অপমানের জ্বালা ও প্রতিবাদের দৌড়
হুজুগে বাঙালী বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। সম্প্রতি রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অবমাননার চেষ্টাকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো থেকে মনে হয়েছে অবিলম্বে এই প্রবাদ বদলে ‘হুজুগে মুসলমান’ করা উচিত। সমুদ্রের ফেনার মত অগণিত মুসলমান, গর্জন করে তীরে আছড়ে পড়ছে। তারপরেই সেই বুদবুদ গায়েব।
১.
সারা দুনিয়াতে মুসলিমরা অভিযোগ করছে মুহাম্মদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অবমাননা করা হয়েছে। এ কথা বলার আগে কেউ ভেবেও দেখল না আসলে কি রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অবমাননা করা যায়? সূর্যের দিকে থুথু ফেললে কি সেটা সূর্যের গায়ে লাগে? সারা পৃথিবীর মানুষ যদি এক হয়ে থুথু ছোড়ে তাহলেও সেটা মাধ্যকর্ষণের বাঁধা পার হতে পারবেনা; সূর্যে পৌছা তো বহু দূরের কথা। রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হচ্ছেন এমন মানুষ যিনি ইসলামের কথা বলতে গিয়ে পাথরের আঘাতে রক্তাক্ত হয়েছিলেন। তিনি তায়েফে মাস্তানি করতে যাননি, এলাকা দখল করতেও না। তিনি মানুষকে বলতে গিয়েছিলেন তোমরা এই সব পাথরের পূজা করার বদলে এক আল্লাহর ইবাদাত কর। ধারাল ছুরি দিয়ে রক্ত বের করা সহজ কিন্তু দূর থেকে পাথর মেরে রক্ত বের করতে হলে কতগুলো পাথর কতক্ষণ ধরে ছুড়তে হয় ভাবা যায়? সেই রক্ত বয়ে শরীর দিয়ে গড়িয়ে পড়ে জুতাটাকে চামড়ার সাথে শক্ত করে আটকে ফেলল। তিনি একটা খেজুর বাগানে এসে আশ্রয় নিয়ে কি ভাবলেন? তিনি ভাবলেন হয়ত তিনি ঠিকভাবে দাওয়াহ দিতে পারেননি। আঘাত পেয়েও তিনি নিজেকে দুষলেন। জিবরিল আমিন মালাকুল জিবাল বা পাহাড়ের ফেরেশতাকে নিয়ে আসলেন তায়েফবাসীকে দু পাহাড়ের মাঝে পিষে ফেলার অনুমতি চাইতে। রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনুমতি দেননি, তিনি তাদের ক্ষমা করেছিলেন। তিনি তাদের হিদায়াতের জন্য দু’আ করেছিলেন।
এই মানুষটাকে কি অপমান করার সাধ্য কি কারো আছে? শত কোটি চেষ্টাতেও এই মানুষটাকে কি অবমাননা করা যায়?
করা যে যায়না তিনি নিজেই কি সেকথা বলেননি?
তোমরা কি লক্ষ্য কর না যে কিভাবে আল্লাহ আমাকে কুরাইশদের অবমাননাকর গালি, অভিশম্পাত থেকে রক্ষা করেন? তারা আমাকে মুযাম্মামকে গালি দেয়, মুযাম্মামকে অভিশম্পাত করে; আর আমি মুহাম্মাদ।১
মুহাম্মাদ মানে প্রশংসিত, যে প্রশংসিত তাকে তো আর গালি দেয়া যায়না। তাই কাফেররা রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাম বিকৃত করে ডাকতো মুযাম্মাম অর্থাৎ নিন্দিত। এখন যখন কাফেররা মুযাম্মামকে গালি দিচ্ছে তখন তারা মুযাম্মামকে গালি দিচ্ছে, মুহাম্মাদকে তো গালি দিতে পারছে না।
সারা দুনিয়াতে রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোন ছবি নেই। যাকে বিকৃতভাবে এঁকে, মুভিতে উপস্থাপন করে শয়তানরা নাম কামাতে চাচ্ছে সেটা কি আসলেই রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম? শেখ হাসিনার ক্যারিকেচার করা যায়, হিটলার-বুশ সবারই কার্টুন আঁকা যায় কিন্তু যাকে বর্তমান বিশ্বের কেউ কখনও দেখেনি তার ছবি আঁকা চলে কিভাবে? নগ্ন ঐ দেহটা তো নাস্তিকদের নবী ডারউইন কিংবা কার্ল মার্ক্সেরও হতে পারে!
