জীবনের বাঁকে বাঁকে

‘আপনি যদি ক্ষুধার্ত হন আর পকেটে টাকা না থাকে তাহলে বিনামূল্যে খেয়ে যান’

মাথার উপর অগ্নিসম রোদ। এর মধ্যেই দিনে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা কাজ করা তাদের স্বাভাবিক নিয়ম। দুটো পয়সা বেশি আয়ের জন্য কেউ কেউ ওভার টাইমসহ ১৫/১৬ ঘণ্টাও কাজে থাকেন। এভাবেই দিন যায়,সপ্তাহ গিয়ে মাসও শেষ হয়।

এবার রক্ত পানি করা পরিশ্রমের টাকাটা হাতে পাওয়ার অপেক্ষা। টাকা পেয়েই কেউ স্ত্রীকে পাঠাবেন। কারো মেয়ে লজ্জায় স্কুলে যাচ্ছে না শিক্ষকরা বেতন চান বলে। দু’দিন পর পর মেয়ে ফোন দিয়ে অনুযোগ করে- আব্বু, তুমি টাকা পাঠাও না কেন! আমি স্কুলে যেতে পারছি না। বাবা তখন বলেন, এই তো ১ তারিখ আসছে, পাঠিয়ে দেব।

মাস শেষ হয়েছে। এবার বেতন মিলবে। পরিবারের অভিযোগ-অনুযোগ শেষ হবে। বেতনের আশায় বসের সামনে গিয়ে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়ান শ্রমিক। কিন্তু ‘বস’ জানালেন, কোম্পানি এ মাসের টাকা সময় মতো দেবে না! কোনো কারণ নেই। কোনো ব্যাখ্যা নেই। দেবে না তো দেবে না। কে আদায় করতে পারবে জোর করে?

মেয়ের স্কুলে যাওয়াও শেষ। স্ত্রীকে ফোন দিতে পারছেন না লজ্জায়। এদিকে নিজে আগামী এক মাস এই বিদেশ বিভুইয়ে চলবেন কিভাবে টাকা ছাড়া? যে কয় রিয়াল হাতে আছে তাতে হয়তো কয়েকটা দিন যাবে। বাকিটা মাস কোনো বেলা অনাহারে কোনো বেলা অর্ধাহারে কাটাতে হবে! এটাই নিয়তি। এভাবেই চলছে কাতারে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করা কয়েক লাখ বাংলাদেশি, ভারতীয় ও নেপালি মানুষের জীবন।

ভাগ্যবিড়ম্বিত এই মানুষগুলোকে দেখার কেউ নেই। কাতার সরকারের উপর মানবাধিকার সংস্থাগুলো বহু চাপ প্রয়োগ করলেও তাতে কোনো ফল আসছে না।

দুই ভাইয়ের অনন্য দৃষ্টান্ত:

তবে আর কেউ এগিয়ে না এলেও খুব কাছে থেকে দুঃখী শ্রমিকদের এই দুর্দশা দেখে তাদের ক্ষুধার কষ্ট দূর করতে নিজেদের সাধ্য অনুযায়ী এগিয়ে এসেছেন মহানুভব দুই মুসলিম সহোদর। ব্যবসায়ী নিশাব খান এবং তার ভাই শাদাব খান তাদের রেস্টুরেন্টে টাকা দিতে না পারা শ্রমিকদের জন্য বিনামূল্যে খাবারের ব্যবস্থা করেছেন।

‘জাইকা’ নামের রেস্টুরেন্টের সামনে সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছেন তারা। সেখানে লেখা রয়েছে- ‘আপনি যদি ক্ষুধার্ত হন আর পকেটে টাকা না থাকে তাহলে বিনামূল্যে খেয়ে যান।’

দুনিয়ার সবচেয়ে ধনী এলাকাগুলোর একটি কাতারের রাজধানী দোহা। এই নগরীর আকাশচুম্বী কাঁচের ভবনগুলো থেকে মাত্র ১০ মাইল দূরত্বে দেশটির ‘শিল্প এলাকা’ হিসেবে পরিচিত একটি জায়গা আছে। সেখানে মূলত শ্রমিকরা কাজ করেন এবং থাকেন। তাদের জীবনমান একেবারে প্রান্তিক। ওখানেই ‘জাইকা’ রেস্টুরেন্টটির অবস্থান।

রেস্টুরেন্টে খেতে এসেছিলেন নেপালের নাগরিক গোফরান আহমদ। তিনি একটা কোম্পানিতে মেকানিকের কাজ করেন। গোফরানের সাথে কথা হয় এএফপি’র। তিনি বলেন, কাতারে বহু কোম্পানি মাস শেষে সময় মতো বেতন দেয় না। কোনো কোনোটি তো কয়েক মাস কাজ করিয়ে এক টাকাও না দিয়েই শ্রমিকদের বিদায় করে দেয়। সেখানে একজন শ্রমিক বড়জোর ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা পান সারা মাস কাজ করে।

যারা সময় মতো টাকা পান তাদের জন্যও দোহার মতো ব্যয়বহুল জায়গায় সেটা দিয়ে কোনো মতে চলাও সম্ভব হয় না। তার মধ্যে আবার বেশিরভাগ শ্রমিকই আয়ের বড় অংশটা দেশে পরিবারকে দিয়ে দেন। ফলে নিজেদেরকে সেখানে মানবেতর জীবন কাটাতে হয়।

