জীবনের বাঁকে বাঁকে

ফিসফিস

“প্রতিবার ডিপ্রেশনে (বিষণ্ণতা/অবসাদ) পড়লে আমার মনে হয় হঠাৎ আমার মনে কোন বজ্রপাত হয়েছে, আর সব ঝকঝকে পরিষ্কার হয়ে গেছে, যেন নতুন আলোয় সবকিছু অন্যরকম দেখছি। এই পরিবর্তন ঘটতে এক ঘণ্টার বেশী লাগে না। হঠাৎ করেই আমার সব চিন্তা ভাবনা হতাশ রূপ ধারণ করে। যখন পেছন ফিরে দেখি, যেন স্পষ্ট দেখতে পাই জীবনে যা করেছি সব বৃথা। সুখের সময়গুলো মনে পড়লেও, মনে হয় সেগুলো ছিল স্বপ্ন, কল্পনা। জীবনে যা সাফল্য পেয়েছি সব যেন কোন সিনেমার সেটের মতো নকল, সব জালিয়াতি। আমি যে একটা অপদার্থ- এই বিশ্বাসটা আমার মধ্যে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হতে থাকে। আমি দৈনন্দিন কোন কাজকর্ম করতে পারি না, কারণ নিজের উপর অবিশ্বাস আমার হাত পা বেঁধে ফেলে। আবার কিছু না করে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়েও থাকতে পারি না, কারণ তাহলে কষ্টগুলো বাড়তে বাড়তে এক সময় অসহ্য হয়ে যায়।”

কথাগুলো একজন ডিপ্রেশন ভুক্তভোগীর স্বীকারোক্তি, যখন পড়ছিলাম, মনে হচ্ছিলো আসলে এই ভদ্রমহিলা আমার কথাই বলছেন। এবং আমার ধারণা, যে কোন ডিপ্রেশনের ভুক্তভোগীর এটা পড়ে আমার মতোই মনে হবে। ওই সময়টাতে মনে হয়, যেন জীবনের আসল সত্যগুলো এতদিন জানতামই না, এতদিন একটা ঘোরে ছিলাম, এই মাত্র জেগে উঠেছি। আগে যা ভাবতাম সব মিথ্যা বানানো কথা। জীবনের সেই বিশ্রী “সত্য” গুলো সাধারণত এই ধরনের হয়ঃ আমি একজন ব্যর্থ মানুষ, আমাকে কেউ ভালোবাসে না, অমুক মানুষটা আমার সাথে অন্যায় অবিচার করেছে, সে মহাপাপী। আসলে সব মানুষ খারাপ। এই পুরো পৃথিবীটা নিষ্ঠুর।

ইত্যাদি…

ফিসফিস… ফিসফিস…

সোহেল অফিস থেকে আসতে দেরি করেছে। কেন দেরি করলো? ও কি জানে না আমার ওকে দরকার? আমার দরকারের সময় ও আমার পাশে থাকে না। ও কীভাবে এমন করতে পারলো? আসলে ও আমাকে আর ভালবাসে না, তাই বাসায় আসতে চায় না। আগেও এমন করেছে। ভবিষ্যতেও করবে। ও আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। তখন আমি একা হয়ে যাব। সম্পূর্ণ একা… আমার জীবনটা বৃথা হয়ে যাবে… এই খালি বাসায় আমি একা পড়ে থাকবো, কেউ আমাকে দেখতে আসবে না। আমাকে এতো কষ্ট দিচ্ছে? ও এতো খারাপ? কীভাবে মানুষ এতো খারাপ হয়? আমাকে কেউ ভালোবাসে না। সবাই খারাপ! এই খারাপ মানুষদের সাথে আমি থাকতে পারব না! আমি আর সহ্য করতে পারছি না! আমি মরে যেতে চাই!

কখনও যদি শয়তানের ফিসফিস তোমাকে প্ররোচিত করে, সাথে সাথেই তুমি আল্লাহ তায়ালার কাছে আশ্রয় চাও, অবশ্যই তিনি (সব কিছু) শোনেন এবং (সব কিছু) জানেন। [৭:২০০]

এরকম মানসিক অত্যাচার কি বন্ধ করা যায়? একজন depressed মানুষকে জিজ্ঞেস করলে বলবে, আমার সাথে মশকরা করো? কখনই না, আমি সারাজীবন এমনই থাকবো। এটাই আমার নিয়তি। হয়তো কিছুদিনের জন্য ঠিক হবো, আবারও এমন হয়ে যাব।

আসলেই কি তাই?