২.
একজন ভদ্রলোককে যদি রাস্তার ছোটলোক একটা খারাপ কথা বলে তাহলে বুদ্ধিমানের কাজ তাকে অবজ্ঞা করা। রগচটা কেউ হয়ত মারামারি করে বসতে পারে কিন্তু তাতে আঘাত যেমন জুটবে বাড়তি আরো অনেকগুলো গালিও জুটবে। কিন্তু সুস্থ মাথার এমন কাউকে পাওয়া যাবেনা যে অপমানের কথাকে পাঁচকান করে বেড়াবে। রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কেন্দ্র করে যা কিছু মিথ্যা অপবাদ রটানো হচ্ছে সেগুলোর আলোচনার রুচি আমাদের কি করে হতে পারে? ‘ইনোসেন্স অফ মুসলিম’ দেখার মত বা মুক্তমনার ব্লগ পড়ার মত, পড়ে অন্যদের সাথে শেয়ার করার মত মানসিকতা আমাদের হয় কি করে? যে জিনিসটা কোনোই দৃষ্টি আকর্ষণ করতোনা সেটাকে আমরা সার্চ ইঞ্জিনের প্রথমে ঠেলে দিলাম। বিকৃত তথ্যের এই ছবির প্রচারণা চালালাম আমরা – এই মুসলিমরা। কোথাকার কোন উজবুককে আমরা বিশ্ববিখ্যাত বানিয়ে দিলাম। ইসলাম অবমাননা প্রকল্পে তাদের হাতের গুটি হিসেবে আমরা ব্যবহৃত হলাম। আমাদের বুদ্ধি কি হাটুতে নেমে গেছে?
ইন্টারনেটে যাদের ভাল ঘাটাঘাটি আছে তারা জানে কি পরিমাণ নোংরামি তাতে ছড়িয়ে আছে। ধর্মকে আক্রমণ করার সাইট আছে হাজার হাজার। যখন নাস্তিকরা ঈসা আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে অপবিত্র কথা বলেছে, মুসা আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নোংরামোতে জড়িয়েছে তখন কেন প্রতিবাদ হয়নি? তারা কি আমাদের নাবী নন? ইহুদি-খ্রীষ্টান নামধারীরা যখন বাক-স্বাধীনতার নামে নিজেদের ধর্মকে ব্যঙ্গ করেছে তখন আমরা আঙ্গুল চুষেছি, এখন কেন আমাদের এত আঘাত লাগছে?
কোন জিনিস একবার ইন্টারনেটে চলে আসলে সেটা মুছে ফেলা যায়না। একটা মুভি যদি একবার প্রচার পেয়ে যায় তাহলে সেটা কোথাও না কোথাও পাওয়া যাবেই। ইউটিউব থেকে যদি স্যাম ব্যাসিলের একাউন্ট বন্ধও করে দেয়া হত, আরকেউ আরেকটা একাউন্ট থেকে ভিডিওটা আপলোড করত। ইনোসেন্স অফ মুসলিমে যে ৪৩ হাজার লাইক পড়েছে এরাই করত। বিশ্বে বর্তমানে ৭১ এর বেশী ভিডিও হোস্টিং সাইট আছে। ইউটিউব থেকে সরালে মেটাক্যাফেতে দিত, মাইস্পেসে দিত, হুলুতে দিত, মেভিওতে দিত। কথার কথা ধরে নেই – পৃথিবীর সব সাইট থেকে সরিয়ে দেয়া হল – টরেন্ট থেকে মানুষ তখন ডাউনলোড করত। নতুন নতুন সাইট বানাত শুধু এই একটা মুভিকে জায়গা করে দেয়ার জন্য। আমরা একটা জিনিস বুঝিনা যে ভার্চুয়াল জগতে কোন কিছু মোকাবেলা করার সবচেয়ে ভাল কৌশল হচ্ছে সেটাকে উপেক্ষা করা, পাত্তা না দেয়া। এটা গ্রীক পুরাণের হাইড্রার মত, একটা মাথা কাটলে দু’টো গজাবে। এখানে প্রতিক্রিয়া দেখানোই মানে ক্ষতি। লিবিয়ার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সারা দুনিয়া বিষয়টি নিয়ে এভাবে মেতে উঠল। ফ্রেঞ্চ ম্যাগাজিন আরো নোংরা কার্টুন আঁকার আগ্রহ পেল।
