জীবনের বাঁকে বাঁকে

আমার জীবনটাতে এত সমস্যা কেন?

এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল যার জীবনটা নিয়ে কোনো দুঃখ নেই, কষ্ট নেই, হতাশা নেই। সমস্যাবিহীন কোনো মানুষই হয়তো নেই। আমরা অনেকেই জীবনের এত এত সমস্যার মুখোমুখি হয়ে খেই হারিয়ে ফেলি। মুখ ফুটে কিংবা মনে মনে বলে ফেলি, “আল্লাহ্‌ বারবার আমাকে এত সমস্যায় ফেলছেন কেন? এত পরীক্ষা করছেন কেন আমাকে? আমি কি আল্লাহ্‌র খুবই অপছন্দের কেউ?”

সমস্যাগুলো এমনই- যা আমাদেরকে ধ্বংস করে দিতে পারে, আবার পারে আমাদের বিকশিত করতে, পারে আল্লাহ্‌র কাছে আমাদের মান-মর্যাদা বাড়িয়ে দিতে। কীভাবে আমরা সমস্যাগুলোকে দেখছি, কীভাবে রেসপন্ড করছি তার উপরই নির্ভর করছে এ ধ্বংস হওয়া কিংবা বিকশিত হওয়া। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, আমরা বেশিরভাগ মানুষই বুঝতে সক্ষম হই না যে, আমাদের উপকারের জন্যই আল্লাহ্‌ আমাদের জীবনে বিভিন্ন সমস্যা দিচ্ছেন। একটুও ভেবে দেখতে চাই না, জীবনের এই সমস্যাগুলো আমাদের জন্য কতটা মঙ্গল বয়ে নিয়ে আসছে।

কিন্তু এভাবে আর কতকাল বন্ধু? এখনই কী উৎকৃষ্ট সময় না আমাদের জীবনটা নিয়ে নতুন করে ভাববার? নতুন ছাঁচে গড়ে তুলবার? চলুন তাহলে একটু দেখে আসি আল্লাহ্‌ কেন বিভিন্ন সমস্যা আমাদের জীবনে দিচ্ছেনঃ

১) সমস্যার মাধ্যমে আল্লাহ্‌ আমাদের দিক-নির্দেশনা দিচ্ছেন:

জীবনটা যখন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে বয়ে চলে, তখন আমরা অনেকেই আল্লাহ্‌কে ভুলে বসি। আমাদের জীবনের আসল উদ্দেশ্য কী, কেন আল্লাহ্‌ আমাদের এ পৃথিবীতে পাঠালেন, আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য কী, পরকালের পরম আরাধ্য মুক্তি কোনপথে আসবে- এসব আমরা বেমালুম ভুলে যাই। কিন্তু যখনই আল্লাহ্‌ আমাদের কোনো বিপদাপদে পতিত করেন, তখন কিন্তু আমাদের টনক নড়ে ওঠে। নতুন করে ভাবতে বসি, হিসেবের খাতা মেলাই। আমি যেভাবে আমার জীবন চালাচ্ছ, যে পথে চলছি- সেটাই কি প্রকৃত পথ যা আমাকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে? নাকি কোথাও আমার একটু ভুল হয়ে যাচ্ছে? যদি উত্তর হ্যাঁ হয়, তখন আমরা কাঙ্ক্ষিত পথটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। আল্লাহ্‌ যেন এভাবেই আমাদের মনোযোগটা তার দিকেই ফিরিয়ে নিচ্ছেন, নিজে থেকে গাইড করছেন আমাদের তাঁর দেখানো পথে।

২) সমস্যার দিয়ে আমাদের পরীক্ষা করছেন:

বলা হয়ে থাকে, মানুষ অনেকটা টি-ব্যাগের মতো। ওটার ভেতরে আসলে কী আছে, তা জানতে হলে ওটাকে একটু গরম পানিতে ছেড়ে দিলেই বোঝা যাবে। ঠিক তেমনই, মানুষকে চেনা যায়, তার আসল রূপ বেরিয়ে আসে যখন সে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হয়, বিপদের মধ্যে পড়ে। আল্লাহ্‌ মানুষকে সমস্যায় ফেলে পরীক্ষা করছেন, তার বান্দা কি তাতে ধৈর্য ধারণ করছে? তার উপর পূর্ণ ভরসা রাখছে? নাকি সে হতাশ হয়ে পড়ছে? অকৃতজ্ঞ বান্দায় পরিণত হয়ে পড়ছে?