ডিপ্রেশন সারাজীবনের জন্য দূর করার কিছু বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত উপায় আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে কার্যকরী উপায়ের নাম সি.বি.টি. (cognitive behavioural therapy)। এই থেরাপির আবিষ্কারক আরন বেক-এর মতে ডিপ্রেশনের মূল কারণ আমাদের মস্তিষ্কের কিছু একঘেয়ে স্বয়ংক্রিয় চিন্তা (automatic thoughts), যেগুলো ডিপ্রেশনের সময় কয়েক গুণ বেড়ে যায়। তাই এর থেকে বের হবার জন্য সেই চিন্তাগুলোকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ডিপ্রেশনের সময় যেই সব “সত্য” গুলো পরিষ্কার হয়ে যায় সেগুলো যে আসলে সত্যি নয়, এটা বুঝতে পারলেই অনেকদূর এগিয়ে যাওয়া যায়। ডিপ্রেশনের সময় আমাদের সাথে লেগে থাকা শয়তানটা আমাদের সব positive চিন্তাকে ছেঁকে ফেলে দেয়, এবং সব negative চিন্তাগুলোকে অনেকভাবে বিকৃত করে ফেলে। এই বিকৃতকরণ প্রক্রিয়া (cognitive distortions) মূলত দশ রকমের। এই দশটা আক্রমণকে পরাজিত করতে পারলে ডিপ্রেশনকে চিরতরের মতো দূর করা সম্ভব।

(আপনার কি ডিপ্রেশন আছে কি না, থাকলে কোন পর্যায়ে আছে তা জানতে এই পরীক্ষাটি করুন। আশা করি নেই। ডিপ্রেশন না থাকলেও নিচের তথ্যগুলো দৈনন্দিন জীবন-যাপনের আরও শান্তি আনার জন্য কার্যকরী।)

১/ সাদা-কালো চিন্তা (All or nothing thinking): পরীক্ষার ফলাফল দেখে শাবাবের মন খারাপ, ৯টার মধ্যে একটা পরীক্ষায় B পেয়েছে। একটা প্রশ্নের উত্তর জেনেও সে ঠিক মতো লিখতে পারেনি, তাই নিজেকে মনে মনে কষিয়ে থাপ্পড় মারছে। তুই একটা failure, অকর্মণ্য।

imagesহয়তো বুঝতে পারছেন শাদা-কালো চিন্তা মানে কি বুঝাচ্ছেন সি বি টি সায়কোথেরাপিস্ট ডঃ বারন্স। জীবনের সব ঘটনাকে ছেঁটে দুইয়ের এক বাক্সে ফেলতে হবে, হয়তো ভালো নাহলে খারাপ, মাঝখানে কিছু নেই। এই ধারণাটা মোটেও যুক্তিসম্মত নয়। কোন মানুষ সম্পূর্ণ নির্ভুল নয়, আবার কোন মানুষ সম্পূর্ণ গর্দভও নয়। কোন জিনিস সম্পূর্ণ পরিষ্কার বা সম্পূর্ণ নোংরা হয় না। আপনার ঘরের মেঝের দিকে এখনই একটু তাকান। সেটা কি সম্পূর্ণ পরিষ্কার? নাকি সম্পূর্ণ ধুলো দিয়ে ঢাকা? সৃষ্টির কোন জিনিস perfect নয়, perfect শুধুমাত্র আমাদের সৃষ্টিকর্তা। আপনি কি সৃষ্টিকর্তার স্থান নিতে চান? না চাইলে নিজের থেকে perfection আশা করা বন্ধ করুন।

২/ ঢালাও চিন্তা (overgeneralization): হাসান রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। হঠাৎ একটা কাক মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল। যাবার সময় হাসানকে একটা উপহার দিয়ে গেল। হাসান সাথে সাথে মহাবিরক্ত হয়ে বলল, “ধুত্তুরি! ঢাকা শহরের সব কাক শুধু আমাকেই বাথরুম বানায় কেন!” সে আর তার কাজে না গিয়ে বাড়ি ফিরে গেল, গোসল করল, তারপর টিভি দেখতে দেখতে বিক্ষিপ্ত মনকে ঠিক করার চেষ্টা করলো।