আমরা এ জমানার মুসলিমরা না দ্বীন বুঝি, না দুনিয়া। কিভাবে কার্যকরী প্রতিবাদ করতে হবে, তার ভাষা কি হবে, ধরণ কি হবে সেটা নিয়ে আমাদের বিন্দুমাত্র চিন্তা নেই। ভিডিও নির্মাণ করল কে, আর সেজন্য প্রাণ দিতে হল কাদের! মহান আল্লাহ যেখানে কুরানে স্পষ্ট বললেন –
হে যারা ঈমান এনেছো! আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায়ের সাক্ষ্য দেয়ায় তোমরা অবিচল থাকবে। কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদেরকে যেন কখনো সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে। সুবিচার করবে, এটা তাকওয়ার নিকটতর এবং আল্লাহকে ভয় করবে। তোমরা যা করো নিশ্চয়ই আল্লাহ তার সব খবর রাখেন।২
মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে হত্যা করা কোন ন্যায়বিচার হল? একের অপরাধে অন্যকে হত্যা করা কি ইসলামী রীতি? ওরা ইরাক-আফগানিস্তানে নির্বিচারে মানুষ মারছে বলে আমরাও নির্বিচারে মানুষ মারব এটাই যদি যুক্তি হয় তাহলে ওদের আর আমাদের মধ্যে পার্থক্য রইল কি? আল্লাহর ওয়াহীর কি দু’পয়সা দাম নেই আমাদের কাছে?
৩.
কারো আদর্শকে সহ্য করতে না পারলে সাধারণত তার বিরুদ্ধে ব্যক্তি আক্রমণ করা হয়। রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মক্কাতে যা প্রচার করতেন – এক আল্লাহর ইবাদাত করা, দরিদ্রদের প্রাপ্য দেয়া, মেয়ে শিশুদের হত্যা না করা, ইয়াতীমদের সম্পদ আত্মসাৎ না করা – এসবের বিরুদ্ধে কোন যুক্তি খুঁজে না পেয়ে তাকে পাগল বলা হত, মিথ্যাবাদী বলা হত, কবি বলা হত। যে মানুষটিকে তারা এতদিন আল-আমীন বলে ডাকত হঠাৎ তিনি মিথ্যা বলা শুরু করলেন? যে পাগল সেকি ছন্দ মিলিয়ে কবিতা বানাতে পারে? তাদের এই ব্যক্তি আক্রমণের পরষ্পর বিরোধীতা থেকে বোঝা যায় যে ব্যক্তি আক্রমণ কত ঠুনকো। আদর্শের মোকাবেলায় যারা ব্যক্তিকে অপবাদ দিয়ে খাটো করার চেষ্টা করে তারা কাপুরুষ। কোন যুক্তিবাদী মানুষ যদি ইসলামের আদর্শের বিরুদ্ধে যৌক্তিক কিছু বলত – আমরা পালটা যুক্তি দিতাম। কিন্তু মিথ্যা কথার প্রতিবাদ কি যুক্তি দিয়ে করা যায়? এর প্রতিবাদ হচ্ছে এমন সবকিছুকে অবজ্ঞা করা আর সত্যটা মানুষের সামনে তুলে ধরা – ইতিহাস থেকে প্রমাণসহ। যে মানুষের মধ্যে ন্যুনতম সৌজন্যতাবোধ আছে সে সত্য মানুক আর না মানুক, সত্য থেকে মিথ্যাটাকে আলাদা করতে পারে। আমরা খালি মানুষকে ধমকই দিয়ে যাব – “এই মিথ্যা কথা বলবানা”, কিন্তু সত্যটা কি সেটা না বলে চুপ করে থাকব – এটা কি শোভনীয়?