গোফরান বলেন, ‘এসব মানুষের জন্য বিনামূল্যে খাবারের ব্যবস্থাটা থাকা খুব প্রয়োজন।’

এই ‘প্রয়োজন’টা বুঝে তা পূরণে নেমে পড়েন দুই ভাই শাদাব ও নিশাব। তারা ভারতের দিল্লী থেকে গিয়ে কাতারে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা করছেন গত প্রায় ১৩ বছর ধরে।

সপ্তাহ তিনেক আগে তাদের রেস্টুরেন্টের সামনে একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেন দুই ভাইয়ের ছোটজন নিশাব খান। সেখানে লেখা- ‘আপনি যদি ক্ষুধার্ত হন আর পকেটে টাকা না থাকে তাহলে বিনামূল্যে খেয়ে যান।’

শাদাবদের রেস্টুরেন্টটি খুব বড় কিছু নয়। একসাথে মাত্র ১৬ জন বসে খেতে পারেন। টাকার বিনিময়ে আর বিনামূল্যে খাওয়ার ব্যবস্থাতে কোনো তফাত নেই। যার কাছে টাকা নেই তিনি অন্যদের মতোই খাবার খেয়ে গিয়ে শুধু ‘টাকা নেই’ বললেই হয়।

ছোট ভাইকে এই উদ্যোগের কৃতিত্ব দিয়ে ৪৭ বছর বয়সী শাদাব খান বলেন, ‘সাইবোর্ডটি প্রথম দেখে আমার চোখে পানি চলে এসেছিল। এখনো যখন বিষয়টি নিয়ে কিছু বলতে যাই আমার কথা আটকে যায়।’

শাদাব খান, যিনি একজন চলচ্চিত্র নির্মাতাও, বলেন- যারা খাবারের জন্য আসেন তারা প্রায় সবাই বাংলাদেশ, ভারত বা নেপাল থেকে আসা নির্মাণ শ্রমিক।

তিনি বলেন, আমরা এক পর্যায়ে বুঝতে পারলাম এখানে অনেক মানুষ আছেন যারা সময় মতো বেতন পান না এবং এজন্য তাদের কাছে দু’বেলা খাওয়ার টাকাটাও থাকে না।

আমাদের রেস্টুরেন্টে অনেকে এসে এক রিয়াল দিয়ে একটা ব্রেড কিনে পানি দিয়ে সেটা খেয়ে চলে যান! এ থেকেই আমাদের দৃষ্টিতে আসে বিষয়টি। তখন থেকে আমরা চেষ্টা করছি এই মানুষগুলোকে অন্তত খাবারটা যেন খাওয়াতে পারি।

কিন্তু শাদাব বলেন, কাজটা আসলে অত সহজ নয়। আত্মসম্মানবোধের কারণে অনেকে টাকা না থাকলেও বিনামূল্যে কিছু নিতে চান না।

শাদাব দুঃখের সাথে জানান, এজন্য গত তিন সপ্তাহে দিনে গড়ে মাত্র দুই/তিনজনকে বিনামূল্যে খাওয়াতে পেরেছেন তারা।

তার বক্তব্যের প্রমাণ পাওয়া যায় রেস্টুরেন্টে বসেই। এএফপি’র সংবাদদাতা সেখানে থাকা অবস্থায় দু’জন শ্রমিক ঢুকে বাইরের লোকজন দেখে না খেয়ে চলে যান।

যে শ্রমিকরা কাতারের নাটকীয় উন্নতিতে অবদান রাখছেন তাদের কষ্টের আরেকটি তথ্য সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন মার্কেটে ছোটাখাটো দোকান খুলে ব্যবসা করা যেসব শ্রমিক বর্ধিত ভাড়া ঠিকমতো দিতে পারছেন না তাদেরকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। জাইকা’র মালিকরাও একই ভয়ে আছেন।

তবে সে ভয় শাদাব আর নিশাবকে শ্রমিকদের জন্য বিনামূল্যের খাবার সরবরাহ থেকে বিরত রাখতে পারছে না মোটেও। তারা বরং পরিকল্পনা করছেন কিভাবে মানুষগুলোর আত্মসম্মান বজায় রেখে তাদেরকে খাবার দেয়া যায়।

শাদাব বলেন, আমরা একটা ফ্রিজ রেস্টুরেন্টের দেয়ালের সাথে রাস্তামুখী করে রেখে দেয়ার চিন্তা করছি। এটা তালা ছাড়া থাকবে। তখন লোকজনকে খাওয়ার জন্য ভিতরে এসে টাকা না দেয়ার জন্য বিব্রত হতে হবে না। বাইরে থেকে নিয়েই চলে যেতে পারবে।

২৩ লাখ জনসংখ্যার দেশ কাতারে মোট ৭ থেকে ১০ লাখ শ্রমিক কাজ করছেন বর্তমানে। আগামী ২০২২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজনসহ নানা ধরনের শত শত নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে দেশটি।

এসব প্রকল্পে কাজ করা শ্রমিকদের ন্যূনতম অধিকার রক্ষিত হচ্ছে না বলে প্রকল্প পরিচালক কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আসছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো। এতে সরকার চাপে থাকলেও বাস্তবে এখনো কোনো সুফল পাচ্ছেন না শ্রমিকরা।

এএফপি

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button