চলুন হাসানকে প্রশ্ন করি, আসলেই কি সব কাক তাকেই বাথরুম বানায়? ঢাকা শহরের হাজার হাজার কাক যদি তাকে আসলেই বাথরুম বানাত, তাহলে কি সে কোনদিন বাসা থেকে বের হতে পারত? একেই বলে overgeneralization। এই পদ্ধতি দিয়ে একটা কাক একজন মানুষের মস্তিষ্ককে বিক্ষিপ্ত করতে পারে।

৩/ ছাঁকনি (mental filter): পরীক্ষা হল থেকে ভ্রু কুঁচকিয়ে বের হল শিরিন, কয়টা প্রশ্নে ভুলের সম্ভাবনা আছে গুনতে গুনতে। সতেরটা! আমি এবার নিশ্চয়ই ফেল করবো। এক সপ্তাহ পরে ম্যাডাম দেকে বলল, “তুমি ৮৩% পেয়েছ, ক্লাসের highest!”

শিরিনের ছাঁকনি দিয়ে সব সঠিক প্রশ্নগুলো বের হয়ে গিয়েছিলো। তাই সে দেখতেই পারেনি যে আসলে পরীক্ষা অনেক ভালো হয়েছে। যখন আমরা সব ভালো চিন্তাগুলো ছাঁকনি দিয়ে ছেকে ফেলি, তখন শুধু রয়ে যায় negative চিন্তা। আর তাই তখন মনে হয় যে সবকিছুই negative। এই ছাঁকার কাজটা আমরা ইচ্ছা করে করি না। ইচ্ছা করে কেউ কি হতাশায় ভুগতে চায়? অন্য সব বিকৃতিগুলোর মতো এটা একটা automatic process। অবশ্য ইচ্ছা করলে আমরা এটা করা বন্ধ করতে পারি।

৪/ “ভালোটাও খারাপ” (disqualifying the positive): সোহেল তার স্ত্রীকে বলল, “তোমাকে আজকে খুব সুন্দর লাগছে।“ শিরিনের মনে চিন্তা আসা শুরু হল, আসলেই আমাকে সুন্দর লাগছে? না, ও মিথ্যা কথা বলছে, আমাকে খুশী করার জন্য… আমাকে করুণা করছে। নাকি আমার থেকে কিছু চায়? নিশ্চয়ই কিছু চায়, নাহলে হঠাৎ আমার মিথ্যা প্রশংসা করবে কেন?”

Disqualifying the positive বিকৃতি তখন হয় যখন আমাদের ভেতরে দৃঢ় বিশ্বাস থাকে যে আমি খারাপ আর আমার সব খারাপ। তাই কেউ যদি প্রশংসা করে সাথে সাথে সেটাকে উড়িয়ে দেই, “না এটা তেমন কিছু না।” অথচ যদি কেউ নিন্দা করে তাহলে সাথে সাথে বিশ্বাস করি। ডঃ বারন্স তাঁর একজন রোগীর বর্ণনা দিয়েছেন যার ধারণা ছিল, “আমাকে কেউ ভালবাসতে পারবে না কারণ আমি একটা খারাপ মানুষ, আমি অমিশুক, এই পৃথিবীর কেউ আমাকে নিয়ে এক বিন্দুও ভাবে না।” সে যখন হসপিটাল থেকে চলে যাচ্ছে সেদিন অনেক রোগী ও কর্মচারীরা তাকে অনেক আদরের সাথে বিদায় দিলো। তখন সে বলল, “ওরা গোনায় পড়ে না, ওরা তো জানেই না আমি আসলে কীরকম।”

৫/ সবজান্তা (jumping to conclusions): ঠিক মতো বিবেচনা না করেই একটা নেতিবাচক চিন্তাকে সত্যি মনে করা। এটা দুই প্রকারেরঃ

ক। মস্তিষ্ক পাঠ (mind reading): তারিনের তার বান্ধবীর সাথে বাইরে যাবার কথা। শেষ মুহূর্তে বান্ধবী জানাল যে সে আসতে পারবে না। মস্তিষ্ক পাঠঃ এই মেয়েটার কোন কিছুতেই কোন কেয়ার নেই! অলস। নিশ্চয়ই ঘুম থেকে উঠেছে দেরিতে। আসলে ও আমাকে ওর বন্ধু মনে করে না। অথচ হতে পারে মেয়েটির আসলেই কোন কারণ ছিল না আসার, সেটার সম্ভাবনাই বেশী কারণ আগে কখনও সে এরকম করেনি। Mind reading করার সময় আমরা একদম নিশ্চিত হয়ে বলে দেই অন্য আরেকজন কি ভাবছে। এই ব্যাপারে আল্লাহ্‌ তা’আলা বলেছেন,