৩) সমস্যার মাধ্যমে আল্লাহ্‌ সংশোধন করে দিচ্ছেন:

কিছু কিছু শিক্ষা আছে যেগুলো আমরা অর্জন করি কেবলই বেদনা আর ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে। একটা উদাহরণ টানতে পারি। বন্ধু ধরুন, একটা ছোট শিশু, হয়তো সে এখনও তেমন কিছু বুঝতে শিখেনি। তার মা তাকে বলল, আব্বু তুমি চুলার কাছে যেয়ো না, আগুনে তোমার হাত পুড়ে যেতে পারে। মায়ের এ আদেশ তার জন্য অত কার্যকর নাও হতে পারে। কিন্তু একবার যখন আগুনে হাত দিয়ে হাত পুড়িয়ে ফেলবে, এরপর থেকে সে স্বভাবতই সতর্ক হয়ে যাবে। এটা আগুন, এটা পুড়িয়ে দেয়, এটার কাছে যাওয়া যাবে না। অনেক সময়ই  আমাদের সুস্বাস্থ্য, সচ্ছলতা আর সম্পর্কের বাঁধনগুলোকে আমরা তুচ্ছ করে দেখি, অত পাত্তা দিতে চাই না। কিন্তু যখনই এর কোনো একটা হারিয়ে ফেলি জীবন থেকে, তখন ঠিকই বুঝি কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল এগুলো আমাদের জন্য।

৪) সমস্যার মাধ্যমে আল্লাহ্‌ আমাদের রক্ষা করছেন:

শুনতে একটু অন্যরকম লাগলেও কথা কিন্তু আসলে সত্যি। অনেকক্ষেত্রেই সমস্যগুলো ছদ্মবেশে আমাদের জন্য আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ হিসেবে আসতে পারে। কি, অবাক হচ্ছেন বন্ধু? উদাহরণ দিয়ে বলি তাহলে। মনে করুন, সুফীলের চাকুরি চলে গিয়েছে আজকে কোনো কারণে। সে চাকুরি হারিয়ে অথৈ জলে পড়লো, তীব্র হতাশায় ভুগছে আর অভিশাপ দিচ্ছে নিজের ভাগ্যকে। দুশ্চিন্তায় রাতের ঘুম নেই, খাওয়া-পরার ঠিক নেই। ২ দিন পর সকালে ঘুম থেকে উঠে সে খবর পেল তার অফিস ভবন ধ্বসে পড়েছে। ভেতরে তার যে সহকর্মীরা ছিল তারা মারাত্নক আহত হয়েছে। সে যদি অফিসের ভেতরে থাকত, তাহলে হয়তো তারও একই দশা হোতো। সে মনে মনে আল্লাহ্‌কে ধন্যবাদ দিল চাকুরিটা চলে যাবার জন্য! আপাতদৃষ্টিতে খুব বড় একটা সমস্যার মধ্যে দিয়ে আল্লাহ্‌ সুফীলের জীবনটাই রক্ষা করে দিলেন।

৫) সমস্যার মাধ্যমে আল্লাহ্‌ আমাদের আরও নিখুঁত করছেন:

আমাদের জীবনে যতই সমস্যা আসুক না কেন, সেগুলো যদি আমরা সঠিকভাবে মোকাবেলা করতে পারি, তাহলে এ সমস্যাগুলোই আমাদের সচ্চরিত্র গঠনকারী হয়ে উঠবে। এটা আমাদের মনে রাখতে হবে বন্ধু,  আমাদের জীবনের আরাম-আয়েশের চেয়ে আমাদের চরিত্র আল্লাহ্‌র কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, আল্লাহ্‌র সাথে আমাদের সম্পর্ক আর আমাদের চরিত্র- এ দুটো জিনিসই পরকাল পর্যন্ত আমাদের সাথে যাবে।

তো বন্ধু, কী ভাবছেন এখন? এখন থেকে আমাদের জীবনে যতই সমস্যা আসুক, বিপদাপদ আসুক, আমরা অধৈর্য হব না, হা-হুতাশ করব না, অকৃতজ্ঞতা পোষণ করব না ইন শা আল্লাহ্‌। সমস্যাগুলোকে আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে আমাদের জন্য অনুগ্রহ ভাববো ইন শা আল্লাহ্‌। কেননা,সমস্যার আড়ালে তো আল্লাহ্‌ আমাদের গাইড করছেন, না হয় পরীক্ষা করছেন, নতুবা আমাদের ভুলগুলো সংশোধন করছেন, নইলে আমাদের আরও বড় কোনো বিপদাপদ থেকে রক্ষা করছেন। আর না হয় আমাদের চরিত্রকে আরও নিখুঁত করে তুলছেন। যা হচ্ছে, সব তো আমাদের ভালোর জন্যই।

শেষ করছি এক মনীষীর কথা দিয়ে, “যখন তুমি বিভিন্ন ধরনের বিপদাপদে পতিত হও, তোমার খুশি হয়ে যাওয়া উচিত। কেননা, তুমি জানো এ সমস্যাগুলো তোমার ঈমানকে পরীক্ষা করছে এবং এ বিপদাপদই তোমাকে ধৈর্যশীল ব্যক্তিতে পরিণত করবে।”

এ লেখার মধ্যে যা কিছু ভালো, যা কিছু কল্যাণকর সবই আল্লাহ্‌র (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) পক্ষ থেকে। আর যা কিছু ভুল-ত্রুটি-বিচ্যুতি সবই আমার ব্যর্থতা। আল্লাহ্‌ সর্বজ্ঞানী।

ahobaan.com

মন্তব্য করুন

Back to top button