মেরেছে আরেকটি বাচ্চা। ভয়ংকরভাবে ফুলে গেছে চোখ। ভেতর থেকে চুঁইয়ে রক্ত মিশ্রিত অশ্রু ঝরছে চোখ থেকে। সাথে যে মহিলাটি এসেছে সে বাচ্চাটি হাত দিয়ে ধরে রেখেছে, কিন্তু তাঁর চোখ দিয়ে ঝরছে পানি। একজন পুরুষও ধরে রেখেছে বাচ্চাকে, বিধ্বস্ত চেহারা।

অনেক সময় দেখা যায় চোখের ইনজুরিতে চোখের পাতা বা আইলিড নিজে বড় হয়ে ফুলে যায় কিন্তু চোখের প্রধান অংশগুলো রক্ষা পায় ক্ষতির হাত থেকে। খুব আশা করছিলাম যেন অবোধ শিশুটিরও যেন তাই হয়। তবে তা হলো না। চোখের ভেতর কর্নিয়া ছিদ্র হয়ে গেছে। সাথে বেরিয়ে পড়েছে চোখের কিছু ভেতরের গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ। আইবলের ভেতরে রক্ত জমছে। রক্ত ঢেকে দিয়েছে চোখের দৃষ্টি। খুব খারাপ ধরণের ইনজুরি। এই চোখে স্বভাবিক দৃষ্টি ফিরিয়ে আনা খুব ভাগ্যের ব্যাপার। শিশুটির দিকে তাকিয়ে মনটা ভারাক্রান্ত হলো। মহিলাকে বললাম,

-আপনি ওর মা?

– না স্যার, আমার দেবরের ছেলে।

-ওর মা কোথায়?

– বাইরে বইসা আছে।

– বাবা কি করে?

– স্যার, বাবা মারা গেছে দুই মাস আগে। খুব কষ্ট কইরা চলতেছে ওর মা।

– পুরুষটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম-

– আপনি কি হন?

– চাচা হই স্যার।

জরুরীভাবে ভর্তি হয়ে অপারেশন করাতে হবে কিন্তু তারপরও দৃষ্টি পুরো স্বাভাবিক হবার সম্ভাবনা ক্ষীণ-এভাবেই রোগের ভয়াবহতা বুঝিয়ে বললাম। চাচা-চাচির চোখে পানি ঝরলো আবার।

সরকারি হাসপাতাল। বিছানা ও খাবার থেকে নিয়ে প্রায় সব ওষুধ বিনামূল্যে পাওয়া যাবে, সার্জারিরও কোন চার্জ লাগবে না। এর পরও আনুষাঙ্গিক কিছু ব্যয় আছে এই বাচ্চাটির জন্য, দরিদ্র পরিবারটির জন্য এইই হয়তো অনেক। ভর্তি দেয়ার সময় চাচাটি বলল, “স্যার খরচপাতি যাই হোক যেভাবে ভালো হয় করেন”।

ভর্তির জন্য বিস্তর কাগজপত্র লিখতে হয়। তাদেরকে ওয়েটিং এরিয়ায় বসিয়ে সব কিছু লিখে যখন বাইরে বের হয়েছি তখন দেখলাম ছেঁড়া একটি ব্যাগে ঠাসা করে আনা হয়েছে জিনিসপত্র। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কাপড়-চোপড়, বালিশ-কাঁথা। এর মাঝখানে শিশুটিকে কোলে নিয়ে মেঝেতে বসে ওর মা মুখে মুখ গুঁজিয়ে কাঁদছে। মাকে পেয়ে শিশুর অসুস্থ্য চোখের কান্না বন্ধ হয়েছে বটে কিন্তু বন্ধ হয়নি মায়ের সুস্থ্য চোখের অশ্রুধারা।

সরে এলাম দ্রুত। মনটা ভিজে উঠলো। আজ এই রাতে কত লক্ষ কোটি চোখ দেখছে পৃথিবীর মায়াবী রূপ। এটা যে আল্লাহর কত বড় অনুগ্রহ তা শুধু সেই বুঝছে, যে চেষ্টা করেও আজ দেখতে পাচ্ছে না।