হে ঈমানদার ব্যক্তিরা, তোমরা বেশী বেশী অনুমান করা থেকে বেঁচে থাকো, (কেননা) কিছু কিছু (ক্ষেত্রে) অনুমান (আসলেই) অপরাধ এবং একে অপরের (দোষ খোঁজার জন্যে তার) পেছনে গোয়েন্দাগিরি করো না[৪৯:১২]

খ। ভাগ্য গণনা (fortune-teller error): আমি ওই চাকরিটার জন্য দরখাস্ত দিবো না। যদি দেই তাহলে নির্ঘাত ওরা আমাকে reject করবে, তখন আমি আরও আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলব। তাই আমি দরখাস্তই দিবো না। তাই আমি সারাজীবন বেকার থাকবো। এরকম ভাগ্য গণনায় কোন লাভ হয় না, বরং একরকম self fulfilling prophecy হয়ে দাঁড়ায়। কেউ যদি চাকরির দরখাস্তই না দেয়, তাহলে তো সে বেকার থাকবেই!

OLYMPUS DIGITAL CAMERA৬/ বাইনোকুলার (magnification and minimization): শাবাবকে তার বস রুমে ডেকে বলল,  “তোমার supervisor তোমার ব্যাপারে কমপ্লেন করেছেন। তুমি নাকি আগের কাজটায় ডেডলাইন পেরিয়ে গেছো? সমস্যা নেই, যেহেতু আগে কখনও এমন হয় নি। তবে এখন থেকে একটু কেয়ারফুল থেকো এই আরকি।” শাবাব চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে দেখল, “হায় হায়! আমার কি হবে গো! এখন সবাই জেনে যাবে আমি আসলে যে কি অলস, আমি যে কোন কাজের না! আমার মান ইজ্জত গেল!” বাইনোকুলারের অপর দিক থেকে দেখলে বড় জিনিস ছোট দেখায়। তেমনই নিজের সার্থকতাগুলোকে শাবাব ছোট করে দেখছে।

শাবাব, বাইনোকুলারটা খুলে ফেলো।

৭/ আবেগ দ্বারা বিবেচনা (emotional reasoning): যুক্তিটা এরকমঃ “আমার নিরাশ লাগছে, তাই আমার ভবিষ্যৎ আশাহীন।” “আমার কিছু করতে ইচ্ছা করছে না, তাই আমি কিছু করবো না।” “আমার তোমার প্রতি রাগ লাগছে, তার মানে নিশ্চয়ই তুমি খারাপ কিছু করেছ।”  এই সমস্যাটার কারণেই ডিপ্রেশন থেকে উঠে আশা কষ্টকর হয়। আমার বিষণ্ণ লাগছে, তার মানে আমি depressedতার মানে আমার বিষণ্ণ লাগতেই থাকবে।

৮/ “উচিত” কথা (should statements): আমাকে এটা করতেই হবে, আমাকে সেটা করতেই হবে। “আমাকে ১০ দিনের মধ্যে ১০ কেজি ওজন কমাতেই হবে।” এইভাবে অনেক সময়ই আমরা নিজেদের উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হয়। নিজের ওপর অযথা চাপ পড়ে, তখন কাজটা আরও করতে ইচ্ছা করে না। আর না করলে প্রচণ্ড অপরাধবোধ হয়, নিজের ওপর রাগ উঠে। একই জিনিস হয় যখন অন্যদের ব্যাপারে এই ধারণা করি যে ওর এইটা করা উচিত/উচিত না। He/she should/shouldn’t/must/mustn’t। “সোহেলের প্রতিদিন আমাকে অফিস থেকে ফোন করা উচিত।” ব্যাস, একদিন ফোন না করলে মন খারাপ, কারণ সোহেল খারাপ, সে “উচিত” কাজ করেনি। আমাদের সম্পর্কগুলোতে অযথা উচিত অনুচিত লাগালে অন্যকে চাপ দেয়া হয়, আর তখন আমাদের মন মতো সে না চললে তার উপর রাগ উঠে। ভুলে যাই যে সে মানুষ, আমরা সবাই মানুষ, আর মানুষ তৈরি হয়েছে দুর্বল।

আল্লাহ তোমাদের বোঝা হালকা করতে চান। মানুষ দুর্বল সৃজিত হয়েছে। [৪:২৮]

কেন শুধু শুধু নিজেদের বোঝা বাড়াবো?