সমস্যা হচ্ছে আমরা সত্যটা বলব কিভাবে? বলতে হলে তো জানতে হবে। আর জানার ব্যাপারেই আমাদের যত আপত্তি। যারা রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্মান রক্ষার্থে রাস্তায় এসে বিক্ষোভ করছেন তাদের ক’জন তার জীবনকথা পড়েছেন? এদের মাহফিল তো ভর্তি থাকে নাম-না-জানা ওলীদের বানোয়াট কেচ্ছায়। এদের ওয়াজে নাবী কি করেছেন, কি করতে বলেছেন সেগুলো শুনিনি বললেই চলে। এমনকি রসুল নিজে যে দরুদ শিখিয়ে গেছেন সেই দরুদ বাদ দিয়ে হুজুরদের ‘বালাগাল উলাবি কামালিহি’ পড়তে শোনা যায়। আর যখনই শ্রোতাদের মধ্যে ঘুম ঘুম ভাব দেখা যায় তখনই তাদের কোরাসে দরুদ গাইতে লাগিয়ে দেয়া হয়। একজন মুসলিমের জন্য রসুলের শিক্ষাকে উপেক্ষা করার চাইতে আর বেশী কি অবমাননাকর হতে পারে?
আমরা যারা অন্তর্জাল উত্তপ্ত করছি তারা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেরা নিজেদের প্রশ্ন করি, আমি আমার নাবী সম্পর্কে কতটুকু জানি? আমরা কি তার সব স্ত্রীর নাম জানি যাদের তিনি ‘আমাদের মা – উম্মুল মু’মিনিন’ হিসেবে সম্মানিত করেছেন? তার সাহাবাদের ক’জনের নাম আমরা জানি? নিজেই নিজের পরীক্ষা নেই। ক’জন ক্রিকেটার, ফুটবলার আর মুভিস্টারের নাম জানি সেটাও একটা কাগজে লিখে ফেলি। এরপর দু’টো তালিকা মিলিয়ে রসুলের প্রতি ভালবাসার দাবীর সত্যতাটা বিচার করি।
রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একজন মুসলিমের রক্ত এবং সম্পদ অন্য মুসলিমের জন্য হারাম করেছেন। ঢাকায় বাস ভাংচুর করে, পাকিস্তানে দোকান লুট করে, লিবিয়ায় মানুষ খুন করে বিক্ষোভকারীরা রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোন সম্মান রক্ষা করল? যিনি আমাদের শিক্ষা দিলেন –
দু’জন মানুষের মাঝে ইনসাফ দেয়া হচ্ছে সাদকাহ্, কোন আরোহীকে তার বাহনের উপর আরোহন করতে বা তার উপর বোঝা উঠাতে সাহায্য করা হচ্ছে সাদকাহ্,ভাল কথা হচ্ছে সাদকাহ্, সালাতের জন্য প্রত্যেক পদক্ষেপ হচ্ছে সাদকাহ্ এবং কষ্টদায়ক জিনিস রাস্তা থেকে সরানো হচ্ছে সাদকাহ্।৩
সেখানে আমরা কোটি মানুষকে কাজ করতে না দিয়ে বেইনসাফি করলাম। যান-বাহন চলাচল বন্ধ করে, মাঠে-ঘাটে চিৎকার করে, রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা দিয়ে – হরতাল করলাম। এই জন্যই বোধহয় কিয়ামাতের দিন রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর কাছে অনুযোগ করবেন যে তার উম্মাত কুরানকে, কুরানের শিক্ষাকে পরিত্যাগ করেছিল।৪ রসুলের সম্মান রক্ষা করতে গিয়ে আমরা তার সুন্নাহকে অপাংক্তেয় করে ফেলেছি। পাকিস্তানে যে মানুষগুলো বিক্ষোভ করতে গিয়ে জীবন দিল তাদের যদি প্রশ্ন করা হয় কেন জীবন দিলে – তার হয়ত বলবে রসুলকে ভালোবেসে। কিন্তু যদি প্রশ্ন তোলা হয় রসুল কি আসলেই তার উম্মাতকে এভাবে জীবন দিতে বলেছিলেন তাহলে তার উত্তর কি হবে? আল্লাহর দেয়া জীবন কি এতই ফেলনা? অপাত্রে, অস্থানে জীবন অপচয় করা এমনই ভুল যার প্রায়শ্চিত্ত করার কোন সুযোগ থাকেনা। জীবন দেয়ার আগে জেনে তো নেই কিসের জন্য জীবন দিচ্ছি!
৪.
