জীবনের বাঁকে বাঁকে

শার্লক হোমস হইতে চাই

ডঃ ওয়াটসন শার্লক হোমসের সাথে প্রথম পরিচয়ে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন যে এত তুখোড় মেধাবী লোকটা জানেনা পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে! তথ্যটা জানাতেই শার্লক হোমস বলে ওঠেন তাঁর কাজের সাথে এই তথ্যের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই, সুতরাং এটি তাঁর জানার কোন প্রয়োজন নেই; যেহেতু তথ্যটা যেভাবেই হোক তিনি জেনে গিয়েছেন, তিনি চেষ্টা করবেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটি ভুলে যেতে। লাইনগুলো পড়ে সেই অল্প বয়সে আমার মনে হয়েছিল কথাগুলো চরমপন্থী। কিন্তু আজ পরিণত বয়সে এসে আমার মনে হচ্ছে শার্লক হোমস একজন যুক্তিবাদী মানুষ। কিন্তু যুক্তিবাদী লোকজনের সমস্যাই হোল তাঁদের আশেপাশে কেউ তাঁদের যুক্তি বুঝতে পারেনা বা এর পেছনে কারণগুলো অনুধাবন করতে পারেনা।

আমি আমার নিজের যুক্তি খাটিয়ে এখন যেটা বুঝি সেটা হোল, যার জীবনের কোন লক্ষ্য নেই তার কথা  আলাদা, কিন্তু যার জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য তাঁর কাছে স্পষ্ট তিনি তো সে তথ্যই সংগ্রহ করবেন যা তাঁর জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যে তথ্য তাঁর জীবনের লক্ষ্য অর্জনের সহায়ক হবে। আর নইলে এস এস সিতে এসে বিভাগ নির্বাচন বা অনার্সে বিষয় নির্বাচনের কোন প্রয়োজনই হতনা। আমরা মাস্টার্স, পি এইচ ডি পর্যন্ত সকলে সকল বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে থাকতাম। কিন্তু, আমরা কেউ কার্যত Jack of all trades, master of none হতে চাইনা। আমাদের ইচ্ছে থাকে অন্তত একটি বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করার। তাই আমরা সে বিষয়ে অধিক জ্ঞান অর্জন করায় লিপ্ত হই যেটা আমাদের কাঙ্খিত সাফল্য এনে দেবে।

আমরা বাজারে গেলে নিশ্চয়ই অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনে ব্যাগ ভর্তি করে নিয়ে আসিনা। প্রথমত, এতে টাকা নষ্ট হয়, এত টাকা আমাদের অধিকাংশেরই নেই। দ্বিতীয়ত, এতে সময় নষ্ট হয়, এতটা সময় নষ্ট করার পক্ষপাতী আমরা অধিকাংশই নই। তৃতীয়ত, যে জিনিসের প্রয়োজন নেই সেটি ঘরে স্থান দেয়ার মত প্যালেস আমাদের অধিকাংশেরই নেই। এবার যদি আমরা টাকার জায়গায় মেধা, সময়ের জায়গায় জীবন এবং প্যালেসের জায়গায় মস্তিষ্ক পড়ি তাহলে হয়ত চিত্রটা আমাদের কাছে আরেকটু স্পষ্ট হবে। আমাদের অধিকাংশের মেধা সীমিত, সুতরাং সেটা খরচ করা দরকার খুব বুঝেশুনে, ব্যাবসায় টাকা লগ্নি করার মত করে, যেখানে মেধা খরচ করলে উত্তম প্রতিদান পাওয়া যাবে সেখানে। ক্ষণস্থায়ী জীবন আমাদের, কখন কোন ফুঁৎকারে নিভে যায় কেউ জানেনা। তাহলে আমাদের আসলেই কি সময় আছে ঘন্টার পর ঘন্টা সিনেমা টিভি দেখে, আজেবাজে ম্যাগাজিন পড়ে, চ্যাটিং কিংবা ফেসবুকিং করে জীবনের অমূল্য মূহূর্তগুলো নষ্ট করে ফেলার? অথচ এই সময় আর ফিরে আসবেনা কোনদিন! আর মস্তিষ্ক? সে তো আরেক বিশাল চ্যাপ্টার।