৯/নামকরণ  (labeling): এই ধরনের বিকৃতি শুরু হয় আমি একটা … সে একটা … এইভাবে। ক্লাসে বই নিতে ভুলে গিয়ে হাসান নিজেকে নিজে বলে “আমি একটা ছাগল।

এতক্ষণ যত ধরনের বিকৃতি নিয়ে কথা বললাম সবগুলোরই একটা মিল আছেঃ কোনটাই যুক্তিসম্মত নয়। এগুলোকে দূর করার জন্য নিজের উর্বর মস্তিষ্ক ব্যাবহার করে নিজের সাথে নিজে যুক্তিতর্ক করতে হবে। যেমন, হাসান কি আসলে ছাগল? ধরা যাক সে বোঝাতে চেয়েছে তার বুদ্ধি ছাগলের মতো। আসলেই কি তাই? ছাগল কি কলেজে পড়তে পারে?

এটা আসলে ১ নম্বর বিকৃতির চূড়ান্ত পর্যায়। নিজেকে এক বাক্যে ধারণ করার চেষ্টা, যেটা সম্ভব নয়। কারণ মানুষ কোন মূর্তি না, মানুষ একটা বহমান নদীর মতো – তার বৈশিষ্ট্যগুলোকে এক শব্দে বাঁধা যায় না। আপনি নিঃশ্বাস নেন দেখে কি নিজেকে “নিঃশ্বাসগ্রহণকারী” ঘোষণা করবেন? তাহলে জীবনের একটা পরীক্ষায় হারলে নিজেকে “loser” বলবেন কেন?

১০/ নিজের ঘাড়ে নেয়া (personalization): ছেলের report card দেখে মা ভাবল, “আমি আসলে একজন অযোগ্য মা, তাই আমার ছেলে এতো খারাপ করেছে।” যখন কোন একটা জিনিস ঠিক মতো না হয়, তখন কোন যুক্তি ছাড়াই নিজেকে দোষারোপ করাটাই personalization। এখানে সমস্যাটা আসলে এই যে আমার মনে হচ্ছে সব কিছু আমার নিয়ন্ত্রণে চলে। আমি যদি ছেলের খারাপ ফলাফলকে নিজের দোষ মনে করি, তার মানে আমি মনে করছি যে ছেলের যোগ্যতা/অযোগ্যতার ওপর আমার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে। আসলেই কি তাই? কোন একটা মানুষ কি আরেকজন মানুষকে (অথবা কোন ঘটনাকে) পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে? পারে না, এই কাজটা শুধু আল্লাহ্‌ পারে।

 তিনি (একমাত্র) সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান। [৫:১২০]

এই বিকৃতির শেষ প্রান্তের মানুষদের কে বলা হয় control freak।

***

আপনি হয়তো ভাবছেন, এই মানুষটা আমাকে সব ধরনের বিকৃত চিন্তাভাবনার কথা বলল, কিন্তু এসব জেনে কি হবে? এসব জেনে যেটা হবে সেটা হল আপনি নিচের পদ্ধতিটা ব্যবহার করে এই চিন্তার গোলকধাঁধার থেকে উঠে আসতে পারবেন ইন শা আল্লাহ্‌। এটা এমনি এমনি হবে না, আল্লাহর উপর ভরসা থাকা লাগবে, তাঁর থেকে ভালোর আশা করতে হবে। আল্লাহ্‌ কুরআনে বলেছেনঃ

অবশ্যই তোমার পরবর্তীকাল আগের চেয়ে উত্তম; [৯৩:৪]

বিষণ্ণ হয়ো না, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। [:৪০]

আল্লাহর রহমত (মমতা) থেকে নিরাশ হয়ো না। [১২:৮৭]

জীবনকে যতই অন্ধকার লাগুক, যতক্ষণ জীবন আছে ততক্ষণ আশার আলো আছে। শুধু আত্মনিবেদন নিয়ে এগিয়ে জেতে হবে।