ইসলামের সৌন্দর্যের মধ্যে একটা বড় দিক হচ্ছে এর ভারসাম্যতা। ইসলামে ক্ষমা যেমন আছে তেমন শাস্তিও আছে। রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেমন তায়েফবাসীকে ক্ষমা করেছিলেন তেমনি তিনি মদীনাতে কাব ইবন আশরাফ এবং আবু রাফে’কে হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন। এ দু’জনেরই অপরাধ ছিল তারা ইসলামের বিরুদ্ধে কবিতা লিখত। কবিতা লেখার অপরাধে মৃত্যুদন্ড – এটা আমাদের কাছে খুব কঠিন মনে হতে পারে কিন্তু মনে রাখতে হবে তখনকার কবিতা আজকের মত আজিজ মার্কেটে বিক্রয়যোগ্য পণ্য ছিলনা। তখন কবিতাই ছিল মুভি, কবিতাই ছিল টিভি, কবিতাই ছিল গণমাধ্যম তথা প্রোপাগান্ডার হাতিয়ার। কবিতার প্রোপাগান্ডাতে দিনকে রাত করা হত, সত্যকে মিথ্যা। দূর-দূরান্তের মানুষের মনে ইসলামের সত্য দিকটার বদলে একটা মিথ্যা বিদ্বেষ দিয়ে বুক ভার করে ফেলা হত কবিতা দিয়ে। এই ইন্টারনেটের যুগেও প্রোপাগান্ডাকে কতটা শক্তিশালী ধরা হয় তার প্রমাণ আমরা পাই আল-কায়েদাকে কেন্দ্র করে ডেপুটি এটর্নি জেনারেল পল ম্যাকনাল্টির বক্তব্য থেকে –
They want to demoralize us. That’s why propaganda is so important to them, and why facilitating that propaganda is such an egregious crime.
ইমাম আনওয়ার আল আওলাকিকে ইয়েমেনে ড্রোন হামলা চালিয়ে হত্যা করার পিছনে আমেরিকানদের এই যুক্তিই ছিল যে তিনি ইংরেজি ভাষাভাষীদের মধ্যে আল কায়েদার প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছেন।
মদীনার ইহুদিদের সাথে রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চুক্তি ছিল যে তারা মুসলিমদের কোন ক্ষতি করবেনা এবং তার বদলে মুসলিমরা তাদের নিরাপত্তা দেবে। কিন্তু যখন কাব ইবন আশরাফ কিংবা আবু রাফে’ সেই চুক্তি ভঙ্গ করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে থাকল তখন তাদের হত্যার আদেশ দেয়া হল। এই হত্যাদুটো ছিল গুপ্তহত্যা যাতে একজনের অপরাধে পুরো গোত্রটিকে যুদ্ধে জড়াতে না হয়। উল্লেখ্য এ হত্যাকান্ডের আদেশ দিয়েছিলেন রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যিনি ছিলেন মুসলিম রাষ্ট্রের শাসক। তিনি এরপরে এই হত্যার দায়িত্বই শুধু নেননি, কেন এ হত্যার আদেশ দেয়া হয়েছিল সেটা তিনি ইহুদিদের ব্যাখ্যা করেছিলেন।৫ একইভাবে একজন অন্ধ সাহাবার মুক্ত করে দেয়া দাসী, উম্ম ওয়ালাদ, যখন রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অপমান করে কথা বলত, বারবার সাবধান করার পরেও ক্ষান্ত হতনা, তখন সেই সাহাবা সেই দাসীকে হত্যা করেন। ইহুদিরা এর বিচার চাইতে গেলে সাহাবা যখন দায় স্বীকার করে কারণ বর্ণনা করেন তখন রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই হত্যা বৈধ বলে রায় দেন।৬ রসুল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুরো মক্কাবাসীর মধ্যে কেবল ছ’জনকে হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন।৭ মাফ করে দেয়া অনেকেই বদর আর উহুদে সরাসরি মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। কিন্তু যাদের হত্যার আদেশ দেয়া হয়েছিল এরা যুক্ত ছিল নানান ধরণের প্রোপাগান্ডার কাজে, ইসলাম ও মুসলিমদের হেয় করার কাজে।