আমরা আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসগুলো তুলে রাখি আলমারীতে। সে আলমারী সাধারনত হয় বসুন্ধরার মত। এতে যতই জিনিস ঢোকানো হয় ততই যেন জায়গা বাড়ে। কিন্তু তাই বলে এই সুযোগের অপব্যাবহার করাও সঙ্গত নয়। অগোছালো আলমারীর ক্ষেত্রে দেখা যায় দরজা খোলার সাথে সাথে ঝাঁকে ঝাঁকে জিনিসপত্র যেন ‘আক্রমন কর!’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়তে থাকে, কিন্তু তাদের আক্রমনের বূহ্য ভেদ করে কিছুতেই কাঙ্খিত বস্তুটি খুঁজে পাওয়া যায়না। অপরদিকে একটি গোছানো আলমারীতে হাত দেয়া মাত্র প্রয়োজনীয় বস্তুটি খুঁজে পাওয়া যায়। মস্তিষ্কের ব্যাপারটাও তেমনই। এতে বাছাই করে জিনিস রাখলে সুসজ্জিত ফাইল ক্যাবিনেটের মত প্রয়োজন হওয়ামাত্র কাঙ্খিত তথ্য বেরিয়ে আসে। অপরদিকে যে মস্তিষ্ক  দুনিয়ার হাবিজাবি তথ্যে পরিপূর্ণ সেখানে দু’আ বলতে গেলে গান বেরিয়ে আসে। যেমন একবার এক পুলিশ অফিসার হাইওয়েতে প্যাট্রোল ডিউটিতে ছিলেন। দেখলেন, তাঁর সামনে দিয়ে উচ্চস্বরে গান বাজাতে বাজাতে দ্রুতগামী একটি গাড়ী চলে গেল। কিছুক্ষণ পর তিনি সামনে গিয়ে দেখলেন গাড়ীটি অ্যাকসিডেন্ট করেছে। গাড়ীর ভেতর দুই তরুণকে দেখলেন তখনো প্রান আছে, কিন্তু বোঝা যাচ্ছে ওদের বাঁচার সম্ভাবনা নেই। তিনি তাদের কালেমা পড়ানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু তাদের মুখ দিয়ে কিছুতেই কালেমা এলোনা, তারা যতবারই বলার জন্য মুখ খুললো প্রতিবারই তাদের মুখ থেকে কেবল গান বেরিয়ে এলো, এই অবস্থাতেই তারা মারা গেল। কি ভয়ানক মৃত্যু!

গানের ব্যাপারেও আছে আরেক বিশাল চ্যাপ্টার। সাধারনত মানুষ গান শোনার সময় কথাগুলো তেমন খেয়াল করেনা, কিন্তু কথাগুলো নিজের অজান্তেই ঢুকে যায় মাথার ভেতর, আর তারপর সেগুলো গুনগুন করে বের হতে থাকে সময় অসময়ে। যেমন একবার আমার এক বান্ধবীর বাবা সিরিয়াস অসুস্থ। সকালে ওকে ফোন করলাম জানার জন্য কি অবস্থা। বিকালে ওর বাসায় গিয়ে দেখি মন ভীষণ খারাপ। জিজ্ঞেস করলাম আঙ্কেলের অবস্থার অবনতি হয়েছে কি’না। বলল, না, অবস্থা তূলনামূলকভাবে ভালো। আশ্চর্য হলাম, তাহলে এত মন খারাপ কেন? বলল, ‘তোমার সাথে কথা বলার পর ফোনের পাশে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আকাশপাতাল ভাবছিলাম আর কি যেন গুনগুন করছিলাম খেয়ালও করিনি। কিছুক্ষণ পর দেখলাম মেজ খালা সামনে দিয়ে যেতে যেতে প্রচন্ড সন্দেহ নিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে। তখন খেয়াল করলাম আমি গাচ্ছি, ‘পান খাইয়া ঠোঁট লাল করিলাম, তবু বন্ধুভাগ্য হইলোনা’। কোথায় কখন শুনেছি, মাথায় বিঁধে গিয়েছে। কিন্তু খালা কি ভাবল? খালা ভাবল ফোনে আমি কোন ছেলের সাথে কথা বলেছি। তারপর মনের আবেগে গান ধরেছি। অথচ ওদিকে আমার বাবা হাসপাতালে শয্যাশায়ী। কি অসভ্য মেয়ে! এখন আমি যদি খালাকে বলিও যে আসলে ব্যাপারটা তেমন না – আমি কথা বলেছি তোমার সাথে, তোমাকে তো খালা চেনেই; যদি বলি আমি আসলে আব্বার কথা ভাবছিলাম; যদি বলি আমি জানিনা আমি কেন এত গান থাকতে ঐ গান গুনগুনাচ্ছিলাম – কে বিশ্বাস করবে আমার কথা?’