প্রতিতিন ১০/১৫ মিনিট এই exercise টা করুন। ডঃ বারন্সের মতে ২ সপ্তাহের মধ্যে ডিপ্রেশন হালকা হয়ে যাবে। ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, এটা আসলেই কাজ করে।

Dysfunctional Thought-Record sheet:

স্বয়ংক্রিয় চিন্তা (automatic thoughts) বিকৃতিকরন প্রক্রিয়া (cognitive distortions) যুক্তিসম্মত উত্তর (rational response)

পদ্ধতিঃ প্রতিদিন মাথায় এমন যেসব চিন্তা আসে যেগুলো আপনাকে উত্তেজিত করে, কষ্ট দেয়, সেগুলো ছকটির প্রথম কলামে লিখবেন। এই কাজটা আসলে ভালই কঠিন, কারণ ওই ফিসফিসগুলো এতো দ্রুতগামী যে চিনতে পারা কঠিন। কিন্তু একটু খেয়াল করলে ধরতে পারা যায়, এবং প্র্যাকটিসের সাথে এই ক্ষমতা বাড়ে। একবার উড়ন্ত ভাবনাগুলোকে বন্দী করতে পারলে, সেটা উপরের ১০ টা distortion এর কোনটায় পড়ে তা দ্বিতীয় কলামে লিখবেন। এবং তারপরে ভাবনাগুলোর প্রত্যুত্তর দেয়ার চেষ্টা করবেন। খেয়াল রাখতে হবে যে প্রত্যুত্তরটা যেন যুক্তিসম্মত হয়, নাহলে পদ্ধতিটা কাজ করবে না। কোথাও আটকে গেলে সেটা নিয়ে বেশী ভাববেন না। ২/১ দিন পর সেটাকে আবার সমাধানের চেষ্টা করবেন, দেখবেন অনেক দ্রুত পেরে গেছেন ইন শা আল্লাহ্‌।

নিচে উদাহরণস্বরূপ একটা পূরণ করা ছক দেয়া হল। আশা করি ব্যাপারটা ট্রাই করে দেখবেন এবং ফলাফল জানাবেন।

automatic thoughts cognitive distortions rational response
সোহেল অফিস থেকে আসতে দেরি করেছে। কেন দেরি করলো? ও কি জানে না আমার ওকে দরকার? should statement যখনই আমার দরকার হয় তখনই সোহেলের আমার পাশে থাকতেই হবে এমন কোন নিয়ম নেই। আমি একজন প্রাপ্তবয়স্কা, নিজের খেয়াল নিজে রাখতে পারি।
আমার দরকারের সময় ও আমার পাশে থাকে না। All or nothing thinking ভুল। অনেকবার আমার দরকারের সময় ও আমাকে সাহায্য করেছে।
আসলে ও আমাকে আর ভালবাসে না, তাই বাসায় আসতে চায় না। jumping to conclusions -mind reading ও হয়তো কোন কাজে আটকা পরেছে, অথবা জ্যামে আটকে আছে। হয়তো ফোনে চার্জ শেষ তাই ফোন করছে না। ও বাসায় দেরি করার সাথে আমাকে ভালবাসার কোন স্পষ্ট সম্পর্ক নেই।
আগেও এমন করেছে। ভবিষ্যতেও করবে। ও আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। তখন আমি একা হয়ে যাব। আমার জীবনটা বৃথা হয়ে যাবে. jumping to conclusions – fortune-teller error ও ভবিষ্যতে কি করবে তা আমি বলতে পারব না। ভবিষ্যৎ শুধু আল্লাহ্‌ তা’আলা জানেন।
আমাকে এতো কষ্ট দিচ্ছে? ও এতো খারাপ? emotional reasoninglabeling আমাকে ও কষ্ট দিচ্ছে না, কষ্ট দিচ্ছে আমার চিন্তাগুলো। আমি কষ্ট পাচ্ছি তাই নিশ্চয়ই ও খারাপ এটা ভুল।ও খারাপ না। ও ২৪ ঘণ্টা খারাপ কাজ করে না।
আমাকে কেউ ভালোবাসে না! overgeneralization ভুল। আমাকে অনেকেই ভালোবাসে। আমার মা, বোন, ভাই সবাই আমাকে ভালোবাসে।

আরও জানতে দেখুনঃ

  1. Feeling Good, by David Burns
  2. http:/moodgym.anu.edu.au/

ahobaan.com

মন্তব্য করুন

Back to top button