ইসলামী শরিয়া প্রবর্তন পাঁচটি বিষয় রক্ষা করতে – মানুষের দ্বীন, জীবন, সম্মান, সম্পদ এবং বিবেকবোধ। একজন নারীর নামে যদি কেউ ব্যাভিচারের অভিযোগ আনে কিন্তু চারজন চাক্ষুস সাক্ষী না আনতে পারে তবে সেই অভিযোগকারীর শাস্তি হবে আশিটি বেত্রাঘাত; নারীটি সত্যি ব্যভিচার করে থাকলেও। যেখানে সাধারণ মানুষের সম্মানের ক্ষেত্রে ইসলাম এত সজাগ সেখানে শেষ নাবী ও রসুলের সম্মান রক্ষার্থে আইনটি যে অনেক কড়া হবে তা বলাই বাহুল্য। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া তার “আশ-শারিম আল মাসলুল ‘আলা শাতিম আর-রসুল” বইটিতে বিভিন্ন দলিলসহ প্রমাণ করেছেন যে রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মিথ্যা অপবাদ/কটাক্ষ/অবমাননার চেষ্টার শাস্তি মৃত্যুদন্ড। ইসলামের ভিত্তি হচ্ছে তাওহিদ এবং রিসালাত। এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা মানে ইসলামিক রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা। এই অপরাধটাকে ইংরেজিতে বলে ‘হাই ট্রিজন’।’ দু’শ বছর আগেও ব্রিটিশ আইনে এই অন্যায়ের শাস্তি ছিল – hanged, drawn and quartered; অর্থাৎ ঘোড়াতে ছেঁচড়ে শহরের মধ্যেখানে এনে মৃতপ্রায় অবস্থা পর্যন্ত ঝুলিয়ে রাখা, পুরুষাঙ্গ কেটে, পেট থেকে নাড়ী-ভূড়ি বের করে, মাথা কেটে, সারা শরীর চার টুকরো করে লন্ডন ব্রিজে ঝুলিয়ে রাখা।৮ অপরাধী যদি নারী হত তাহলে অবশ্য তাদের প্রতি অনেক রহমত করা হত, জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হত। আমাদের সৌভাগ্য যে ইসলামী শরীয়তে ব্রিটিশ ভদ্রতা নেই।
ইসলামী শরীয়তের হিসাবটা অনেক সোজা, তোমাকে জোর করে মুসলিম হতে হবেনা; জিযিয়া দাও – নিরাপত্তা পাবে। মুনাফিক হও, জিযিয়া দেয়া লাগবেনা। তোমার মনে যত ইসলামবিরোধীতা থাক – প্রকাশ্যে কিছু বলতে পারবেনা। মত প্রকাশের স্বাধীনতা পৃথিবীর কোথাও নেই, আমেরিকাতে এক বছর থেকে সেটা চাক্ষুস দেখে এসেছি। জুলিয়ান আসাঞ্জের হেনস্তা চোখে লেগে আছে, তারেক মেহান্না এখনও সলিটারি কনফাইনমেন্ট থেকে বেরোতে পারেননি। ইসলামে গণতন্ত্রের মত দ্বিমুখীতা নেই – যেটা করা যাবেনা সেটা স্পষ্ট বলে দেয়া হয়েছে। সীমালঙ্ঘনের শাস্তিও বলা আছে।
৫.
ইসলামের ক্ষেত্রে যদি আমরা আইন নেই কিন্তু আইনের প্রেক্ষাপট বাদ দেই তাহলে মহা মুশকিল। হুদুদ শাস্তি কায়িমের জন্য ইসলামিক আইনের শাসন থাকা আবশ্যক। শাসক না থাকলে অপমানকারীদের হত্যাকারীকে নিরাপত্তা কে দেবে যেটা রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সাহাবাকে দিয়েছিলেন? এ জন্য মক্কায় যখন শাসন ক্ষমতা ছিলনা তখন রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সব অত্যাচার অপমান সহ্য করেও মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন, দ্বীন শিখিয়েছেন। তের বছর প্রচেষ্টার পরেও যারা সেই দাওয়াতের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালিয়েছে তাদের তিনি মৃত্যুদন্ড দিতে পারেন। কিন্তু যারা একজন অমুসলিমকেও ইসলামের কথা বলতে পারেনি, তারা যখন মৃত্যুদন্ডের দাবীতে রাস্তায় নামে তখন হাসিই আসে। কার্টুনিস্টের মৃত্যুদন্ড কে দেবে? তাগুতী আইন? তাগুতের ক্ষমতা আছে বলে পাকিস্তানে এসে উসামা বিন লাদিনকে মেরে গেছে, লাশ নিয়ে চলে গেছে। মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত। আর আমাদের দৌড় পতাকা আর পুতুল পোড়ানো অবধি। আমাদের অসভ্য আচরণ দিয়ে সত্যি সত্যি ‘ইনোসেন্স অফ মুসলিম’ নামকরণ সার্থক করে ফেলেছি।