 

ফজরের সময় পার হয়ে কেবল চারিদিক ফর্সা হতে শুরু করেছে, এমন সময় হাজির হলো মেয়েটি। ধরা যাক তার নাম ফারিয়া। বয়স সতেরো। সাথে এসেছে সমবয়সী একটি ছেলে আর মধ্যবয়সী একজন মহিলা অভিভাবক। চোখে আঘাত লেগেছে। লাল হয়ে আছে চোখ। ইমার্জেন্সির সহকারী তার প্রাথমিক পরিচর্যা করে কল দিলো। প্রথমে দেখেই অপ্রস্তুত হলাম। ভীষণ দৃষ্টিকটু পোষাক তার পরনে। এই সাত সকালে ঢাকা শহরের অধিকাংশ লোকের আড়মোড়াও ভাঙা হয়নি এখনো, তারপরও রোগীকে দেখতে ইমার্জেন্সি রুমের বাইরে ছোটখাট জটলা তৈরী হয়েছে।

চোখের আঘাত পরীক্ষা করলাম। খুব গুরুতর কিছু নয়। চিকিৎসা দিয়ে ছড়ে দেয়া যায়। প্রেস্ক্রিপশন লিখতে যাবার সময় মহিলাটি বললো, “স্যার, কেইস করা হবে। সেভাবেই লিখে দিয়েন”। তাহলে তো ডিটেইলস লিখতে হবে। অভিভাবক মহিলাটিকে ডেকে নিলাম হিস্ট্রি নেয়ার জন্য। বাংলাদেশের আপামর মা-খালাদের মতো মধ্যবয়সী একজন শালীন মহিলা।

– রোগী আপনার কি হয়?

– আমার মেয়ে।

– কিভাবে আঘাত লেগেছে?

– বয়ফ্রেন্ড মারছে।

বেশ একটা ধাক্কা খেলাম। বয়ফ্রেন্ড শব্দটা এতো সাবলীল আর খানিকটা গর্বের সাথে তিনি বললেন যে, তা এমন মানুষের মুখে শুনে আঁতকে ওঠাটা অনিবার্য। যেন মনে হলো আমাদের সমাজের রক্ষনশীল কোন মা-খালাদের মুখ থেকে শব্দটি বের হচ্ছে।

– মেয়ে কি করে?

– ড্যান্সার। ………টিভিতে ড্যান্স করে।

– কি দিয়ে মেরেছে?

– থাপ্পড় দিছে। ছেলে বদমাইশ কোথাকার। দেখি কই যায়।

ইনজুরির বিস্তারিত লিখলাম। যে ইনজুরি তাতে কেস করলেও সাজা তেমন কিছু হবার কথা নয়। মহিলা নানাভাবে বিভিন্ন কথা বলে বাড়িয়ে লেখানোর চেষ্টা করলেন।

– স্যার, মাথায় খুব ব্যথা। মাথাই তুলতে পারতেছে না। চোখ দিয়া রক্ত বাইর হইছিলো। আমরা মুছে নিয়া আসছি। তাকাতেও কষ্ট হচ্ছে।

মহিলাটিকে ওয়েটিং রুমে বসতে বলে সব কিছু লিখলাম। তিনি পাশের রুমে গিয়ে মেয়েটির পাশে বসে জোরে জোরে বলছিলেন “তুই কোন চিন্তা করিস না। আমি দেইখা নিমু। প্রোগ্রাম সব তুইই করবি……”।