শুধু গানই নয়, অধিকাংশ আজেবাজে জিনিসই আমাদের মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে দীর্ঘ সময়। যদিও কোন বাজে দৃশ্য, বাজে কথা, বাজে ছবি, বাজে তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে মনকে কৃষঙ্গহ্বরে ঠেলে দেয়; কিন্তু পরবর্তীতে ওখানে থেকে বেরিয়ে এলেও এসব জিনিস মাথা থেকে বেরোতে চায়না সহজে, বরং বার বার ভেসে ওঠে মনের স্ক্রিনে আর পীড়া দিতে থাকে নিরন্তর। অদ্ভুত ব্যাপার হোল এই ধরনের জিনিসগুলো বার বার ঘটতে থাকলে এক সময় এগুলো আমাদের কাছে সহজ হয়ে যায়, হয়ে আসে স্বাভাবিকও। তখন এগুলো আর আমাদের পীড়াদায়ক মনে হয়না বরং আনন্দ দিতে থাকে। আনন্দময় জিনিস সহজেই আমাদের মন মগজ মস্তিষ্কে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। এক পর্যায়ে আমাদের মন এক সময় যেটাকে ঘৃনা করত সেটাকেই আলিঙ্গন করে নিতে প্রস্তুত হয়ে পড়ে। জ্ঞান পরিণত হয় কর্মে। মানুষের জীবনে বিনোদনের প্রয়োজন আছে। কিন্তু সেটা নির্মল এবং বুদ্ধিবৃত্তিক হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়, যেটা জীবনে আলোর বিস্তার ঘটায়, দূর করে অন্ধকার।

একবার এক ব্যাক্তি আমাকে বলেছিল, ‘আমি আমার সন্তানকে এমনভাবে বড় করতে চাই যেন সে নামাজী হয়, আবার গান বাজনাও পছন্দ করে’। কিন্তু দু’টো বিপরীতমুখী জিনিস কি একই হৃদয়ে ধারণ করা সম্ভব? একটি হোল স্রষ্টার সামনে অবনত হওয়া, আরেকটি হোল স্রষ্টার প্রদত্ত উপহারের প্রদর্শনেচ্ছা। একটির জন্য প্রয়োজন বিনয়, আরেকটির জন্য অহংকার। কি করে সমন্বয় হবে এই দুটির? আর কিভাবেই বা দু’টোর মধ্যে সুসম ভারসাম্য বজায় রাখতে পারবে একজন মানুষ যে সৃষ্টিগতাবেই দুর্বল, যার পেছনে লেগে রয়েছে শয়তান এবং যার ভেতরে অবস্থান করে নিরন্তর তাড়না দিয়ে যাচ্ছে নাফস?

এখানেই আমরা ভুল করি। আমরা সেটাই করি যেটাকে ইংরেজীতে বলে to bite more than one can chew. আমরা তলস্তয়ের সেই লোভী কৃষকের মত করতে চাই যে বার্বারদের কাছ থেকে বেশি জমি পাওয়ার আশায় ভোরবেলা লাঙ্গল নিয়ে যাত্রা শুরু করে বিশাল এলাকা নিয়ে আয়তক্ষেত্র আঁকতে যায়। কিন্তু সন্ধ্যায় সে মৃত্যুর কোলে লুটিয়ে পড়ে আয়তক্ষেত্র পুরো হবার মাত্র কয়েক ফুট বাকী থাকতেই। তাকে কবরস্থ করতে প্রয়োজন হয় মাত্র ছয়ফুট জমি।

জীবন সীমিত, মেধা সীমিত। সুতরাং আমাদের ঘর পরিচ্ছন্ন রাখা জরুরী। আমাদের সময় সেই জ্ঞানের পেছনেই ব্যায় করা বুদ্ধির কাজ যা আমাদের কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছতে, সাফল্য অর্জন করতে সাহায্য করবে; সেই জ্ঞানকেই আত্মস্থ করার পেছনে মেধা ব্যায় করা উচিত যা আমাদের জন্য কল্যাণকর; সেই জ্ঞানেরই অনুশীলন করা প্রয়োজন, এমনভাবে চর্চা রাখা প্রয়োজন যেন দরকার হবার সাথে সাথে তা এসে বলে, ‘হুজুর, বান্দা হাজির’। বাকীটুকু এক জীবনে অর্জন করা যাবেনা, প্রয়োজনও নেই। একে প্রলোভন মনে করে এড়িয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

– রেহনুমা বিনতে আনিস

ইসলামিক ইমেইল নিউজলেটার
নতুন পোস্ট প্রকাশিত হলে সরাসরি আপনার ই-মেইল ইনবক্সে পেতে সাবস্ক্রাইব করুন।
icon

১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

Back to top button