খিলাফাত ব্যাতিরেকে গুপ্তহত্যা যে কল্যাণ বয়ে আনেনা তার প্রমাণ ভুরি ভুরি। এক হুমায়ুন আজাদের শত সন্তান এখন বাংলা ব্লগ বিচরণ করে চলছে – প্রতিনিয়ত আল্লাহ এবং তার রসুলকে অবমাননার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ‘সাবমিশন’ চলচ্চিত্রের নির্মাতা থিও ভ্যান গঘকে মুহাম্মদ বুয়েরি হত্যা করে আজীবন কারারুদ্ধ হলেন। ইসলামকে অপমান করেও এখন থিও ভ্যান গঘ অমর বীর। চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্যের লেখিকা আয়ান হিরসি আলিকে আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউটে ফেলো হিসেবে নিয়োগ দেয়া হল। এখন কিভাবে ইসলামের ক্ষতি করা যায় সেটা নিয়ে নিশ্চিন্তে গবেষণা কর। কাজের কাজ কি হল? শুধু ২০০৫ সালেই নেদারল্যান্ডে বিভিন্ন মসজিদ এবং ইসলামিক স্কুল হামলার শিকার হল ৩১ বার।
আমাদের মুসলিমদের একটি জিনিস বুঝে নেওয়া দরকার। কে কার সম্পর্কে কি ভাববে সেটার উপরে আমাদের কোন হাত নেই। জোর করে সুধারণা সৃষ্টি করা যায়না। যারা রসুল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে জানেনা তাদের যা বলা হবে তারা তেমনই ধারণা পাবে। আর ধারণা পাবে যারা কথাগুলো বলছে তাদের কীর্তিকলাপ দেখে। আমাদের মুসলিমদের কাজ দেখে কি আমাদের শিক্ষক সম্পর্কে ভাল ধারণা পাবার কোন উপায় আছে? আমেরিকা-ইউরোপের কথা বাদ দেই, এই বাংলাদেশে, লালমনিরহাটের অজগাঁয়ে, কানের মোবাইলের ইয়ারফোনে গান শুনতে থাকা মুসলিম তরুণকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আমাদের রসুলের নাম কি? সে বলতে পারেনি। আমি কোন মুক্তমনার কথা বলছি না, একটা চাষার ছেলের কথা বলছি। আমাদের লজ্জা হওয়া উচিত।
আমাদের যখন আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন রসুলকে ভালোবাসার দাবীর প্রমাণে কি করেছি তখন কি উত্তর দেব? রসুল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে আমাদের একটি দিনের ২৪ ঘন্টা মিলিয়ে দেখি – কয়টি মুহূর্ত মেলে? তার আদর্শ শিখি, তার চরিত্র, তার ভদ্রতা, তার কর্মপন্থা নিয়ে একটু জানার চেষ্টা করি। একটু মানার চেষ্টা করি। এরপরে সেগুলো মানুষকে জানাই। যতটা সম্ভব জানাই। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ মুহাম্মাদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ রহমাতুললিল মুসলিমিন নয়, রহমাতুললিল ‘আলামীন করে পাঠিয়েছেন। তিনি কেন এবং কিভাবে সমগ্র সৃষ্টির জন্য দয়া এটা নিজে জানা এবং মানুষকে জানানোর ভার আমাদের। আল্লাহ যেন আমাদের এ দায়িত্ব পালনে সাহায্য করেন। আমিন।
– শরীফ আবু হায়াত অপু
——————————————————-
১ সহীহ বুখারী ৩৫৩৩
২ সুরা আল মায়িদা ৫:৮
৩ সহীহ বুখারী ২৯৮৯, সহীহ মুসলিম ১০০৯
৪ সুরা আল ফুরকান ২৫:৩০
৫ সীরাতে ইবনে হিশাম
৬ সিলসিলায়ে সাহীহা আবু দাউদ ৩৬৫৫
৭ সিলসিলায়ে সাহীহা আবু দাউদ ২৩৩৪
৮ The Treason Act 1814 Chapter 54 Geo. III c. 146