মাথার মধ্য ‘বয়ফ্রেন্ড’ শব্দটি ঘুরছিলো। আজ সমাজে হারাম আর হালাল উল্টে গেছে। রাসুল সাঃ আর ইসলামের স্বর্ণযুগে বিয়ে ছিল খুব স্বাভাবিক ব্যাপার আর বয়-গার্লফ্রেন্ড নামের ফিতনা ছিলো কল্পনার অতীত। সমাজে এমন কোন সাবালিকা মেয়ে পাওয়া কষ্টকর ছিলো, যে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয়নি। কেউ যদি বিধবা বা তালাকপ্রাপ্ত হতো, তাহলেও স্বপ্লতম সময়ে তাদের আবার বিয়ে দিয়ে দেয়া হতো। ফলে সমাজে অনাচার আর মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতা ছিলো না। বিয়ের মতো চমৎকার সামাজিক বন্ধন যে কতোটা স্বচ্ছ ছিলো তা অনেক হাদিসে এসেছে। যেমন-সহীহ বুখারীতে এসেছে, জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবী আবদুর রাহমান বিন আউফের হাতে হলুদ রঙ দেখে রাসুল সাঃ জিজ্ঞেস করলেন, “কি ব্যাপার আবদুর রাহমান?” তিনি বললেন, “ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমি একটি মেয়েকে এক আঁটি সমান স্বর্ণ মোহর দিয়ে বিয়ে করেছি”। তিনি বললেন, “তুমি কি ওয়ালিমা করেছো?” আবদুর রাহমান বললেন, “না”। রাসুলুল্লাহ সাঃ বললেন, “একটি ছাগল দিয়ে হলেও ওয়ালিমা করো”। লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হলো এই যে, আবদুর রাহমান বিন আউফ ছিলেন মুহাজির সাহাবী যিনি মক্কা থেকে নিস্বঃ অবস্থায় হিজরত করে মদীনায় এসেছিলেন, যেখানে রাসুলুল্লাহ সাঃ ছাড়া তার আর প্রিয়জন কেউ ছিলো না। অথচ তিনি বিয়ে করলেন রাসুলকে না জানিয়েই আর রাসুল সাঃও এই বলে অভিযোগ করলেন না যে, “তুমি বিয়ে করলে আর আমাকে জানালেও না?” অথচ আজ আমাদের সমাজে বিয়ে একটি কমপ্লেক্স বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ যদি লিভ টুগেদার করে তাতে কারো আপত্তি নেই, কিন্তু দুটি বিয়ে করলে বা বর কনের বয়সের ব্যবধান বেশী হলেই ছি ছি বলে উঠে সারা সমাজ।

জেনে বুঝে বাবা-মা’র চোখের সামনে দিয়েই বিয়ে না করেও নির্বিকার মেলামেশার মতো ভয়াবহ আচার আজ স্বাভাবিক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। অথচ দুই দশক আগেও পরিস্থিতি এমন ছিলো না। আমাদের অধিকাংশের ছোটবেলায় বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ডতো দূরের কথা, বাবা-মা যদি শুনতেন ‘ছায়াছন্দ’ নামের সিনেমার গান দেখেছি, তাহলেই আর রক্ষা ছিল না। আব্বার সাথে বসে এমন কোন প্রোগ্রাম দেখেছি যেখানে কোন ছেলে কোন মেয়ের হাত ধরেছে, তা হয়নি কখনো। আমাদের বাবা-মায়েরা নিজেদের শ্রম ও মূল্যবোধের শেষটুকু পর্যন্ত দিয়ে আমাদের বড় করে তুলেছেন। এর যথাযোগ্য বিনিময় আল্লাহ দুনিয়া ও পরবর্তি অনন্ত জীবনে তাঁদের দিন। “রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বায়ানি স্বগীরা-ও আমাদের রব, আমাদের বাবা-মা’র উপর রহম করুন যেমনটি তারা আমাদের ছেলেবেলায় আমাদের উপর করেছেন”।

 

– আবু উসাইদ

১টি মন্তব্য

  1. বর্তমান সমাজে আধুনিকতার নামে চলছে বেহায়াপানা অার নোংরামি। আপনি তাদেরকে কিছু বললে তারা আপনাকে উল্টো UNCULTURED বলে গালি দিবে। কিন্তু দেখেন মা তার মেয়েকে কত সহজ ভাবে তার বয়ফ্রেন্ড (!!) এর সাথে মিশতে দিচ্ছে। যেন এটা কিছুই না। এর নাম আধুনিকতা। ভাবতেই ভালো লাগে (!!!!!!!)

    তবে বড় ভাই আপনার এই মূল্যবান পোস্টের জন্য ধন্যবাদ।

মন্তব্য করুন

Back to top button